এই সব ব্যক্তিগত গালাগালি ছেড়ে কখনও কি আসল কথাগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা হবে?
যেমন,
১) ইজরায়েল প্যালেস্তাইন দুশমনির মূল কারণগুলো কী?
২) ইউরোপে কয়েকশতক ধরে ইহুদীবিদ্বেষ (কম বেশি সমস্ত রাষ্ট্রে, আমেরিকা এবং রাশিয়া সমেত) এবং মাঝে মাঝেই 'প্রগ্রোম' চলার পর হঠাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 'হলোকস্ট'এর খবরে বিবেক জেগে উঠল এবং মনে হল -- না, বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে। ইহুদীদের একটা আলাদা রাষ্ট্র দরকার। বিশেষতঃ আইন্সটাইনের মত বৈজ্ঞানিক এবং বড় বড় ব্যাংকার সব আমেরিকায়।
৩) কিন্তু তাদের সেই রাষ্ট্র ইউরোপে দেওয়া হল না। রাষ্ট্রসংঘ (ইংগ-মার্কিন দাদাগিরি) প্রস্তাব পাশ করে ব্রিটেনের খালি করা মধ্যপ্রাচ্যের উপনিবেশে মিশর ঘেঁষা সিনাই এবং বেদুইন অধ্যুষিত অঞ্চলের টুকরো এবং উপরে জর্ডন নদীর পশ্চিম পাড়ে এক টুকরো নবীন রাষ্ট্র ইসরায়েলের নামে করে দিল। অনেকটা আমাদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মত।
কিন্তু দুটো বড় ফারাক।
ক) দুই পাকিস্তানের মধ্যে কোন কমন ল্যান্ডএর যোগসূত্র ছিল না। এখানে যাতায়াতের সুবিধের জন্য দেওয়া হয়েছে।
খ) পাকিস্তান সৃষ্টির সময় ভারতের হিন্দু এবং মুসলিমদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রসংঘে শুধু ইজরায়েলের প্রতিনিধি ছিলেন। প্যালেস্তাইনের বা ওই এলাকা আগে যাদের দখলে ছিল সেই জর্ডন, সিরিয়া, মিশরের সম্মতি ছিল না।
গ) এমনকি জাওনিস্টদের একশ' বছরের দাবি, যে আমাদের শাস্ত্রে বলা মূল ভুখণ্ডে জেরুজালেমে বসতি করতে দাও সেটা মানা হয় নি।
কারণ, রোমান আক্রমণে (আরব বা তুর্কি আক্রমণে নয়) রাজা সলোমনের মন্দির ভেঙে পড়ার পর রাজা হেরোদের জেরুজালেমে তৈরি মন্দিরও ফের রোমান সৈন্যরা ভেঙে দেয়। মাত্র একটা দেওয়াল দাঁড়িয়ে আছে। সেই ওয়াল অফ ওয়েলিং বা বিলাপের প্রাচীর ইহুদি মননে পবিত্র ধর্মস্থান।
আবার ঠিক তার ওপরেই মুসলিমদের আল আস্কা মসজিদ, যা নাকি মক্কা-মদিনার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেখান থেকেই নাকি পয়গম্বর মহম্মদ ঘোড়ায় চড়ে আকাশে উড়ে আল্লার দরবারে গিয়ে পবিত্র নির্দেশ নিয়ে ফিরে এসে পৃথিবীতে প্রচার করেছিলেন। আবার সেখান থেকে পাঁচশ মিটার দূরে এক মহাপবিত্র গির্জা। যেখানে নাকি ক্রস থেকে যীশুর শরীর নামিয়ে এনে ক্ষতস্থান ধুইয়ে সমাধিস্থ করা হয়, তারপরে পুনরুত্থান।
৪) কেউ কি খেয়াল করেছেন যে নবগঠিত ইজরায়েল রাষ্ট্রকে প্রথম কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয় -- আমেরিকা নয় -- স্তালিনের রাশিয়া? সরকারি কম্যুনিস্টরা চেপে যান যে প্রথম ইস্রায়েল-আরব যুদ্ধে স্তালিনের চেকোশ্লোভাকিয়ার পাঠানো অস্ত্রসাহায্য না পেলে ইজরায়েল হেরে যেত?
৫) খেয়াল করেছেন যে মহাত্মা গান্ধী, নেহরু এবং অটলবেহারি বাজপেয়ী ইহুদীদের যন্ত্রণার প্রতি সমব্যথী হয়েও কয়েক শতক ধরে প্যালেস্টাইনের মূল অধিবাসী আরবদের ওখান থেকে বাস্তুচ্যুত করে ইহুদীরাষ্ট্র গড়ে দেওয়াকে অনৈতিক মনে করে খোলাখুলি বিবৃতি দিয়েছেন? অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিন্দু মহাসভার সাভারকর এবং আর এস এসের গোলওয়ালকর হিটলারের সমর্থন করেছেন, নিপীড়িত ইহুদীদের নয়।
৬) এহ বাহ্য। এটা খেয়াল করুন যে প্রত্যেকটি আরব-ইজ্রায়েল যুদ্ধের পর ইজরায়েল তার এলাকা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। আজকের প্যালেস্তাইন ১৯৪৮ এর তুলনায় ছোট্ট এক টুকরো মাত্র। পশ্চিমে মিশরের গা ঘেঁষে গাজা স্ট্রিপে এবং এলাকার আরেক প্রান্তে জর্ডন নদীর পশ্চিম পাড়ে জেরুজালেমের কাছে রমল্লা, বেথলেম এলাকায় সীমিত। বেশিরভাগ প্যালেস্তাইনের আরব আজ নিজভূমে পরবাসী। রিফিউজি ক্যাম্পে গোটা দুই প্রজন্মের জীবনযাত্রা।
৭) কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে যতবার সন্ধি হয়েছে, পিএলওর ইয়াসির আরাফাত বেঁচে থাকাকালীন, সেগুলো ইজরায়েল কাজে মানে নি? রিফিউজি এলাকাতেও পুলিশ এবং সৈন্যবাহিনী ইজরায়েলের, শুধু সিভিক দায়িত্ব প্যালেস্তাইনীদের। তাতেও মাঝেমধ্যেই পুলিশ এসে এলাকা ধরে বাড়ি খালি করায় এবং সেখানে ইসরায়েলীদের বসায়।
৮) এর ফলে নতুন প্রজন্মের প্যালেস্তাইনী যুবকদের মনে হয়েছে পিএলও নরমপন্থী, বিশ্বাসঘাতক। আলাপ আলোচনা, নেগোশিয়েসন শুধু প্রতাড়না এবং প্রতারণার জন্ম দিচ্ছে। ফলে উগ্রপন্থী হামাসের পতাকাতলে সমবেত হয়ে অস্ত্র ধরলেই ভবিষ্যত।
৯) হামাসের শক্তি মিশর ঘেঁষা গাজা এলাকায়। পিএলও জেরুজালেমের কাছে রামাল্লায়। হামাসের আক্রমণ চলছে গাজা থেকে। ইসরায়েল নোটিস দিয়েছে উত্তর গাজা এলাকা থেকে ৪ লক্ষ আরবদের ঘরবাড়ি ছেড়ে দক্ষিণে চলে যেতে হবে। কাল গাজাতে একটা হাসপাতালে বোমা পড়ে পাঁচশ নিহত। জেরুজালেমে বা রমল্লায় কোন যুদ্ধ হচ্ছে না। কারণ পিএলও এই যুদ্ধের সমর্থক নয়। কিন্তু কাল রামাল্লাতেও বোমা মেরে ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলের লক্ষ্য এবার পুরো প্যালেস্তাইনকে নিশ্চিহ্ন করা। ইজরায়েল সরকারি ভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাহলে জেনেভা কনভেনশন মানছে না কেন?
১০) আজকে হামাসের এই আক্রমণ বাস্তবে এজেন্ট প্রভোকেচারের কাজ করল। এই মরীয়া আক্রমণের কোন ভবিষ্যত নেই। আরব দুনিয়ায় প্যালেস্তাইন একা। আরব লীগের জর্ডন, সিরিয়া, মিশর, লেবানন কেউই ওদের পাশে নেই। সৌদি আরব কী করছে সবাই জানে।ঠিক যখন খোদ ইসরাইলে উগ্র দক্ষিণপন্থী নেতা নেতানেয়াহু নাস্তানাবুদ হচ্ছিল, ওর বিরুদ্ধে চারটে দলের সম্মিলিত জোট শক্তিশালী (তাদের মধ্যে আরব পার্টিও আছে) হয়েছে, তখন হামাসের এই আক্রমণ নেতানেয়াহুকে শক্তি যুগিয়ে দিল।
আমাদের অন্য কিছু মনে পড়ছে কী?