গত ২১শে মে, মধ্যপ্রদেশের নিমাচে একজন প্রৌঢ়কে পিটিয়ে মারা হয়। তাঁকে বারবার জিজ্ঞাসা করা হয় তাঁর নাম কি মহম্মদ, তাঁকে আধার কার্ড দেখাতে বলা হয়। কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হওয়ার কারণে প্রৌঢ় কোনও উত্তর দিতে পারেন না; অতএব চড় থাপ্পড় এবং তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু। অবশেষে জানা যায় হতভাগ্য মানুষটির নাম ভানওয়ারলাল জৈন এবং তাঁর বাড়ি রাতলাম জেলার সার্সি গ্রামে। তিনি পার্শ্ববর্তী জেলার একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গেছিলেন। সেখান থেকে পথ হারিয়ে ফেলেন এবং মানসিক ভাবে অপ্রকৃতস্থ হওয়ার কারণে, নিজের অজান্তেই ঘুরতে ঘুরতে ১২৫ মাইল দূরে মানসা জেলার নিমাচে পৌঁছে গেছিলেন। সমাজ এতো দিন এই ধরণের মানুষকে সহানুভূতির চোখে দেখে এসেছে। তাঁর সেবা শুশ্রূষার ব্যবস্থা করেছে, বাড়ির লোকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আজকের ভারতে সহমর্মিতার কোনও স্থান নেই। সাম্প্রদায়িকতার বিষ এতো গভীরে প্রবেশ করেছে যে প্রায় প্রতিটি মানুষ সন্দেহভাজন। যে কোনও মানুষ নাম না বলতে পারার কারণে, কোনও পরিচয় পত্র না দেখাতে পারার কারণে শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার সন্দেহ তে চরম বিপদের সম্মুখীন হতে পারে।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ঘটনার মাত্র পাঁচ দিন আগে নিমাচের একটি মুসলিম দরগার সামনে হনুমান মূর্তি স্থাপন করার কারণে এলাকায় সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। একটি ধর্মস্থানে অগ্নিসংযোগের ফলে এলাকায় কার্ফু জারি করা হয়। নিমাচে সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোল নতুন ঘটনা নয়। গত বছর একটি ধর্মস্থানে লুটপাট হয়েছিল এবং তত্ত্বাবধানকারি ও আরও কয়েকজনকে মারধোর করা হয়েছিল। সুতরাং ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসার বাতাবরণ তৈরিই ছিল এবং সেটা এতোটাই যে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে একজন হিন্দুই হত্যা হয়ে গেলেন। রাজ্যের বিজেপি সরকারের কাছে এই ধরণের ঘটনা অস্বস্তিকর, তারা তো হিন্দুদের স্বঘোষিত রক্ষাকারী, অভিভাবক! তাই মৃত্যুর নানা অজুহাত খাড়া করা হচ্ছে। যেমন বলা হচ্ছে ভানওয়ারলাল নাকি জলশূন্যতায় (ডিহাইড্রেশন) ভুগছিলেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ তিনি নাকি একবার ‘মহম্মদ’ কথাটা বলে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ মহম্মদ হলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়! মধ্যপ্রদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নরোত্তম মিশ্র হিন্দুত্বর সাম্প্রতিক পোস্টার বয়। একের পর এক বিতর্কিত বিবৃতির কারণে তিনি সব সময় সংবাদের শিরোনামে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন মৃতর পরিবার জানিয়েছে যে প্রৌঢ় অপ্রকৃতস্থ ছিলেন, যার জন্য বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ ‘বিভ্রান্তি’ হয়েছে যে তিনি মুসলিম ছিলেন যার জন্য তাঁকে মারধোর করা হয়েছে। এই কথায় ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল, বুঝিয়ে দেওয়া হল সংখ্যালঘু নিগৃহীত করলে তাতে অসঙ্গত কিছু নেই। মনে রাখতে হবে এই নরোত্তম মিশ্র গত অগস্ট মাসে এক মুসলিম চুড়ি বিক্রেতাকে পিটিয়ে খুন করাকে সঙ্গত মনে করেছিলেন এই কারণে যে তিনি নাকি নিজের নাম, ধর্ম গোপন রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি স্বনামধন্য চিত্র পরিচালক প্রকাশ ঝার ওয়েব সিরিজের নাম ‘আশ্রম’ দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন, বলেছিলেন এই নাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগকে আঘাত করে। অভিযোগ তাঁর প্ররোচনামূলক বিবৃতির কারণে বজরং দলের ক্যাডাররা পরিচালকের সেট ভাঙচুর করে, তাঁর মুখে কালি লেপন করে।
কাহিনীর সারাংশ হচ্ছে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রকল্প যত এগোচ্ছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তা ততো বিঘ্নিত হচ্ছে। মুসলিমরা সব সময়ই টপ টার্গেট, নানা ফন্দি করে তাঁদের টাইট দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত। বিভিন্ন রাজ্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছে কে কত এই সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করতে পারে। কেউ সরকারি মাদ্রাসা বন্ধ করে দিচ্ছে, কেউ প্রকাশ্যে নামাজ পড়া বা মসজিদের মাইক লাগানো নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে, কেউ কসাইখানা বন্ধ করে গোশালা খুলছে, কেউ ধর্মস্থান গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, ঐতিহাসিক সৌধর ‘সাচ্চা ভারতীয়’ নামকরণ করছে, কেউ বা আবার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার তোড়জোড় শুরু করেছে। জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরা এমনকি কুতুব মিনার ও তাজমহলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে যে কুনাট্য প্রতিনিয়ত রচিত হচ্ছে তা এক কথায় অভূতপূর্ব! বলাই বাহুল্য এতে রাষ্ট্রের পুরো প্রশ্রয় আছে। বারবার আওরেংজেবকে তথাকথিত ‘হিন্দু নিপীড়নকারী’ হিসাবে প্রতিপন্ন করে আওয়াজ দেওয়া হচ্ছে তিনশো বছর আগে তিনি যে পাপ করে গেছিলেন সেটার মূল্য আজ মুসলিম জনতাকে কড়ায় গণ্ডায় চোকাতে হবে।
এছাড়া আছেন ‘আর্বান নক্সাল’রা যাঁদের ইউএপিএ সহ বিভিন্ন কালা কানুনের ফাঁসে, কৃত্রিম অভিযোগ তৈরি করে বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ২০১৮র ৬ই জুন সোমা সেন, মহেশ রাউত, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, রোনা উইলসন, সুধীর ধাওয়ালেকে ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়। এঁরা সবাই বিশিষ্ট গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী। এরপর ধাপে ধাপে আরও এগারো জনকে গ্রেপ্তার করা হয় যার মধ্যে একজন প্রয়াত এবং দু’জন বহু টালবাহানার পর আপাতত জামিনে মুক্ত। এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর যেমন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও প্রধানমন্ত্রীকে খুনের প্রচেষ্টা। অথচ এতো গুরুতর অভিযোগের কোনও যথার্থ, বাস্তবসম্মত প্রমাণ নেই। তাই বিনা বিচারেই তাঁদের বছরের পর বছর বন্দি করে রাখা হয়েছে। এঁরা প্রত্যেকেই প্রবীণ, নানা ব্যাধিতে জর্জরিত, কিন্তু তাঁদের জামিনের আবেদন বারবার নাকচ হয়। অথচ যারা দিল্লির বুকে দাঁড়িয়ে গণহত্যা, গণ-ধর্ষণের হুমকি দেয় তাঁরা হেলায় জামিন পেয়ে যান। সাল্লি ডিলস, বুল্লি বাই অ্যাপের নির্মাতারা মানবিকতার কারণে (বিচারক বলেন দীর্ঘ কারাবাস তাঁদের জীবন নষ্ট করে দেবে!) জামিন পেয়ে বেমালুম ঘুরে বেড়ায়।
এই বৃত্তটা কিন্তু বাড়ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আর্বান নকশালদের বাইরে আরও অনেক অনেক মানুষ হিন্দু রাষ্ট্র বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। যেমন আমিষভোজী, যাঁরা নবরাত্রিতে মাছ মাংস খান, মাছ খেকো বাঙালি (এছাড়া যে কোনও বাঙালি মুসলমান সন্দেহভাজন এক ‘ধর্মগুরু’ নিদান দিয়েছেন), দলিত, আদিবাসী ও আরএসএস-বিজেপি বিরোধী, সবাই। সম্প্রতি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার রতন লালকে জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে ‘আপত্তিকর’ পোস্টের কারণে, যা নাকি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে, গ্রেপ্তার করা হয়। জিগ্নেশ মেওানিকে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে টুইট করার জন্য গুজরাট থেকে গ্রেপ্তার করে আসামে নিয়ে আসা হয়। স্মরণ করুন একই ভাবে দিশা রবিকে ব্যাঙ্গালোর থেকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কারণ তিনি কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে গ্রেটা থুনবার্গের সাথে কিছু তথ্য আদানপ্রদান করেছিলেন। অল্পবয়সী যুবতীটিকে ‘দেশদ্রোহী’, ‘আন্তর্জাতিক চর’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
ঠিক আছে এঁরা তো সবাই দিল্লির শাসক দলের বিরোধী, তাঁদের সমালোচক। কিন্তু দিল্লির সৌরভ শর্মা, যিনি নিউজ ১৮এর সাংবাদিক, যে চ্যানেলটি গোদি মিডিয়ার অন্তর্ভুক্ত বলে পরিচিত, তিনি আক্রান্ত হলেন কেন? নয়ডাতে তাঁর বাড়ির বাইরে রাত্রি বারোটার সময় তারস্বরে বাজনা চলছিলো। সৌরভ পুলিশে অভিযোগ করেন এবং নীচে নেমে এসে জনতাকে মিউজিক বন্ধ করতে বলেন। সৌরভ নিজের পরিচয় দেন, বলেন যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান তিনি সমর্থন করেন; কিন্তু ধর্মান্ধ জনতা কোনও যুক্তির ধার ধারে না। তাঁরা তাঁকে তাড়া করে, পাকিস্তানি বলে গালি দেয়, তাঁর স্ত্রী অঙ্কিতাকে নগ্ন করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। অঙ্কিতা বলেন তাঁরা তাঁর স্বামীকে মদ্যপ বলে যেখানে তারা নিজেরা পুলিশের সামনে মদ্যপান করছিলো। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হল যে অঙ্কিতা মিনতি করেন যে তিনিও নয় দিন উপবাস করেছেন, তাঁরাও হিন্দু, ব্রাহ্মণ। কিন্তু ভক্তির অর্থ তো এই নয় যে মধ্যরাতে তুমি নাচগান করবে; কে নবরাত্রি করবে বা করবে না সেটার সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে নেই, আমাদের জোর জবরদস্তি করা হচ্ছে। এই পরিবেশে আমি কী ভাবে আমার সন্তানকে মানুষ করব? তিনি অসহায় হয়ে জিজ্ঞাসা করেন। স্মরণ করুন এই একই প্রশ্ন তোলাতে অভিনেতা আমির খান ও তাঁর স্ত্রীকে ভয়ানক ভাবে ট্রোলড হয়েছিলেন এবং তাঁদেরকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছিল।
এই ঘটনা কোন দিকে ইঙ্গিত করে? যাঁরা ধর্মপ্রাণ হিন্দু, ব্রাহ্মণ, সমস্ত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করেন এবং হিন্দু রাষ্ট্রর প্রকল্পকেও সমর্থন করেন তাঁরাও আজ বেপরোয়া, হামলাবাজ ধর্মান্ধ গেরুয়া বাহীনির দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ আজ আর নিরাপদ নন। হিন্দুত্ব রাজনীতির সমর্থক হলেই যে তুমি ছাড় পেয়ে যাবে এমনটা হবে না। তোমাকে সঙ্ঘীদের সমস্ত আগ্রাসন, জোরজুলুম বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে হবে, তাতে তোমার পরিবারের সুখ শান্তি যদি বিঘ্নিত হবে তো হবে!