এই সমাজের নোংরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির শিকার রাজ্যের সিংহভাগ শ্রমিকেরা। যাঁদের ন্যূনতম রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি হরণ হয় প্রতিদিন। এবারের ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে(৩রা জানুয়ারি ২০২৪) 'কাজের বোঝা' বেড়ে যাওয়া ও মজুরি কমে যাওয়াকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ চটকলগুলি শ্রমিক বিক্ষোভের সম্মুখীন। ফলে, মালিকপক্ষ বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের দাওয়াই দিতে 'গেট বাহির' করছেন। বজ্জাত শ্রমিককে ছাঁটাই করতে ঘনঘন 'ডোমেস্টিক এনকোয়ারি' বসিয়েছেন। শ্রমিকেরা কাজের আশায় ছুটছেন, থানা, ডিএলসি, শাসক-বিরোধী দুই পক্ষের দুয়ারে। শ্রমিকের কথা শাসকের শোনবার সময় নেই। আর, বিরোধী রাজনৈতিক দল শ্রমিকের কথা শুনে, এক এক জনের খুলি ধরে ভোটের অঙ্ক কষতে ব্যস্ত। আশ্বাস, তাঁদের দলের এমপি এবারেও মন্ত্রী হয়ে ফিরে এলে শ্রমিকেরা কাজ পাবেন, চটকলের সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে। অথচ, সেই রাজনৈতিক দলের এমপিদের চটকল চত্বরে গত পাঁচ বছরে দেখা মেলেনি। পুলিশ-প্রশাসন ঘুরিয়ে নাক ধরবার নিদানে হুঁশিয়ারি দেন শ্রমিককে, ভোটের আগে কোনরকম আন্দোলনে না যাওয়ার।
একদিন কাজ না পেলে শ্রমিকের ঘরের উনুনে আগুন জ্বলে না, একথা কারোর অজানা নয়। পরিবারের ছয় থেকে আটটা চোখ ড্যাব-ড্যাব করে চেয়ে থাকে একজনের মুখের দিকে, সে-ই হল চটকলের শ্রমিক, সংসারের প্রথম এবং শেষ রোজগারের ব্যক্তি। যাঁদের ভোট শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ধৈর্য্য ধরে বসে থাকবার উপায় নেই! এমনই বিপথে ভোট রাজনীতি, সমাজ - যেখানে নির্যাতিতা মেয়ে, শ্রমিকের ন্যূনতম রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক, মৌলিক অধিকারগুলি রক্ষার কোন রক্ষাকর্তা নেই। নেতা, সমাজের রক্ষা-কর্তারা সামগ্রিকভাবে বুঝিয়ে দেন, আগে ভোট পরে অধিকার, আগে ভোটের রাজনীতি পরে সামাজিক সুবিচার। এ বিষয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলিও আজ প্রশ্নহীন। এর ফলে ক্ষতি আখেরে কার, কেবলই সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের? রাজনৈতিক দলগুলির কী নয়?
এবারের তিন দফা ভোট অতিক্রান্ত। প্রথম দফায় ভোট পড়েছে, ৮১.৯১ শতাংশ যা ২০১৯ সালের লোকসভার থেকে ২.৮৮ শতাংশ কম (জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার)। দ্বিতীয় দফায় ৪.০৪ শতাংশ কম। দুই দফার পরে বিভিন্ন রাজনৈতিকদল, নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে অনুমান করা হয়েছিল, গরমের কারণে ভোট দিতে আসছে না বহু সাধারণ মানুষ। তাই নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে তৃতীয় দফায় প্রত্যেক ভোট কেন্দ্রে জল, ওআরএস, ভোটারদের মাথার উপরে ছায়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার পরেও তৃতীয় দফায় গড়ে পাঁচ শতাংশ ভোট কম পড়েছে(মালদা উত্তর, মালদা দক্ষিণ, জঙ্গিপুর, মুর্শিদাবাদ মিলিয়ে), মোট দুই লক্ষ তিরানব্বই হাজার ভোটারের অনুপস্থিতি। অর্থাৎ মূল ক্ষতি রাজনৈতিক দলগুলির, এ সমাজের। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন জানালেন, দুটি কারণ; এক, রাজ্যের অনেক পরিযায়ী শ্রমিকেরা ভোট দিতে আসেননি। দুই, নির্বাচনের প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা ক্রমশ বাড়ছে।
এত বছর ধরে ভোটের আগে নেতা-মন্ত্রীদের আশ্বাস, প্রতিশ্রুতি ও ভোটের পরে ন্যূনতম অধিকারগুলি হারানোর গোলক ধাঁধায় চক্কর খেয়ে মানুষ আজ ক্লান্ত। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক সাংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রচারের হিসেব-নিকেশ দেখে ভোট দিয়ে পরিবর্তনের আশা ক্রমাগত হারিয়ে ফেলছে মানুষ। তবে এই নির্বাচনে কেবল ভোটের হার কমছে যে, এমনটা নয়। 'নতুন ভারত'-এর অষ্টাদশ লোকসভার সময়ে এসেও গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকা, রাস্তা তৈরি না হওয়া, জল না আসায় পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদা জেলার কয়েকটি গ্রামের বহু শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষেরা একত্রিত হয়ে এবারের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন না করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, 'ভোট বয়কটে'র ডাক দিয়েছেন।
আজ শাসক-বিরোধী দলগুলির ভোট রাজনীতি সমাজের একটি অংশের মানুষের জন্যে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাঁদের আছে ভুরিভুরি সম্পত্তি। তাই শাসকশ্রেণীর রাজনীতিতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানের ন্যূনতম উন্নতির কথাগুলিও হারিয়ে যেতে বসেছে। শাসক-বিরোধী দুই পক্ষই এখন 'লাভজনক' রাজনৈতিক এজেন্ডার বাইরে যেতে নারাজ। তাই তাঁদের রাজনৈতিক প্রচারের মুখ্যে স্থায়ী রুজি-রুটির কথা নেই, যা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের মনে এক প্রকারের রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি করছে। ফলে 'সর্ববৃহৎ গনতান্ত্রিক' এ দেশে বিপথে ভোট রাজনীতি, এ সমাজ। এর শেষ কোথায়? কংগ্রেস নেতা নভোজ্যৎ সিং সিধু গতবছর একটি জনসভা থেকে বিজেপি সরকারের দেওয়া ভুয়ো প্রতিশ্রুতিগুলিকে আক্রমন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি'র উদ্দ্যেশে বলেছিলেন, "আবকি বার! বাস কার ইয়ার!" আগামীতে এ কথা প্রতিটি রাজনৈতিকদলকে শুনতে হবে নাতো? মানুষের মন কিন্তু সমস্ত হিসেব কড়ায়গন্ডায় গুছিয়ে রাখবার আলমারি।