অন্যদিকে, সৌদিরা পায় প্রচুর পরিমাণে মার্কিন অস্ত্র। একইসাথে পায় নির্বিঘ্নে ওহাবি মতবাদ প্রচারের সু্যোগ। দেশটি মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়।
গোল বাঁধে ৯/১১-য়। আল-কায়দার টুইন টাওয়ার হামলাকে অজুহাত হিশাবে ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু হামলাকারীদের অধিকাংশই যে সৌদি নাগরিক, এই অস্বস্তিকর সত্যটা অনেকেরই চোখ এড়ায় নি।
৯/১১-র পর থেকেই সৌদ পরিবার বুঝতে শুরু করে: আগের মত প্রশ্নহীন মার্কিন সমর্থন আর পাওয়া যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্রদের অনেকেও সৌদি আরবের ব্যাপারে ক্রমেই সন্দিহান হয়ে উঠতে থাকে। দেশটির সম্পূর্ণ গণতন্ত্রহীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, আর নারী অধিকারের কার্যকর অনুপস্থিতির মত যেসব বিষয় এতকাল পশ্চিমারা উপেক্ষা করে আসছিল; সেসব নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়।
আরব বসন্ত সরাসরি রাজ্যটিকে স্পর্শ করে নি। কিন্তু তা নিঃসন্দেহে সৌদ পরিবারকে আশঙ্কিত করেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল সংস্কার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
২. সৌদ পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম, রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের নাতি আর বর্তমান রাজা সালমানের ছেলে, ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের উত্থানকে এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতেই দেখতে হবে।
৩. গণমাধ্যমে মোহাম্মদ বিন সালমান 'এমবিএস' হিশাবে উল্লেখিত। রাজ্যের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীর অনুরাগীর অভাব নেই দেশবিদেশে। ভবিষ্যৎ রাজাকে 'প্রগতিশীল' বলে প্রচার করা হচ্ছে।
এমবিএস মুখে খুব নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছেন। রাজ্যের কুখ্যাত ধর্মীয় পুলিশের বিলুপ্তির পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাঁর উদ্যোগে বহুকাল পরে দেশটিতে সিনেমাহল খুলেছে। কনসার্ট আয়োজিত হচ্ছে। সেইসব কনসার্টে বিদেশ থেকে নারী শিল্পীও আসছেন। আয়োজিত হচ্ছে কার রেসিং সহ নানান প্রতিযোগিতা। রীতিমতো এলাহি কারবার।
কিন্তু মোহাম্মদ বিন সালমান কি আসলেই প্রগতিশীল?
৪. এমবিএসের উত্থানকালে দমনপীড়ন অতীতের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে, নজরদারি পৌঁছে গেছে নজিরবিহীন মাত্রায়। ইসলামপন্থী স্কলার হোন আর নারীবাদী অ্যাকটিভিস্ট হোন, সৌদ পরিবারের সমালোচক মাত্রই হয় জেলে যাচ্ছেন, নয় দেশ ছাড়ছেন। সারা দুনিয়ার মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিরোধিতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিরশ্ছেদ আর ক্রুশবিদ্ধকরণের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা অব্যাহত আছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এমবিএসের রেকর্ড ভালো নয়৷ বিশ্ববাসী যখন সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে আলোড়িত ছিলেন, ঠিক সেই সময়, ইয়েমেনকে একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে সৌদি আরব। এই যুদ্ধের মূল হোতা মোহাম্মদ বিন সালমান।
এই হচ্ছে মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রগতিশীলতার নমুনা।
৫. এমবিএসের সৌদি আরবে সংস্কারের নামে যা হচ্ছে, তা আসলে দেশটিতে বড় আকারে পশ্চিমা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দেয়া কিছু ছাড় ছাড়া আর কিছুই নয়।
৬. কিন্তু এই দুনিয়ায় কারো ক্ষমতাই নিরঙ্কুশ না।
এককালের মহাপ্রতাপশালী ওসমানি সালতানাতের পতন ঘটেছে। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুটো ঘটনাই বিংশ শতাব্দীর।
কৌতূহলউদ্দীপক ব্যাপার হল, ওসমানি সালতানাতের পতন ঘটার কয়েক দশক আগে, সেখানে তানজিমাত বা সংস্কার পর্ব শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগের দশকে যেমন শুরু হয়েছিল গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রোয়কা। এসব উদারীকরণের উদ্দেশ্য ছিল ব্যবস্থাগুলোর ভাঙন ঠেকানো। কিন্তু কার্যত এগুলো ব্যবস্থাগুলোর ভাঙনকেই ত্বরান্বিত করেছে। মানুষ একবার খোলা হাওয়ার হদিস পেয়ে গেলে আর বদ্ধ কামরায় ঢুকতে চায় না। আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্র বা সোভিয়েত-উত্তর রাশিয়ার রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা থাকতেই পারে। কিন্তু ওসমানি সালতানাত বা সোভিয়েত ইউনিয়ন যে আর ফিরে আসবে না এটা নিশ্চিত করে বলে দেয়া যায়।
৭. এমবিএসের সংস্কার কর্মসূচি যত লোকদেখানোই হোক, তা বিশেষত সৌদি আরবের তরুণ প্রজন্মের সামনে একটা জানলা খুলে দিয়েছে। সেই জানলা দিয়ে তারা দুনিয়া দেখতে পাচ্ছে। আস্তে আস্তে এই বোধও তীব্রতর হচ্ছে যে, সৌদি আরব যেই শাসনতান্ত্রিক মডেল দাঁড় করিয়েছে, তা বিকল্পহীন নয়।
সামাজিক মাধ্যমে সৌদি ভিন্নমতাবলম্বীদের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে। তারা সৌদি ডায়াসপোরার সহমর্মিতা ও সহযোগিতা পাচ্ছেন। খুব ধীরগতিতে হলেও এমন একটা রাজনৈতিক কল্পনা তৈরি হচ্ছে, যেই বদলে দেয়া ভবিষ্যতে সৌদ পরিবারের ঠাঁই নেই।
মোহাম্মদ বিন সালমানসহ পুরো সৌদ পরিবার এই ভবিষ্যৎ বদলে দেয়ার প্রকল্প রুখে দিতে তাঁদের পক্ষে সম্ভবপর সবকিছুই করবেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হবে কিনা তাঁদের, তার জবাবটা সম্ভবত আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই পাওয়া যাবে।