সালটা ১৮২২। প্রতিষ্ঠিত হল নেটিভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশন। নেটিভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশনের প্রধান হিসেবে যোগ দিলেন এক বাঙালি ডাক্তার - মধুসূদন গুপ্ত।
এরপর প্রায় তেরো বছরের বিরতি। ১৮৩৫ সালে ভারতীয় চিকিৎসাক্ষেত্রে ঘটে গেল এক নিঃশব্দ বিপ্লব। কল্লোলিনী তিলোত্তমার বুকে তৈরি হল মেডিক্যাল কলেজ। ইউরোপীয় পদ্ধতিতে ভারতীয় ডাক্তাররা আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে প্রথমবারের জন্য করমর্দন করলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের বদান্যতায়।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম সুপার হিসেবে নিযুক্ত হন এম জে ব্রামলে এবং আনাটমি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এইচ এইচ গুডিভ। অন্যদিকে নেটিভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশন থেকে ডেমনস্ট্রেটর হিসেবে যোগ দেন পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত। ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে সেই সময় ইউরোপীয় পণ্ডিতদের একাধিপত্য, সেই সময়ই হুগলির বৈদ্যবাটির মধুসূদন গুপ্ত ঘটিয়ে ফেললেন এক আশ্চর্য কাণ্ড। যদিও হুগলির বৈদ্যবাটি থেকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পথ মধুসূদনের জন্য আদৌ প্রশস্ত ছিল না। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে বৈদ্যবাটির এক বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রণ করেন মধুসূদন। চিকিৎসার চৌহদ্দির মধ্যে বেড়ে ওঠা তার। কিন্তু কিশোর বয়সে পড়াশোনায় অমনোযোগী হবার কারণে একসময় বাড়ি থেকে তাঁকে বের করে দেন বাবা। তারপর একপ্রকার জেদের বশেই সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগে ভর্তি হলেন মধুসূদন। পুঁজি বলতে ছিল রাম কবিরাজ নামক এক কবিরাজের কাছে কিছুদিন শিক্ষানবিশির কাজ। একসময় সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগটি বন্ধ হয়ে গেলে নেটিভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশনে যোগ দেন তিনি। সেখান থেকে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ মধুসূদন যোগ দিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে।
১৮৩৬ সালের ১০ই জানুয়ারি (মতান্তরে ২৮ অক্টোবর) সমগ্র মেডিক্যাল কলেজ ভেঙে পড়েছে মর্গের সামনে, তিল ধারণের জায়গা নেই। কিন্তু কেন এই জনসমুদ্র? কারণ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মধুসূদন গুপ্তের হাত ধরে কল্লোলিনী তিলোত্তমা সাক্ষী থাকবে এক নতুন ইতিহাসের। ভারতের মধ্যে কলকাতার বুকেই প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ তৈরি করবে এক অনন্য ইতিহাস।
তবে শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে আদৌ সহজ ছিল না এই কাজ। তার অন্যতম কারণ ছিল হিন্দু রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষু। বিধবা বিবাহ বাল্য বিবাহ তখনও প্রচলিত, হিন্দু সমাজ ঘুরে মরছে অন্ধকার চক্রব্যুহে। শব ব্যবচ্ছেদকে হিন্দু রক্ষণশীল সমাজ তখন দেখত বাঁকা চোখে। এমনই পরিস্থিতিতে আরও চার সহযোগী রাজকৃষ্ণ দে উমাচরণ শেঠ দ্বারকানাথ গুপ্ত এবং নবীনচন্দ্র মিত্রকে নিয়ে সুসম্পন্ন করলেন ভারতের প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ। সেদিন ফোর্ট উইলিয়াম থেকে তাদের পঞ্চাশ রাউন্ড গান স্যালুটে সম্মান জানানো হয়।
কেমন ছিল সেদিন শহর কলকাতার পরিস্থিতি? এলিট ড্রিঙ্ক ওয়াটার সাহেবের বক্তব্য ছিল এমন - "মেডিক্যাল কলেজের সব ফটকগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাছে এই বিধর্মী কাজ করার জন্য প্রাচীনপন্থীরা কলেজে আক্রমণ চালায়...।" এই সামান্য বক্তব্য থেকেই ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে সেদিন শহর কলকাতার পরিস্থিতি আদৌ এই ঐতিহাসিক কাজের অনুকূলে ছিল না।প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সঙ্গে করেই নবযুগের দিশারী হয়ে ওঠেন মধুসূদন গুপ্ত ।
১৮৫৬ সালের ১৫ই নভেম্বর মৃত্যু হয় মধুসূদন গুপ্তের। তবে তার আগেই আরও এক ইতিহাস সৃষ্টি করেন তিনি। বাঙালিদের সুবিধার জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে একসময় বাংলাতেই ডাক্তারি শাস্ত্র পড়ানো শুরু হয়। তার অধ্যক্ষ রূপে যোগদান করেন মধুসূদন। ১৮৫৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর 'এনাটমি' নামক বইটি। এমনকি এনাটমি-কে যে আমরা বর্তমানে 'শারীরবিদ্যা' বলে অভিহিত করি, সেই কথাটির পথিকৃৎ হিসেবেও উজ্জ্বল হয়ে আছে মধুসূদন গুপ্তের নাম।
হুগলির বৈদ্যবাটি থেকে কলকাতার বুকে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ - কঠিন ছিল সেই পথ। কিন্তু তাকেই হেলায় অতিক্রম করেছিলেন মধুসূদন। আমরা তাঁকে মনে রাখিনি, কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রে এক আলোকোজ্জ্বল পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন মধুসূদন গুপ্ত।
তথ্যসূত্র -
১। 'মধুসূদন গুপ্ত ; ভারতের প্রথম এনাটমিস্ট ' - অতনু চক্রবর্তী
২। এশিয়া তথা ভারতের প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদ, কলকাতার সাতকাহন
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।