ড. শারদা মন্ডল
সেন পরিবার অত্যন্ত সংস্কৃতিমনস্ক এবং মানবিক। গত দেড়শো বছরে, কোনদিনই ঐ পরিবার বিরাট কোনো ব্যয়বাহুল্য করে নি, আবার ভয়ঙ্কর আর্থিক দুর্দশাতেও পরে নি, যেটা কীর্তি মিত্রের পরিবারে হয়েছে। এই যাদুবলে আজও ঐ পরিবার তাদের যৌথ বাড়িতে বাস করছে এবং মণিলাল সেনের পৌত্র, দাঁতি সেনের পুত্র প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও রাজ্যপাল শ্যামল সেনের মতো বংশের কৃতি সন্তানেরা বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেছেন। পারিবারিক শ্রুতিতে জেনেছি যে আমার মায়ের ঠাকুরদা শরৎচন্দ্র বোস ও মোহনবাগানের জন্মে যুক্ত ছিলেন এবং অর্থসাহায্য করেছিলেন। হয়তো এমন আরও মানুষ আছেন। মোহনবাগানের প্রথম দিকের কমিটিগুলিতে তাঁদের নাম নথিভুক্ত নয় বলে মোহনবাগানের ইতিহাস থেকে তাঁরা আজ হারিয়ে গেছেন। আমার মনে হয়, প্রধান পরিবারগুলি তাঁদের জীবিকার জন্য ইংরেজ সরকারের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তাই সরাসরি বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না। যদিও এর ব্যতিক্রম ভূপেন বোস। বঙ্গভঙ্গের পর প্রথম সঞ্জীবনী পত্রিকায় স্বদেশী ও বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন ব্রাহ্ম নেতা কৃষ্ণকুমার মিত্র। তিনি আমার মায়ের ঠাকুমা কুমুদিনীর বাবা, রাজনারায়ণ বসুর জামাই, অরবিন্দ ঘোষের মেশোমশাই। ভূপেন বোস সরাসরি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। কুমুদিনী শোভাবাজার রাজবাড়িতে বসেই কলম দিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে আগুন ঝরিয়েছেন। এতে অবশ্যই স্বামী শরৎচন্দ্রের পূর্ণ সমর্থন ছিল, নইলে তাঁর পক্ষে এসব কাজ সম্ভব ছিল না। আরও একটা বিষয় আমাকে খুবই অবাক করেছে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে কৃষ্ণকুমারের কারাদন্ড হয়। তিনি আগ্রা ফোর্টে বন্দী হন। অথচ একই পথের পথিক কন্যা কুমুদিনীর গায়ে পুলিশের আঁচ লাগে না কেন? শ্বশুরবাড়ি মানে শোভাবাজার রাজবাড়ি এবং বাকি ক্ষমতাবান পরিবারগুলির অক্ষ বা জোট কি তাঁর নিরাপত্তার ঢাল হয়ে দাঁড়ায়? দেড়শ বছর পরে ইতিহাস পুনর্গঠন খুবই কঠিন। অনেক সময়েই অনুমানের ভিত্তিতে তথ্য হাতড়াতে হয়। যদিও ১৮৮৯ সালে মোহনবাগানের জন্মের সময়ে তিনি নববধূ, কোলে সদ্যজাত জ্যেষ্ঠপুত্র সতীশ চন্দ্র। তবে পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করে মোহনবাগানের জন্মকালে জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। এরপরেও সেকালে লেখাপড়া জানা কলেজের গন্ডিতে পৌঁছনো মানুষজনের ওপরে ছিল ডিরোজিওর প্রভাব। এইসব কারণে আমার মনে হয় লেখাপড়া, ডিরোজিও এবং ব্রাহ্ম ও অন্যান্য সমাজ সংস্কারের সান্নিধ্যে এসে এই পরিবারগুলির মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হয়। সেই আবেগ ফুটবল দলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে, যা পূর্ণতা পায় ১৯১১ সালে, খেলার মাঠে ইংরেজের দল ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে। এই জয় উপলক্ষে তৎকালীন মানসী পত্রিকায় প্রকাশিত কবি করুণানিধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গান দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে -
"জেগেছে আজ দেশের ছেলে
পথে লোকের ভিড়
অন্তঃপুরে ফুটল হাসি
বঙ্গ রূপসীর।
গোল দিয়েছে গোরার গোলে
বাঙালির আজ জিত,
আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও
উন্মাদনার গীত।
আজকের এই বিজয়বাণী
ভুলবে নাকো দেশ।
সাবাশ সাবাশ মোহনবাগান!
খেলেছ ভাই বেশ। ....."
কবির বাণী সত্য হয়েছে। দেশ ঐ জয়ের কথা আজও ভোলে নি।
মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে - মোহনবাগান একটা আদর্শ, আমাদের পূর্বপুরুষদের অনেক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে গড়া যখের ধন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক, আমাদের অস্তিত্ব। মোহনবাগানের হারজিত, আর আমাদের জেতা হারা এক। সেদিন না বুঝলেও, এবারে একটু একটু বুঝতে পারছি। মোহনবাগানের প্রথম দিকের দলের একটি নাম নিয়ে আমি খুবই আগ্রহী। ইনি কে? সেই নামটি হল দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু। মায়ের ঠাকুমা কুমুদিনী বসুর প্রথম দিককার বই ১৯০৬ এ প্রকাশিত মেরী কার্পেন্টার - এর প্রকাশকও দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে ইংরেজ মহিলা শিক্ষাবিদ মিস মেরী কার্পেন্টার কলকাতায় আসেন। রাজনারায়ণ বসু ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। ১৮৭৬ সালে তিনি বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। তাঁরই জীবনী এই বই। তখনকার নব্যলেখিকা কুমুদিনী সম্ভবত সিটি কলেজের অধ্যাপক পিতা কৃষ্ণকুমার মিত্রের পরিচয়টি কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন, তাই লেখিকার নাম ছাপা আছে শ্রী কুমুদিনী মিত্র বি.এ., বিবাহিতা বলে কুমারী লিখতে পারেন নি। আজও সুচিত্রা সেনের দৌহিত্রীর নাম রাইমা দেব বর্মন না হয়ে সেন হয়, এও কতকটা তেমন। যাই হোক, পিতার সঞ্জীবনী পত্রিকার সহসম্পাদক ও সহযোদ্ধা দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির শ্যালক মানে, প্রথম বাঙালিনী চিকিৎসক কাদম্বিনীর ভাইও দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু। সমকালে এই তিন দ্বিজেন্দ্রনাথ কি এক মানুষ নাকি আলাদা? আবার এও হতে পারে তিনি ভূপেন্দ্রনাথের আত্মীয়। সন্ধান করছি এখনো, উত্তর পাই নি।
রামমোহন ১৮৩৩ সালে গত হন, তাঁর সঙ্গে মেরি কার্পেন্টারের যোগাযোগ কিভাবে সম্ভব?
ধন্যবাদ ঋতাদেবী। সংশোধন করলাম।
মেরী কার্পেন্টারের সঙ্গে অল্প বয়সে রামমোহনের দেখা হয়েছিল ইংল্যান্ডে। এই জায়গাটা লেখায় স্পষ্ট করে দিতে হবে।