এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • হারানো গল্পের খোঁজে - একটি নভেলা

    Krishna Malik (Pal ) লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০৭ নভেম্বর ২০২২ | ১১০৫ বার পঠিত
  • তিন
    অরিন্দমবাবুর কথাগুলো শুনছিলাম তাঁর দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে।  কিন্তু আমার মন চলে গেল অনেকগুলো বছরের ওপারে।

        শেষপর্যন্ত কিনা নিমুদাদাকে বড়াই বানাল সৎপথী! সৎপথী আর আমার পিসির ছোটছেলে নিমুদাদা আমার একক্লাস আগে পড়ে, টুয়েলভে।
       সেই নিমুদাদা স্কুল ছুটির সময় আমাকে ডাকল।কথা বলতে বলতে স্কুল থেকে বেরোলাম, বলল, “শোন, তোর সমুদ্রগুপ্তকে কেমন লাগে রে?”
    “কীরকম আবার লাগবে? ফানি ! তাছাড়া বেশ হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা ভাব আছে একটা। কেন রে, এরকম জানতে চাইছিস হঠাৎ?” আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে দু’দিকের কোমড়ে দু’হাত রেখে কৈফিয়ৎ চাওয়ার মেজাজে জিগ্যেস করি।
        ও আমার তেড়িয়া ভাব দেখে বলল, “না মানে – ও তোকে খুব পছন্দ করে।”
      “করে তো করে! করতেই পারে, কিন্তু সেকথা কাউকে সাতখানি করে বলার কী আছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তাছাড়া আমাকে ভালো লাগার মতো সুন্দরী তো নই!” আমি যে যথেষ্ট রেগেছি তা ও বেশ বুঝতে পেরেছে। মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল, “ও তোকে ভালোবাসে।” বলেই ছুট দিয়েছে।নয়তো রাস্তাতেই আমার কিল ঘুঁষি হজম করতে হতো নিমুদাদাকে। অবশ্য ওসমস্ত কথা আমি বাঁ কান দিয়ে ঢুকিয়ে ডান কান ঠুকে বের করে দিয়েছি।   
        সেবার ভ্রাম্যমান বিজ্ঞান প্রদর্শনীর গাড়ি এসেছে। এক একটা ক্লাস লাইন দিয়ে যাচ্ছে, ডেমো দেওয়া হচ্ছে তাদের সামনে, তাদের হয়ে গেলে অন্য ক্লাস। প্রতিবেশী এক স্কুলের প্রদর্শনী গাড়ি আর তাদেরই একাদশ-দ্বাদশের ছাত্র-ছাত্রীরা ডেমো দিচ্ছে। আমাদের স্কুলের হনুন্দরমাশ ছেলেরা উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে তাদের হয় নারেডিস্তুক, নয়তো দাউদাউ জ্বলনিকভ বানিয়ে ছাড়ছে। মাঝে এক দুবার খবর পেয়ে অপরেশ বসু স্যার ছড়ি হাতে বেধড়ক্কাধুল ওড়াতে এলেন, ওড়ালেনও কয়েকজনকে, কিন্তু তাতে কি হান্দুরাশমি কমে ডেঁপোদের?
       স্কুলে তখন সারা বছর অনুষ্ঠান, সারাবছর গান নাচ আঁকা ফুটবল কবাডি, নয়তো তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, বিতর্ক, কুইজ ইত্যাদির অনুশীলন। স্কুলে, আন্তঃস্কুলে জোনালে ব্লকে জেলা স্তরে নানা প্রতিযোগিতা। আমাদের কো-এড স্কুলে স্যারদের সঙ্গে সেসব প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাই আমরা। ক্লাস চলাকালীন মনেই হয় না স্কুল চলছে, এত নিঃশব্দ থাকত স্কুল চত্বর। ক্লাস শেষ হলে অবশ্য বিচ্ছু ছেলেমেয়েরা একটু হই-হুল্লোড় যে করত না তা নয়। টিফিনে আর ছুটির পরে কান পাতা যেত না স্বাভাবিকভাবেই।

      ইদানীং শুনি বিনা বাধায় ক্লাস নিতে পারেন না শিক্ষক শিক্ষিকারা। নানা সরকারী প্রকল্পের কারণে ছাত্রছাত্রীদের অফিসঘর আর ক্লাসরুম করতে করতেই স্কুল শেষ হয়ে যায়। স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তেমন করার সময় হয় না – এমনই সিলেবাস, পরীক্ষার সিডিউল ইত্যাদি। পড়াশুনা সেকেন্ডারী ব্যাপার, আমাদের মফস্বলের আর গ্রামের স্কুলগুলোতে টিচারাও নাকি ছাত্রছাত্রীদের জন্য নানা সরকারী কাগজ,  তালিকা, তথ্য দিনরাত প্রস্তুত করে চলেছেন। স্কুল একেবারে সর্বদা গমগমে এক অফিস যেন।
      
        বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরোনোর পর প্রায় বারো বছর হয়ে গেলো জেলা গ্রন্থাগারের আমি একজন গ্রন্থাগারিক। ইদানীং বই পড়ার অভ্যাস থেকেও মানুষ দূরে সরে গেছে তা নিজের কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা থেকেই জানতে পারছি। ইন্টারনেটে পাঠের নানা দরজা খুলে গেছে, এ কথাও ঠিক। তবু বই হাতে নিয়ে বইএর গন্ধ নিতে নিতে আখরের আলো হৃদয়ে প্রবেশের যে আনন্দিত অভিজ্ঞতা হতো পাঠকের তা যে কমেছে তা নিশ্চিত।
      আমাদের গ্রন্থাগারের সদস্য্য হিসাবে নিয়মিত বই নিতে আসেন অরিন্দমবাবু।  তিনি একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। তাঁর কাছ থেকেই এখনকার স্কুলের পরিবেশ ও অন্যান্য খবর পাওয়া যায় কিছু কিছু।  কারণ বই নিতে এলে তিনি আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করে যান। তাঁর যা বয়স তাতে অল্প কয়েক বছর পরই অবসরকাল ঘনিয়ে আসছে।
      তিনি আজও বই পাল্টাতে এলেন। সে কাজ হয়ে গেলে বললেন, “আজ আর গল্প করার সময় হবে না, ম্যাডাম!”
    “কেন স্যার? বৌদির সঙ্গে মুভি দেখতে যাবেন নাকি?”
    “ হা হা হা হা! দুঃখিত! হাসিটা বেশ জোরেই হয়ে গেল।” আরে আর বলবেন না,  স্কুলে নানা তথ্য চেয়ে প্রায়ই সরকারী নানা নির্দেশ আসে তখনই তা পাঠাতে হবে বলে, হয়তো হাতে একঘন্টা সময় আছে, কিংবা একবেলা। আজ সেরকমই একটা কাজ করতে হলো ক্লাস বাদ দিয়ে, তাই নিয়ে দু-একজন টিচার গাঁইগুঁই করে বললেন, এই তো কদিন আগেই এই তথ্যগুলো দিয়েছি, আবার লাগবে? বেশ, দেব, কিন্তু সিলেবাস শেষ করতে পারব এভাবে চলতে থাকলে?  প্রধান শিক্ষক মশাই বললেন,  আনঅফিসিয়ালি বলছি, পড়াশুনাটা সেকেন্ডারী মশাই, আগে কাগজপত্র তৈরি করুন।” প্রায় ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলে থামলেন।
      কিন্তু তাঁর যে দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি তা কেন মনে করাতে পারি না, উপরন্তু ছটফট করছি মনে মনে। আমি আমার কেবিনের বাইরে বড়ো ঘরটায় এসে একটা ক্যাটালগ থেকে দরকারী কিছু তথ্য খুঁজছিলাম। আমার সহকর্মী তিনজন যে যার নিজের নিজের কাজে নিরত। অল্প দু-একজন মেম্বার বই খুঁজছেন। অরিন্দমবাবুর বই নেওয়া হয়ে গেছে।আমাকে দেখে কথার ঝুলি খুললেন আর কি!   

         কথার সূত্র ধরে বলে চললেন, এই তো দেখুন না, বিদ্যাসাগরের কততম যেন জন্মদিন উপলক্ষ্যে নানা অনুষ্ঠান করতে হবে বলে নির্দেশ এলো। তো সময়টা এমনই, আর হাতেও সময় এতটাই কম ছিল যে, আমরা স্টুডেন্টদের তৈরি করতেই পারলাম না, কারণ শুধু তো নাচ গানের অনুষ্ঠান নয়!  ভেতর বর্ন আর্টিস্ট অনেক আছে, বললেই ধেই ধেই করে নেচে দেবে। কিংবা গান গেয়ে ফেলবে। কিন্তু যেখানে মেধা ও মননচর্চার ব্যাপার সেখানে তো তাদের সময় দিয়ে অনুশীলন করাতে হবে! তবে – ম্যাডাম,  কথা হলো ওইসব নির্দেশিকামূলক অনুষ্ঠানগুলো নাকি কতটা কী বাস্তবে করা গেল সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হলো কিছু ছবি টবি তুলে প্রমাণ পাঠালেই চলবে যে, হ্যাঁ, নির্দেশ মতো সব অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেমন আমরা প্ল্যাকার্ড বা ফেস্টুনের সামনে ছাত্রছাত্রীদের দাঁড় করিয়ে, কিংবা ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লিখে দিলাম বিধিমতো যা যা লেখা দরকার, আর তার সামনে, ধরুন একজনকে তাৎক্ষণিক বক্তৃতার জন্য দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে ফেললাম। নির্দিষ্ট সরকারী দপ্তরে পাঠিয়ে দিলাম, ব্যস! কাগজেকলমে প্রমাণ থাকলেই হলো। বুঝলেন কিনা!

          “বুঝলাম সবই, মাস্টারমশাই। তাহলে আর কি, আপনি আসুন! পরের দিন কথা হবে।” তিনি হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে “হ্যাঁ হ্যাঁ, দেরি হয়ে যাচ্ছে” বলতে বলতে চলে গেলেন।  
           আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম তখনই।  অতীতের ভেতর ঢুকে পড়ার ফলে আমাকে বর্তমান ও অতীতের ভেতর টানাপোড়েনে থাকতে হচ্ছিল।  তাই তিনি চলে যেতে আমি স্বস্তি পাই, আর প্রধান গ্রন্থাগারিক হিসাবে আমার নিজস্ব ক্ষুদ্র কেবিনটিতে এসে বসি।

           অপরাধ প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, কাগজে কলমে প্রমাণটাই আসলে বড়ো কথা। নাহলে আদালতে পাক্কা অপরাধীও বিচারের নামে প্রহসনে মুক্তি পেয়ে যায়, আর গার্হস্থ্য পরিবেশে তো ছোটখাটো অপরাধের বিষয়ে তো কথাই নেই। আমার কাজ করে যে মাসি, তার মুখে একদিন সর লেগে আছে দেখতে পেলাম। জিগ্যেস করতে বলল, “দুধ গরম করার সময় দেখলাম একটা চা পাতা পড়েছে, সেটা তোলার পর বোধহয় মুখে হাত লেগে গেছে -!
       অপরাধ অপরাধই, ছোট হোক, বা বড়ো। তার কিঞ্চিত শাস্তি প্রাপ্য ছিল বইকি। কিন্তু আমি যেহেতু তার অপরাধ চোখে দেখিনি, তাই শাস্তি হিসাবে প্রাপ্য নূন্যতম মৌখিক ভর্ৎসনাও করতে পারলাম না। সত্যিই, এতে কিছু বলা যায় না! যদিও এই ছোট ঘটনাটিতেও অনেক দর্শন ও তত্ত্বকথা লুকিয়ে আছে। তুচ্ছ এই ঘটনাটি হাসিরও উদ্রেক করবে। খাদ্যের মতো একটা স্পর্শকাতর বস্তু, আর খুবই সামান্য একটা ব্যাপার, সেটা মুখে দেওয়া সাধারণ একটা গার্হস্থ্য লোভ মাত্র, তার সঙ্গে সমাজের কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। তবু, এর ভেতর অপরাধের বীজ ও সেই সুগভীর দর্শন ও তত্ত্বকথা রয়েই যায়।

          অথচ বিরাট একটি ঘটনা হয়েও সমুদ্রগুপ্তের হত্যাাপরাধের কোনো মামলাই হলো না। সরকার পক্ষে নিয়ম রক্ষার্থে যেটুকু হয়েছিল তাতে না ছিল কোনো সাক্ষ্য, না যথেষ্ট প্রমানাদি। এমনকি গামছাটাও নাকি তার নিজের বলে সাব্যস্ত হলো, আর হত্যা শব্দের আগে ‘আত্ম’ শব্দটা বসে গেল!  মাঝখান থেকে সৎ ছেলেটার নামে লাগানো হলো কলঙ্ক, যদিও তার তাতে কাঁচকলা তো বটেই, তার বাপেরও। কিন্তু আমার মতো কারও কারও বুকে তার মৃত্যু কেটে বসে দগদগে ঘা করে দিলো। সমস্ত সমাজ জুড়েই কি ওই অপরাধের শেকড় প্রোথিত ছিল না? গোটা সমাজ কি কিছু প্রত্যক্ষ ও অনেকটা পরোক্ষে দায়ী ছিল না? সব অপরাধ সম্বন্ধেই সম্ভবত একথা বলা যায়।

      নিমুদাদার কথাটা শোনার পর থেকেই লক্ষ্য করছিলাম দ্বাদশের সমুদ্রগুপ্ত সৎপথী আমাকে বেভুল হয়ে দেখছে।আমি মাছি তাড়ালাম, আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে দৃষ্টিশক্তি খারাপ হয়েছে ভেবে গাছের সবুজ দেখলাম। তারপরও একই কান্ড। আমি সাতেপাঁচে থাকি না তেমন। স্কুল, বাড়ি, বই আর মনে মনে আমার তো তখন থেকেই গল্প খোঁজা আর দৃশ্যের পর দৃশ্য জোড়া কাজ। ওসব ভাবিই না, কে তাকাল –  কেন তাকাল। বিশেষুদ্দেশ্যে তাকাল মনে হলে মনচলিস অক্ষর ফোটাই কোড়াকাগজে, বেফোট যা, বাপ!
       তাছাড়া সেই মধুসূদনমামার কাছে পাতি সব খবর, আর পার করো গো বলে মনআকাশে নজরের মাউস চালাই, ক্লিক করল কীনা? আমি তো কোন তালাবন্দী চিলেকোঠার লজঝর বাতিলের ভেতর আলাদিনের প্রদীপ ভাবি নিজেকে। ম্যাড়ম্যাড়ে, না রূপ, না গুণ। যদিও জানি, প্রকৃত লোকের হাতে শোভা খুলবে, আলো জ্বলবেও, আর ভরে যাবে তার সপ্তমঞ্জড়োয়ালি মাইলের পর মাইল উৎকীর্ণ ফলকে।

      প্রদর্শনী গাড়িতে সমুদ্রগুপ্ত আমার পাশে কখন কোন ফাঁকতালে এসেছিল কে জানে! একটু চাপাচাপি হয়ে গেল হঠাৎ, আর টাল সামলাতে হাতের পাতা বাসের দেওয়ালে রেখে সাপোর্ট নিলাম। অমনি আমার হাতের উপর এসে পড়ল সৎপথীর হাত।“ধ্যাত্তেড়িকা!” বলে আমি ঝাপট মেরে আমার হাত সরিয়ে নিতেই সে সম্ভবত অপ্রস্তুত দিলচাখমি তাকাল আমার দিকে। কিন্তু আমার বিশ্বাস নির্ঘাত ইচ্ছে করেই করেছে আমাকে ইঙ্গিতাতে।
      নেমে আসার সময়, কী কান্ড!  বাসের সিঁড়িতে নীলপাড় সাদা শাড়ির আঁচলে পা আটকে পড়িতং পড়িতং করতে করতে সামলালাম কাকে ধরে ফেলে? কাকে? না সৎপথী হতচ্ছাড়াটাকে। সেকি আমার সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে নাকি? বেফোট! স্কুলের পুরোনো বিল্ডিংএর সামনের কাঁকড়ের রাস্তায় চলতে শুরু করি প্রখর রোদ্দুরের ভেতর দিয়ে। রাস্তার পাশে লাল দেশি জবার গাছে অজস্র ফুল ফুটে আছে, আর একটা দুর্গা টুনটুনি পাখায় অজস্র কাঁপন তুলে ফুলের ভেতর ঠোঁট ডুবিয়ে মধু খাচ্ছে। হোঁচট খেতে খেতেও দৃশ্যটা দেখি। নিজের ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ে একবার জানলা দিয়ে অকারণ তাকাই ফুল, পাখি, না কি আর কাউকে দেখতে তা স্পষ্ট নয় আমার কাছে।
        সেদিনের থেকে তার নজর আর সরেই না যাওয়া আসার পথে, স্কুলেও সামনাসামনি আশেপাশে পড়ে গেলে। বই খুলে পড়তে বসলে, একা হলে আমার মনে পড়ছে, কিন্তু বিরক্তিতে হ্যামারান্ডাম মাথাখানা জ্বলে যাচ্ছে একেবারে। পরে খেয়াল হলো, আরে! সে যে আমাকে দেখছে কেউ তো আর আমায় বলেনি, আমি জানলাম কীকরে? নিশ্চয় আমিও তাকাচ্ছি বলেই না? আর তাকাবই না। কিন্তু আমি তো আর চোখ চালিয়ে খুঁজে খুঁজে দেখছি এমন নয়।  যাই হোক, আমাকে সতর্ক থাকতে হবে।

        আজ মঙ্গলবার, কেমিস্ট্রির ল্যাব আছে।  প্র্যাকটিক্যালে যেতে দেরি করলে মকরন্দ স্যার খুব রেগে যান। আগের ইংরেজির ক্লাসে একটা নোট লেখাচ্ছিলেন গৌতমবাবু। ঘন্টা পড়ার পাক্কা দু’মিনিট পরে স্যার এইমাত্র  ক্লাস থেকে বেরোলেন, ফলে তাড়াহুড়ো। প্রায় ল্যাবের দরজা থেকে ছুটতে ছুটতে ক্লাসে ফিরে দেখি বুলবুল সেইমাত্র বেরোচ্ছে। ওর সঙ্গেই আবার ল্যাবের দিকে হাঁটা দিলাম। আমার তাড়াহুড়ো দেখে বুলবুল বলল, অতো হাপসে যাচ্ছিস কেন? স্যার একটু রাগ করবেন নাহয়! আমরা পিছন দরজা দিয়ে ঢুকে ম্যানেজ দেব , চলতো! তারপর একটু থেমে বলল, হ্যাঁরে! তোর কেসটা কী?
       কী কেস?
      উঁ! দুদুভাতু! কিছু বোঝে না! গুপ্ত থেকে গুপ্ত কিছু খেল দেখাচ্ছে না বলতে চাস?
    এই! ঝেড়ে কাশ তো? আমি কেমন মেয়ে তুই জানিস।
     তোকে কিছু বলছি নাকি?
      তবে?
      তবে-র উত্তর আমার আর শোনা হলো না,  ল্যাবে ঢুকলাম। ওমা!  মকরন্দবাবু এখনও আসেননি! আজ ইলেভেন টুয়েলভ জয়েন্টে নাকি স্যার কী একটা পরীক্ষা করে দেখাবেন, তাই ওই ক্লাসের কিছু ছেলেমেয়েও এসেছে প্র্যাক্টিক্যালের জন্য। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রী আমাদের স্কুলে খুব বেশি নেই। দুটো ক্লাসেই আজ এমনিতেও কম ছেলেমেয়ে। সব মিলিয়ে হয়তো আঠারো কুড়িজন হবে।

            পায়ে পায়ে আমি উল্টোদিকে গিয়ে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের বাগান দেখছি। একটা মোহনচূড়া! টরটর করে হাঁটছে, আর মাথার ঝুঁটি খুলে মেলে ধরছে। দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে গেছি।  সেসব দিনে নানা পাখি প্রকৃতিতে জম্পেশ করেই থাকত বটে! চোখেও পড়ত খুব, তাই একদিন মৌটুসী আর একদিন মোহনচূড়া দেখতে পেলাম বলে সাজানো ব্যাপার মনে করবেন না, দয়া করে! আচমকা কে কী যেন কানের কাছে বলল আর আমি চমকে তাকালাম। দেখি মকরন্দ স্যার! বলছেন, এই যে, মা-জননী! ধরাধামে এসো, মা!
      স্যার আমায় স্নেহ করেন তাই, নাহলে আর রক্ষে ছিল না আমার। ব্যাটা সৎপথীও ছিল ল্যাবে।আছে। আমি তার উপস্থিতি জেনে আর দ্বিতীয়বার তাকাই না তার দিকে। বিকারে অ্যাসিডের একটা টেস্ট করলাম, স্যারের বিশেষ বিষয়ের পরীক্ষাটা দেখানো হয়ে গেলে পর। আমরা কয়েকজন রয়ে গেছি। স্যার বললেন, তোরা দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে চাবিটা অফিসে রেখে যাস।
      
        আমি ল্যাব থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি, খেয়ালও করিনি। বুলবুলের ছটফটানিতে বিকার উল্টে আমার গায়ে পড়ার আগেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল সৎপথী। আর খানিকটা অ্যাসিড ওর পায়ের বুড়ো আঙুলে পড়ল। ও একবার চেঁচিয়ে উঠেই দেখি মুখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে অনুলোম বিলোমের ঢংএ। একটা কষ্টেরও আওয়াজ নেই ওর মুখে।তারপর তো হুলস্থুল কান্ড।

       আমি সৎপথীকে আগে কোনোদিন অত ভালোভাবে লক্ষ্যি করিনি, তার সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। নিমুদাদা মাঝে মাঝে কানের কাছে তার গপ্প জুড়ত, তবে আমার ঝাড়ি খেয়ে থেমেও যেত। সেভাবেই একদিন বলল, “ছোটবেলায় ওর মা মারা গেছে, জানিস? আর বাপটা  টিরকেন্ডাস কেমন - ওকে ছেড়ে পালিয়ে গেল! ভাব একবার”।
    “তো আমি কী করব? থাম না!”
      তবু নিমুদাদা বলে যেতে লাগল, ও নাকি থাকে মামা-মামীর কাছে, জন্মস্থান নবদ্বীপ, সেখানে ঠাকুমা আর কাকুরা থাকে ইত্যাদি। তথ্যগুলো  না চাইতেই আমার মনে কিঞ্চিত কি “প্যাথোজ” সৃষ্টি করল? কে জানে! লম্বা, রোগা, মাঝারি ফরসা সরলপানা মুখের ছেলেটার নরম ঘাসের মতো গোঁফ দাড়ি দেখলে অবশ্য আমার মনে হয়েছে একটু হাত বুলিয়ে দিই। চোখ দুটো একটু চঞ্চল অবশ্য। লেখাপড়ায় সে ভয়ঙ্কর রকম ভালো না হলেও ভালোই ছিল। ছিল তো তাতে কার কী?

        কিন্তু পরপর দু’বার আমায় বাঁচিয়ে দিয়ে সে কী প্রমাণ করতে চাইল তাই তো বুঝলাম না। তবে যখন তার একেবারে ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হয়ে গেল, তখন আর তার প্রতি অতটা উদাসীন থাকতে পারলাম না এও ঠিক। একান্তে কথাবার্তা কোনোদিন বলিনি অবশ্য। এরপর স্কুলে যে কটা মাস সে ছিল, নানা অনুষ্ঠানে স্বরস্বতী পুজোয় ইত্যাদিতে সবার মাঝে একটুআধটু কথা বলেছি।তাতে সে কতটা আস্কারা পেল জানি না। কোনো চিঠিও কখনও লিখিনি, হাবুডুবুও খাইনি তার প্রেমে। তাতে দেখি তার আমার ল্যাংবোট হওয়াতে আটকায়নি!  নিজেই যেন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল।

      পাকেচক্রে একই কলেজে গিয়ে আমিও জুটলাম। সম্পর্কটা তার দিক থেকে ঘন হচ্ছিল। তার সঙ্গে মিশতে বা কথাবার্তা বলতে আমারও আর ততটা খারাপ লাগত না। তবে তাকে ভালোবাসি কিনা নিজের কাছে তা স্পষ্ট ছিল না। ভালোবাসি না –  এটা সে জানত আর কষ্টও যে পেত সেটা আবার আমি জানতাম। একটা স্বীকারোক্তি সে চেয়েছিল আমার কাছ থেকে। নিজেই মুখ ফুটে বলেছিল, বাসো আমায়?  বল না! না বাসলেও বল, আমার তাতে কোন অসুবিধা নেই।
    তাহলে জানতেই বা চাইছ কেন?
    তবু! অনিশ্চয়তা ভালো লাগে না।
      আমি এত অহঙ্কারী, দেমাকি – তাও কিচ্ছু বললাম না। এত ঢঙি, ন্যাকা মেয়ে আমি তাকে কি ল্যাজে খেলাতে চাইছিলাম? অথচ আমার তো তাকে হ্যাঁ বলতে ইচ্ছে করেছিল, তাহলে কেন বললাম না, কেন! একটা দিনের জন্যও তাকে একটা  নিশ্চয়তার আনন্দানুভূতি দিতে পারলাম না?  ওর ঝুলন্ত দেহটা দেখার দিন বাড়ি ফিরে আমার আর পাপিয়াদির যৌথ ঘরটিতে দরজা বন্ধ করে সেই প্রথম বোবা পশুর মতো ছটফট করে কেঁদেছি, নিজেকে চড়ের পর চড় মেরেছি। জীবনে নিশ্চয়তা যে থাকে না, সে যে পুরোপুরি এত দ্রুত অনিশ্চিত হয়ে যাবে কীকরে বুঝব?  
        সেটা কলেজের দ্বিতীয় বছর। দুই ছাত্রদলের মধ্যে গন্ডগোল চলছিল। ও হোস্টেলে কার কাছে কোনো দরকারে গিয়েছিল, সে সময় নাকি কী একটা মারাত্মক অপরাধ ঘটতে দেখে ফ্যালে। তার জন্য ওকে থ্রেট করা, চড়-থাপ্পড় মারা মাঝে মাঝেই চলছিল। ও ভয় পেয়েছিল প্রথমটায়, পরের দু-তিনদিন কলেজেও এলো না। কিন্তু অপরাধীরা নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না।
      চতর্থ দিনে ক্যান্টিনে আমাকে ডেকে ফিসফিসিয়ে বলল,  “আমি এখন কিছুদিন কলেজ আসব না। তুমি কিন্তু সাবধানে থাকবে, খুব দরকার না হলে কলেজ আসা কিছুদিন বন্ধ রাখো।”
    “কেন? আমার কীসের ভয়?”
    “জানি না! কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার কিছুটা ঘনিষ্ঠতা সবাই তো জানে। যদি তোমায় বিপদে ফ্যালে?”
    “আচ্ছা, কী হয়েছিল বলবে আমায়?”
    “কোনো দরকার নেই জানার।আমি বলব না কাউকেই।” ঠিক এই সাক্ষাতের সময়েই সেইসব কালপ্রিট বা তাদের দু-একজন সঙ্গী কাছাকাছি এসে আওয়াজ দিল।– “কী বে! খুব ফূর্তি, অ্যাঁ! খুব কেলাচ্ছিস? কিন্তু সাবধান!”
         ঘৃণায় আমার মুখটা বেঁকে গেল, আর সমুদ্র ঠায় ওদের চোখে একপলক তাকিয়ে নস্যাৎ করার ভঙ্গীতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। নীরবতাও কখনও কখনও যথেষ্ট ঘৃণা ও প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে। ওরা তা লক্ষ্য তো নিশ্চিত করেছে। এরপর ছাত্র নামধারী গুন্ডাগুলো বিচ্ছিরি হাসতে হাসতে চলে গেল আমাদের দুজনকে দেখতে দেখতে।
         তখনই হঠাৎ খুব আবেগতাড়িত হয়ে ও বলল, বাসো আমায়? --- আর আমি তখনও, তখনও মাথামোটা মেয়ে কিচ্ছু বললাম না। ও কি তবে আাঁচ করতে পেরেছিল যে, ওর দিন ঘনিয়ে এসেছে? জানতে পেরেছিল কিছু? পরের দিন ও শেষবার কলেজ আসে।কিন্তু ওর আর বাড়ি ফিরে যাওয়া হয় না। ফাঁকা একটা কোণের দিকের ক্লাসরুমে ওকে ঝুলতে দেখা যায়। কালপ্রিটরাই কুমীরের কান্না কাঁদল বেশি আর রটিয়ে দিল, ওদের ক্লাসের কোন এক মেয়েকে নাকি সিডিউস করেছিল, ধরা পড়ে যাওয়ায় লজ্জায় আত্মঘাতী হয়েছে।

      আর দ্যাখো, গলায় গামছা বাঁধা ফ্যান থেকে ঝুলন্ত সমুদ্রগুপ্তের মুখের দিকে প্রথমে আমার চোখ পড়ল না!  আমার নজর গেল কিনা তার পায়ের অ্যাসিডে পোড়া বুড়ো আঙুলের দিকে? ও কি আমাকে বলতে চাইল – দ্যাখো, আমি কিন্তু তোমার কাছে পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি?  অথচ মুখে তো ওর স্বভাবসুলভ লাজুক হাসিটা নেই?  বরং ঘাড় বেঁকে গেছে, চোখ বিস্ফারিত ও দৃষ্টিশূন্য। সারা মুখে কেমন একটা ছাপছাপ কালচে দাগ। খুনীরা চড় থাপ্পড় কসিয়েছিল নিশ্চিত!   

         খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। দেখে সহ্য করতে পারিনি, চোখে অন্ধকার দেখে দেওয়ালে মাথা ঠুকে বসে পড়েছিলাম। শ্রীমতী আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসে।  
      প্রশ্ন অনেক ছিল।  যে গামছায় ফাঁস দিয়ে ঝুলল, সেটা কি তবে কলেজে এসে মরবে বলে বাড়ি থেকে সঙ্গে এনেছিল? নাকি হোস্টেলে কারও রুম থেকে চুরি করে পকেটে ঢুকিয়ে এনেছিল?  মুখের চড়-থাপ্পড়গুলো নিজেই নিজেকে মেরেছিল তবে? এরকমই অজস্র সহজ প্রশ্নের জানা  উত্তর অনুচ্চারিত রয়ে গেল আজও। তা যে হবে সে তো বোঝাই যায়। নাহলে যে কয়েকজন স্যার ও অফিস স্টাফের সাথে সাথে শহরের কাউন্সিলর, নেতা ও পার্টি-পলিটিক্সও জড়িত তা বেরিয়ে পড়ত না?  সব পন্থীরই কেউ না কেউ কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে ছিল যে, ওই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোনো আর কি।

       কলেজে রাজনীতি আসলে ক্যাডার আর গুন্ডা তৈরির আঁতুড়ঘর। বিভেদ আর হিংসা উসকে তখন থেকেই পরস্পরকে ভ্রাতৃত্ব শিক্ষার বদলে লড়িয়ে দেবার শিক্ষা সেটা। পড়াশুনা করতে এসে সংসদীয় কোন ঢপের বাস্তব শিক্ষা ছাত্র সমাজ পায় তা আমার জানা নেই। তাবে তাতেই নাকি তারা ভবিষ্যতের গনতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতিতে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। এসব ঢপের তত্ত্বকথায় কোনো বিশ্বাস ছিল না, নেইও। তবু কলেজ নির্বাচনে কোনো নমিনি ফাইল করতে দেওয়া হলো না, এত্ত ভয় তাদের।

         আমি সোজা প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে গিয়ে বললাম, স্যার! আমি নির্দলে নমিনি ফাইল করতে চাই। আমাকে সুযোগ দেওয়া হোক।
      স্যার ভীষণ অবাক। বললেন, “তুমি ভালো করে ভেবে বলছ তো? ঘাড় ধরে বিপদ ডেকে এনো না, মৃণ্ময়ী! এসব রাজনীতির চক্করে কেন আসতে চাইছ?”
         “কিছুই না! একটা প্রতিবাদ, স্যার! ওদের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতিবাদ, সমুদ্রগুপ্ত সৎপথীর মৃত্যুর প্রতিবাদ। কেন ওরা নমিনেশন ফাইল করতে দেবে না কাউকে? তবে এও ঠিক স্যার, আমি বিরোধী দলের লোগোতে দাঁড়াতে পারব না, ভয়ের কারণে হয়তো নয়। তবে কেনো দলকেই আমি বিশ্বাস করি না।”  
          আমার সহপাঠী বন্ধুরাও খুব অবাক হয়েছিল। আক্রান্ত হবার ভয় করি না, মারলে মারবে – এই সাহস কোথা থেকে পেল মেয়েটা? আমি সটান একটা টুল নিয়ে কলেজের গেটে আমার ঘনিষ্ঠদের নিয়ে বক্তৃতা করতে শুরু করলাম। কী বলব কিচ্ছু ভাবা ছিল না, কিন্তু টুলে উঠে পড়লাম। খালি গলায়, প্রথমেই বললাম, আই হেট পার্টি এন্ড পলিটিক্স।তারপর কেবল মানুষকে ক্রীড়নক করে রাখার বিরুদ্ধে আর মানবতার পক্ষে কথা বলে গেলাম। রাজনৈতিক বক্ত্যবের ঢং পরিহার করে নিজের মতো করে বলতে গিয়ে সরাসরি কোনো দলের, কোনো নীতির সমালোচনা, কোনো রাজনীতির কথা উচ্চারণ করলাম না।  কোন ভূত ভর করেছিল আমি জানি না, আমার ভেতর একটা জ্বালা টের পাচ্ছিলাম। সমুদ্রগুপ্তের মুখ মনে পড়ছিল, আর ভেতর থেকে কথা বেরিয়ে আসছিল। আমি সমুদ্রগুপ্তের কথা বলছিলাম, ওর ব্যক্তিজীবন, ওর মজা করা, ওর সরলতা, ওর ভীতি ও সাহসিকতা – সব মিলিয়ে একটা সাধারণ ছেলের সাধারণত্বের কথা বললাম, কিন্তু একটা আঙুলও কারও প্রতি তুললাম না। শুধু বললাম, যারা তাকে ভালোবাসত, যারা তার নির্দোষীতায় বিশ্বাস করে তারা আমাকে ভোটটা দিয়ে তার বিদেহী আত্মাকেই যেন সমবেদনা জানায়। আমি শুধু তার মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাতেই কলেজ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। শেষে আমি চরম আবেগে কেঁদেও ফেললাম।

      অন্যায়ের একটা প্রতিবাদ তো করতেই হতো আমাকে। সেই মধুসূদনমামাকে কী জবাব দিতাম, বলুন তো?

       জীবনের প্রথম আর শেষ বক্তৃতাটা শেষ হতে বন্ধুরা হাততালি দিলো খুব। কাছে ঘনিয়ে এলো। আমি ভীড়ের ওপর দিয়ে দেখি বিকেলের দিকে এগিয়ে যাওয়া সূর্যের ত্যারছা আলো পড়ে রয়েছে গেটের পাশের গাছে গাছে, দেওয়ালেও নেতিয়ে পড়ে আছে ম্রিয়মান আলো। একটা রিক্ততার ছায়া যেন চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে, যে রিক্ততা দেশ রাজ্য আর সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে ওই মরা রোদের মতো। কলেজ ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গেছে তখন। আমাকে বাস স্ট্যান্ডে যেতে হবে। রীতা, শৌনকদের সঙ্গেই ফিরি অন্য দিন। সেদিন ওদের দেখিনি, হয়তো কলেজে আসেনি। অন্যরা আমাকে একা ছাড়ল না। সমুদ্রের সহপাঠী বন্ধু বিভাস বলল, শোন, এই ক’দিন তুই একা চলা ফেরা করবি না।--- এই নির্মাল্য, তুই ওকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে আয় তোর বাইকে।

       বন্ধুরা সহসা আমার প্রতি এত মনোযোগী হয়ে পড়ল যে আমার খারাপ লাগছিল। - “অত ভয় পাবার  কিছু নেই। তোরা বেশিই ভাবছিস” আমি বললাম।
            শ্রীমতী বলল, “হয়তো তাই, তবু সাবধানের মার নেই।”
      আবার ভালো লাগছিল, এও ঠিক। যদিও এমন কিছু আমি করিনি যাতে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাববে কেউ –  এরকম অকপট ভাবনা আমার মাথা ছেড়ে কিন্তু বেরিয়ে যায় নি।

      বক্তব্য রাখার ক’দিন পর পর্যন্ত যথেষ্ট প্যাঁক খেলাম, ঠাট্টা তামাশা করল যাদের করার কথা তারাই। প্রিন্সিপাল স্যরের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম - ওই যে আসচে রে,  ঢেউ আসচে, ঢেউ! –  গালাগাল দিতে দিতে দু-তিনটে ছেলে বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে।

        “কিন্তু নমিনি ফাইল করা থেকে আমাকে আটকাতে পারবে না ওরা”,  শ্রীমতীকে বললাম।
          শ্রীমতী বলল, “চল, দেখি! ম্যানেজিং কমিটির মিটিংএ কী সিদ্ধান্ত হলো! যদি নাকচ করে তোকে তাহলে ধর্ণায় বসব।”
        “স্যার! আসব- ” বলতে না বলতে ইকনমিক্সের এক প্রফেসর স্যারের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন, যদ্দূর জানি তিনি রুলিং পার্টির উচ্চকিত সমর্থক। আমাদের দেখতে দেখতে চলে গেলেন। রুষা গলা নামিয়ে তাঁকে দেখে বলল, “তাঁবেদার লোক একটি!”
        আমাদের দেখে স্যার বললেন, ঠিক আছে, মৃণ্ময়ী তোমারই জয়। আগামীকাল একটায় নমিনেশন ফাইল।
         শেষ পর্যন্ত আমার পাশে অনেককে পেয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, ওরা বুঝতে পারেনি আমি ছাত্রছাত্রীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হব। আমাদের ক্লাসের অধিকাংশ ভোট আমি পেলেও সংসদে না গিয়ে সিটটা ছেড়ে দিলাম। কারণ আমার তো সে উদ্দেশ্য ছিল না। কেবল সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর প্রতিবাদটাই করতে চেয়েছিলাম।

        তবে আপনারা যদি জানতে চান, আমার এই আটত্রিশ বছর বয়সেও আমি বিয়ে করিনি কেন? তার উত্তরে একথা বলতে পারি না যে, সৎপথীকে ভালোবেসেছিলাম বলে অন্য কাউকে বেটার হাফ করতে চাইনি। বললে সেটা ভুল হবে। কারণ আমার নিজের ঘরে একলা হয়ে ঘুমোতে গিয়ে সৎপথীর সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে জানিয়ে দিয়েছি, যে মাঝপথে আমাকে ফেলে পালায় তাকে আমি একটুও ভালোবাসি না। কেবল মাঝে মধ্যে ওর সঙ্গে সাক্ষাতের শেষের দিনের ছবিটা আমায় বড্ড খোঁচা দেয়, আর আমার ঘুমের মধ্যে চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়।

       সেইদিনের ক্যান্টিনের সেই টেবিলটায় বসে একবার কেবল ওর সঙ্গে দেখা হোক। ওর চোখের ভেতর চোখ দুটো পুঁতে দিয়ে ওকে বলে দেব, ভালোবাসি। সেদিকেই নিরন্তর যাত্রা আমার সকল দিনরাত্তির ধরে আমার অন্তর বাহিরের।     
     
               লাইব্রেরী থেকে ছুটির পর বেরিয়ে এলাম আমার এক সহকারী রজতের সঙ্গে। বাকি দুজনের একজন আহজ আসেননি, অন্যজন একটু আগেই বেরিয়ে গেছেন। রজত বয়সে আমার থেকে অনেকটাই ছোট। তবে ও ভীষণ পড়ুয়া, আর দরকারের বাইরে তেমন কথা বলে না।
        আজকে একটা বই ইস্যু করেছে পড়ার জন্য্য। বইটা হাত থেকে ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, স্বামী অভেদানন্দের “মরণের পরে” বইটা অনেকদিন ধরে পড়ব বলে ভাবছিলাম। বাব্বা! বইটার এত্ত ডিম্যান্ড, নাগাল আর পাই না!

     গেটের কাছে এসে একবার শনিবার দুপুররোদের বহরখানা নজর করে ছাতা খুলতে খুলতে বললাম,
    “হুম! কলেজের ছাত্রও এই বই পড়ছে, দেখে ভালো লাগল। ছেলেটি বই ফেরত দেবার সময় ভাগ্যিস তুমি ছিলে! প্রায় চার মাস আগে বইটা নিয়ে গিয়েছিল।”
    “তাই তে!”  রজত বলে।
       সৎপথীর মৃত্যুর পর অনুতাপে দগ্ধ এই আমার তাকে যখন দেখতে ইচ্ছেও করত তখনও ভগবানকে ডাকিনি, দেবতার মূর্তির কাছে মাথা নত করিনি। ভাবতাম, পরকাল কি সত্যি আছে? অপঘাতে মরা সমুদ্র কি আমার আশেপাশে আসে, এখন আছে? তাহলে জানান দিক। একলা হলে কথাগুলো তার উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করতাম। কিন্তু কোথায় কী? সীমাহীন স্তব্ধতা শুধু। তাই সমুদ্রের মৃত্যুর পরে জীবনের অসারতা ও সীমাবদ্ধতাই কেবল টের পেয়েছি।

      রজত কী ভেবে কে জানে, বলল, “এই যে শৃঙ্খলিত, সুনিয়ন্ত্রিত নিয়মের পারম্পর্য বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে বহমান – বলুন তো, সে কি কোনো শক্তি? তা কি স্বয়ংচালিত, স্বয়ংসৃষ্ট?  যাই হোক না কেন, আমি কিন্তু তাকেই ঐশীশক্তি বলে বিশ্বাস করি। তার কাছে মাথা নত করি। করতে হয়, নয়তো আমিই শেষ কথা - এই অহং জন্মায় মানুষের।”

      ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের পথে হাঁটতে হাঁটতে আপনমনে ভাবি, অতশত জানি না! তবে 'আমি' কেউ নয় এই বিশ্বে; প্রকৃতির একটি কণিকারও ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশের ভগ্নাংশমাত্র, এটুকু মানি। জীবজগতে কোনো প্রাণীই কেউ কারও থেকে প্রকৃতির নিয়মে একচুল কমবেশি নয়। মানুষও নয়। আমাদের চেতনা আছে। আমরা স্বপ্ন দেখি। আমরা অতীতচারী। কিন্তু এগুলো যে অন্যদের নেই কে বলল?

        তবে আমরা ঘটনার পুনর্নির্মাণ করতে পারি কখনও কখনও একথা হয়তো ঠিক। সেই কারণেই আমরা অতীতের কাছে বারবার ফিরে যেতে চাই এই ভেবে যে, হারানোকে যদি একবার ছোঁওয়া যায়!

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৭ নভেম্বর ২০২২ | ১১০৫ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    কবিতা - Aminul Islam
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ২০:৩৫513612
  • ইসে আপনিই  কি মলয় রায়চৌধুরী? এটা  অন্য আইডি? কিম্বা তাঁর আত্মীয় কেউ? আপনার বিহিন্ন ব্লগে দেখছি মলয়বাবুর লেখা লিংক করা। যেমন এই লেখাটা আসছে তিন হিসেবে আর ১ এ আসছে এইটে  
    আবার আপনার এই লেখার পাশে ২৬ এ মলয়বাবুর এইটে 
     
    প্রথমে ভেবেছিলাম হয়ত ভুল করে জুড়ে গেছে, কিন্তু একাধিকবার হতে দেখে ধন্ধে পড়ে গেলাম। ভুল হলে এডিট করে আপনার আইডির লেখাসব লিঙ্ক করে দিন। smiley
  • r2h | 192.139.***.*** | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ২১:০৩513613
  • এটা মনে হচ্ছে মলয়বাবু ভুল করে করছেন।
  • | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ২১:৩২513614
  • ক্কি ক্কান্ড! উনি তো দিনে দশ পনেরোটা করে লেখা নামান। আবার অন্যের ল্রখাও জুড়ে নিচ্ছেন নিজের সাথে!! 
    আজব লোক!
  • Krishna Malik (Pal ) | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ২৩:১১513616
  • আমি একেবারে আনাড়ি। আমার লেখার পাশে একটা একদিন এক এক সংখ্যা দেখে বুঝে উঠতে পারছিলাম না, ব্যাপারটা কী? এবার বুঝলাম, কিন্তু আমি জাস্ট লেখাটা এখানে পেস্ট করে আনুষঙ্গিক বিষয়গুল উল্লেখ করে পোস্ট করে দিদি। এর বেশি ুলেম আমার নেই। 
  • Krishna Malik (Pal ) | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ২৩:১২513617
  • এক একদিন এক এক সংখ্যা। উপরের মন্তব্যের ভুলটা ঠিক করে দিলাম।
  • Krishna Malik (Pal ) | ০৭ নভেম্বর ২০২২ ২৩:১৬513618
  •  গল্পের খোঁজে - একটি নভেলার এটি তৃতীয় পর্ব। আর আমি কস্মিনকালেও মলয় বা মলয়া কেউ নেই। আমি কৃষ্ণা মালিক পাল। 
  • kk | 2601:448:c400:9fe0:cdd8:1196:cd4c:***:*** | ০৮ নভেম্বর ২০২২ ০২:০০513620
  • এই সিরিজটা বেশ ভালো লাগছে পড়তে।
  • Krishna Malik (Pal ) | ০৮ নভেম্বর ২০২২ ২২:১৮513625
  • kk ধন্যবাদ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন