এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • আমি মোহনবাগানের মেয়ে  (পর্ব পাঁচ)

    Sara Man লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০৪ আগস্ট ২০২১ | ৮০১ বার পঠিত
  • ড. শারদা মন্ডল

    এবারে যা বলছিলাম আবার সে প্রসঙ্গে ফিরি। কলকাতার এই কুলীন পরিবার গুলির মধ্যে যেহেতু অন্দরে বাহিরে লেখাপড়ার চর্চা ছিল, কোনো না কোনো সদস্যের হাত ধরে ব্রাহ্ম এবং অন্যান্য সমাজ সংস্কারক ভাবনা গুলি ঢুকে পড়েছিল। ভূপেন বসুর পুত্রবধূ মানে গিরীন্দ্রনাথ বসুর স্ত্রী মলিনা দেবী ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী দ্বারকানাথ মিত্রের মেয়ে। এই দ্বারকানাথ আবার ছিলেন বিদ‍্যাসাগরের সহযোগী। এই গিরীন্দ্র-মলিনার পুত্র কমল বসু হয়েছিলেন কলকাতার মেয়র। শোভাবাজার রাজবাড়িতে আমার মায়ের ঠাকুমা কুমুদিনী ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যা ছিলেন। তাঁর কবিতা ও উপন‍্যাসের বইগুলিতে প্রকাশ কালের জায়গায় ব্রাহ্ম সম্বৎ ছাপা আছে। কুমুদিনী ঋষি রাজনারায়ণ বসুর নাতনি। রাজনারায়ণের আত্মচরিতে লেখা আছে, তিনি রাধাকান্ত দেবের দৌহিত্রকে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। সমাজ রাধাকান্ত দেবের সতীদাহের পক্ষে আর বিধবা বিবাহের বিপক্ষে দাঁড়ানোটাই বেশি করে মনে রেখেছে। তাঁর শব্দকল্পদ্রুম, স্কুল কলেজ স্থাপনগুলি মনে রাখে নি। একথাও মনে রাখেনি যে রামমোহনের পরিবারেও সতীদাহ হয়েছে, দেব পরিবারে একটিও হয়নি। অবশ‍্য এতে সমাজকে দোষ দেওয়া যায় না। রেঁনেশার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে রাধাকান্ত আজও ভিলেন। তবে একথা আমি মন থেকে মানি ঐ বাধার পাহাড় দাঁড়িয়ে ছিল বলেই রামমোহনের আর বিদ‍্যাসাগরের জয় চিরস্থায়ী। যাকগে ঐ রাজবাড়ির কথা এখানে উঠছে, কারণ ওখানে শোভাবাজার ফুটবল ক্লাব স্থাপিত হয়েছিল এবং সাহেবদের বিরুদ্ধে খেলে নামডাক ও হয়েছিল।

    এবারে কেশব সেনের প্রসঙ্গে আসি। কেশব সেনের কন‍্যা সুনীতি দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয় কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ দেবের। এই বিবাহ হয়েছিল মোহনবাগানের জন্মের এগারো বছর আগে, ১৮৭৮ সালে। সেযুগে এই বিবাহের অভিঘাত এতটাই ছিল, যে কেশব সেনের ভারতীয় ব্রাহ্ম সমাজ এরপরে দুটুকরো হয়ে যায়। তবে সেসব কথা এখানে আলোচ‍্য নয়। নৃপেন্দ্র নারায়ণ বৃটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও প্রজাহিতৈষী এবং আধুনিক কোচবিহার শহরের রূপান্তর ও তাঁর হাতে হয়েছে। আবার এই বৃটিশ শিক্ষার হাত ধরেই কোচবিহারে আসে ফুটবল। এবং নৃপেন্দ্র নারায়ণের পুত্র রাজা রাজরাজেন্দ্র নারায়ণ মোহনবাগানের অন‍্যতম শুভানুধ্যায়ী হয়ে ওঠেন। তার মানে সম্পর্কে কেশব সেন হলেন রাজরাজেন্দ্রের দাদু। এই রাজরাজেন্দ্রের ভ্রাতুষ্পুত্র মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ফুটবল আর ক্রিকেট দুটি খেলাতেই পারদর্শী ছিলেন। বিংশ শতকের চারের দশকে রঞ্জি ট্রফিতে তিনি ছিলেন বাংলার ক্রিকেট অধিনায়ক। এই জগদ্দীপেন্দ্রের ভগিনী হলেন মহারাণী গায়ত্রী দেবী। এসব কারণেই মনে হয় মোহনবাগান নিয়মিত কোচবিহার কাপ খেলতে যেত। এছাড়া মোহনবাগানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন শ‍্যামপুকুরের মহারাজা দুর্গাচরণ লাহা। মোহনবাগান ভিলার মাঠ হাতছাড়া হবার পর, লাহাবাবুরাই মাঠের ব‍্যবস্থা করে দেন। যা হোক, সেযুগে এত রাজারাজড়া, ব‍্যবসায়ীদের সমাবেশের জন্যই বোধ হয় অন্তর্জালে লেখা আছে, ধনাঢ্য ব‍্যক্তিরা ব্রিটিশ আমোদের অঙ্গ হিসেবে ফুটবলের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন।

    তবে মোহনবাগানের জন্মটা কেবল বৃটিশ আমোদের অনুকরণ একথা আমার সত্যি বলে মনে হয় না, কারণ এই জন্মের সূত্রে ভূপেন বোস, সেন পরিবার ও অন‍্যান‍্য নক্ষত্রের এক বিরল সমাবেশ তৈরি হয়েছিল। মোহনবাগানের জন্মদাতারা তাঁদের জীবনের পরবর্তী অধ‍্যায়ে হয়ে উঠেছিলেন দেশমাতৃকার সৈনিক। কয়েকজনের কথা একে একে বলি। প্রথমে স‍্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে দিয়েই শুরু করি - কারণ তিনি আমার দেশের বাড়ি যেখানে, সেই বসিরহাটের লোক। রাজেন মুখুজ‍্যে হলেন তৎকালীন ভারতের এক যশস্বী শিল্পপতি ও সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে মার্টিনের রেলপথ, এমনকি বেলুড় মঠ সবেতেই তাঁর হাতের ছোঁয়া আছে। যে বছর মোহনবাগান খেলার মাঠে ইংরেজ দলন করে, মানে ঐ ১৯১১ সালে স‍্যার রাজেনই ছিলেন কলকাতার শেরিফ। এঁরই পুত্রবধূ হলেন রবীন্দ্র-স্নেহধন‍্যা লেডি রাণু মুখার্জি। মোহনবাগানের প্রথম দিকের কমিটির আর এক সদস্য হলেন রায়বাহাদুর চুনীলাল বসু। তিনি ছিলেন সেযুগের থেকে একজন এগিয়ে থাকা মানুষ। স্বাস্থ্যব‍্যবস্থা, খাদ্যে ভেজাল, সুষম আহার এইসব বিষয়ে গবেষণা করে জনসচেতনতা গড়ে তোলার কাজ করছিলেন। ইনিও কলকাতার শেরিফ হয়েছিলেন। এছাড়াও মোহনবাগান দল তৈরিতে জড়িয়ে আছেন স‍্যার নৃপেন্দ্রনাথ সরকার। তিনি স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ প‍্যারীচরণ সরকারের পৌত্র এবং নগেন্দ্রনাথ সরকারের পুত্র। নগেন্দ্রনাথ ছিলেন ডেপুটি ম‍্যাজিস্ট্রেট। নৃপেন্দ্রনাথ তাঁর পিতামহ এবং পিতার মতোই যশস্বী। সাইমন কমিশন অনুযায়ী বিলেতে তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকে তিনি ছিলেন ভারতের প্রতিনিধি। তাঁর একটি বিশাল কীর্তি হল, বাংলায় পাটের শুল্ক ব‍্যবস্থা সংস্কার। বাংলার চাষীরা জলে ভিজে, ম‍্যালেরিয়ায় ভুগে যে পাট উৎপাদন করত, সেই কাঁচা পাট ইংরেজ সরকার ইংল্যান্ডে চালান করত। এই রপ্তানিতে ভারতের যে শুল্ক উপার্জন হত, তা ভারত সরকার জমা রাখত, বাংলার প্রাদেশিক সরকারকে কোনো ভাগ দিত না। নৃপেন্দ্রনাথ বহু চেষ্টায় সেই উপার্জনের এক অংশ বাংলায় নিয়ে আসার ব‍্যবস্থা করেন। এবারে আসব সেন পরিবারের কথায়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৪ আগস্ট ২০২১ | ৮০১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন