কত কত মানুষ আমার জীবনে। তাঁরা না থাকলে যেটুকু পথ এসেছি, আসতে কী পারতাম? মনে হয় না। বাবা মা দাদা দিদি ভাই বোন ছাড়াও আমার খেলার সাথীরা, গ্রামের মাসি পিসি খালা ফুপু চাচা চাচি টাকা কাকিমা।তাঁদের কথা আসবে কাদামাটির হাফলাইফে। এছাড়া আমাদের বাড়ির গৃহসহায়ক গৃহসহায়িকারা, বাড়ির খানদানি দলিজে আশ্রয় নেওয়া হঠাৎ অতিথিরা। এঁরা ছাড়াও আরো কত মানুষ রঙিন করে দিয়েছেন জীবন।
আজ বইয়ের আলমারি গোছাতে হচ্ছে।
বেরিয়ে এল কত শত বই। বই তো নয়, এক একজন মানুষের জীবন শিক্ষার লিখিত অভিজ্ঞান।
কমরেড লাইনটা সোজা করুন-- লিখেছিলেন কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়। দুর্গাপুরের শিল্প শ্রমিক সংগঠক। পরে সক্রিয় রাজনীতি ছাড়েন। কিন্তু লেখায় রাজনীতি থাকবে না হয়।
দীর্ঘদেহী নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি।
সহজ সরল পোশাক। পাজামা পাঞ্জাবি। আর মুখভর্তি দাড়ি। সেখান থেকে ছিটকে আসে হাসি।
১৯৮২-র ডিসেম্বরে আলাপ। দুদিনের কবি সম্মেলন। গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের আহ্বানে। কী সুন্দর একটা কার্ড। তাতে আমার নাম লেখা। ছাপা। অষ্টম শ্রেণি থেকেই কবি সম্মেলনে ঘুরছি। সেখানে নাম থাকতো না। আর এত সুন্দর কার্ড। খাওয়া দাওয়া সাজানো সব অভিজাত।
আমাদের কৃষি এলাকার খাওয়া এক ধরনের দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা।
মুখ ডাল যে এত রইস হতে পারে শিখলাম।
গাজর মটরশুটি সহযোগে তার রূপ স্বাদই আলাদা।
তোরণ পোস্টার সজ্জা সেগুলোও এ বলে আমাকে দেখ ও বলে আমাকে। তখন তো ফ্লেক্স যুগ নয়। সব হাতে লেখা আঁকা।
সে সময় উদ্ধৃতি লিখে রাখার খুব রেওয়াজ ছিল। এ-,বিষয়ে সেরা বর্ধমান পলিটেকনিক কলেজের রঞ্জিতদা।
আমি উদ্ধৃতি টুকরায়। একটু আধটু সাধ্যমতো ছবি কপি করলাম। তখন শিল্পী হওয়ার ঝোঁক ছিল। ছবি নকল করা জরুরি।
সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
কবিতা পড়ার পর আমার ধুম জ্বর এসে গেল। দুর্গাপুরের শুকনো শীত দক্ষিণ দামোদরের কৃষক শীতের চেয়ে আলাদা।
ছোটোবেলা থেকেই রোগেতাপে ভুগি। এ আর নতুন কী? ফিরে এলাম বাসে স্যারের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে।
কেষ্টদার সঙ্গে আলাপ নিবিড় হল ১৯৮৮ তে। নতুন চিঠি পত্রিকার দপ্তরে। জমাটি মানুষ। তাঁর কবিতা মানেই পার্টিকে ঠোকা।
কিন্তু বেশ লাগত। পার্টি অন্ত প্রাণ। মানাতে পারছেন না।
মানতেও।
লিখছেন সে-সব যন্ত্রণার কথা।
একসময় কলকাতা এলাম। ১৯৯৩-এ পাকাপাকিভাবে। কেষ্টদাও। দুর্গাপুর ছেড়ে সল্টলেকে।
দেখা হতে লাগলো কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে নবজাতক প্রকাশনীতে। সেখানে মাজহারুল ইসলাম, জিয়াদ আলি, নীহারদা আসেন নিয়মিত। আর মাঝে মাঝে আসতেন সুদর্শন রায়চৌধুরী। সুকান্ত ভট্টাচার্যের নিজের ভাইয়ের বইয়ের দোকান পাশেই। কম করার মানুষ। দেখি শুনি।
কেষ্টদা পরে উঠে পড়ে লাগলেন আমার যাতে একটা স্থায়ী ঠিকানা হয়। বাড়ি ভাড়া পাওয়া নিয়ে ঝামেলা নামের জন্য।
কেষ্টদা বললেন, নিজের জমি হলে কেউ কিছু বলতে পারবে না।
আর সল্ট লেকের গায়ে জমি আছে। চলো। সেক্টর ফাইভ পেরিয়ে যাওয়ার হলো।
ষাট হাজার টাকা কাঠা। এ গল্প ২০০০ এর। কিন্তু আমার তো সঞ্চয় থাকে না। দেড় লাখ টাকায় আড়াই কাঠা। কেনা আর হলো না।
পরে শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে রবিবার রবিবার দেখা হতো।
লক ডাউনে তাও গেল।
কেষ্টদার লেখার সঙ্গে দেখা হল আজ। আবার হবে।
কিন্তু মানুষ কেষ্টদার সঙ্গে আর দেখা হবে না।
চার দশকের সঙ্গ ভেঙে দিয়েছে করোনাকাল।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।