এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  স্বাস্থ্য

  • ব্যর্থ বোঝাপড়া

    শুভাশিস পাল
    আলোচনা | স্বাস্থ্য | ০৪ মার্চ ২০২২ | ২২০৬ বার পঠিত | রেটিং ৪.৬ (৮ জন)

  • যেটুকু জীবন বেঁচেছি আর যতদিন বাঁচবো, দেখতে পাচ্ছি জীবনের ছাঁচ বদলাচ্ছে রোজ। জীবন মাস্টার কখনো নিজেই হাত ধরে শেখাতে চায়, কখনো দূরে দাঁড়িয়ে চুপ করে মুচকি হাসে।
    অঙ্কোলজি, বিশেষ করে বাচ্চাদের অঙ্কোলজির চিকিৎসা শিখতে শুরু করেছি, ওদের সঙ্গে কাটানো প্রত্যেক ঘন্টা নতুন নতুন গল্প বলে গেছে। বড়দের চিকিৎসা আর বাচ্চাদের চিকিৎসা অনেকটা আলাদা এইখানে, যে বহু ক্ষেত্রেই বড়দের চিকিৎসা Life prolonging, মানে আর যদি কিছু মাস তাঁকে দেওয়া যায়, উদ্বৃত্ত কাজগুলো শেষ করে যেতে পারেন নিশ্চিন্তে, নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে। বাচ্চাদের আয়ু কয়েক মাস বাড়ানো শুধু চিকিৎসার ব্যর্থতা ছাড়া কিছু নয়।
    ২০১৯ এ আমার ছেলের জন্মের মাসখানেক পরেই একটি সিজারিয়ান অ্যাটেন্ড করেছিলাম। অত্যন্ত সপ্রতিভ মায়ের এক ছোট ফুটফুটে মেয়ে হয়। অল্পবয়সী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত স্বামী স্ত্রীর প্রথম সন্তান। নাম রাখা হয় নদী। সদ্যোজাতার আগমনী উৎসব শেষ হতে না হতেই নিজের ব্রেস্টে লাম্প খুঁজে পান মা। FNAC তারপর Biopsy তে malignancy আর তারপর COVID এর প্রথম ঢেউ। সময় বয়ে যায় বেশ খানিকটা। কর্কট অপেক্ষা করেনি। দেরীর কথা জেনে আতঙ্কিত আমার পরামর্শে বেশ কয়েক মাস পরে PET CT জানিয়ে দিল ক্যান্সার ছড়িয়েছে সারা শরীরে, লিভারে, ভার্টিব্রায়।

    ১ বছরের নদী আর ভালোমানুষ স্বামীর মুখ চেয়ে মা শক্ত করে রাখলেন নিজেকে। ক্লিনিকে যখন মেয়েকে নিয়ে আসতেন, মুখস্থ বলে যেতেন মেয়ের রোজনামচা, ওষুধের এতটুকু নড়চড় হতো না। পেইনকিলার বাড়ছিল দিনে দিনে। হরমোনাল থেরাপিতে মেটাস্ট্যাসিস বাড়ছিল। কমছিল আশা আর আয়ু। ছোট্ট হয়ে যাচ্ছিলেন দিনের পর দিন। খেতে পারছিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন একদিন, নদীর কি ব্রেস্ট ক্যানসারের সম্ভাবনা আছে? বললাম জিন টেস্টিং এর কথা, কিন্তু আপাততঃ আপনার খুব প্রয়োজন সুস্থ থাকার।
    উত্তর পেলাম, আমার পরিবার টা ভেসে যাচ্ছে। আমার বরটি নিজে থেকে কিচ্ছু খুঁজে পাননা। রুমাল, পার্স আমাকেই খুঁজে দিতে হতো। এখন সব নিজে করছে, রান্নাও। Dependent হয়ে পড়েছি তো! নিজেরই খারাপ লাগছে খুব।
    হায় রে, বাঙালি প্রেমিকা, একাধারে প্রেয়সী, বান্ধবী ও স্নেহময়ী।

    মাঝখানে দেখা হয়নি কয়েক মাস। মাসখানেক আগে আবার এসেছিল নদী। এবার এক মাঝবয়সী মহিলার কোলে চেপে। ২ বছর পেরিয়ে গেছে সদ্য। উচ্চতা কম। ওজন বেশ খানিকটা কম বয়সের তুলনায়। বাবার চোখগুলো দেখছে সব, অথচ কিছু পড়ছেনা। উদভ্রান্ত। ক্যানসার কেড়ে নিয়েছে নদীর মা'কে মাস দুয়েক আগে আগে। ব্যথা বেড়ে গেছিল অসম্ভব। কড়া ডোজের মরফিনে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন, চিনতে পারতেননা কাউকে। একটা সময় পরিবারের সবাই চাইতে শুরু করলেন, চলে যাক এই অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করার চেয়ে।
    নদীর দেখাশোনা করছেন দূর সম্পর্কের পিসি। তিনি ও হয়তো ফিরে যাবেন মাস দেড়েক পর। নিজের পরিবার ছেড়ে ক'দিন থাকা যায়! নদী ভুগছে psychosocial dwarfism এ। Emotional deprivation আরো specifically maternal deprivation এ বৃদ্ধি আটকে রয়েছে। জেদী, একবগ্গা, tantrum করা মেয়েটাকে আমি চিনতে পারলাম না।

    Solid tumor যখন চিকিৎসায় সাড়া দেয় না, ফিরে আসে আবার, আমি ভয় পাই, ভীষন ভয়। অজস্র ছোট ছোট মাংসপিন্ড গজিয়ে উঠতে শুরু করে শরীর জুড়ে। কোনোটা ঠিক পিত্তনালির মুখ টা আটকে দেয়, কোনো টা আটকে দেয় মূত্রথলি। কষ্ট বাড়তে থাকে দিন দিন। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে অর্ধ চেতন শরীর আর দিশেহারা স্বামীর ওপর বোঝা হবার আক্ষেপ। একটু একটু করে পিছলে যাওয়া মেয়ের স্মৃতি, তারপর শুধু নিশ্ছিদ্র নিকষ আঁধার। একটাই আকুতি শেষ পর্যন্ত: পরিবার টা যেন ভেসে না যায়!

    সঙ্গে সঙ্গে আমার আরেকটি অনুভূতি হলো, নিজের জীবনে আমি লোকটা protagonist, কিন্তু এই পরিবারের জীবনের চলচ্চিত্রে আমি জীবনের এক অন্ধকার চৌমাথায় দাঁড়িয়ে থাকা এক চরিত্র। এক মহাজাগতিক উইপোকার ঢিপির অজস্র ক্রসরোডের একটা অকিঞ্চিৎকর মোড়ে এই পরিবারের সঙ্গে আমার দেখা। ছোট্ট কোণায় আমার জীবন বেঁচেছি, এদের জীবনও তেমনই আরেক কোণায় চলছে‌। এদের জীবনের ট্র্যাজেডি এরা সবটা দিয়ে অনুভব করছে, আমি তার খানিকটা পারছি।

    জন কোনিগ নামে এক ভদ্রলোক কিছু নতুন শব্দ আনলেন, The Dictionary of Obscure Sorrows নামে এক অনলাইন শব্দসংগ্রহ, তথাকথিত ডিকশনারিতে জায়গা হয়নি এখনো শব্দগুলোর। তাতে রয়েছে 'sonder' নামের একটি শব্দ‌। এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে the realization that each random passerby is living a life as vivid and complex as your own—populated with their own ambitions, friends, routines, worries and inherited craziness.
    এই গিজগিজ করা শহরটাকে মাটির কাছাকাছি নেমে যখন দেখি, কোটি কোটি গল্প হেঁটে যায় সামনে দিয়ে। আমার কাছে অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু নিজের গল্পে আমি হয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জন্য সেই গল্প গুলো ঘোর বাস্তব। যে সমস্যাগুলো আমার কাছে দু'ছত্র খসখসানো প্রেসক্রিপশন, দুঃস্বপ্নের মতো সেই দুঃখগুলো টেবিলের অপর প্রান্তের জীবনে আতসকাচ দিয়ে দেখার মতো ম্যাগনিফায়েড‌।

    Sonder আমাকে জানিয়ে দিলো, life prolongation একটা মিথ্যে প্রবোধ ছাড়া কিছু নয়। টেবিলের এপার থেকে স্বজন হারানোর পর থেকে যাওয়া শূন্যতা বিচার শুধু empathy দিয়ে অসম্ভব। জীবন শুধু উইল বানানোয় সম্পূর্ণ হয়না। আসন্ন বিচ্ছেদের সাবধান বাণী শোনাই বইয়ে পড়া life expectancy বিচার করে, আমার বোধগম্য হয়না যে উদ্বৃত্ত কাজগুলো কখনো শেষ হয়না। নিঃশর্ত মুক্তি কেউ চায়নি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতিতে একদিন আমাদের end of life counseling এর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। ততদিন মনে রাখব, আশা শেষদিন পর্যন্ত শেষ হয়না। মনে রাখব জীবন প্রলম্বিত করার জন্য যথেষ্ট সময় বলে কিছু নেই। Life prolongation আমাদের জন্য আসলে একটা ব্যর্থ বোঝাপড়া।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৪ মার্চ ২০২২ | ২২০৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ০৫ মার্চ ২০২২ ১৭:২৮504714
  • নমস্কার!!
  • b | 117.194.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২২ ১৭:৩৫504715
  • এই লাইনগুলি মনে প্ড়ে গেলো । 
    ভালো থাকবেন ​​​​​​​। ​​​​​​​
     
  • Sandipan Majumder | ০৭ মার্চ ২০২২ ০১:০৩504752
  • ,মন খারাপ করে দেওয়া  অথচ  সত্যনিষ্ঠ  লেখা।
  • বিদেশ মণ্ডল | 2401:4900:3823:4c8f:1:2:70c0:***:*** | ০৭ মার্চ ২০২২ ২২:২৮504757
  • মৃত‍্যুই নিত্য, আর যা কিছু সব অনিত্য।
  • Sobuj Chatterjee | ১৫ মার্চ ২০২২ ০৭:৫৫504888
  • এক অসাধারণ বোধের কথা পড়লাম।কতটা বোধগম্য হলো তাই কি জানি ছাই! 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন