বাৎসল্যের এক রূপ আমরা সকলে জানি। মা বাবা আত্মীয়স্বজনের কাছে থেকে সুখে দুখে ভালোমন্দে মিশে বড়ো হওয়া। মাচার ওপর নিবিড় লতানো গাছের মতোন ফুলে ফলে একটা সংসার। কিন্তু এর বাইরে যে কতো যাযাবরী আছে তা কি জানি? অল্প অল্প জানি। মনে পড়ে চুরুলিয়ার দুখু মিয়াঁর কথা? নজরুল ইসলামের চাইতেও চুরুলিয়ার দুখু আমার অনেক কাছের। আমি বিভেদ করছিনা। নজরুল সারাজীবন কষ্ট পেয়েছেন তবু ওই দুখু, ওর কথা মনে পড়লেই চোখ থেকে জল পড়ে আর মনে হয় পারবো, পারবো সব। সারাদিন রুটির দোকানে কাজ করে রাতে লেটোগান গাইতে যেতো দুখু। ওইটুকু ছেলে। এ আমাদের চেনা জীবন নয়। দারিদ্র্যের ধারণা আমাদের নেই তা নয়। কিন্তু দারিদ্র্য বহুরূপী। কিছু কিছু মানুষের জীবনও দারিদ্র্যের বহুরূপী জীবনের অনুরূপ। নটবর তাদেরই একজন। পেটে ভাত না থাকলে বিদ্যার্জন স্রেফ বিলাসিতা। নটবর ফাইভ কি সিক্স অবধি পড়েছিলো। বাবা ক্ষেতমজুর। সারাদিন খেটে পেতেন আট আনা। অনেক পরে সুন্দরবনে এসে নটবর জানবে এই আট আনার ভেতরে ছিলো তেভাগা আন্দোলনের বীজ৷ আমরা সেকথা অন্য কোনোদিন বলবো। নটবরের মা বাবারও বাৎসল্য ছিলো প্রবল। তবু আগে তো বাঁচা। বেঁচে থাকলে তো আদর। তখন এত পরিচয়পত্রের রমরমা ছিলোনা। নটবর ফতুয়া আর হাফপ্যান্ট পরে বেরিয়ে পড়লো। পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে কোলকাতা হয়ে এখানে ওখানে কাজ করতে করতে কবে যে সে এক মুরগিবিক্রেতার শাগরেদ হলো তা নিজেও জানেনা। নটবর বলেন, তখন হিন্দু বাড়িতে মুরগির মাংস ঢুকতোনা কিন্তু ধীরে ধীরে মাংস খাবার চল হচ্ছিলো। লোকে উঠোনে রাঁধতো বা আলাদা পাকশালা বানিয়ে সেখানে রাঁধতো। সেই এক আধুনিক জামাই, তার মুরগির মাংস খেতে চাওয়া আর হিন্দুবাড়িতে সেই প্রথম পৃথক পাকশালা গড়ে মাংস রান্নার মজার গল্প অনেকের জানা। তাহলে ওই মুরগিপালক হিন্দু হবেন এমন সম্ভাবনা কম। এ হলো পঞ্চাশের দশকের কথা। যারা মুরগি কিনতো, নটবর তাদের মুরগি ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে দিতো। এই ছিলো ছোটো নটবরের কাজ। দুজনের কেউ কাউকে চেনেনা অথচ একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। রাতে রাস্তায় এখানে ওখানে শোয়। নটবর বলেন, "লোকটার নামও জিজ্ঞাসা করা হয়নি কোনোদিন। তাই জানতামও না সে হিন্দু না মুসলমান। জানবার প্রয়োজনও অনুভব করিনি। আমি তখন ছোট মানুষ। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তাম। সে খাবার নিয়ে এসে আমার ঘুম ভাঙিয়ে খাইয়ে দিতো। দুটো রুটি আর দু টুকরো মাংস, ঝোল, আলু। কিসের যে মাংস তাও জানতাম না।"
কেনো এসব লিখছি জানেন? হ্যাঁ জানেন। এদেশে জানেন তো মাংস খাওয়ার অপরাধে নরহত্যা করা হয়। কার ঘরে কোন মাংস আছে, কে হিন্দু কে মুসলিম এইসব নিয়ে প্রতিদিন হিংসা ছড়ানো হয়। হিংস্রতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়!
আমরা আজকাল অচেনা মানুষকে সময় জিজ্ঞেস করতে দ্বিধাবোধ করি আর ওরা দুজন একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতো। কেউ নাম জানেনা। একসঙ্গে থাকে খায়। কি খায় তাও জিজ্ঞেস করেনা।
কখন এমন হয় জানেন? সত্যি করে ভালোবাসলে।
নটবরের এই একটুকরো জীবনকথাকে যদি সাদাকালো রিলে বসিয়ে ঘুরিয়ে দেখি, মনে হয় পথ্য পাবো। আমাদের চারিদিকে বড়ো অসুখ। পথ্য পেলে একদিন সুস্থ হবো নিশ্চয়ই।
মাধবনগর গ্রামের মেষপালক মণি। হাঁটুর ওপর গুটিয়ে তোলা নীল ধুতি, গায়ে গামছা, মাথা ন্যাড়া, নির্বাক, নির্বিকার, হাতে লম্বা একরকম লাঠি। এই হলো মণি। মণির কুলপরিচয় কিচ্ছু জানিনা। তার সঙ্গে ওই বয়সে কোনো কথাও বলে উঠতে পারিনি। কিই বা বলতাম? মণি মেজাজি লোক। চুপ থাকাই তার পছন্দ অথচ উঠে দাঁড়িয়ে এমন কিছু একটা সে করতো যে ভেড়ারা একজায়গায় চলে আসতো। মাঠের ধারে উবু হয়ে গামছা মাথায় বসে থাকা মণিকে আজকাল সেই ভালোবাসার রাখালের মতো মনে হয়। এমন লম্বা লাঠি আমি সৌরাষ্ট্রের পশুপালকদের হাতেও দেখেছি।
হঠাৎ মণি মারা গেলো একদিন। অকাল মৃত্যু। মনে হয় অনাহারে অর্ধাহারে।
আজ ২০২২ সাল, ঝড় বন্যায় বিধ্বস্ত সুন্দরবনের চাষবাস পশুপালন নিয়ে নতুন ভাবনা চলছে। গরু পোষা ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। এখন তাই গাড়োল ভেড়ার নাম উঠে আসছে খুব। সে এই সুন্দরবনের জলবায়ুতে সবচেয়ে উপযুক্ত। দু একটা NGO এসব ভাবছে। কিছুদিন পর দূর থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে তারা হাজিরও হবে কিন্তু সুন্দরবনের মাটিতে বছরের পর বছর পশুপালন করে মণি যে অভিজ্ঞান লাভ করেছিলো তা আর আমরা পাবোনা। মণি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে একপাল গাড়োল ভেড়াই পালন করেছিলো!
মণিকে কথা বলানোর জন্য তার ভেড়াগুলোকে ঢিল মারতাম। মণি তখন রেগে উঠে বলতো, "ওয়! আমার ভেড়াগুলাকে ডগা মারুটু কেনি রে?"
মণি হয়ত অনেক আশা নিয়ে মেষপালন শুরু করেছিলো। কিন্তু কেউ তাকে এগিয়ে যেতে বিন্দুমাত্র সাহায্য করেছিলো বলে মনে হয়না। ভেড়া ধীরে ধীরে তাই ছেড়ে দিতে হলো। আজ যখন নতুন করে সেই ভেড়া ফিরে আসছে, দেখা যাচ্ছে এ অঞ্চলে গাড়ল ভেড়াকে নিয়ে বলবার আর কেউ নেই। আর কেউ ভেড়া পালনও করেনা। তখন বুঝি,
আমরা মণির মর্ম বুঝিনি।
সরস্বতী বাগদেবী। আমাদের সরস্বতী হলো মৌমাছি, শ্রমিক, কৃষক, পালক আরো কতো কি। সরস্বতীর হাতে ঘড়ি নেই। সরস্বতীই আমাদের ঘড়ি। সকালে সে কাজে চলে যাচ্ছে মানে এখন বাজে সাতটা। সে ফিরে আসছে মানে এখন বাজে এগারোটা। এইরকম আর কি। এমনিতে সে খুব মুখরা। কিন্তু সরস্বতী একথা বুঝে নিয়েছিলো যে নরম মাটি পেলে সকলে মাড়িয়ে যাবে। ছেলেমেয়ে স্বামী নিয়ে তার ভরা সংসার। সরস্বতী উদয়াস্ত খেটে এসব দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কোথাও হাত পাতার প্রশ্নই নেই। কলগড়ায় সে বলেছিলো, "পড়নে শুননে কি হবে? ঘষি গুড়িনে জ্বাল হবে!"
মানে পড়াশুনো করে লাভ নেই, গোবর গুড়ালে রান্নার জ্বালানি হবে। এই কথার কোনো অন্য তাৎপর্য থাকলে পাঠক সময় নিয়ে ভেবে তা বার করবেন। আমার আজ ভাবতে চমৎকার লাগে কথাটি।
ফেরবার পথে সরস্বতী তার ছাগলগুলোকে খুঁটি উপড়ে আনে। তার দাঁড়াবার সময় একেবারে নেই। পথে আসতে আসতে সে ছাগলের সঙ্গে কথা বলে। ছাগল ল্যাজ নেড়ে মাথা নেড়ে কি উত্তর দেয় আমরা বুঝিনা। ফিরে সে রেঁধেবেড়ে অবেলায় স্নান করতে আসে। সন্ধ্যায় লম্ফ জ্বেলে বসে ছোলা মটর ডিম সেদ্ধ বেচতে। সারাদিনের ক্লান্তিতে ওইখানে বসেই সে মাঝে মাঝে ঢুলে পড়ে। সরস্বতী রোগা কিন্তু চোখের তলায় কালি নেই। ফিটনেস তার হরিণের মতো। আমি কখনো তাকে রিগ্রেট করতে দেখিনি। এমন মানুষ কম দেখা যায়, না?
অথচ দেখো সরস্বতীর গুরুকুল নেই, স্কুল কলেজের থিয়োরি নেই। স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রতা বিষয়ক নানা তর্ক ও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির ডামাডোলের ভেতর বসে চারবেলা খেটে খাওয়া স্বাধীনচেতা সরস্বতী এখন তার ছাগলদের জন্য জামা বানাতে বসেছে।