দ্বিতীয় পর্ব
(১) কুন্দনন্দিনীর কথা ১লা এপ্রিল, রবিবার, সকাল ৬টা
বিলাসপুর সেন্ট্রাল জেল। দুটো রাত কেটে গেছে। ঘুম হয় নি। দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে ছিলাম। দিদি আমার কাঁধে মাথা রেখে একটু ঝিম মেরে রয়েছিল। আমরা খুনি নই, নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখেছি -- এটা সত্যি না ব্যাড ড্রিম। আনফরচুনেটলি সত্যি। একেবারে কাফকা মার্কা। পিজি ক্লাসে কাফকার ‘দি ট্রায়াল’ পড়াই। কখনও ভেবেছি এইরকম কাফকেস্ক অভিজ্ঞতা আমাদের দু’বোনের কপালে জুটবে? আমরা দুই বোন, সংস্কৃত সাহিত্য ও ইংলিশ লিটারেচারে ডক্টরেট, তাও শান্তিনিকেতন থেকে — আমরা আজ ছত্তিশগড়ের জেলে আন্ডার ট্রায়াল প্রিজনারদের সেকশনে বন্দী! খুনের দায়ে, ভাবা যায়? আমাদের মোবাইল পর্য্যন্ত চালাকি করে বুড়ারে সেই মোটা মত লোকটা পরীক্ষা করার অজুহাতে সীজ করে নিয়েছে।
আমরা বন্দী; আমরা নাকি খুনী? আমাদের বোকা বানিয়ে যা খুশি প্রশ্ন করে সাইন করিয়ে শেষে এই দশা! সুমন্ত্রকে মেসেজ করতে পারছি না। ও সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, আমিই না করেছিলাম। ভুল করেছিলাম, মহাভুল। ও সঙ্গে থাকলে এভাবে ফাঁসাতে পারত না। ভুল একটা নয়, অনেকগুলো; একের পর এক। নিমন্ত্রণ চিঠিতে কোন ফোন নাম্বার বা ইমেইল আইডি ছিল না। কোন ভেরিফিকেশন করা যায় নি। এখন মনে হচ্ছে ওই চিঠিটা একটা ফাঁদ। কিন্তু কে পাতল? কার লাভ? যেই হোক সে আমাদের নাড়িনক্ষত্র জানে। আচ্ছা, আমরা এত সোজা একটা ফাঁদে পা দিলাম কেন? দশ বছর আগের সেই অপমানের পর সব কি চুকেবুকে যায়নি? তাহলে কি সেই ঘটনাই একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল? টোপ? কুইন’স গ্যামবিট?
পরশুদিন শুক্রবার যখন বিলাসপুর পৌঁছে ছিলাম তখন সূর্য ডুবলেও আকাশে লালচে আভা। সিটি সুপারিন্ডেন্ট অফ পুলিসের অফিসের গায়ে লাগা সিভিল লাইন্স থানায় আমাদের অ্যারেস্টের ওয়ারেন্ট বানিয়ে সাইন করাল। আমাদের নাকি ৩০ তারিখ সন্ধ্যে সাতটায় বিলাসপুরে গ্রেফতার করেছে। রাগে হাড়পিত্তি জ্বলে গেল। বললাম-সাইন করব না। ইজ ইট আ জোক? সকাল বেলায় বুড়ারে যে আমাদের গ্রেফতার করছি বলে গাড়িতে তুললেন?
ভুঁড়িওলা লোকটা নির্বিকার। এসপি’র মুখে ফিচেলমত মিচকি হাসি। বললেন - ভুল শুনেছেন, হাতকড়ি লাগাইনি তো। তখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে আনা হয়েছিল। এখন গ্রেফতার করা হচ্ছে। বলে উনি পাশের কেবিনে চলে গেলেন।
হলঘরে টেবিলে বসে যে বুড়ো মুন্সি আমাদের কাগজ তৈরি করছিল সে বলল - সাইন করে দিন; তারপর গরম কড়িমিঠি চা আর সামোসা আসছে। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। জিদ করে লাভ নেই। দেখুন বহেনজী, চাক্কু খরমুজা পর গিরে ইয়া খরমুজা চাক্কু পর, কাটনা তো খরমুজা কো হী!
তরমুজের গায়ে চাকুর ঘা বা চাকুর গায়ে তরমুজের হামলে পড়া, ফল তো একই — কাটা পড়বে তরমুজই।
দিদি আমার দিকে তাকাল, আমরা দুজনেই সাইন করলাম। চা খাওয়ার পর কালো বর্ডারের শাড়ি ও ব্লাউজ পরা দু’জন মহিলা সেপাই আমাদের নিয়ে একটা কালো গাড়িতে তুলে পাশে চেপে বসল। ওদের হাতে খেটো লাঠি। আমাদের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে মেডিক্যাল চেক আপ করানো হল, তাতে অসব্যের মত শরীরের তল্লাসি ছাড়াও শরীরে কোন চোট, জন্মদাগ জড়ুল এবং মদ খেয়েছি কিনা — সব লেখা হল। তারপর ফের থানায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে লক আপে ঠেসে দেওয়ার পর ওই দুই চেড়িকে জিজ্ঞেস করলাম বাথরুম যাব, তলপেটে চাপ বেড়েছে। ওরা লক আপের কোণায় একটা মাটির পাতিল ও বালতি এবং কিছু বালি দেখিয়ে দিল। বলল, রাত্তিরে বেরোনো চলবে না। ওতেই কাম চালিয়ে নাও। আমি অবাক। আবার বলায় শুনতে হল - আমি কি বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে এসেছি? খুন করার সময় মনে ছিল না? বড়লোকি চাল তোর পেয়ারের আদমির কাছে দেখাস গে!
পরের দিন সকালে চা ভাজিয়া আর পাঁউরুটি খাইয়ে কোর্টে নিয়ে গেল। বারান্দা পেরিয়ে একটা ঘরের সামনে খুব ভীড়। আমাদের বাইরে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে রাখল অনেকক্ষণ, দু’পাশে বেঁটে লাঠি হাতে দুই রাবণের চেড়ি। দরজার উপরে একটা ছোট বোর্ডে সাদায় কালো দিয়ে লেখা পূর্ণিমা শ্রীবাস্তব, ম্যাজিস্ট্রেট, প্রথমশ্রেণী।
মহিলা জজ, নির্ঘাৎ বেইল দেবে।
চারদিকে লোকজন আর শকুনের মত কালো কোট পরা উকিলের দল ঢুকছে বেরোচ্ছে। কখনও কখনও পেশকার বেরিয়ে এসে খুব জোরে হাঁক পাড়ছে — সুমিত্রা বাঈ, রামখিলাওন, গণেশী বাঈ বগেরহ-হ-হ-অ! অমনি কিছু লোক যারা বেঞ্চিতে বা বারান্দায় ফরাসে বসে ছিল, তড়বড়িয়ে ওঠে ভেতরে চলে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ পরে বুঝলাম আমাদের ব্যাপারটা বেশ চাউর হয়ে গেছে। লোকজন এবং কিছু উকিল এসে উঁকি দিয়ে দেখে ফিসফিসিয়ে কিছু না কিছু বলে যাচ্ছে। একবার কানে এল - হাতকড়ি লাগায়নি যে! পালাবে না? শুনিস নি, দুটো বোন একই মর্দের সঙ্গে!
কেউ ফোড়ন কাটল — আখির বঙ্গালি হ্যায় না! এরা সব পারে। লাজ-লজ্জা নেইকো! আজ যাকে অমুকদা তমুক দা বলে ডাকছে দেখবি কল উসীকে গলে মেঁ হার ডাল দে রহী; ছি ! ছি!
ভাবি, আমরা নির্লজ্জ? আজ যাকে অমুকদা তমুকদা বলি কাল তার গলায় মালা দিই? খিদেটা চাগিয়ে উঠেছে। একজন সেপাই গিয়ে কাঁচের গেলাসে করে চা নিয়ে এল, দুই মহিলা পুলিশ ও আমাদের জন্যে। গোটা কয়েক চুমুক দিয়েছি কি কানে এল পেশকার ডাকছে -- সরকার বনাম সুবালিনী কুন্দালিনী — ঈ-ঈ-! মহিলা পুলিশ দু’জন তড়বড়িয়ে উঠে বলল - চলিয়ে, আপলোগো কা পুকার হো গয়া!
আগে কখনও আদালতে যাই নি। একেবারে হিন্দি সিনেমার মত কাঠের বেড়া দিয়ে বিচারকের জায়গা পার্টিশন করা। মহিলা জজ একটু উঁচুতে কাঠের পাটাতনের উপর চেয়ারে বসে পাশে টাইপিস্টকে নীচু গলায় ডিক্টেশন দিচ্ছেন। সামনে কয়েকজন উকিল ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে। দরজার কাছে দেয়াল ঘেঁষে কিছু আলমারি। তার সামনে তিনজন ক্লার্ক একগাদা ফাইল নিয়ে বসে আছে। আমাদের ওদের পাশে খানিক দাঁড়াতে বলে একজন কালো কোট আর কালকের থানার সেকন্ড অফিসার কীসব বলাবলি করতে লাগল।
ডিক্টেশন দেয়া শেষ করে মহিলাটি আমাদের সঙ্গের পুলিশ অফিসারদের দিকে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন। অফিসার একবার মাথা ঝুঁকিয়ে বাও করে আমাদের ইশারা করল। ব্যাস্, দুই চেড়ি আমাদের ঠেলতে ঠেলতে একটা কাঠগড়া মতন, তার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে বলল। মহিলাটি সরকারি উকিলকে বললেন - এরাই সেই?
হ্যাঁ, হুজুর! দুই বোন।
- বেশ, আপনি রেডি? আচ্ছা, এদের উকিল।
-- নেই, কিন্তু সরকারের নিয়মে একজন নতুন প্যানেল ল’ইয়ার দামলে দাঁড়াচ্ছে।
সরকারি উকিল আমাদের নাম জিজ্ঞেস করে জজের সামনে ওয়ারেন্ট, এফআইআরের কপি, মেডিক্যাল রিপোর্ট সব পেশ করল। তারপর বলল, তদন্ত এখনও প্রাথমিক পর্য্যায়ে। জামিনের প্রশ্ন নেই। তদন্তের স্বার্থে আরও ইন্টারোগেশনের জন্যে সাতদিনের পুলিশ কাস্টডি চাইছি।
কালো কোট পরা একটা বাচ্চা মত ছেলে নার্ভাস মুখ করে আমাদের কাঠগড়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সরকারি উকিল তার দিকে তাকাতেই ও পাখিপড়ার মত গড় গড় করে বলল — ঘটনাস্থলে আরও লোকজন ছিল। ছোরাতে কার হাতের ছাপ তার ফরেনসিক রিপোর্ট আসে নি। এঁরা মহিলা, তায় সরকারি গেজেটেড অফিসার। পালাবার প্রশ্নই নেই। এদের অবিলম্বে জামিন দেওয়া হোক।
হরি হরি! এই বাচ্চাটা মিঃ দামলে? আমাদের ডিফেন্স ল’ইয়ার! সরকারের খরচায়।
কিন্তু ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই মহিলা জজটি বললেন — ভেরি সিরিয়াস চার্জ, বেইল রিজেক্টেড। বাট নো নীড অফ পুলিস কাস্টডি। জেল কাস্টডি ফর সেভেন ডেজ। পুলিশ জেলে গিয়ে জেরা করুক। আসামীরা বেইলের জন্যে সোমবার নিয়মানুসার সেশন্স কোর্টে আবেদন করতে পারে। হ্যান্ডকাফ লাগাতে হবে না।
আমরা দমে গেলাম। মহিলা জজ তো আমাদের নিতবর মার্কা উকিলের আর্গুমেন্ট ভাল করে শুনলেনই না! দিদির যেন বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমাদের এখন জেলে পুরবে।
আমার মুখে একটা বিস্বাদ বোদা অনুভূতি। আবার কালো ডগগা, এবার বিলাসপুর সেন্ট্রাল জেল।
জেলের অফিসের নিওনবাতির নীলচে আভার জোনটুকু ছাড়িয়ে ঘটাং ঘট চারটে লোহার দরজা পেরিয়ে একটা লম্বামত ব্যারাক বিল্ডিং; বড় একটা সাইনবোরড, হিন্দিতে গোটা গোটা করে লেখা - ‘বিচারাধীন বন্দী বিভাগ’, তার নীচে ছোট করে ‘মহিলা প্রকোষ্ঠ’।
দিদি আর আমাকে একই রকম আকাশী রঙা সালোয়ার কুর্তা আর হাওয়াই চটি পরিয়ে একটা কামরায় ঢুকিয়ে দিল। তাতে খালি আমরা দু’জন। একটা কম্বল পাতা, আর একটা গায়ে দেবার। এই কম্বলগুলো আগে কারা গায় দিয়েছে কে জানে? কেমন স্যাঁতসেঁতে সোঁদা গন্ধ। উকুন আছে কিনা কে জানে? মরেচে, এই সময়ও আমি উকুনের চিন্তায় মাথা ঘামাচ্ছি! শান্তিনিকেতনে একবার একজনের থেকে মাথায় উকুন এসেছিল, সেকী হ্যাপা! অনেক কষ্টে ছাড়ান পেয়েছিলাম, আর না!
রাত্তিরে চারটে রুটি আর কুঁদরু না কি যেন বলে তার আধভাজা তরকারি আর একবাটি ট্যালটেলে ডাল দিয়েছিল। একেবারে সন্ধ্যের মাথায়, সাতটা বেজেছিল বোধহয়। খেতে পারি নি। একটু চা পেলে ভাল লাগত। কিন্তু সেটা নাকি পরের দিন সকাল আটটার আগে পাওয়া যাবে না। আচ্ছা, গল্পের বইয়ে যে পড়ি জেলের মধ্যে টাকা খরচ করলে মনপসন্দ খাবার, সিগ্রেট, মদ সবই পাওয়া যায়! চায়ের জন্যে মাথা ফেটে যাচ্ছিল, কিছু চেষ্টা যে করব তার উপায় নেই। পার্স জামাকাপড় সব জেলারের অফিসে জমা নিয়ে নিয়েছে, এন্ট্রি করে সাইন করিয়েছে। তার আগে ফের একবার নমো নমো মেডিক্যাল চেক আপ।
জেলের দোরগোড়ায় সেই দামলে উকিল এসে লজ্জা লজ্জা মুখ করে হাত কচলাতে লাগল। বলল, কাল রবিবার, কোর্ট বন্ধ। তাই সোমবার সকাল দশটার মধ্যে ও সেশন জজ মিঃ খারে’র কোর্টে দরখাস্ত দেবে। এবার জামিন হওয়ার চান্স খুব বেশি।
আমি কোন উত্তর দিলাম না। দিদি জিজ্ঞেস করল - ফী কত দিতে হবে?
দামলে জিভ কেটে জানাল ও সরকারের লীগাল হেল্প সেন্টারের প্যানেল অ্যডভোকেট। এ যাত্রায় কোন পয়সা লাগবে না। তবে সোমবার জামিন পেয়ে গেলে জামিনদারের কিছু খরচ আছে। তার উপরে দিদিরা যদি খুশি হয়ে কিছু দিতে চান সেটা ছোটভাই মাথায় ছুঁইয়ে গ্রহণ করবে।
- জামিনদারের খরচটা কী?
-- বুঝিয়ে দিচ্ছি। জামিন হলে জজ সাহেব বলবে অত হাজার বা অত লক্ষ টাকার বন্ড। তখন আপনাদের জামিনদার হিসেবে কাউকে কোর্টে তার সম্পত্তির কোন কাগজ, সাধারণতঃ বাড়ি বা জমির, পেশ করতে হবে যার মূল্য জামিনের টাকার থেকে বেশি। অর্থাৎ আপনারা যদি ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান বা বেইল জাম্প করেন তখন আদালত জামিনদারের থেকে অত টাকা আদায় করবে, না দিতে পারলে ওই জমি বা বাড়ি বাজেয়াপ্ত হবে, এই আর কি!
দিদির চোখ বড় বড়, চেহারায় মেঘ ঘনায়। বলে এই অচেনা শহরে আমাদের জন্য কে জামিনদার হবে? কে তার সম্পত্তির কাগজ নিয়ে সোমবার কোর্টে আসবে? আর আমাদের কাছে টাকা কোথায়?
-- হ্যাঁ দিদি। আপনারা তো তৈরি হয়ে আসেন নি।
আমার কোথাও একটা তার ছিঁড়ে যায়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলি — সত্যিই তো, আসার আগে কি জানতাম যে খুন করব, গ্রেফতার হব, জেলে যাব?
দামলের গলার স্বর নরম হয়।
-- আমি আপনাদের অবস্থা বুঝতে পারছি দিদি, বিশ্বাস করি না আপনারা অমন কাজ করেছেন। আমি সোমবার সেশন্স কোর্টে খুব চেষ্টা করব।
-- ঘোড়ার ডিম করবে। আজ কোর্টে যা আগড়ম বাগড়ম বকেছ তাই তো সেদিনও বলবে। আজ জামিন হয়নি, সেদিনও হবে না। কোন নতুন কথা তো নয়। তোমার প্র্যাকটিস কত বছরের?
দামলে উকিলের চেহারা পালটে যায়।
-- একটা কথা বলি দিদি? আমি জোর দেব যে প্রসিকিউশন কেস ডায়েরিটা আদালতে পেশ করুক। আর আমার কাছে নতুন তথ্য আছে। এরমধ্যে ছোরার ফরেন্সিক রিপোর্ট এসে গেছে। কিছু পয়সা খরচ করেছি যাতে আজ রাতে আগাম একটা কপি পেয়ে যাই। তবে একটা কথা, ডাক্তার উকিল আর গুরুঠাকুরের কাছে কিছু লুকোতে নেই। আপনারা ড্যাগারে হাত দেন নি তো? কিছু না ভেবে? ক্ষণিক উত্তেজনায়?
আমরা দুই বোন প্রাণপণে মাথা নাড়ি।
দামলের মুখ উজ্বল হয়ে যায়।
- বাঁচালেন দিদি। আমি শিওর - সোমবার আপনাদের বেইল হয়ে যাবে। ইন্ডিয়ান ক্রিমিনাল জুরিস্প্রুডেন্স অনুযায়ী presumption of innocence is with the accused person except proven otherwise।
দিদি এই সদ্য গোঁফ গজানো ছেলেটার মুখে আচমকা ইংরেজি শুনে চমকে ওঠে। আমার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়।
Listen dear! We are not going to be impressed by your legal blah blah! Tell us something concrete about your strategy and that too in common parley.
- সরি দিদি। আপনারা আমাকে ভুল বুঝেছেন। আপনি কলেজে ইংরেজি পড়ান, আপনাকে কী ইম্প্রেস করবো? সোজা কথায় বললে ভারতীয় আইনে যতক্ষণ না কাউকে অপরাধী প্রমাণ করা হচ্ছে ততক্ষণ সবাইকে নির্দোষ ধরে নিতে হবে। তাই সরকারের বা পুলিশের উকিলের দায়িত্ব প্রমাণ করা যে আপনারা অপরাধী বা আপনাদের অপরাধী মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু আমার মানে ডিফেন্সের দায়িত্ব একটু কম। অর্থাৎ প্রাথমিক অবস্থায় আপনাদের নির্দোষ প্রমাণ না করে যদি প্রসিকিউশনের থিওরিতে কিছু ভাইটাল ছ্যাঁদা করে দিতে পারি তাহলেই যথেষ্ট।
আমার বুক ঢিপ ঢিপ করে। এ কীসব বলছে! কোত্থেকে পাশ করেছে?
আমার মনের ভাব কি মুখে ফুটে উঠেছিল?
ও যেন সেটা আন্দাজ করে বলল - দিদি, আমি কিন্ত রায়পুরের বড় ল’ কলেজ থেকে পাঁচ বছরের কোর্স করেছি এবং ন্যাশনাল মুট কোর্ট কম্পিটিশনে দু’বছর আগের চ্যাম্পিয়ন, দিল্লিকে হারিয়ে। মানছি, এটা আমার প্রথম কেস, কিন্তু সোমবার দেখবেন। আপনাদের আশীর্বাদে এই কেস থেকেই আমার সিক্কা জম জায়েগা। যাকে বলে যাত্রা হোল শুরু।
*******
শৈবলিনী ২রা এপ্রিল, সোমবার, সকাল ৯.৩০
কিছুই মাথায় ঢুকছে না। গতকাল ছিল ১লা এপ্রিল, দামলে বলে গোবৎসটি আমাদের কীসব বলে গেল — এপ্রিল ফুল বানিয়ে দিল না তো! আগড়ম বাগড়ম বকে আরও কিছু টাকা খিঁচে নেওয়ার ধান্ধা। অবশ্যি সোজাসুজি চায় নি। বলেছে জামিন হলে খুশি হয়ে যদি কিছু দিই।
এর মধ্যে চালাকি আছে। আমরা নির্দোষ, কাজেই সেশন্স জজ যখন পুরো ব্যাপারটা ভাল করে শুনবেন তখন এমনিই জামিন দেবেন। আরে বাবা, আমরা তো পালিয়ে যাচ্ছিনে, তদন্তে সহযোগিতা করছি। তাহলে? ব্যস্ সহজে জামিন হয়ে যাবে। আর তখন ব্যাটা দেঁতো হাসি হেসে হাত পেতে দাঁড়াবে। হুঁঃ, ঝড়ে বক মরে আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে। সে যাই হোক, এখান থেকে ছাড়া পেলে বাঁচি। আর উকিল ছেলেটাকে কিছু টাকাকড়ি দিয়ে বলতে হবে আমাদের দুই কলেজে দুটো টেলিগ্রাম করে দিতে — ছুটি বাড়ানোর জন্যে।
ধ্যাৎ, জামিন হয়ে গেলে মোবাইল নিশ্চয় ফেরত দেবে, তখন আমরা নিজেরাই প্রিন্সিপালকে শরীর খারাপের কথা জানিয়ে ছুটির ব্যাপারটা পাকা করে নেব। এখন এখান থেকে বেরোতে পারলে হয়। জেলে ঢোকার পর রোজ সকালে বিষ্ণুর ষোড়শ নাম জপ করছি — ‘ঔষধে চিন্তয়েৎ বিষ্ণু ভোজনে চ জনার্দনম্--’। আমি জানি ‘ষোড়শৈতানি নামানি প্রাতরুত্থায় যঃ পঠ্যতে, সর্বপাপং বিনির্মুক্তঃ বিষ্ণুলোকং সঃ গচ্ছতে’। সকালে উঠে ওই ষোল নাম নিলে একটা ম্যাজিক হবেই। আমাদের এখন একটা ম্যাজিক দরকার।
এখানকার খাবার,, মশা, ছারপোকা ভরা কম্বল ছাড়াও সকালে বালতি মাজা ও পাবলিক টয়লেট পরিষ্কার করার ডিউটি; আর পোষাচ্ছে না। মেয়েগুলো তামাক চিবিয়ে দেয়ালে পিক ফেলে! ম্যাগো! গা গুলিয়ে ওঠে। ছোট বলছে দিদি তুই খালি জল ঢেলে দে, আমি ঝ্যাঁটা ধরছি। তাহোক, দুদিনেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।
মনে হয়, আজ আমার প্রার্থনা ঠাকুর শুনবেন। আমার পরীক্ষা অনেক নিয়েছেন। এবার ছাড়ান দিন।
**********
বিলাসপুর, সেশন্স কোর্ট ২রা এপ্রিল, সকাল ১১.৩০
এবার এক মাঝবয়েসি টেকো বিচারক, কিন্তু ভুঁড়ি আছে। এদের বিশ্বাস নেই। বুড়ারে একটা ভুঁড়িওলা সাদাপোষাকের গোয়েন্দা বড্ড বোকা বানিয়েছে।
আমরা দু’বোন জাজের ডান হাতের দিকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। সবাই আমাদের দেখছে। হঠাৎ একটা ভয় আমার শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দিল। যদি আজ জামিন না হয়? নাহলে আবার সেই নোংরা জেলের খুপরি, সেই অখাদ্য খাবার আর ছারপোকাওলা কম্বল। কিন্তু তারচেয়ে বড় ভয় হল নরেন্দ্র, আমার ছেলে যে ছোটুকে মা বলে জানে — ওকে কী বলে প্রবোধ দেওয়া যাবে? কেন মাসি আর মাকে দেখা যাচ্ছে না? কোথায় গেছে ওরা? সুমন্ত্র কী ভাবে সামলাবে?
আর যদি আমাদের জেলে থাকতে হয় এই খুনের চার্জে, তাহলে আমার আর বোনের সরকারি চাকরি, তার কী হবে? আগে তো সাসপেন্ড করে দেবে। এখনও জানে না বোধহয়। কিন্তু জামিন না হলে জানতে পারবে? আর ভাবতে পারছি না। আজকে আমার সবচেয়ে বেশি ঠাকুরকে দরকার। একটা গানের কলি, মাথার মধ্যে গুনগুন করছে — মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান!
আরে! ওই নতুন গোঁফওঠা আমাদের উকিল ইংরেজিতে আর্গুমেন্ট করছে? না,না; জজসায়েবকে কিছু রুল বুক নাকি আইন শেখাচ্ছে। মরেছে, জজকে কখনও আইন শেখাতে আছে?
ও বলছে - The general principle requires the Court to presume the innocence of the accused until proven otherwise and it is upon the prosecution to establish the guilt of the accused. এখন অব্দি প্রসিকিউশন মার্ডারের সঙ্গে মাত্র কিছু সারকামস্ট্যনাশিয়াল এভিডেন্স দেখিয়েছে। কেস ডায়েরি দেখুন হুজুর। আর যে ছোরাটা দিয়ে দুইবোনকে মার্ডারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে সেই ছোরাটার মালিক কে? প্রসিকিউশন দেখাতে পারেনি যে ওটার মালিক ওই দুই বোন। আর ছোরাটায় কার হাতের ছাপ? হুজুর, প্রসিকিউশন কেন ফরেনসিক রিপোর্ট আপনার সামনে পেশ করছে না?
সরকারি উকিল কি একটু ভ্যাবাচাকা? না বোধহয়। ও হিন্দিতে বলছে - প্রিসাম্পশন অফ ইনোসেন্সের ব্যতিক্রম বা এক্সেপশনও আছে। হুজু্র, আমি এভিডেন্স অ্যাক্ট সেকশন ১০৫ এর কথা বলছি। আমরা প্রাইমা ফেসাই দেখাতে পেরেছি যে অভিযুক্তরা রাত্তির ৮.৫০ থেকে মোটামুটি ৯.১০ পর্য্যন্ত নিহতের কাছে ছিল। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলছে মৃত্যু হয়েছে রাত ৮টা থেকে ৯.৩০ এর মধ্যে। হত্যায় ব্যবহৃত ছোরার গায়ে যে রক্ত লেগে আছে তা নিঃসন্দেহে নিহতের। রক্তাক্ত ছোরাটি পাওয়া গেছে অভিযুক্তদের একজনের ব্যাগের মধ্যে। কাজেই স্বাভাবিক অনুমান ছোরাটির মালিক অভিযুক্ত মহিলা। এবং সম্ভাব্য মোটিভ হল আগের অপমানের বদলা নেওয়া। এছাড়া আর কেউ সেই সময়ে নিহতের কাছাকাছি ছিলেন না। এখন মূল কেসের বিচার সাক্ষ্য এসব শুরু হচ্ছে না। তদন্তের প্রাথমিক স্তরে এইটুকু প্রমাণ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জ ফ্রেম করার জন্যে যথেষ্ট। ফলে এখন এভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা ১০৫ অনুযায়ী ‘প্রিসাম্পশন অফ ইনোসেন্স’ প্রাসঙ্গিক নয়। এখন অভিযুক্তদেরই প্রমাণ করতে হবে যে ওরা নির্দোষ এবং হত্যার কাছাকাছি সময়ে ওরা কেন নিহতের কাছে ছিল, কেন হত্যায় ব্যবহৃত হাতিয়ার ওদের কাছেই পাওয়া গেল - এসবের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ওদেরই দিতে হবে।
আমি তদন্তের সুবিধের জন্যে এদের জামিন দেওয়ার বিরোধিতা করছি।
এটুকু শোনার পর বিচারক বললেন — ঠিক কথা; প্রিলিমিনারিতে এতসব কাটাছেঁড়ার দরকার নেই। প্রসিকিউশনকে দেখাতে হবে যে এক, একটি হত্যা হয়েছে। দুই, হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র পাওয়া গেছে। তিন, অভিযুক্তদের এই হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার মোটিভ এবং সুযোগ সবচেয়ে বেশি। ব্যস্ এবং আমার মতে অভিযোজন পক্ষ সেটা দেখাতে সফল। তবু আমি রায় দেবার আগে ডিফেন্সের বক্তব্য শুনতে চাই।
আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। ভগবান, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?
কিন্তু এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে উঠেছে দামলে উকিল।
ইয়োর অনার! আমার কাছে ছোরার ফরেনসিক রিপোর্টের কপি আছে। তাতে দুই বোনের হাতের ছাপ নেই, বরং ছাপ রয়েছে জনৈক শান্তিরাম ওরাঁওয়ের, যে কিনা নিহতের ড্রাইভার; এই দেখুন!
এছাড়া লোকটি তার জবানবন্দী অনুযায়ী সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার পর থেকে হত্যার সম্ভাবিত সময় পর্য্যন্ত রাজোয়ারায় যুবরাজ সাহেবের কাছেই ছিল, ওষুধ ফল ও সরবত খাইয়েছিল - ও কেন প্রসিকিউশনের সন্দেহের তালিকায় নেই?
-- অবজেকশন! ছোরাটি ওই শান্তিরামই উদ্ধার করেছিল এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট উইটনেস কুমারসাহেব ও ডিটেক্টিভ এজেন্সির সৌরভ বিশ্বাসের সামনে টিস্যু পেপারে মুড়ে টেবিলে রেখেছিল। পুলিশ আসার পর তাদের সুপুর্দ করেছিল। তাহলে তার আঙুলের ছাপ না তো কি আমার তরুণ কলিগ দামলেজির ছাপ থাকবে?
কিন্তু দামলে আজ মা সরস্বতীর আশীর্বাদ পেয়েছে। ওকে থামায় কার সাধ্যি!
-- আমার মাননীয় সিনিয়র ভুল বুঝেছেন। প্রশ্ন এটা নয় - শান্তিরামের আঙুলের ছাপ ছোরাতে কী করে এল? আমার সহজ প্রশ্ন - অভিযুক্তদের কারও হাতের ছাপ হত্যায় প্রযুক্ত অস্ত্রে নেই কেন?
-- এর উত্তরও সহজ। হত্যাকারী আগেই ছোরাটির সব ছাপ ভাল করে মুছে দিয়েছে।
-- এবার আরও সহজ প্রশ্নঃ সব ছাপ ভাল করে মুছে দিলে তো রক্তের দাগও মুছে যাওয়ার কথা। সেটা কেন হয়নি? বা অন্যভাবে দেখলে রক্তের দাগ না মোছা গেলে কী ভাবে ছোরার গায়ে হাতের ছাপ মুছে ফেলা সম্ভব?
-- ইয়োর অনার! এগুলো প্রিলিমিনারির বিষয় নয়। এর জন্য এক্সপার্টকে অ্যাজ উইটনেস আদালতে ডাকতে হবে। সেসব রেগুলার হিয়ারিং এর সময় করলেই হবে। আজকে শুধু জামিনের উপর আর্গুমেন্ট হওয়া উচিত।
- হুজুর, মোবাইলের মেসেজের টাইম ৮.৫০ মিনিট। অভিযুক্ত বোনেরা সেই মেসেজ পাওয়ার আগে মন্দিরে বসে ছিল। এর ইন্ডিপেন্ডেন্ট সাক্ষী আছে-সৌরভ বিশ্বাস এবং মন্দিরের পূজারী। ওদের, সৌরভের ও অন্যান্য সাক্ষীর বয়ান থেকে আন্দাজ করা যায় যে অভিযুক্তরা রাজোয়ারায় প্রায় ৯টা থেকে ৯টা১০ অব্দি ছিল। এইটুকু সময়ের মধ্যে দুই মহিলা অমন দশাসই যুবরাজকে খুন করে ছোরা থেকে আঙুলের ছাপ মুছে ব্যাগে লুকিয়ে রেখে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এল — এটা আপনার ক্রেডিবল মনে হয়? যদি হয় তো বেইল অ্যাপ্লিকেশন রিজেক্ট করে আমাদের পিটিশন ডিসমিস করে দিন। খালি একটা কথা মাননীয় আদালতকে বলিঃ The Indian Judiciary has acknowledged presumption of Innocence within article 20 and 21 of the Constitution. In the landmark case of Maneka Gandhi, the presumption of innocence was observed as the fundamental right of the accused.
আমার আর কিছু বলার নেই।
বিচারক রায় দেওয়া মুলতুবি রেখে দুই উকিলকে লাঞ্চের পরে তাঁর চেম্বারে আসতে বললেন।
আমাদের আবার দুই চেড়ি এসে বারান্দায় বেঞ্চিতে বসিয়ে দিল।
************
কুন্দনন্দিনী বিলাসপুর, সেশন্স কোর্ট , ২রা এপ্রিল, বিকেল ৪টে
আবার ডাক পড়ল।
আমরা আবার কাঠগড়ায়; প্রত্যেকবার এখানে এসে দাঁড়াতে আমার বড় অপমান বোধ হয়। দুজন উকিল মঞ্চের পেছনে জজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল। দামলে উকিল আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। লক্ষণ ভাল ঠেকছে না।
একটু পরে পেশকার বলল উনি আসছেন। সবাই উঠে দাঁড়াল ।
ভুঁড়িওলা জজসাহেব একবার আমাদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, অভিযুক্তেরা শিক্ষাবিভাগের গেজেটেড অফিসার, কোন প্রিভিয়াস ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। আপাততঃ পঞ্চাশ হাজারের আলাদা আলাদা বন্ডে জামিন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শর্ত হোল, আগামী একমাসের ভিতর তদন্তের স্বার্থে ওরা বিলাসপুর শহর ছাড়তে পারবেনা। এবং পুলিশ যখনই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকবে তখন মহিলা থানায় বা এসপি অফিসে হাজির হতে হবে। ইনভেস্টিগেশনে ফুল কোঅপারেশন করতে হবে।
এবার জজ উকিলের দিকে তাকিয়ে বললেন - জামিনদার আছে?
দামলে উকিল মাথা হেলিয়ে - জী হ্যাঁ বলার সংগে সংগে দু’জন মাঝবয়েসি গেঁয়োলোক এগিয়ে এসে ওর হাতে দুটো জমির মালিকানার কাগজ বা রেভিনিউ বুক ধরিয়ে দিল। বিচারক সেগুলো একনজর দেখে পাশে বসা ক্লার্ককে ইশারা করলেন। ও দুটো বুকস এ খসখস করে কিছু লিখে তাতে কোর্টের মোহর লাগিয়ে দিল।
এবার ক্লার্কের ইশারায় আমরা কাঠগড়া থেকে নেমে বারান্দায় এলাম। আমার পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরেছে।
কানে আবছা ভেসে এল চাপরাশির চিৎকার - আলাউদ্দিন বনাম সাকিনা বী, ফৈজুদ্দিন বগেরহ---হ—হ!
দামলে উকিল এগিয়ে এল, মুখে একগাল হাসি।
-- আশীর্বাদ করুন দিদি। জামিন পেয়ে গেলেন তো! আমার তালিম দেখলেন? জীবনের প্রথম কেস, পরে যখন রেগুলার শুনানি হবে, অন্য কোন উকিল না নিয়ে আমাকেই রাখবেন। কোর্ট ফি ও টাইপিং খরচ বিনা একটা পয়সাও নেব না।
আমার মাথায় প্রশ্ন জেগেছে। ওই যে জামিনদার দু’জন ওদের কত করে যেন দিতে হবে? দামলে হাসে, ওসব ভাববেন না। ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
-- মানে? এখন আমরা মুক্ত, এখান থেকে বেরিয়ে যাব। তাহলে কখন ওদের পেমেন্ট করব?
-- দিদি, আজকে এই সব আদালতী প্রসিডিওর এর পর আছে জেলের প্রসিডিওর। আগে কোর্টের অর্ডার টাইপ হয়ে জেলারের কাছে পৌঁছবে, তাতে আজ রাত্তির বা কাল সকাল হয়ে যাবে। ফলে রেগুলেশন অনুযায়ী আপনাদের মেডিক্যাল করে রিলীজের কাগজপত্র তৈরি করে নিজেদের জিনিসপত্র ফেরত নিয়ে বাস্তবে চার দেয়ালের বাইরে আসতে আসতে কাল সকাল দশটা এগারোটা।
আমার কান্না পেয়ে গেল। ফের সেই কুটকুটে কম্বল! সেই মাটির পাতিল? আরও একটা রাত?
- চিন্তা করবেন না দিদি। ভগবানের নাম নিয়ে কোনরকমে আজকের রাতটা পার করে দিন। আমি সকাল নটা নাগাদ জেলারের অফিসে পৌঁছে যাব। দেখব, যাতে তাড়াতাড়ি ফর্ম্যালিটি নিপটে যায়।
কিন্তু তারপর? আমার মাথায় কিছু আসছে না। আবার যেন একটা পুরুষালি পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছি -- ক্যালভিন ক্লাইনের এর ‘অবসেশন’!
তবে দিদি কী যেন বলেছিল? ধাঁধার জট ছাড়িয়ে আর কাজ নেই, খুব শিক্ষে হয়েছে। প্রথমে সোজা রায়পুর, বাস-ট্রেন যা পাই, তারপর ক’দিন আরাম করে যে যার কাজে জয়েন করব। ও হ্যাঁ, সুমন্ত্রকে বলব - নরেন্দ্রকে নিয়ে এস। সবাই মিলে বারনয়াপারা টাইগার স্যাংচুয়ারি বেড়াতে যাব।
একী! দিদি দামলে উকিলকে বলছে — ভাই, অনেক করেছ। আরও একটু হেল্প কর। জামিন হয়েছে, লেকিন জজসাহেব বলেছেন আমরা অন্ততঃ একমাস যেন বিলাসপুরের বাইরে না যাই। তুমি আমাদের জন্যে কোন গেস্ট হাউসে বা ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেলে একটা ওয়ান বেডরুম, ডাবল অকুপ্যান্সি বুক করে দিতে পারবে? বেশি ভাড়া দিতে পারব না। একমাসের জন্য নিচ্ছি বললে একটু কমসম করতে পারে। বাথরুম কিন্তু অ্যাটাচড্ চাই। আর বিস্তরা অউর ঘর সাফসুথরা ক্লীন অউর টিপটাপ হোনা চাহিয়ে, ঠিক হ্যায়? অ্যাডভান্স দে দেনা। কল ছুটনেকে বাদ হম আপকে সারে হিসাব ক্লিয়ার কর দেঙ্গে।
-- হো জায়েগা দিদি; আপলোগ চিন্তা ন করেঁ।
*****
৩রা এপ্রিল, দুপুর সোয়া ১২টা
যাক, অবশেষে রেহাই পাওয়া গেল। ভুল বলছি, ঠিক রেহাই নয়, একরকম নজরবন্দী, তাই বা কম কী! একটু খুলে বলি।
দামলে ন’টার মধ্যে একটা মারুতি ভ্যান চালিয়ে এসে গেছল, কিন্তু ফর্ম্যালিটি পুরো হতে হতে সাড়ে এগার’টা। আমরা কয়েদির পোষাক ছেড়ে নিজেদের পুরনো জামাকাপড়ে ফিরে গেলাম। তারপর সোজা একটা এটিএম গিয়ে টাকা তুললাম। দামলেকে জামিনদারদের পয়সা দিয়ে বাড়ি ভাড়ার টাকা দিলাম একহাজার। কিন্তু ও বলল, দেড় হাজার দিন। ভালো বাড়ি এর কমে পেলাম না। আমি কথা না বাড়িয়ে দিয়ে দিলাম। গাড়ি চলল লিংক রোড ধরে, দ্রুত শহরের ভীড় আর ঘনবসতি এড়িয়ে রিং রোড নাম্বার ২তে পড়ল। একটা নতুন কলোনি, ফাঁকা ফাঁকা। সাদা রঙ করা দোতলা বাড়ি, সুন্দর বাগান, নতুন তৈরি মনে হচ্ছে। নিচের তলায় একটা অফিস, ছত্তিশগড় ট্যুরিজম, একটা ছোট বিউটি পার্লার। মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। আমরা ওর পেছন পেছন দোতলায় উঠে গেলাম। করিডরে একটা গ্রিলের গেট, তালাটা খোলা। দামলে বলল, দুটো ঘর, রান্নাঘর, একটা বাথরুম, ইন্ডিয়ান। ফার্নিশড, খাট বিছানা সোফা সেট, গ্যাস ওভেন - সবই আছে। মায় ওয়াশিং মেশিন ও মাইক্রোওয়েভ। এসি নেই, কিন্তু সব ঘরে উইন্ডো কুলার। আপনাদের কোন কষ্ট হবে না।
আমরা অবাক। ভেতরে গিয়ে সোফায় বসে পড়ি। দামলে সিলিং ফ্যান চালিয়ে দেয়। মাত্র দেড় হাজার টাকায় এমন অ্যাপার্টমেন্ট? আজকের বাজারে এর ভাড়া চার হাজারের কম হওয়ার কথা নয়। রায়পুর হলে দশ হাজার। দামলে কি ম্যাজিক জানে?
রান্নাঘরে ঠুং ঠাং আওয়াজ। ও কি রান্নার বা ঠিকে কাজের লোকও লাগিয়ে দিয়েছে? এত করতে ওকে কে বলেছে? নীল পর্দা নড়ে উঠল। এবার পর্দা সরিয়ে একটা ট্রেতে ধোঁয়া ওঠা তিনকাপ সাজিয়ে যে ড্রইং রুমে ঢুকল তাকে দেখে আমার হার্ট অ্যাটাক হবার দশা।
সৌরভ বিশ্বাস! রীতিমত দন্ত কেলাসিত।
ও এখানে কী করছে? এ আমরা কোথায় এলাম? ফুটন্ত কড়াই থেকে উনুনে? নতুন কোন ফাঁদ? আমাদের উকিল ছেলেটাও কি এদের সঙ্গে সাঁট করেছে? মাথা ঘুরছে। কিন্তু আমার আগে আরেকজনের মাথা খারাপ হল। আমার সাদাসিদে দিদি শৈবলিনী। সৌরভ কফি টেবিলে চায়ের ট্রে নামাতেই ও সোফা ছেড়ে সোজা গিয়ে ওর কলার চেপে ধরল।
-- তুই এখানে কী করছিস? বেইমান, নীচ! বেরিয়ে যা! এই মুহুর্তে! এটা আমার ঘর, আগাম ভাড়া গুণে দিয়েছি, তোর এখানে পা রাখার সাহস হল কী করে? দামলেজী! ইস কো নিকালো, আবভি নিকালোঁ।
- ছোড়িয়ে দেবীজি, ছোড় দীজিয়ে। উসকী কোঈ গলতি নহীঁ হ্যায়।
করিডোর দিয়ে ঢুকছে ওই ভুঁড়িওলা সাদাপোষাকের পুলিশ অফিসার, সৌরভ নামের খোচরের বস; হুঁঃ খোচরের আবার বস্! আমি গিয়ে দিদিকে টেনে এনে আগের জায়গায় বসিয়ে দিই। তারপর সৌরভকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ওর মালিককে প্রশ্ন করি।
- হোয়াটস হ্যাপেনিং হিয়র? এনাফ ইজ এনাফ! ইয়ু ও আস অ্যান এক্সপ্ল্যানেশন; ডোন্ট ইউ থিংক সো?
মিঃ কোসলে নামের ভুঁড়িওলার কি ইংরেজিতে কোন অসুবিধে আছে? নইলে অমন থতমত খেল কেন? হতেই পারে শ্যালক আইপিএস নয়, হাবিলদার থেকে পেছন ঘষটে ঘষটে ক্যারিয়ারের শেষে গিয়ে ডিএসপি হয়েছে।
-- আমি বুঝিয়ে বলছি। প্রথমে মাফ চাইছি, আপনাদের কষ্টের জন্য। কিন্তু কী করা যাবে? অন্য কোন রাস্তা খোলা ছিল না যে!
- মানে?
-- আপনাদের অ্যারেস্ট না করলে বোম্বাগড় রাজ্যের ভক্ত প্রজারা আপনাদের ছিঁড়ে খেত, মব লিঞ্চিং বোঝেন তো? ধরে নিন তার থেকে আপনাদের বাঁচিয়ে দিলাম।
-- তার মানে আপনি আমাদের খুনি ভাবেন না?
-- পাগল! আপনাদের মত বোকা মেয়েরা, মাফ করবেন, প্রেমে পড়তে পারে, কিন্তু এরকম কাঁচা খুন করতে পারে না।
ফুঁসে উঠল দিদি।
-- তাহলে এই সব নাটকের মানে কী ?
- ধরে নিন, প্রটেক্টিভ অ্যারেস্ট।
-- কার থেকে প্রটেকশন? জনতার থেকে, যারা বুড়ার থানার সামনে ফাঁসি দো! ফাঁসি দো! করছিল?
এটা আমার প্রশ্ন।
-- ওদের থেকে এবং খুনির থেকে।
-- খুনির থেকে? খুন তো হয়ে গেছে, যেই করুক। আবার খুনের কথা কেন?
- দেখুন, যে একটা খুন করেছে সে নিজেকে বাঁচাতে আরও করতে পারে। সেদিক দিয়ে দেখলে আপনাদের বাঁচাতে সবচেয়ে সেফ কৌশল হল আপনাদেরই খুনি বলে অ্যরেস্ট করা। তাহলে খুনি নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে, অসতর্ক হয়ে ভুল করবে।
-- আর এই বাড়িটা?
- এটা ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের। নীচের অফিস, দোকান, পার্লার – সবই ওদের।
-- তার মানে এখানে আমরা নজরবন্দী?
-- একরকম তাই। জামিন পেয়ে বাড়ি গেলে তারপরও আপনাদের উপর হামলার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমার পরামর্শে এখানে রাখলে আপনারা নিরাপদ, চারদিকে সাদা পোষাকের পুলিশের পাহারা। আর খুনি ভাববে আমরা আপনাদের বিরুদ্ধেই প্রমাণ জোটাতে ব্যস্ত।
-- আপনারা জানেন খুনি কে?
-- ঠিক সেভাবে জানি না, আবার কিছুটা জানি। আপনারা এখানে আছেন আমার অনুরোধে এবং এসপি সাহেবের সম্মতিতে। তাই নিশ্চিন্তে সময় কাটান, একমাস লাগবে না। তার আগেই কেস সল্ভ হয়ে যাবে। সবটা এখন তদন্তের স্বার্থে ডিসক্লোজড করা যাবে না। মাঝে মাঝে এখানে এসেই পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। প্লীজ, রেগে না গিয়ে কোঅপারেট করবেন।
ওরা চলে গেল।
না, এ’রকম জামিন পেয়ে কোন আনন্দ হচ্ছে না। বিকেলে মাথা ঠান্ডা হলে সুমন্ত্রকে ফোন করব। ও একবার আসুক। এই সাদাপোষাক খাকিপোষাক সবার সঙ্গে কথা বলে আমাদের বলুক -কার কথা বিশ্বাস করব? আর কতটুকু?
আমার মনে পড়ছে কবি এমার্সনের ‘ব্রহ্ম’ কবিতার ক’টি লাইনঃ
If the red slayer think he slays,
Or if the slain think he is slain,
They know not well the subtle ways
I keep, and pass, and turn again.
জমে ক্ষীর। অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বের।
চমৎকার সাসপেন্স জমেছে
ওহ বেশ জমেছে এবার। এটা অনেক বেশি আঁটোসাঁটোও হয়েছে। অপেক্ষায়...
রঞ্জনদা, নরেন্দ্র কেন শৈবলিনীকে 'বড়মাসি' বলে ডাকে? উনি তো ওর একমাত্র মাসি। আমার মনে এমনি সব আজগুবি প্রশ্ন আসে, কিছু মনে করবেন না কেমন?
সত্যিই এই পর্বটা এখনও পর্যন্ত সব সেরা। একবারমাত্র সুমন্ত্র আর সুমন্ত গুলিয়েছে। তা সেটা কিছুনা। ভালো লাগছে সৌরভ, দামলে -- এইসব সাধারণ রূপে বুদ্ধিদীপ্ত নতুন প্রজন্মের উপস্থিতি।
কিন্তু আমি মনে হয় বুঝে গেছি কে এবং কেন।
দেখা যাক মেলে কিনা।
কেকে
আরে মনে করব কেন? এটা জেনুইন স্লিপ। যেমন সুমন্ত ও সুমন্ত্র। শুধরে নিচ্ছি। বুড়ো হয়েছি, পদে পদে ভুল হয়। দেখিয়ে দিলে খুশি হব।
দারুণ হচ্ছে রঞ্জনদা। এবারের পর্ব খুব জমাটি হয়েছে।
ভালো লাগছে পড়তে ..
রোমহর্ষক! উড়ুক