এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  খ্যাঁটন  খানা জানা-অজানা

  • খাওয়া দাওয়া রান্না নিয়ে আলাপচারিতা

    অরিন লেখকের গ্রাহক হোন
    খ্যাঁটন | খানা জানা-অজানা | ০২ নভেম্বর ২০২৫ | ২৭৪ বার পঠিত
  • "খাই খাই করো কেন, এসো বসো আহারে —
    খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।
    যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
    জড় করে আনি সব — থাক সেই আশাতে।
    ডাল ভাত তরকারি ফল-মূল শস্য,
    আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,
    রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি,
    ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি,
    আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে —
    খুঁজে পেতে আনি খেতে — নয় বড়ো সিধে সে!"
    (খাই খাই, সুকুমার রায়)

    আমরা খাবার খাই, আমাদের মধ্যে অনেকে প্রাণধারণের জন্যই শুধু খাই, আবার অনেকে খাব বলে প্রাণধারণ করি। কয়েক বছর আগে এক নিমন্ত্রণসভায় জনৈক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন "ফুডি" বলে। তার আগে ঐরকম কোন কথা শুনিনি, তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম ফুডি মানে কি? তিনি বললেন, তিনি নাকি খেতে ভালোবাসেন এবং খাবার মানে ইংরিজিতে যাকে ফুড বলে, সেসব চাখবার বিষয়ে অভিজ্ঞ বা নিজেকে বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তাই তিনি নিজের পরিচয় দিলেন ফুডি। আমি মনে মনে ভাবলাম ভালোমন্দ খেতে কে না ভালোবাসে, সবাই তো তাহলে "ফুডি", কিন্তু সেদিন ভদ্রলোককে কথাটা বলবার সাহস পাইনি। সে যাই হোক, আমার এই প্রবন্ধ ফাঁদার উদ্দেশ্য ঠিক খাবার খাওয়ার ভালোবাসা নিয়ে নয়, বরং খাবার খাওয়া আর রান্না করার প্রথাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা। আমার আলোচনার বিষয় মূলত সাবেক বাঙালী খাবার দাবার, ও সাবেক বাঙালী রান্নাকে আধুনিকতার চোখে দেখলে কেমন লাগে, বিশেষ করে আহার "নির্মাণ", "বিনির্মাণ", এবং খাবার খাওয়া নিয়ে একটি আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়েছে। আমার পড়া ও দেখা বাংলায় যতরকম খাদ্য সংক্রান্ত লেখালিখি হয়েছে, তার নিরিখেই এই লেখার অবতারণা। 
     
    খাওয়া দাওয়া নিয়ে লেখালেখি আমি যতদূর দেখেছি তিন বা চার রকমের । সবচেয়ে বেশি দেখেছি রন্ধনপ্রণালী বা পাকপ্রণালী বা রেসিপির বই, শুধু বই নয়, রেসিপির বর্ণনা ইউটিউবে, ওয়েবসাইট, ব্লগে অনেকেই দেন। বইয়ের কথায় এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ এবং ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ  বর্ধমান রাজবাড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত "পাকরাজেশ্বর" যা কিনা উনবিংশ শতকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। যেটি এখানে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, এই বইটি পাশ্চাত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরাসী রান্নার বই Georges Auguste Escoffier বিরচিত Le guide culinaire নামে ফরাসী রান্নার বইয়ের অন্তত ৩০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল।   পরববর্তীকালে বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের "পাক প্রণালী" বইটি যা কিনা আরো কয়েকটি লেখার সংকলন, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত খুব সম্ভবত প্রথম রেসিপির বই, শুধুই বাংলা রান্নার বই, এও বর্ধমান মহারাজবাড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা হয়েছিল । কাজেই অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনায় না গিয়েও যে কথাটি বাংলা রান্নার ঐতিহ্য সম্বন্ধে বলা যায় যে, আমাদের প্রথাগত বাঙালী রান্না নিয়ে আমাদের পূর্বসূরীরা বিস্তর চর্চা করেছিলেন, এবং সে চর্চাকে রীতিমতন লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বাঙালীর খাবার দাবার এমনকি খাদ্যাভ্যাস নিয়েও বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা আগেও হয়েছে, এখনো হয়ে চলেছে। 

    এই ধরণের খাবার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার অন্যতম আঁতুড়ঘর বলে ঠাকুর পরিবারের পরিচিতি আছে। তার অবশ্য কারণও থাকতে পারে যে খাবার খাওয়াকে কেন্দ্র করেও সেই পরিবারের কলকাতায় আগমনের সূত্রপাত, এমন একটি পারিবারিক ইতিহাস তাঁদের ছিল। সেই প্রসঙ্গে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বাংলা খাবার নিয়ে লেখা বই যার প্রভূত পাঠকসংখ্যা, সে বই ঠাকুরপরিবারের কন্যা, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুহিতা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর (১৮৮৪-১৯৫০) দুই খণ্ডে প্রকাশিত আমিষ ও নিরামিষ আহার । আগে উল্লিখিত "পাক প্রণালী" বইয়ের প্রায় সমসাময়িক এ বই। ঠাকুরপরিবারের রান্না বান্না ও খাবার নিয়ে নানারকমের পরীক্ষানিরীক্ষা ও বিচিত্র খাদ্যসম্ভার কে কেন্দ্র করেও বেশ কিছু অনবদ্য বই রয়েছে, তার মধ্যে প্রজ্ঞাসুন্দরীর বোন পূর্ণিমা ঠাকুরের (১৯০৮-১৯৬৮) ঠাকুরবাড়ির রান্না একটি অনন্যসাধারণ বই, যেখানে বেশ কিছু রেসিপি তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। সে বইয়ের প্রচ্ছদে দেখছি লিখেছেন এর বেশ কিছু রান্না তিনি জেনেছেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর রান্নার বই থেকে। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী নিজে রান্না না করলেও ভাল খাবার যখনই খেতেন যিনি রান্না করতেন তাঁর কাছ থেকে রেসিপি সংগ্রহ করে লিখে রাখতেন। তাছাড় পূর্ণিমা ঠাকুরের মায়ের কাছ থেকেও তিনি রান্না শিখেছিলেন, সে সব রান্নার বর্ণনা তিনি এই বইতে লিখে রেখেছেন। বইটি রেসিপি সংগ্রহ হিসেবে অনবদ্য । এছাড়াও আরো বহু পাকপ্রণালীর বই পত্র রয়েছে যার কথা এখানে লিখে রাখা সম্ভব হল না |

    বই ছাড়াও দেশ বিদেশের বহু রেসিপির সংগ্রহ এক সময়ে বাংলায় নানান ঘরোয়া পত্রিকাগুলোতে পাওয়া যেত। বাঙালিদের মধ্যে যদিও খাবার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার একটি চল আছে, তাহলেও শুধু খাবার এবং তৎসংক্রান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়েই পত্রিকা আমি দেখিনি । তবে মনে রাখতে হবে যে একসময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এই সমস্ত রেসিপির জনপ্রিয়তা ছিল । যেমন আমি আমার মা কে দেখেছি পত্রিকা থেকে রেসিপি টুকে রাখতেন। তো সে একরকম। ২০২৫ এর শেষে এই লেখাটি লিখছি গুরুচণ্ডালিতে, এই প্রসঙ্গে বলতেই হবে যে এখানে অনেকে রেসিপি দিয়েছেন, খোঁজ করলে প্রচুর রেসিপি পাবেন, এর মধ্যে যেমন ডিডির রেসিপি সংগ্রহ অনবদ্য । বাংলার খাবার ও বাঙালি খাবার রান্নার রেসিপি নিয়ে বহু ভিডিও দেখা যায়, তার মধ্যেও অনেকে হারিয়ে যাওয়া বাংলা রান্না নিয়ে রেসিপি খুঁজে প্রকাশ করেন। আমার দেখা এমন একজন শুভজিৎ ভট্টাচার্যির লস্ট এন্ড রেয়ার রেসিপি শিরোনাম একটি পুরনো বাংলা রান্নার অনবদ্য ইউটিউব চ্যানেল ।

    পাকপ্রণালী সংগ্রহ একটি দিক। খাওয়া দাওয়া নিয়ে লেখার দ্বিতীয় যে দিকটি নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হয়েছে বিশেষ করে বাংলা ভাষায়, সেটি বিভিন্ন খাবারের বর্ণনা ও সে খাবার খেয়ে লেখকের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। এই ধরণের লেখায় হয়ত রেসিপি  প্রায় থাকে না, বা সবাই দেন না, কারণ লেখকের উদ্দেশ্য খাবার নিয়ে লেখা, কিভাবে তাকে "নির্মাণ" করতে হবে তা নিয়ে তিনি বিশেষ মাথা ঘামান না । এই ধরণের লেখার কথা বলতে গেলে আমার নিজের সৈয়দ মুজতবা আলী,  রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, আর বুদ্ধদেব বসুর নাম বিশেষ করে মনে হয় । বুদ্ধদেব বসুর ইলিশ মাছ নিয়ে লেখা তো রয়েইছে, এবং চারটি প্রবন্ধের সংকলন “ভোজনশিল্পী বাঙালি”, যেটি তাঁর সুযোগ্য কন্যা দময়ন্তী বসু সিংহের সম্পাদনায় ইংরেজী বাংলা উভয় ভাষায় লেখা, যারা পড়েছেন জানেন যে বাঙালির খাবার নিয়ে খাওয়া দাওয়া নিয়ে, খাবারের ইতিহাস ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর নানান চিন্তার গভীরতা। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে (১৯২৭-২৯) বইয়ের লেখার শুরুতে কাবুলে খাবার খাওয়ার অনবদ্য বর্ণনা, আমার কাছে অন্তত তাঁর বিশেষ করে বরফের ওপরে আঙুর  খাওয়া এবং সে বরফ আনার তরিবত করে খাবার বর্ণনা, ভারী চমৎকার লাগে। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত কলকাতার জমজমাট আড্ডায় নানান খাবারের কথা লিখেছেন, তবে আমার নিজের তাঁর লেখা "মাছ ও বাঙালি" নাম দিয়ে অনবদ্য মাছের ওপর বইটি সবচেয়ে পছন্দের, এবং ইলিশ মাছ নিয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষের আহলাদ করে রেঁধে বেড়ে খাওয়ার অনবদ্য বিবরণী তাঁর স্মৃতিকথায় লেখা আছে; পঞ্চাশ ষাটের দশকের কলকাতায় ফার্পোয় লাঞ্চ খাবার বর্ণনা পড়ে মোহিত হয়েছিলাম। এই ধারায় অজস্র লেখাপত্র রয়েছে তার অনেকটাই মানুষের দেশে বিদেশে খাওয়া দাওয়া করার সুবাদে সে সব খবরের রূপ রস গন্ধ স্বাদ নিয়ে , হয়তবা ফেলে আসা দিনের খাবারের স্মৃতিচারণায় রকমারি খাবারের প্রসঙ্গ উঠে আসে। আবার এই ঘরাণার লেখাতেই অনেকে খাবারের রেসিপির সঙ্গে ইতিহাস ভূগোলের গল্প জুড়ে দেন। যেমন এ প্রসঙ্গে মীনাক্ষী দাশগুপ্ত আর বানি চালিহার ক্যালকাটা কুকবুক বা চিত্রিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাইফ এন্ড ফুড ইন বেঙ্গল বা সাম্প্রতিক আসমা খানের লেখা মনসুন নামে বইয়ের নাম মনে পড়ে। তবে যেহেতু এই সব লেখা মূলত ইংরিজি ভাষায়, এবং এর উদ্দিষ্ট পাঠক বাঙালী অবাঙালী দিশি বিদেশী সব মিলিয়ে, আমার এই লেখায় এই ধরণের বই নিয়ে আলাদা করে আলোচনায় যাচ্ছি না। 

    এ বাবদ তৃতীয় যে ধরনের লেখার কথা বলছি সেখানে রান্না ও খাবারের প্রসঙ্গ এসেছে বটে তবে সে গল্পে, সাহিত্যই সেখানে প্রধান, খাবার সেখানে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে। খাবারের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু তার আখ্যান ইত্যাদি অন্য কিছু নিয়ে। যেমন  ত্রয়োদশ শতকের লক্ষীনাথ ভট্টের  প্রাকৃতপইঙ্গল কাব্যে আমরা দেখি কলাপাতায় ঘি দিয়ে গরম ভাত খাবার বর্ণনা ("ওগগর ভত্তা, গাইক ঘিত্তা ..." ), দ্বাদশ শতকে জীমূতবাহনের কলাবিবেক নামের লেখায  ইলিশ মাছের উল্লেখ, তারপর ধরুন মঙ্গলকাব্যের তো তুলনাই নেই, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল , তারপর চৈতন্যভাগবত সব মিলিয়ে এই বইগুলো পড়লে সে আমলের সমাজজীবনের যেমন ছবি পাওয়া যায়, তেমনই, সাবেক বাংলার খাওয়া দাওয়া আর রান্নবান্না নিয়ে চমৎকার পরিচয় পাওয়া যায় । আনন্দের বিষয় যে আজও সে সব রান্না কয়েক জায়গায় যেমন বৈষ্ণব আশ্রমগুলোতে অনেকে রাঁধেন ও ভোগ দেন। 

    যেহেতু আমার এই লেখাটি একেবারেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা, তাই একান্ত ব্যক্তিগতভাবে লিখছি যে এত সব লেখার মধ্যে যেটি আমার সবচেয়ে মনে ধরে সেটি রবীন্দ্রনাথের আমসত্ত্ব নিয়ে এই কয়েকটি লাইন যেখানে তিনি লিখছেন,

    "আমসত্ত্ব দুধেতে ফেলি
    তাহাতে কদলী দলি
    সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
    হাপুস হুপুস শব্দ
    চারিদিক নিঃশব্দ
    পিপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে "
     
    কি চমৎকার, ছড়ার আঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথ একটি রেসিপি লিখে পেশ করেছেন | আমি তাকে রেসিপির আকারে লিখে ফেলে দেখি  । 
     
    রেসিপি 
    দুধ আমসত্ত্বের পায়েস (?)
     
    উপকরণ 
    দুধ ২০০ গ্রাম 
    আমসত্ত্ব ৫০ গ্রাম (কয়েকটি )
    সন্দেশ ৫০ গ্রাম 
    কলা ১ টি ছোট 
     
    বিশেষ উপকরণ 
    Immersion  blender 
     
    প্রণালী 
    সবকটি উপকরণ একসঙ্গে যোগ করে immersion blender এর সাহায্যে মিশিয়ে নিন |

    Immersion blender না থাকলে সাধারণ ব্লেনডার বা মিক্সিও ব্যবহার করতে পারেন। 
    অতি সহজ রেসিপি, প্রায় কিছুই করতে হবে না। 
     
    আমি এই কবিতায় যা পড়েছি, তার বাইরে এই খাবারটির উল্লেখ বা রেসিপি আমি কোথাও দেখিনি । অতি সহজে তৈরি করা যায় এবং অতি উপাদেয় এই ডেসার্ট টিতে দুটি বিষয় নজর করুন ।  
    এক ,  দুধ ,  আমসত্ত্ব ,  কলা  আর সন্দেশ এর সংমিশ্রণ ভারী  আকর্ষণীয় , বিশেষ করে দেখুন যে এতে চাল জাতীয় কিছু দিতে বলছেন না , দুধ গরম করাও হচ্ছে না , অতিরিক্ত চিনি বা মধুও পড়ছে না । স্রেফ  ঠান্ডা দুধ, কলা ,  ও সন্দেশের মিশ্রনে একটা texture তৈরী হচ্ছে, মিষ্টির স্বাদ আসছে আমসত্ত্ব, কলা, ও সন্দেশের সূত্রে। শুধু তাই নয়, এই মিষ্টি স্বাদকে উসকে দিচ্ছে আমসত্ত্বের  ঈষৎ অম্লমধুর স্বাদ | আমরা যেহেতু স্বাদ ও খাবারের গন্ধ একসঙ্গে গ্রহণ করি, লক্ষণীয় যে এ খাবারে আম আর কলার যে Flavour Molecules , মানে নানান রকমের Ester, তার নিপুণ ব্যবহার। 

    দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি আমার অন্তত ভাল লাগল বিশেষ করে খাবারের বর্ণনা থেকে যে , খাবার খাওয়া কেবলই  স্বাদ গন্ধের ব্যাপার নয়,  আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতিটি ইন্দ্রিয় খাবার রান্না ও খাবার গ্রহণের সঙ্গে জুড়ে আছে ।  আমরা দাঁত, জিভ তালু দিয়ে খাবার খাই বটে ,  কিন্তু সকলের আগে আমরা "চোখ দিয়ে খাই ", আমাদের খাবার গ্রহণে খাবারের বাহ্যিক রূপের একটি ভূমিকা থাকে । চোখ বন্ধ করা অবস্থায় খাবার গ্রহণ করে দেখতে পারেন, স্বাদ একরকম হবে না। গুরুচণ্ডালীতে এক সময় "কেকে" অন্ধকার ঘরে খাওয়া দাওয়া নিয়ে একটি চমৎকার লেখা লিখেছিলেন, পড়ে দেখলে দেখবেন যে অন্ধকার ঘরে যেখানে কি খাবার খাচ্ছেন দেখতেই পাবেন না, চেনা স্বাদের খাবারও মানুষ ভুল করে অন্যরকম ভাবে। সে না হয় একরকম, তাই বলে সব ইন্দ্রিয়ের সদব্যবহার? তার মধ্যে শব্দও পড়ে নিশ্চয়ই ?  আমাদের রান্না খাওয়ায় শব্দের ভূমিকা অনস্বীকার্য ।  
     
    যেমন আমরা যখন বলি কড়কড়ে ভাজা খাবারের কথা, আমরা একটি শব্দের কথা ভাবি, সে শব্দ মুখের ভিতরের আওয়াজ বা কুড়মুড়ে করে ভাজা শাক , ভাজি ,  বা পটেটো চিপস খাওয়ার "মজা" সে জিনিসের রূপে যত না , আমার মনে হয় মুখে দেবার পর সে খাবার চিবোনোর আওয়াজেও  কিছু কম নয়  । খাবার ব্যবসায়ীরা বিলক্ষণ জানেন, আর তাও তাঁরা "kurkure" নামের খাবার বাজারে নিয়ে আসেন।  ভেজা ,  মিইয়ে যাওয়া শাকসবজি কেই বা খেতে ভালোবাসে ?  আজকাল যখন অনেকের কাছে শুনি যে আজকালকার দিনে ছেলেমেয়েরা শাকসবজি মুখে দিতে চায় না ,  আমার মনে হয় অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক শাকসবজির নয় ,  তাকে কিভাবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে তার ওপর অনেকটাই মানুষের খাবার খাওয়ার ইচ্ছে নির্ভর করে ।   
    যে কারণে লিখলাম, রাবীন্দ্রিক এই ডেসার্ট - টিতে এই যে "হাপুস হুপুস", এই যে একটা আধা তরল  খাওয়ার শাব্দিক প্রকাশ , একে তৃপ্তির প্রকাশ বলেই ধরতে হবে, খাবারের নির্মাণে একেও মাথায় রাখতে হবে বৈকি ?  এ অনেকটা জাপানের zuru-zuru (ずるずる) র মতন ব্যাপার, ইংরেজিতে যাকে বলে slurping , নুডলস খাবার সময় হুশ হাশ করে বাটি থেকে নুডলস তুলে নেওয়ার শব্দ খুবই তৃপ্তিদায়ক ।  এ তো শুধু খাবার কথা ; রান্না করার ক্ষেত্রেও শব্দের গুরুত্ব কিছু কম নয় । 
    যেমন ধরুন ভাজার তেল কতটা গরম হয়েছে বুঝবেন কিভাবে ?  Infrared thermometer ব্যবহার করে দেখতে পারেন তেল ১ ৭ ০  ডিগ্রির কাছাকাছি হয়েছে কিনা ,  কিন্তু কজনই বা মাছ ভাজতে infrared থার্মোমিটার ব্যবহার করেন? কড়া কতটা গরম হয়েছে বুঝতে কড়া গরম হবার পর তাতে একফোঁটা জল দিন, চড়চড় করা শব্দে বিলক্ষণ বুঝবেন এইবার তেল দেবার সময় উপস্থিত; আবার গরম তেলে একটি জিরের দানা ছেড়ে "শুনুন "  কতক্ষনে সে "চিড়বিড় "  আওয়াজ করে , তেলের temperature বুঝতে অসুবিধা হয় না  । রান্নাঘরে আওয়াজ আর শব্দ আপনার থারমোমিটারের কাজ দেবে। 
     
    (চলবে, পরবর্তী পর্যায়ে "পায়েসের রকমফের ও ডিম " )
     
     
     
    (চলবে )
     
     
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • খ্যাঁটন | ০২ নভেম্বর ২০২৫ | ২৭৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বেলুর - %%
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Somnath mukhopadhyay | ০২ নভেম্বর ২০২৫ ০৯:৫১735413
  • এমন মাগ্গিগণ্ডার দিনে খাবারের কথা পড়ে যদি উদরের এক পঞ্চমাংশ‌ও পূর্ণ হয় তাহলে 'ফুডি' হতে সামান্য আপত্তি নেই। আপাতত নাক উঁচিয়ে বসে আছি।
  • অরিন | ০২ নভেম্বর ২০২৫ ১১:৪১735414
  • laugh ভালো বললেন ​​​​​​​
     
  • kk | 2607:fb91:4c21:664d:142f:2f35:171c:***:*** | ০২ নভেম্বর ২০২৫ ২১:০৪735419
  • চমৎকার! চলুক চলুক। আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। তবে একটা অনুরোধ আছে। রোজকার লেখা কি পর্ব হিসেবে দেওয়া যায়? কারণ লেখা যত লম্বা হতে থাকবে, ঠিক কতখানি আগের দিন হয়েছিলো সেটা খুঁজে নিয়ে তার পর থেকে নতুন অংশ পড়াটা একটু কঠিন লাগে আর কী।
  • অরিন | 119.224.***.*** | ০২ নভেম্বর ২০২৫ ২৩:৫৩735425
  • ঠিক বলেছেন। 
    আজ থেকে একেকটি পর্ব হিসেবে পেশ করব। 
  • dc | 2402:e280:2141:1e8:68c5:3b2d:b6f2:***:*** | ০৩ নভেম্বর ২০২৫ ১১:১৩735428
  • রবীন্দ্রনাথের ডেজার্টটা কি এভাবে প্লেটিং করা যায়? 
     
    "প্রণালী 
    সবকটি উপকরণ একসঙ্গে যোগ করে immersion blender এর সাহায্যে মিশিয়ে নিন |"
     
    প্লেটিং 
    একটা পুডিং বোল এ মিশ্রণটা ঢেলে নিন, তারপর একটা কলা থিনলি স্লাইস করে বোল এর চারধার দিয়ে সাজিয়ে দিন। মাঝখানে দুয়েকটা কিসমিস আর কাজু বা পেস্তা ছড়িয়ে দিন। কিংবা কয়েক স্লাইস ডেট। 
     
    নাম হতে পারে শেষের কবিতা। 
  • অরিন | ০৩ নভেম্বর ২০২৫ ১১:২৫735430
  • স্পট অন, ডিসি | 
    এইটাই চাই | 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন