সুধীর কক্কর রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নন। তবু, তাঁর Young Tagore : The Making of a Genius এ তিনি একটা অসাধারণ কথা বলেছেন। বলেছেন যে, জীবনের একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তিনি ঠিক উপলব্ধি করে উঠতে পারেননি একত্র হলেই তাঁর বাঙালি বন্ধুরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গান কেন আর কেনই বা তাঁদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে সেই ভাব যা তিনি দেখেছেন ভজনের আসরে ভক্তদের মধ্যে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের রসগ্রহণের অক্ষমতা সত্ত্বেও তাঁর প্রশিক্ষিত মনোবিজ্ঞানীর মন এটা বুঝতে পেরেছে যে শিক্ষিত বাঙালিদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত কেবল এক ধরনের গান নয়। এ এক প্রকার যাপনচর্যা। এর সঙ্গে জুড়ে আছে বহু সচেতন ও অচেতন অনুষঙ্গ। বড়ো হয়ে ওঠা, প্রেমে পড়া, জীবন -যাতনার সম্মুখীন হওয়া : এক কথায় এক বিশেষ শ্রেণীর বাঙালির ব্যক্তি অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রবীন্দ্রসঙ্গীত। তারপর তিনি এক চমকে দেওয়া কথা বলেছেন :" I believe that the identity giving power of Rabindrasangeet, butteressing a social, Bengali identity that can counteract personal disquiets, even if temporarily, does not have a counterpart in any of India's other linguistic groups "।
কী সত্যি কথা। কী সাংঘাতিক সত্যি কথা! যদি অন্য সব ভুলে চয়ন নামের এই বাঙালিটির ব্যক্তি ও সমাজজীবনের দিকে চাই তবে এই উক্তির যাথার্থ্য নিয়ে কোন সংশয় থাকে না। কাউকে যদি প্রশ্ন করা যায় যে তার জীবনে প্রথম সজ্ঞানে শোনা রবীন্দ্রসঙ্গীতটির নাম কী, তবে অবধারিত উত্তর আসবে :ঠিক মনে নেই। আমার কিন্তু মনে আছে। ইসলামপুর। বাবাদের ক্লাব। আলোজ্বলা স্টেজ। জিতেনের কোলে আমি। স্টেজে বসা এক ভদ্রলোক গাইছেন, "কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া"। আমার সারা শরীর জুড়ে এক অব্যাখ্যাত শিহরণ। বোঝাতে পারব না। সম্ভব নয়। কারণ, মার সঙ্গে বসে অঙ্ক কষে বুঝেছি আমার বয়স তখন দু বছর সাত মাস। এরপর যা মনে পড়ে বাড়িতে রেকর্ডে বাজছে বাল্মিকীপ্রতিভা : "তবে আয় সবে আয়.. তবে ঢাল সুরা, ঢাল সুরা, ঢাল, ঢাল, ঢাল "। আমার শরীরে, কোষে কোষে উত্তেজনা। দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় "আমার সোনার হরিণ চাই " এর তালে তালে আমার উদ্দাম নৃত্য। বয়স তিনের বেশি হতে পারে না। এর ঠিক দু বছর পর কৃষ্ণনগরের জজ কোর্টের মাঠে এক বসন্ত সন্ধ্যায় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে কচি গলায় "বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা" গাওয়ার কথাও স্পষ্ট মনে পড়ে। মনে পড়ে ওই একই সময়ে বাবার গলায় "আমার যে দিন ভেসে গেছে " শুনে ফুঁপিয়ে কান্নার কথা, রেডিওতে সুচিত্রা মিত্রের গলায়, "যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে " শুনে বিষণ্ণ হওয়ার কথা, আরেকবার বছর তের বয়সে এক মঙ্গলবার দুপুরে রেডিওতে মায়ার খেলার "আমার পরাণ যাহা চায় তুমি তাই গো " শুনে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি।
আমি কী বলতে চাই স্পষ্ট হল কি? এই গানগুলো আমার ব্যক্তি জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ। কোনওভাবে এদের বিশুদ্ধ নান্দনিক মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু, প্রশ্ন হলো কিসের জন্য এদের জীবনের অংশ হওয়া? কিসের প্রভাব পড়েছিল চয়নের শিশু বা কিশোর মনে? উত্তরটা খুব সোজা। সুরের। যে কটা গান আমি উল্লেখ করলাম তার বাণীর বিশ্লেষণ ঐ বয়সে আমার পক্ষে করা সম্ভবই নয়। কিন্তু, লক্ষ্যণীয়, আমার মনে সেই সব গানেরই স্মৃতি আছে যে গুলোর সুর পাশ্চাত্য সুর ভাঙা, দুলিয়ে দেওয়া, নয়তো হাম্বিরের দ্রুতিকে বাউলাঙ্গে বাঁধা, অথবা কালাংড়া ভৈরবীর করুণ আর্তি। আমার বক্তব্য খুব স্পষ্ট। রবীন্দ্রসঙ্গীত মূলতঃ সঙ্গীত। আর যে অনুষঙ্গ আমার বা আমাদের ভাবজগৎ গড়ে তোলে তা সাঙ্গীতিক অনুষঙ্গ। বাণীশৈল্পিক নয়। অর্থাৎ, শিক্ষিত বাঙালির চিন্তন বিশ্বের বয়ান সাঙ্গীতিক। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, আমাদের জাতের ধারাটাই এই। ধানকাটার গান, ছাদ পেটার গান, টুসুর গান, ভাটিয়ালি, গাজন, গম্ভীরা, ঝুমুর, আলকাপ, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া : গানে গড়া আমাদের ভূবন। গান আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ অনেকদিন ধরেই। সেই গীতিময় জীবনযাপনেরই এক অংশ রবীন্দ্রসঙ্গীত।
কিন্তু, এখানেই এক দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত আর সব গানের চেয়ে একটু আলাদা। কারণ, প্রথমতঃ, এর উৎসমুখ সন্ধান করতে হয় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে। দ্বিতীয়তঃ, রবীন্দ্রনাথের অলৌকিক শব্দ বিভূতি। এই বাকসিদ্ধির জন্যই তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কাঠামো বজায় রাখলেও রাগের দাসত্ব করেননি কখনো। অবলীলায় কথা বসিয়েছেন কীর্তন বা পল্লীগীতির সুরে। আর গোলটাও বেধেছে ঠিক এইখানে। গড়ে উঠেছে তাঁর বাণীকে কেন্দ্র করে এক প্রাতিষ্ঠানিকতা যা প্রমাণ করে ছেড়েছে যে রবীন্দ্রসঙ্গীত মুখ্যতঃ বাণীপ্রধান। আরেকবার স্পষ্ট করে বলি তা হয় না। হতে পারে না। গান কবিতা নয়। যখন কবি মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেন, "রবি ঠাকুর গান মন্দ লেখে না"; তখন তিনি বোঝাতে চান কথা ও সুরে গড়া এক অখণ্ড শিল্পরূপকে। সেখানে বাণী সঙ্গীতের দোসর। প্রভু নয়।
গান চলে তার নিজের নিয়মে এটা আমি বুঝেছি বহু পরে। তার আগে ঐ প্রাতিষ্ঠানিক বয়ানের ফাঁদে পড়ে পরাণ বগা বিস্তর কেঁদেছে। "আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে "শুনে বলেছি, "আহা! কী ভাব! কী কথা! কী দার্শনিকতা। "একবারও ভাবিনি পিলুর কান্না কি ভাবে প্রাণময়ী করেছে বাণীকে। আরেকটু স্পষ্ট করি, "অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো" শুনে তার মধ্যে নিহিত ঔপনিষদিক চেতনা নিয়ে সরব হয়েছি। একবারের জন্যও ভাবিনি বৃন্দাবনী সারং কেমন করে পুরো কথাগুলোকে পালটে দেয়। "বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি/ সেই তো স্বর্গভূমি "। প্রথম ভূ ঊ ঊ মি ই চড়ায় :তীব্র রেখাব আর তীব্র পঞ্চম। দ্বিতীয় ভূ ঊ মি খাদে। তীব্র রেখাব ও নিষাদ ছুঁয়ে সপ্তকে স্থিত। অক্লেশে কথার সঙ্গে আরো এক মাত্রা যোগ করে সুর প্রকাশ করল ধূলিময় ভূমির স্বর্গের চেয়েও মহীয়ান হওয়া। "আলোর অমল কমল খানি" -পড়ে গেলে একরকম। কিন্তু, রামকেলিতে আ আ আ আ আ আলোর টানের মধ্যে শুদ্ধ মধ্যম ও পঞ্চম, শুদ্ধ গান্ধার, কোমল ধৈবত এবং নিষাদের অপূর্ব সমন্বয় ভোরের আলোর পদ্ম হয়ে ফোটাকে নয়ন গোচর করে। আমি জানি, অনেকেরই মনে পড়বে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বহু তির্যক মন্তব্যের কথা। কিন্তু, একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় আপত্তিটা তাঁর মুখ্যতঃ ছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যাকরণের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে। কিন্তু , তাঁর শিল্পী সত্তা রাগের ভাব ও নান্দনিকতাকে বারবার সম্মান জানিয়েছে। ভাবের টানে ব্যাকরণ না মানলেও চলে এই তাঁর বক্তব্য। তাতে ক্ষতি তো হয়নি বিশেষ। শ্রী অভ্র বসু তাঁর 'রাগরাগিণীর ভাব ও রবীন্দ্রনাথের গান ' প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে বেহাগে আধারিত 'আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে 'গানটির 'আমার এ ঘর বহু যতন করে ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে 'র 'হবে মোরে ' এর রেগারেমামাগা চলন বিশুদ্ধ গৌড় সারং এর যাকে অনেকে বলেন দিন কা বেহাগ। গানের অন্তর্নিহিত নান্দনিক সৌন্দর্যের দাবীতে দিবা নিশির মিলনে জন্ম নিল এক রাগভাব যা একান্তভাবে স্রষ্টার নিজস্ব।
উনিশ বছর বয়স থেকে আমার যাপন -চিন্তনের অংশ হয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। তখন থেকে শুরু করে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে বহুদিনের চেনা রবি ঠাকুরের গান আমায় নিয়ত নতুন করে অবাক করে চলেছে। আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখছি রাগরাগিণীর ভাব রূপের পরিসরকে বাণীর শ্রুতিনান্দনিকতার মাধ্যমে কতটা বিস্তৃত করা যায়। গানের পরে গান নতুন রূপে সেজে জীবনযাপনকে সুষমামণ্ডিত করে। বাবা একটা গান গাইতেন। যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, তবে থেকেই গানটা শুনলে খুব কান্না পেত। ছোটোবেলায় বাইরে কাঁদতাম। বড়ো হয়ে ভেতরে। বাবার খোলা গলার সুরে একটা তীব্র যন্ত্রণা। আমায় ঘিরে পাক খেত সেটা। ভাবতাম, কেন গো? এত কষ্ট কিসের? আজ মনে হয়, বুঝি। বুঝছি। মাঝবয়সে বয়ঃসন্ধিকালীন ভুলের মাশুল দিচ্ছি। শরীর-স্বাস্থ্য ভাঙছে আস্তে আস্তে। অক্ষমতার লজ্জা, মেকি সম্পর্কের হঠাৎ প্রকট হওয়া নখ-দাঁত, যা সব চেয়ে বেশি করতে ভালোবাসি তার অবমূল্যায়ন - সব, সমস্ত কিছু, আমার গলায় বাবার গাওয়া রবি ঠাকুরের গানটা এনে দিচ্ছে । ১৯৩৭-এ গানটা লেখেন রবীন্দ্রনাথ, স্বরলিপি বানান শৈলজারঞ্জন মজুমদার। গীতবিতানে প্রকৃতি পর্যায়ের গান। বর্ষার। ৫৩ নম্বর স্বরবিতানে পাওয়া যাবে। গানটা নীচে রইল।
আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে
তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে॥
সে দিন যে রাগিণী গেছে থেমে,
অতল বিরহে নেমে গেছে থেমে,
আজি পুবের হাওয়ায় হাওয়ায়
হায় হায় হায় রে কাঁপন ভেসে চলে॥
নিবিড় সুখে মধুর দুখে জড়িত ছিল সেই দিন--
দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বীন।
তার ছিঁড়ে গেছে কবে একদিন কোন্ হাহারবে,
সুর হারায়ে গেল পলে পলে॥
সারাদিন চোখের জলে ভেসেছে। অন্তঃপ্রকৃতির ছায়া বহিঃপ্রকৃতির মধ্যে। অতীতের কোনও এক অসমাপ্ত রাগিণী অতল বিরহে লীন ছিল। ভুলে ছিলাম তাকে। আজ পুবের বাতাস বয়ে আনছে সেই বেদনার স্মৃতি। চণ্ডীদাসের কথা মনে আসে। সুখ- দুখ দুটি ভাই। সুখে -দুখে জড়ানো জীবনবীণা সুরে বাজত কোনও একদিন। আজ, তার ছিঁড়েছে, সুর হারিয়েছে। হাহাকার করছে সত্তা। রোম্যান্টিক অ্যাগনি? বিশ্বাশ্রু বা লেক্রিমো রেরুমের মুখ খুলে যাওয়া? মৃত্যু চেতনা? জানি না। জানতে চাই না। প্রথম লাইনটা সুরে বললেই আমার বুক মুচড়ে উঠছে। আ|মার্|| যে এ | দিইইন্। মা গা { মাঃ -গঃ মা ণা}। গানে লাগছে কোমল নি, শুদ্ধ মা, আর গা। পরে দেখছি আবার কোমল রে, কোমল গা, কোমল ধা, কোমল নি। আবার, শুদ্ধ নি। কখনও আবার শুদ্ধ রে! কী রাগ রূপে গাইব একে? সুধীর চন্দ বলছেন ভৈরবী কালাংড়া। আমি বলছি ঠাকুরি ভৈরবী গীতি। এই গান বিশুদ্ধতম সঙ্গীতের অন্যতম। বুঝিয়ে বলি। রবি ঠাকুর সারাজীবন গানের সুর দেওয়ার সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কাঠামো মেনেছেন। তবে, সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করেছেন রাগরাগিণীকে নান্দনিক পরিসরে কতটা ছাড় দেওয়া যায়। কোনও বাঁধনই যেন তার পায়ে না থাকে। তার জন্য দু'একটা স্বর এদিক ওদিক হলে কিচ্ছুটি যায় আসে না। রাগের সত্তা, তার আত্মিক ঐশ্বর্য অক্ষুণ্ণ থাকলেই হলো। রবি ঠাকুর ভৈরবীর ভক্ত ছিলেন। তাই এ'গানের কান্নাতেও আমি ভৈরবীর মূর্তি দেখছি। তাঁর নিজস্ব ভৈরবী। আরোহ, অবরোহ, পকড় ভুলে যান। একবার ভৈরবীর ধ্যানমন্ত্র স্মরণ করুন।
স্ফটিকরচিতপীঠে রম্যকৈলাসশৃঙ্গে বিকচকমলপত্রৈরর্চয়ন্তী মহেশম্।
করতলধৃতবীণা পীতবর্ণায়তাক্ষী সকভিরিয়মুক্তা ভৈরবী ভৈরবস্ত্রী।।
স্ফটিকনির্মিত কৈলাসশিখরে এক দেবমন্দিরে প্রস্ফুটিত পদ্মের অর্ঘ্য দিয়ে ব্রহ্মচারিণী ভৈরবী শিবের অর্চনা করছেন। শিবধ্যানে আত্মহারা। হাতে বীণা। সংগীত মূর্ছনার জাগ্রত প্রতীক। তিনি পীতবর্ণা, তাঁর নয়ন আয়ত। এই ভৈরবীর দেবময় রূপ। স্বরময় রূপকে ছাড়িয়ে উঠে এই রূপকেই চৈতন্যরূপে দীপ্ত করার সাধনা গায়কের, বাদকের, সুরস্রষ্টার। আর, যদি সে সুরস্রষ্টা হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি বোঝেন Our sweetest songs are those that tell of saddest thought। ভৈরবীর সঙ্গীতকে তিনি এক করে দেন প্রাণ মোচড়ানো যন্ত্রণার সঙ্গে। দুঃখের বর্ষায় ঝরা চক্ষের জলে ভেজা পথেই বক্ষের দরজায় বন্ধুর রথ এসে থামে। সে বন্ধু মৃত্যু রূপেও আসতে পারেন, যাতনা রূপেও। ফর্ম আর কনটেন্ট-এর সার্থকতম মেলবন্ধন ঘটে একমাত্র সঙ্গীতে। গান নয়। সঙ্গীত। মিউজিক। যে কোনও বড়ো স্রষ্টা এই মিউজিক্যালিটির কথা জানেন। মালার্মে কাব্যে খুঁজতেন নোটেশনের শুদ্ধতা, পেটার বলতেন স্থাপত্যের শেষ সঙ্গীতে। সেই সঙ্গীত, কথা সেখানে সহায়তা করতেও পারে, নাও পারে। রবীন্দ্রসঙ্গীত সেই বিরল সাঙ্গীতিক প্রকাশের একটি।
দয়া করে মনে রাখুন, রবি ঠাকুর সুর ধরতেন আগে, তারপর তাঁর অলৌকিক বাণীর প্রয়োজনে সে সুরকে ব্যবহার করতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত কথাপ্রধান সুর দেওয়া কবিতা নয়। কথা ও সুরের যুগল মিলনে উদ্ভূত বিশুদ্ধ সঙ্গীত। এখানে সর্বোত্তম বাণীশৈল্পিক রূপকে বুঝলে অমৃতাস্বাদন সম্ভব; না বুঝলেও খুব অসুবিধে হয় না। সঙ্গীত বুঝিয়ে দেয়। প্রমাণ চান? আমি এই গান শোনানোর পর চোখ মুছতে দেখেছি কিরঘিজস্তানের আলতেনুইকে, আফগানিস্তানের ফিরোজকে, স্পেনের ড্যানিয়েল আলভারেজকে, আমেরিকার আর্ল জ্যাকসনকে। এঁদের কেউই একবর্ণ বাংলা বোঝেন না। গানাৎ পরতরং ন হি।
আপনারা বুঝছেন আমি কী করতে চাইছি। আমার জীবনে রবি ঠাকুরের গানের রূপকে আপনাদের সামনে ধরে দিতে চাইছি। যা পড়ছেন, তা কোনও অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ নয়। এক ব্যক্তি মানুষ আর তার আপন রবিগানের সংলাপ। আমার প্রিয়তম রবিগানগুলোর মধ্যে, একমাত্র একটা গান শুনে, অনেক দিন পর্যন্ত আমার মনে হয়েছে, ঠাকুরের মাথা, এই গান লেখার সময়, একটু ইয়ে মতো ছিল! গানটায় আসার আগে একটা কথা বলি। এটা সেই গানগুলোর একটা যার কথা বা সুর কোনওটাই আলাদা ভাবে দাঁড়াতে পারবে না, অপরের সাহায্য ছাড়া। অর্থাৎ, খাঁটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। এবার গানটা দেখি।
এই তো তোমার আলোক-ধেনু সূর্যতারা দলে দলে;
কোথায় বসে বাজাও বেণু, চরাও মহা-গগনতলে।
তৃণের সারি তুলছে মাথা, তরুর শাখে শ্যামল পাতা,
আলোয়-চরা ধেনু এরা ভিড় করেছে ফুলে ফলে।
সকালবেলা দূরে দূরে উড়িয়ে ধূলি কোথায় ছোটে।
আঁধার হলে সাঁজের সুরে ফিরিয়ে আন আপন গোঠে।
আশা তৃষা আমার যত ঘুরে বেড়ায় কোথায় কত,
মোর জীবনের রাখাল ওগো ডাক দেবে কি সন্ধ্যা হলে?
আলোর গোরু চরছে তারায় তারায়? আকাশে? ফুলে ফলে ভিড়ও করেছে তারা? সকালবেলা গোরুগুলো দৌড় মারলো, সাঁজের বেলা ঘরে ফিরলো। এক রাখাল বাঁশি বাজাচ্ছেন, যিনি কিনা, সন্ধেবেলা মানুষকেও ডাকেন! এটা কীরকম গান ভাই? ভ্যাবাচাকা ভাবটা যতদিন ছিল, গানটা গাইতে চেষ্টা করিনি। তারপর, বছর পাঁচেক আগে, হঠাৎ চোখে পড়লো এক ঋকমন্ত্র - ইমং চ নো গবেষণং সাতয়ে সীষধো গণম্। আলোক জিনিতে নিয়ে চলো দলবলকে। গো মানে আলো। গবেষণা মানে আলো খোঁজা। গাবঃ মানে গোরুর দল এবং আলোক। আলোকধেনু। আলোর আলো। পরম আলো। বাইরের আলো পড়ে ঝলমলানো চিত্ত থেকে যে আলো ঠিকরে আসে, যে আলো পরম চেতনালোকের খোঁজ দেয়, সেই আলোতে উজলপারা নক্ষত্ররা। সেই আলোতে প্রাণময় তরু-তৃণ-ফুল-ফল। লাইট অফ পিওর কনশাসনেস! তবু, আলো নেভে। যতই দিনমানে দাপিয়ে ফিরুক আলোকধেনুর দল, সাঁঝের বেলা গোঠে ফিরতে হয়, অন্ধকারে মিশতে হয়। এই অন্ধকারকে মৃত্যুও বলতে পারি, আত্মবোধনের ডার্কনেসও বলতে পারি। এই আঁধারে মেশার ইচ্ছে নিয়ে, আমির আড়ালে যে মহা আমি বসা, সব আমির অংশ যে, সেই রাখালকে বাঁশি বাজাতে বলছে এই গান। কেমন ভাবে বলছে? শুদ্ধ সা, মা, গা, পা - এই কটা সুর আলোকধেনুতে প্রাণ দেয়। সুর ধরুন। দেখুন, আলোটা রোমকূপে রোমকূপে ছড়িয়ে যাচ্ছে। চড়ার পগা, গা রে সা, আর নি, ধা, পা, মা - এই কটা পর্দা ফুটিয়ে তুলছে নক্ষত্রখচিত মহাবিশ্ব। ছোট্ট করে কড়ি মা লাগছে গগন কথাটায়। বিস্তার, কালো রঙ, নীহারিকা সব দেখা যাবে বিশ্বাস করুন! গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা? অন্তরা সা, পা, ধা, মা, নি, রে, সা - র ওপর ভর করে ঘাস-ফুল-ফল-পাতা -র ওপর আসা আলোকে দেখিয়ে দেয়। এরপর সঞ্চারী। শুদ্ধ সা, মা, ধা, নি - র খেলা। দুটো জায়গায় কড়ি মধ্যম। কোথায় ছোটে -র কো আর, আন আপন গোঠে-র প্রথম আ। এতে করে কোথায় সম্বন্ধে একটা সম্ভ্রম, এবং আনার ব্যাপারটায় একটা গাম্ভীর্য এসে গেল। কসমিক স্ফীয়ারে বাজা মিউজিককে নিজের জীবনে ডাকতে চাইলে এই awe না আসাটাই অস্বাভাবিক। পা নি ধা, দুই সপ্তকের সা, আর মা ডমিনেট করা আভোগে কড়ি মা লাগে রাখাল কথাটায়। এক ঝটকায় গাছের তলায় বসে বাঁশি বাজানো রাখাল তারায় তারায় বাঁশি বাজাতে উঠে যান। আমার মনে হয়, রাখালটির ছবি আমরা দেখেছি। সুকুমার রায়ের শেষ কবিতার সঙ্গের ছবিটা মনে পড়ছে? মেঘমুলুকে বসে বাজানো বাঁশুরিয়ার বাঁশি? ১৯১৪ সালে লেখা এই গান, ১৯২৩ এ মারা যাওয়ার আগে সুকুমার শোনেননি, এমনটা হওয়া অসম্ভব ছিল! এই কড়ি মধ্যমগুলো শুদ্ধই এই গান কেদার রাগে বদ্ধ। কেদার গাইতে গেলে কড়ি মধ্যম লাগে কি? ওস্তাদরা বলবেন। এটুকু জানি, রবীন্দ্রনাথ জীবনে রাগরাগিণীর বাইরের রূপের তোয়াক্কা করেননি। বরাবর তিনি রাগের অন্তঃরূপের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছেন।
গানটা করুন বা শুনুন। তারপর বলুন মুডটা কী? একটা বিধুর বৈরাগ্যের না? এখানেই রবি ঠাকুর, রবি ঠাকুর। কেদারকে রাগ বললেও তার আদত নাম কেদারী। দীপকের রাগিণী সে। দীপকে দাউ দাউ আগুন। কেদারীতে মৃদু আলো।
জটাং দধানা সিতচন্দ্রমৌলিঃ নাগোত্তরীয়া ধৃতাযোগপট্টা
গঙ্গাধরধ্যাননিমগ্নচিত্তা কেদারিকা দীপকরাগিণীয়াম্।।
যুবতীর এলোকেশে সাপের ভূষণ, মাথার পাশে জাহ্নবীধারা, কপালে চন্দ্রকলা, পরনে গেরুয়া কাপড়। দিবারাত্রি শিবধ্যানে মগ্না। এবার বলুন, এই অদ্ভুত কড়িমধ্যমবিষণ্ণ আলোটাই সারা গানের মধ্যে ছড়ানো নয় কি? এই গেরুয়া আলো? এই আলোই সূর্য-তারার আলোর সঙ্গে মিশলে গো হয়ে ওঠে। আলোক ধেনু।
বুঝতেই পারছেন,গান থেকে গানে গড়ানো আমার জীবন। যাপনের এক এক দিনে রবি ঠাকুরের এক একটা গান গুনগুনিয়ে প্রাণে বাজতে থাকে। বাজতেই থাকে। দিনমান ভরে রাখে অগুরুসুবাসে। যেমন ধরুন, আমাদের সবার চেনা এই গানটার কথা। ১৩১০ সনে বা ১৯০৩ সালে 'গান' বইতে প্রথম বেরোয়। এখন, 'গীতবিতান'-এ পূজা পর্যায়ে এবং ২৭ নম্বর স্বরবিতানে পাওয়া যাবে তাকে। গানটা নীচে পুরো তুলে দিলাম।
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ--
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে ॥
১৯০২ সালের ১৭ই নভেম্বর, রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মারা যান। তার পর পরই গানটি লেখা। কথা গুলো যদি পড়ে যাই, মনে হবে দুঃখকে প্রাণপণ শক্তিতে কাটিয়ে ওঠার গান এটা। প্রবল বিক্রমে অনন্ত প্রাণপ্রবাহকে নিজের ভেতরে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে এতে। ঔপনিষদিক পূর্ণতার বন্দনাগীতিও ভাবতে পারা যায়। সেই পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে। পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলে পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে। পড়লে তাইই মনে হবে। কিন্তু, শুনলে বা গাইলে? এই গানে দু'টো রাগ মিশেছে। যোগিয়া আর ললিত। দু'টোরই সময়কাল রাতের অন্তিম প্রহর। যোগিয়া ভৈরব ঠাটের। ললিত মারোয়া ঠাটের। মারোয়া বেলাশেষের রাগ। যোগিয়া, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভাষায়, ভারী মহাল সৃষ্টি করে। এই রাগে ১৮৮৪তে রবি ঠাকুর আরএকটা গান রচেন। 'চলিয়াছি গৃহপানে খেলাধুলার অবসান।' নিঃসীম ক্লান্তির গান। আছে দুঃখ- র অস্থায়ী আর অন্তরা, আমি যতবার শুনি বা গাই, আমার একটা বিচিত্র অনুভূতি হয়। প্রথমে, একটা প্রেমিস, তারপর 'তবু' বলে উত্তরপক্ষের জবাব। কিন্তু, সুরের চলনে মনে হয়, বারবার পূর্বপক্ষ জিতছে। 'তবু' বলে যা গাইছি, কিছুতেই সেটার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারছিনে যেন। এক প্রগাঢ় শ্রান্তি ইনট্রিউড্ করছে। 'তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা'কে : শুদ্ধ পঞ্চম, কড়ি মধ্যম, কোমল ঋষভ, কোমল ধৈবত এমনভাবে অধিকার করে রেখেছে যে গাইলেই গলায় একটা কান্নার সুর আসতে বাধ্য! এরপর সঞ্চারী। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সবচেয়ে জোরের জায়গা। বারান্তরে এই নিয়ে বলার ইচ্ছে রইল। এখান থেকেই এই গানটা পুরো ঘুরে দাঁড়ায়। তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে, কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে। পড়লে মনে হবে ক্ষয়ের কথা। কিন্তু, এখানেই ললিত মেশে।
প্রফুল্ল সপ্তচ্ছদমাল্যধারী যুবা চ গৌরোল্লসলোচনশ্রীঃ।
বিনিশ্বসম্ দৈববশাৎ প্রভাতে বিলাসবেশা ললিতা প্রদিষ্টা।
রাতের শেষ প্রহরের অবসাদ দূর করে ভোরের প্রথম আলো যখন পৃথিবীর বুকে নতুনচেতনার উদ্বোধন করে এবং সাময়িক মৃত্যুরূপ অন্ধকার থেকে জীবজগৎ প্রাণের আলোয় ফেরে ঠিক তখন প্রভাত-সূর্যকে অভিনন্দন জানানোর জন্য ললিত আলাপ করা হয়। শান্ত-করুণ ললিত অবসাদ আর ক্লান্তি দূর করে মনের স্বচ্ছতা আনে। শ্রান্তি কাটিয়ে আশার তেজোদীপ্তি আনে। এইখান থেকে আভোগ পর্যন্ত গেয়ে দেখুন। দারুণ ওজসে ফেটে পড়বে আপনার কন্ঠ। তবে, একটা কথা। সুরকর্তার নাম রবি ঠাকুর। তাই ললিত পঞ্চম বর্জিত নয়। কোনও কালে রাগোঁকা গুলামি করেননি ভদ্রলোক! দীনু ঠাকুর বলেছিলেন ঠাকুরি ললিতের কথা। এ হলো সেই চীজ্। কিন্তু কী অব্যর্থ প্রয়োগ! কড়ি আর শুদ্ধ মা-এর ওপর দাঁড়িয়ে 'ফুটেএএএএ' পর্যন্ত গলা নামিয়ে গেয়ে গলা ছাড়ুন। আবার যোগিয়া। কিন্তু, 'নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্য লেশ'! শুদ্ধ পঞ্চম, তার সপ্তকের ষড়জ, কোমল ঋষভ, কোমল নিষাদ - এর সোল্লাস বিস্তার আপনাকে পূর্ণতার সামনে আনবেই আনবে। বিষাদ কেটে গেছে। ক্লান্তি, জড়িমা আর নেই। প্রথম দিকে একটা অনিশ্চয়তা ছিল। সেটা পুরো দূর হয়ে এখন প্রবল আত্মবিশ্বাস। পাবই পূর্ণতার সন্ধান। নিশ্চয়ই পাব। চার তুকে বাঁধা 'আছে দুঃখ'- র দ্বন্দ্ব আর উত্তরণ গানটা পড়ে গেলে বোঝা যাবে না। এত তীব্র ভাবে, সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করা যাবে না। সুরে না ফেললে যে কোনও গান অধুরা। রবি ঠাকুরের গানও।
গান, শুধু গান। শুধু গান। - একা লাগলে গান সবচেয়ে ভালো ক্যাথারসিস। "জান কি একেলা কারে বলে? - জানি। যবে বসে আছি ভরা মনে - দিতে চাই নিতে কেহ নাই! - ...তাই বটে! তাই বটে! মনে হয় এ জীবন বড়ো বেশি আছে - যত বড়ো তত শূন্য, তত আবশ্যকহীন।" কথা, কথা! বড়ো কথার কোলাহল চারদিকে। আগে পিছে, ওপরে নীচে। মন ক্লান্ত কথা বলে, কথা শুনে। অথচ, যা বলতে চাই, শোনার কেউ নেই। কী বলতে চাই? তাই তো! সেটাকে তো ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না! বাইরের দিকে চাইলাম। বিকেল শেষ হয়ে আসছে। মনের মধ্যে হঠাৎই স্বপ্রকাশ হলো গান। আমার আপন গান। ১৯০৯ সালে লেখা রবি ঠাকুরের গান। গানটা নীচে দিলাম।
কার মিলন চাও বিরহী-- তাঁহারে কোথা খুঁজিছ
ভব-অরণ্যে কুটিল জটিল গহনে শান্তিসুখহীন ওরে মন ॥
দেখো দেখো রে চিত্তকমলে চরণপদ্ম বাজে- হায়!
অমৃতজ্যোতি কিবা সুন্দর ওরে মন।
গানটা পড়ে গেলে বোঝা যাচ্ছে শান্তিসুখহীন মনের চিরকালীন বিরহ যাতনা মিলন খুঁজছে। মনের মানুষের সনে। পৃথিবী আর অরণ্যকে এক করা তো বহু পুরনো ব্যাপার। দান্তেও করেছিলেন। এরপরই জানছি হৃদকমলে চরণপদ্মপাতে সুর বাজছে। অমৃতজ্যোতি সঙ্গীতকে পেয়ে মন পূর্ণ। সবই ঠিক আছে। কিন্তু, এই কথাগুলো দিয়ে আমি মনোভার নামাতে পারছি না। অথচ, এই গানটা আমার একা লাগা বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে তাকে ভূমা করে তুলছে। কেমনভাবে? বলতে চেষ্টা করছি। তার আগে একটা অন্য কথা বলি। আপনারা নিশ্চয়ই ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত নৌকাডুবি ছবিটা দেখেছেন? সেখানে একটা দৃশ্যে এই গানের ব্যবহার আছে। ইস্কুলের প্রার্থনাসঙ্গীত হিসেবে। আমার মনে আছে, আমি যখন নৌকাডুবি দেখি তখন এই গান শুনে ভেবেছিলাম, এ আবার কী? এই গান প্রার্থনার? আসলে, ছবির ভাষা বুঝিনি। দৃশ্যটায় কী ছিল? গান বাজছে নেপথ্যে। ক্যামেরা প্যান করছে। আকাশ, পুরনো কলকাতার পরিবেশ সব কিছুর মধ্যে যেন বিস্তার ঘটছে সুরটার। যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে নরনারীর সম্পর্কের মধ্যে, তাকে কাটিয়ে এক মিলনান্তক আনন্দকে চাইছে যেন চিত্রভাষ্য। আজ্ঞে হ্যাঁ। সুর। সুচিত্রা মিত্রের গলায় গানটা শুনুন। দেখুন সা, নি, সা আর কোমল রে দিয়ে শুরু হয়ে গানটা গড়িয়ে যাচ্ছে দ্বিতীয় আর তৃতীয় লাইনে। আপনি শুনছেন : তাঁ -হারে/কোথাআ/ খুঁউউজিছোওও/ ভব/অরণ্যে কুটিলো/জটিলো গহনেএ/ শান্তি সুখো হীন/ ওওরে মন। পা, কড়ি মা, কোমল ধা, গা আর নি। এই পর্দাগুলো লাগছে। তবে, মূল গমক আসছে শান্তিসুখহীন ওরে মন - অংশে। কোমল রে, সা, নি, আর পা - এদের অভিঘাতে একটা মন্দ্রতা শোনা যাচ্ছে যা শান্তিসুখহীন মন - এর প্রকাশকে এতটুকু প্যানপেনে করছে না। বরং একটা গরিমা দিচ্ছে। গলা উঠবে এরপর। কিন্তু শুদ্ধ নি আর সা কে কোমল ধা এমনভাবে ব্যালান্স করে যে চিত্তকমল আর চরণপদ্ম কোমলই থাকে। হা আ আ য় এর টানে কোমল রে আর গা। এরপর তারার সা, নি, গা আর কোমল রে মিলে চড়ায় বলবে অমৃতজ্যোতি কিবা সুন্দর। জ্যোতির ছটা দেখতে পাচ্ছেন আপনি। এরপর ঋ ঋ সা সা নি : ওওরে মোওন। কোমল রে, শুদ্ধ সা আর নি। এবার বলুন, গানটা শেষ হওয়ার পর কেমন লাগছে আপনার? একটা শান্ত, গম্ভীর অথচ তেজোদীপ্ত ভাব জাগছে মনে? আমার মতো মনে হচ্ছে, একটা নরম আগুন জ্বলছে ভেতরে? হবেই। কারণ, শ্রী রাগ এটাই করে।
বলেই ফেলি আসল কথাটা। আপনি আসলে তেওড়া তালে ফেলা শ্রী - এর একটা বন্দিশ শুনছিলেন : তনু মিলন দে পরবর। প্রশান্ত পালের রবিজীবনী ষষ্ঠ খণ্ডের ১২২ পাতায় দেখছি গীতাঞ্জলি-র পাণ্ডুলিপিতে পুরো গানটা লিখে তার ওপর বাংলা কথা বসিয়ে গেছেন রবি ঠাকুর!
অষ্টাদশাব্দঃ স্বরচ্চারুমূর্তিঃ ধীরোল্লসৎপল্লবকর্ণপুরঃ।
ষড়্জাদিসেব্যোহরুণবস্ত্রধারী শ্রীরাগরাজঃ ক্ষিতিপালমূর্তিঃ।।
ক্ষিতিপাল মানে রাজার মতো দেখতে রাগরাজ শ্রীকে। আঠেরো বছর বয়স, যৌবনদীপ্ত, কমনীয়, শান্ত, গম্ভীর। লাল কাপড়ে লোহিতবর্ণ সূর্যের মতো দ্যুতিমান। কর্ণে ঈষৎ উৎফুল্ল পল্লবের অলংকার। সাতস্বর তাঁর সেবায় নিযুক্ত। ধীরোদাত্ত, বীর্যবান, শান্ত, সৌম্য শ্রী- এর সামনে কোনও সঙ্কীর্ণতা দাঁড়াতে পারে না। একাবোকা লাগার সাধ্যি কী!
এভাবেই রবি ঠাকুরের গানকে দেখি। তাকে আপন করি। তাকে নিয়ে নেভা বাতি হাতে একলা পথ চলি। আর বেঁচে থাকি। আপনাদের মতোই।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।