এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • আমি মোহনবাগানের মেয়ে (পর্ব চার)

    Sara Man লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০৩ আগস্ট ২০২১ | ১০৯৯ বার পঠিত
  • ড. শারদা মন্ডল

    কীর্তি মিত্রের পুত্র প্রিয়নাথ মিত্রও খেলা নিয়েই বেশি মেতে থাকতেন। প্রিয়নাথের তিন পুত্র। তার মধ্যে কনিষ্ঠ রবীন মায়ের ছোটো পিসেমশাই। তিনি পারিবারিক কারবার দেখাশোনা করতেন। বাকিরা হলেন শিশিল মিত্র এবং মলয় মিত্র। মা ডাকতেন শিলি কাকা আর মন্টি কাকা। শিলি দাদুও আইনজ্ঞ। তাঁর কন‍্যা দীপ্তির সঙ্গে বিবাহ হয় মায়ের বড় পিসির ছেলে বাচি সেনের। মন্টি দাদু অবিবাহিত ছিলেন। দীপ্তি মামীমার মাকে আমার মা ডাকত পেনি খুড়িমা বলে। তাঁর বিবাহ পূর্ব নাম অম্বালিকা দত্ত। আর এই মামীমা যেহেতু মিত্র বাড়ির সূত্রে আমার মাসি, মা এবং মামারা ওনাকে খুকুদি বলে ডাকত। বাচি সেনের বড়দা নমে সেনের স্ত্রী রেখা সেন ছিলেন এন্টালির দেব বাড়ির মেয়ে। ঐ বংশের প্রথিতযশা কন্যা নবনীতা দেবসেন। মোহনবাগান ই-লাইব্রেরি ফেসবুক পেজে নবনীতা দেবসেনের একটা চমৎকার ছড়া পেলাম।

    "যদি মোহনবাগান জেতে,
    ঢাকঢোল আর সানাই নিয়ে
    উঠবে শহর মেতে।

    যদি মোহনবাগান হারে?
    এক মিনিটে লোডশেডিং হয়
    হৃদযন্ত্রের তারে।"

    মায়ের বড় পিসির আর এক পুত্র হুঁকুজ সেনের বিবাহ হয় চিকিৎসক আর জি করের আর এক ভাই রাধারমণ করের দৌহিত্রী এবং জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর কন্যা পূরবীর সঙ্গে। রাধাগোবিন্দ কর বা আর জি কর নিজে নিঃসন্তান ছিলেন। যদিও এইসব প্রজাপতি নির্বন্ধ ঘটেছিল, মোহনবাগানের জন্মের পরে। বোস, সেন আর মিত্র পরিবারের নেতৃত্বে মোহনবাগানের জন্ম হয়। এঁদের সঙ্গে লতায় পাতায় ছিল কর এবং দেব পরিবার। এমনিতেই প্রভাবশালী কায়স্থদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মোহনবাগানের জন্মের পরে দেখছি এই পরিবারগুলি বৈবাহিক প্রজাপতির পাখায় পাখায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী প্রজন্মের এই বাড়তি বন্ধুত্ব বা ভরসা হয়তো তৈরি হয়েছিল এই মোহনবাগান আবেগকে কেন্দ্র করে। আমি ভাবি, যেহেতু আমার মাতামহীও আর জি করের নাতনি এবং দাদু দিদার বিয়ের ঘটকালি করলেন দাঁতি সেন, তার মানে আমার এই অস্তিত্বটা মনে হয় মোহনবাগানের কাছে ঋণী।

    বাংলায় ফুটবলের জনক নগেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীও শোভাবাজার রাজবাড়ি মানে দেববংশের জামাই, যাঁকে দেখে স্বামী বিবেকানন্দের ফুটবলের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল। ১৮৮৫ সালে তখনকার ওয়েলিংটন, ফ্রেন্ডস, প্রেসিডেন্সি ও বয়েজ ক্লাবকে মিশিয়ে দিয়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে তিনি তৈরি করেন শোভাবাজার ক্লাব। সঙ্গে ছিলেন রাজা জিতেন্দ্র কৃষ্ণ দেব। প্রায় একই সময়ে আরও তিনটে ক্লাবের জন্ম হয় - কুমোরটুলি ক্লাব, টাউন ক্লাব আর ন‍্যাশনাল ক্লাব। উমেশচন্দ্র মজুমদারের (মাঠে সকলে যাঁকে ডাকত দুখিরাম) তত্ত্বাবধানে এই সময়েই জন্ম হয় এরিয়ান্স ক্লাবের। আর এই ১৮৮৫ তেই প্রতিষ্ঠা হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের। ১৮৮৭ সালে নবাবজাদা আমিনুল ইসলামের পৃষ্ঠপোষণায় জন্ম নেয় জুবিলী ক্লাব। পরে (১৮৯১) এটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব।

    ১৮৮৯ সালে ভূপেন বসুর বাড়িতে যখন মোহনবাগানের জন্মমূহূর্তের সভা বসে, ভূপেন্দ্রনাথ তখন তিরিশ বছরের যুবক। বয়সে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে দু বছরের আর স্বামী বিবেকানন্দের থেকে চার বছরের বড়। কলকাতা হাইকোর্টের নথি বলছে, বছরখানেক বিবেকানন্দ মানে নরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ভূপেন্দ্রনাথ বসু দুজনে নিমাইচরণ বসুর এজলাসে আর্টিকেল ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতেন। সময়টা সম্ভবত ১৮৮১। নিমাইচরণ বসু সেযুগের একজন মহানুভব ব‍্যক্তিত্ব। জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমারের বংশপরিচয় ষষ্ঠ খন্ডে তাঁর কথা পড়লাম। নরেন্দ্রের বাবা বিশ্বনাথ দত্তও নামী অ্যাটর্নি ছিলেন। ১৮৮০ তে নরেন্দ্রনাথ কেশব সেনের ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন এবং ধর্মালোচনা ও ব্রহ্মসঙ্গীতের সুবাদে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। তবে ১৮৮১ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার পরে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এজলাসে আইনের কাজ শেখাতেও অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তবে লেখাপড়া চলছিল, ১৮৮৪ সালে যে বছর তিনি বিএ পাশ করলেন, ঐ বছরই বাবা বিশ্বনাথ দত্তের তিরোধান হয়। তবে আজন্ম খেলাধূলা প্রিয় বিবেকানন্দ যে ফুটবল ভোলেন নি, তার পরিচয় পাওয়া যায় সাধন জীবনে বিভিন্ন বক্তৃতায়। ১৮৮৯ তে যখন মোহনবাগানের জন্ম হয়, বিবেকানন্দ তখন দেশকে চিনতে ভারত পরিভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন। একথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে জাগে, ১৮৯৭ তে কলকাতায় ফেরার পরে নিশ্চয়ই এই দলের কথা তাঁর গোচরে আসে। ১৮৯৩ এ বম্বে থেকে তিনি শিকাগো ধর্ম মহাসভায় যান এবং বিশ্বজয় করেন। ১৮৯৮ সালে বিনয়কৃষ্ণ দেবের সভাপতিত্বে শোভাবাজার রাজবাড়িতে তাঁকে যখন সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সেই বক্তৃতাতেও তিনি ফুটবলের উল্লেখ করেছিলেন। কেশব সেনের সঙ্গে যেমন বিবেকানন্দের যোগ আছে, তেমন তাঁর সঙ্গে মোহনবাগানও অদ্ভুত একটা সূত্রে জুড়ে আছে, পরে যথাসময়ে বলব। ১৮৯৮ এ বিবেকানন্দের সংবর্ধনার পরের বছরে মানে ১৮৯৯ সালে কলকাতায় ভয়াবহ ভাবে বিউবোনিক প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। আর রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে ভগিনী নিবেদিতা, চিকিৎসক রাধাগোবিন্দ কর মানে আর জি কর সেই প্লেগের বিরুদ্ধে জীবন পণ করে যুদ্ধে নামেন। এই কাজেও সাতাশ বছরের যুবতী বধূ কুমুদিনী (মায়ের ঠাকুমা) ভগিনী নিবেদিতার সহযোগী হয়ে বস্তিতে বস্তিতে পরিচ্ছন্নতা আর স্বাস্থ্যরক্ষার লড়াই শুরু করেন। আসলে একাজে বেশ কিছু আলোকপ্রাপ্ত মহিলা এগিয়ে এসেছিলেন, কারণ অন্দরমহলে পুরুষদের প্রবেশাধিকার ছিলনা। কিন্তু যাদের জন্য করা, তারা সহজে মেনে নেয় নি। রাগের মাথায় লোকে মাথায় গায়ে ময়লা ঢেলে দিয়েছে এমনও হয়েছে। সেই ময়লাই ঝুড়ি করে তাঁরা মাথায় তুলে নিয়ে, আবার জনসচেতনতার কাজে নেমেছেন। আমার মামাতো দিদি মানে বাবলিদি বলে আমার দাদু বিকাশ বোস খুব গর্বের সঙ্গে এসব কাহিনী ওদের শোনাতেন। আমি তো দাদুকে দেখিনি। আমার জন্মের আগের বছর তিনি মারা যান। অন্তর্জালে বিবেকানন্দের প্লেগ ম‍্যানিফেস্টো পড়ে আমি অবাক হয়ে গেছি। প্রথম অংশটুকু বাদ দিয়ে পড়লে, যে কেউ ভাববে ওটা করোনার জন্য লেখা হয়েছে। একথা এখানে উল্লেখ করলাম, তার কারণ নিজের পারিবারিক ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে চোখের সামনে খুলে গেছে কলকাতার বা বাংলার অদেখা অধ‍্যায়। মহামারী অতীতে বারবার আক্রমণ করেছে, কখনো প্লেগ, তো কখনো ম‍্যালেরিয়া, কলেরা বা স্প‍্যানিশ ফ্লু - নানা রূপে। কিন্তু জাতির জীবনসংগ্রাম থেমে থাকেনি। ১৩২ বছরের মোহনবাগান, ১৩০ বছরের মহমেডান স্পোর্টিং আর ১০০ বছরের ইস্টবেঙ্গল ও অনেক মহামারী বা অন্যান্য বিপর্যয় পেরিয়ে এখনো তাদের যাত্রা অব‍্যাহত রেখেছে। তাই করোনা অধ‍্যায়ও তারা জয় করতে পারবে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৩ আগস্ট ২০২১ | ১০৯৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন