১৮৭৪ সাল থেকে ১৮৮৪ সালের মধ্যে বঙ্গদর্শন ও প্রচার‘এ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলার ইতিহাস বিষয়ে চারটি প্রবন্ধ লেখেন। সম্প্রতি সেগুলো জড়ো করে প্রকাশ করেছে স্পার্ক। প্রবন্ধ চারটি, যথাক্রমে —
১ বাঙ্গালার ইতিহাস
২ বাঙ্গালার কলঙ্ক
৩ বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা
৪ বাঙ্গালার ইতিহাসের ভগ্নাংশ কামরূপ-রঙ্গপুর
ততদিনে পলাশী কাণ্ডের শতবর্ষ পার হয়ে গেছে। সিপাহীদের পরাজয়ে অবসান ঘটেছে মুঘল আমলের, আর ভারতবর্ষে শুরু হয়েছে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্ব। প্রবন্ধগুলো পড়ার সময় কনটেক্সটটা মাথায় রাখতে হবে।
‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ শুরু হয়েছে হাহাকারের মধ্য দিয়ে। সকলেরই ইতিহাস আছে, শুধু বাংলার ইতিহাস নাই। এর কারণ বঙ্কিম খুঁজে পেয়েছেন ‘দেব ভক্তিতে’, আর ‘গর্বের অভাবে’; বাঙালি তাঁর নজরে ‘হতভাগ্য জাতিদিগের মধ্যে অগ্রগণ্য’।
উদ্যমী বঙ্কিম তাই ‘বাঙ্গালার ইতিহাসের উদ্ধার’-এ নেমেছেন। সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছেন ‘বাবু’ রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। একটা ‘বাল্যপাঠ্য পুস্তক’ নিয়ে।
মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতা নিয়ে চট্টোপাধ্যায় যে-ইতিহাস উদ্ধার করলেন, তার সারকথা হল এই, এককালে সিংহল-যবদ্বীপ-বালিদ্বীপ সব বাঙালির উপনিবেশ ছিল। এমনকি উত্তর ভারতেও ছিল এই জাতির উপনিবেশ। তাই তারা ‘ক্ষুদ্র জাতি’ হতে পারে না।
কিন্তু কেনো বঙ্কিমের এত বড় হওয়ার সাধ? অনুমান করা যায়, ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনজাত হীনম্মন্যতা! বাঙালি যে ব্রিটিশের চেয়ে কম কিছু নয়, দখলদারিত্বে সমান সমান, তা প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে গেছিলেন বঙ্কিম।
পাঠানদের ব্যাপারে আপাতদৃষ্টিতে অপেক্ষাকৃত উদারতা দেখিয়েছেন তিনি। স্বাধীন পাঠানদের শাসনকে বাঙালির জন্য আশীর্বাদ ভেবেছেন। যথার্থই দাবি করেছেন, এটা বাংলার শিল্প সাহিত্যের উৎকর্ষের কাল ছিল, স্থাপত্যেও উৎকর্ষের সাক্ষ্য দেয় গৌড় বা পাণ্ডুয়া।
কিন্তু এই উদারতার পেছনে আসলে কী আছে? সেটা বুঝতে হলে পরাধীনতা বলতে বঙ্কিম কী বুঝতেন সেটা আগে বুঝতে হবে আমাদের! তো, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পরাধীনতা সম্পর্কে ঘোষণা করছেন —
“রাজা ভিনজাতীয় হইলেই রাজ্যকে পরাধীন বলিতে পারা যায় না।”
কেন যায় না?
“সে সময়ের জমিদারদিগের যেরূপ বর্ণনা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতে তাঁহাদিগকেই রাজা বলিয়া বোধ হয়; তাঁহারা করদ ছিলেন মাত্র।”
বঙ্কিমের বিশ্বাসে বাংলায় পাঠান শাসনেও যেহেতু স্থানীয় জমিদাররাই (এদের ধর্মীয় পরিচয় একটু পরেই পাব) রাজা ছিলেন, তাই মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন আকবরের অধীনস্ত হওয়ার সময় থেকেই বাংলার প্রকৃত পরাধীনতার শুরু, এই রায় দিচ্ছেন তিনি। আবেগমথিত ভাষায় মুঘলদের অর্থনৈতিক শোষণের সমালোচনা করছেন, যদিও তারচে শতগুণ বেশি শোষণ করা ব্রিটিশদের ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকেছেন। বলছেন, “মোগলই আমাদের শত্রু, পাঠানই আমাদের মিত্র”।
এই ‘আমরা’ কারা?
দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালার কলঙ্ক’-এ এর জবাব পাই।
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি এরকম দুটি লাইন,
“… বাঙ্গালি মুসলমান কর্তৃক পরাজিত হইয়াছিল…”
“… বাঙ্গালি পাঁচশত বৎসর মুসলমানের অধীন ছিল…”
চতুর্থ প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালার ইতিহাসের ভগ্নাংশ কামরূপ-রঙ্গপুর’-এ দেখছি,
“বাঙ্গালির দেশ, মুসলমানেরা কখনোই একচ্ছত্রাধীন করিতে পারেন নাই।”
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বঙ্কিমের বোধে এই ‘আমরা’ হচ্ছেন বর্ণ হিন্দুরা, ‘বাঙ্গালি’ বলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আসলে এঁদেরকেই বুঝিয়েছেন।
তবু কারো মনে যদি সন্দেহ রয়ে যায়, সেটি দূর করে দেবে তৃতীয় প্রবন্ধ।
এখানে এসে বাঙালিকে নিম্নরূপে সংজ্ঞায়িত করছেন বঙ্কিম,
“আত্মজাতিগৌরবান্ধ, মিথ্যাবাদী, হিন্দুদেষী মুসলমানের কথা যে বিচার না করিয়া ইতিহাস বলিয়া গণ্য করে, সে বাঙ্গালি নয়।”
ঐতিহাসিক মিনহাজের সমালোচনা করছেন বঙ্কিম এই ভাষায়,
“… সেই গোহত্যাকারী, ক্ষৌরিতচিকুর মুসলমানের স্বকপোলকল্পনের উপর তোমার বিশ্বাস।”
বঙ্কিম যে বাঙালি বলতে বর্ণ হিন্দুদেরকে বুঝতেন, মুসলমানদেরকে ভাবতেন তাদের ওপর উৎপীড়ন চালান ভিনজাতি, তার পক্ষে আর কোনো প্রমাণ পেশ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। অবশ্য পাঠানরা ভিনজাতি হলেও বঙ্কিমের নজরে মিত্র, কারণ তাঁর বিশ্বাসে এঁরা হিন্দু জমিদারদের (বঙ্কিমের ভাষায় ‘রাজা’) কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন নি, এই ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন মুঘলরা। বঙ্কিমের বিশ্বাস ভুল, মুঘল শাসনেও প্রশাসনিক উচ্চপদগুলো যে বর্ণ হিন্দুদেরই দখলে ছিল, আজকে তা সর্বজনস্বীকৃত ঐতিহাসিক সত্য।
শুধু জাতিধারণায় না, বঙ্কিমের ভাষাধারণায়ও ঝামেলা আছে।
দেখতে পাই তৃতীয় প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন,
“বাঙ্গালা ভাষা আত্মপ্রসূতা নহে। সকলে শুনিয়াছি, তিনি সংস্কৃতের কন্যা; কুললক্ষণ কথায় কথায় পরিস্ফুট। কেহ কেহ বলেন, সংস্কৃতের দৌহিত্রীমাত্র। প্রাকৃতই এঁর মাতা। কথাটায় আমার বড়ো সন্দেহ আছে। হিন্দি, মারহাট্টা প্রভৃতি সংস্কৃতের দৌহিত্রী হইলে হইতে পারে, কিন্তু বাঙ্গালা যেন সংস্কৃতের কন্যা বলিয়া বোধ হয়।”
কেন ‘বড়ো সন্দেহ’ আছে বাংলার প্রাকৃতকন্যা হওয়ায়? কেন ‘বোধ হয়’? ভাষাতাত্ত্বিক কারণ দর্শালেও সেটাই কি আসল কারণ?
উনিশশতকে রেসিস্ট ইওরোপিয়ানরা নিজেদেরকে ‘আরইয়ান’ মনে করত। জার্মান ম্যাক্স মুলার সেসময় একটা প্যাঁচ লাগান। আদি হিন্দুশাস্ত্রে আর্য শব্দটি আবিষ্কার করেন তিনি, এবং সিদ্ধান্ত টানেন, এই আর্য হচ্ছে সংস্কৃতে ইওরোপের আরইয়ান‘র প্রতিশব্দ। সংস্কৃতকে একটি আর্য ভাষা মনে করা হয়। প্রাকৃত জনসাধারণের ভাষা। তাই বঙ্কিম বাংলাকে বানাতে চেয়েছেন সংস্কৃতের কন্যা। উদ্দেশ্যটা অত্যন্ত পরিষ্কার, জাতির মত ভাষা প্রশ্নেও ব্রিটিশকে ঠেস দেয়া, যেন সাহেবদের সমীহ আদায়ে সুবিধা হয় বাবুদের।
তবে মুসলমানদের সবাই যে বহিরাগত নন, সেটা স্বীকার করে নিচ্ছেন বঙ্কিম, কৃষিজীবী মুসলমানকে ‘দেশীয় লোক’-এর মর্যাদা দিচ্ছেন।
তৃতীয় প্রবন্ধের একেবারে শেষে এসে লিখছেন তিনি,
“এখন তো দেখিতে পাই, বাঙ্গালার অর্ধেক লোক মুসলমান। ইহার অধিকাংশই যে ভিন্ন দেশ হইতে আগত মুসলমানদিগের সন্তান নয়, তাহা সহজেই বুঝা যায়। কেননা ইহারা অধিকাংশই নিম্নশ্রেণির লোক — কৃষিজীবী। […] দেশীয় লোকের অর্ধেক অংশ কবে মুসলমান হইল? কেন স্বধর্ম ত্যাগ করিল? কেন মুসলমান হইল? কোন জাতীয়েরা মুসলমান হইয়াছে?”
বঙ্কিম এই প্রবন্ধ শেষ করেছেন এই বলে, “বাঙ্গালার ইতিহাসে ইহার অপেক্ষা গুরুতর তত্ত্ব আর নাই।” এই লাইনটা পড়ে রীতিমতো কৌতূহল জাগে! বাংলার ইতিহাসে অনুসন্ধান করার মত চিত্তাকর্ষক বিষয়ের অভাব নাই (একটা বিশাল তালিকা বঙ্কিম নিজেই দিয়েছেন এই প্রবন্ধটিতে), তার মধ্যে মুসলমানদের এই ‘স্বধর্ম ত্যাগ’-ই কেন সবচে ‘গুরুতর তত্ত্ব’ মনে হল এই সৃষ্টিশীল কথাসাহিত্যিকের কাছে?
চতুর্থ প্রবন্ধ মূলত কামরূপ আর রঙ্গপুর নিয়ে। এই প্রবন্ধে বঙ্কিম একটা কৌতূহলউদ্দীপক দাবি তুলেছেন৷ সেটা হল ঐতিহাসিকভাবে বাঙ্গালা অখণ্ড ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন ‘অনার্য জাতির’ দেশের সমষ্টি ছিল। এই দেশগুলোকে জোড়া লাগিয়ে বাঙ্গালা বানাল কারা? বঙ্কিমের বিশ্বাসে, ‘আর্য’-রা। তারা ‘এক ধর্ম, এক ভাষার’ জোরে সবাইকে এক করে ‘আধুনিক বাঙ্গালায়’ পরিণত করল।
এই শেষ দাবিটা বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আজকের বাংলাদেশকে এক ধর্ম (ইসলাম) আর এক ভাষার (বাংলা) দেশ হিশাবে দেখার রাষ্ট্রপ্রকল্প খুব প্রবলভাবেই হাজির আছে। ইন্ডিয়াতেও ক্ষমতাসীন দলের শ্লোগান ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানে’ দেশটিকে এক ধর্ম (হিন্দুধর্ম) আর এক ভাষার (হিন্দি) হিশাবে দেখার রাষ্ট্রপ্রকল্প বর্তমান, যার আছর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ওপর পড়বে না, এমন আশা বাতুলতা। এই দুয়ের শেকড়ই আমরা পাচ্ছি বঙ্কিমের রাষ্ট্রচিন্তায়। তাঁর ইতিহাস ভাবনায়। যা আবার তৈরি হয়েছে কলোনিয়াল কলকাতায় বসে। দুর্ভাগ্যবশত আমরা এখনো ‘বঙ্কিমের বাঙ্গালা’-য় বাস করছি, ধর্ম আর জাতি নিয়ে আমাদের আধিপত্যশীল ভাবনা রেসিস্টই রয়ে গেছে।
আজকে আমরা অনেকেই গণতন্ত্রের কথা বলে থাকি। ধর্ম আর ভাষা প্রশ্নে এর মানে কী? বহুত্বকে ধারণ করা। এক দেশে বহু জাতির সহাবস্থানের পক্ষ নেয়া। ‘বঙ্কিমের বাঙ্গালা’-য় এই গণতন্ত্র পাওয়া যাবে না। সীমান্তের দুইদিকেই রেসিস্ট রাষ্ট্রচিন্তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। তাহলেই গণতন্ত্রের দিকে এক কদম আগাব আমরা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।