এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • আমি মোহনবাগানের মেয়ে (পর্ব ২) 

    Sara Man লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০১ আগস্ট ২০২১ | ১২৩৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ড. শারদা মন্ডল

    .......কিন্তু পূর্ব পুরুষের সঙ্গে সংযোগটা কি? ততদিনে আমি একটু বড় হয়ে গেছি। আনন্দবাজার খুঁটিয়ে পড়ি। অন্য পত্রপত্রিকা যা পাই, মায় ঠোঙা পর্যন্ত গিলে খাই। ১৯১১ এ খালি পায়ে গোরা সাহেবদের হারানোর গল্প জেনে গেছি। স্বাধীনতার আগে মোহনবাগানের আরও কাপ, টুর্নামেন্টে জয়ের খবরও জেনেছি। প্রথম দিকে মোহনবাগানের আদর্শের সঙ্গে ঘটি বাঙালের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ১৮৮৯ সালে মানে মোহনবাগানের প্রতিষ্ঠাকালে, যখন বিবেকানন্দের বয়স মাত্র ছাব্বিশ বছর, তখন বাংলায় এসব কনসেপ্ট আসা সম্ভবও নয়। ১৯১১ এর দলের অনেক খেলোয়াড় পূর্ববঙ্গীয় ছিলেন। ওই আবেগটা দেশভাগের পরে আরোপিত, একথাও জেনেছি। মোহনবাগান কেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই আর জাতীয়তার প্রতীক, তা একটু একটু বুঝতে শুরু করেছি। এমনকি ভবানীপুরের উত্তমকুমার আর পাবনার সুচিত্রা সেনের কালজয়ী বন্ধনের পিছনে ঐ ঘটি বাঙাল আবেগের ইন্ধন আছে, এসব জ্ঞানগর্ভ আলোচনাও পড়েছি। কিন্তু পূর্বপুরুষের ব‍্যাপারটা স্পষ্ট হলো আরও পরে। সে কথায় যাবার আগে আর একটা কথা বলে নিই।

    উচ্চমাধ‍্যমিক পড়তে গিয়ে আমি একজন খেলা পাগল বন্ধু পেলাম। অদ্ভুত ভাবে এরপর থেকে কিকরে কি জানি আজ পর্যন্ত দুজনের জীবন পাশাপাশি সরলরেখায় চলছে। সে হল আমার বন্ধু সেঁজুতি। ওর সঙ্গে আমার তফাৎটা হল এই যে, আমি যেমন কোনদিন মাঠে গিয়ে খেলা দেখতে পারি নি, বাড়িতেই লম্ফঝম্প করেছি, ও কিন্তু প্রচুরবার মাঠে গেছে এবং অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। কারণ ওর জ্যেঠু শম্ভু পান তৎকালীন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের এর জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। ওদের বাড়িতে সকলের ইডেন গার্ডেনের বাৎসরিক সদস্য কার্ড ছিল। আমার মতো সেঁজুতিরও হিরো ছিল শ‍্যাম থাপা। আর মজার কথা হল এই যে কলকাতার ময়দানের বিদেশি ফুটবলার ইরানি খেলোয়াড় মজিদ বাসকরকে ও দুচক্ষে দেখতে পারত না। কারণ মজিদ এতো ভালো খেলে, কিন্তু ইস্টবেঙ্গল ছাড়ে না। তাও যখন ছাড়লো তো মহমেডানে গেলো, তবু মোহনবাগানে এলো না‌।

    ১৯৮২ এর নেহেরু কাপে উরুগুয়ের ফ্রান্সিসকোলির খেলা ও মাঠে বসে দেখেছিল। কলকাতায় খেলে যাওয়া সেই ফ্রান্সিসকোলি ১৯৮৬ তে মেক্সিকো বিশ্বকাপে খেলেছিল। আমি টিভিতে দেখেছি। কিন্তু বিপক্ষকে ট‍্যাকল করছিল। দেখে আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম, দশ নম্বর জার্সি গায়ে তারকা ফুটবলারের এতো ফাউল করা শোভা পায় না। ভাস্কর গাঙ্গুলির ওপরেও সেঁজুতির খুব রাগ ছিল ইস্টবেঙ্গলের কাছে ৫ গোল খাওয়ার জন্য, অথচ সে ইস্টবেঙ্গলে গিয়ে সেরা গোলকিপার হয়ে গেল, তাই গজগজ করত। পরে আবার ও শিশির ঘোষের হেড দিয়ে গোল করার ফ‍্যান হয়েছিল। কলকাতা ময়দানের ক্লাব তালতলা একতার ঠিকানা ছিল সেঁজুতিদের তালতলার বাড়ি। ওর সেজ জ্যাঠামশাই সুনীল পাল (ময়দানের পাগলাদা) মারা যাওয়ার পর তালতলা একতা সঙ্ঘ ঠিকানা বদলায়। সেঁজুতির বাবা সুপ্রকাশ পাল (মাঠের নাড়ুদা) আর সেজ জ‍্যাঠামশাই ক্রিকেট, ফুটবল আর হকি তিনটেতেই প্রথম ডিভিশনে খেলেছেন। আর যে জ্যেঠু সিএবি-র জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন তিনি টেস্ট আম্পায়ার ছিলেন। ওদের বাড়ির বৈঠকখানায় ওনার সাথে পতৌদি আর সোবার্সের ফ্রেম বন্দি ছবি ছিল। সেঁজুতির বাবা মোহনবাগান ক্রিকেট টিমে খেলার ডাক পেয়েছিলেন কিন্তু পারিবারিক দলের মায়া ছাড়তে পারেন নি। পরবর্তীতে তিনি আম্পায়ারিং করতেন, হকিতে ছিলেন টেস্ট আম্পায়ার, সিএবি-এর ক্রিকেট আম্পায়ার। কটকের বারবাটি স্টেডিয়াম এর উদ্বোধনী হকি ম‍্যাচের আম্পায়ার ছিলেন উনি।

    আমরা যখন কলেজে, তখন দীর্ঘ কারাবাস শেষে মুক্তি পান ম‍্যান্ডেলা। ১৯৯০ তে তিনি কলকাতায় আসেন। আর সেই উপলক্ষে কলকাতায় ঘটে যায় আবেগের বিস্ফোরণ। ইডেন গার্ডেনে বিশাল জনতার সামনে তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। ঐ ঘটনা আমি টিভিতে আর সেঁজুতি ইডেনে বসে স্বচক্ষে দেখেছে, ওর বর্ণনা শুনেই মনে হয়, আমিও যেন প্রত‍্যক্ষদর্শী। আটের দশকের শেষের দিকে বা নব্বইয়ের শুরুতে টেলিভিশনে মাঝে মাঝে ছোট ছোট অ্যানিমেশন ছবি দেখানো হত। আমরা তখনও ছোট পর্দায় সম্প্রচারে বিঘ্ন বা সরি ফর দ‍্য ইনটেরাপশন দেখে অভ‍্যস্ত। অ্যানিমেশনের খুব একটা ধারণা ছিলনা। তখনই যাদুকর জুনিয়র পি সি সরকারের দাদা মানিক সরকারের নামটা শুনি। আমেরিকায় থাকেন। নেতাজি ইন্ডোরে একবার সেই মানিক সরকারের চোখ ধাঁধানো লেজার শোয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। তার আগে ইডেনেও অনেক টাকা খরচ করে ইতালিয়ান সাহেবকে দিয়ে লেজার শো করানো হয়েছিল। আমি টিভিতে দেখেছিলাম আর সেঁজুতি যথারীতি মাঠে বসে। তখন আমাদের সাদা কালো বারো ইঞ্চি টিভি। টেলিভিশনে ভালো বুঝতে পারিনি। পরে কাগজে খবর বেরিয়েছিল গঙ্গার তীব্র হাওয়া ঐ শো তে ব‍্যাঘাত ঘটিয়েছিল।

    সেঁজুতি ওর মায়ের কাছে উত্তম সুচিত্রা জুটির শেষের দিকের ছবি নবরাগে ক্রিকেটের শুটিংয়ের কথা শুনেছে ইডেনে। উত্তমকুমার ভবানীপুরের ঘটি, তাই উনি ও মোহনবাগানী। যেদিন উত্তমকুমার মারা যান, তার ঠিক তিন সপ্তাহ পরে কলকাতা ফুটবলের ইতিহাসে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। উত্তমের মৃত্যুদিন ২৪ শে জুলাই আর দুর্ঘটনা ঘটে ১৬ই আগস্ট। ইস্ট-মোহনের ষোলোজন সমর্থকের মৃত্যু হয়। ৮০ সালের ঐ দুটো মাসের কথা আমি কক্ষনো মনে করতে চাই না, তবু দুঃস্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে। মান্না দের 'খেলা ফুটবল খেলা' গানটা বাইরে আজকাল শোনা যায়না। শুধু মনের মধ্যে বাজে। ইউটিউবে আছে। আজও ঐ ঘটনা ভোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যাকগে কথা হচ্ছিল নবরাগ নিয়ে। এখনও মাঝে মাঝে নবরাগে ইডেনের দৃশ্য দেখি ইউটিউবে। সেঁজুতির কথা মনে হয়। ও বলেছিল ছবিতে সুচিত্রা সেনের পিছনে দর্শক ভর্তি ইডেনের যে গ‍্যালারি দেখা যায়, তার মধ্যে একটা চালাকি আছে। কারণ ক‍্যামেরার অ্যাঙ্গেলে যতটা জায়গা ধরে, সেইটুকু সিটে লোক বসানো হয়েছিল। বাকি ইডেন ফাঁকা ছিল। ব্রজবুলিতেও উত্তমকুমার এমন শট খেলেন, বল আকাশে উঠছে তো উঠছে। শেষে তারায় ধাক্কা খেয়ে বল দুখানা হয়ে যায়। আধখানা ওভার বাউন্ডারি হয়, আর আধখানা ক‍্যাচ হয়ে যায়। এখনও মাঝে মাঝে মনখারাপ থাকলে সত‍্যিকারের খেলার ভিডিও বা সিনেমার এইসব দৃশ্য চালিয়ে দেখি। খুব মজা লাগে। মনটা ভালো হয়ে যায়। যাকগে হচ্ছিল ফুটবলের কথা। কিকরে যেন ক্রিকেট, হকি এগুলোও ঢুকে পড়েছে। মোহনবাগান কেন আমার পূর্বপুরুষের যখের ধন, সেই জ্ঞানটাতো আরেক গুপ্তধন, অতীতের কুঠুরিতে ঢাকা পড়েছে। সেটা কিকরে উদ্ধার হল, সে গল্পে আসি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০১ আগস্ট ২০২১ | ১২৩৭ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    লাল রঙ - Nirmalya Nag
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন