জন গ্রীণ এক জায়গায় লিখেছিলেন “অনেক পর্যটক মনে করে যে আমষ্টারডাম পাপের শহর। কিন্তু আসল সত্যি এই যে আমষ্টারডাম এক প্রকৃত স্বাধীনতার শহর – এবং এই স্বাধীনতার মধ্যেই অনেক লোকজন পাপ খুঁজে পায়”!
আমার জানা নেই এই জন গ্রীণের সাথে আমষ্টারডামের ঠিক কেমন সম্পর্ক ছিল, কিন্তু মোক্ষম কথা লিখে গিয়েছেন বলাই বাহুল্য –
আগের পর্বে ‘রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট’ বলেই উল্লেখ করেছিলাম আমষ্টারডামের সেই বিশেষ এলাকাটিকে। তবে ডাচ ভাষায় এই এলাকাকে বলা হয় ‘দি ওয়ালেন’ (de Wallen) – এখানকার জানালায় কোন কোন দেশের মেয়েদের বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সেটাও উল্লেখ করেছিলাম আগের পর্বে। ধীরে ধীরে ইতিহাস ইত্যাদি ব্যাপারে ঢুকব – আজকের পর্বে আলোচনার করে নেওয়া যাক এখানে কেমন ধরণের পর্যটক বা কাষ্টমার আসে সেই সব নিয়ে। ২০১০ সালের হিসেব মত দেখতে পাচ্ছি এই ‘রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট’ এ মোট লাল জানালা বা রুম ছিল ২৯০টির মত (২০২০ তে দেখলাম একজন লিখেছেন এটা কমে ২২৫ এর মত হয়েছে) – এবং প্রায় ৩১ টি বিভিন্ন মালিক এগুলো ভাড়া দিত। সর্বশেষ হিসেব মত পাচ্ছি এখানে ৩৭৫ মত সেক্স ওয়ার্কার কাজ করে।
তবে এখানে একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে যে সব সেক্স ওয়ার্কার-রা লাইসেন্স নিয়ে কাজ করে তারা খাতায়কলমে অন্তত স্বাধীন ভাবে তাদের ব্যবসা চালাবার ক্ষমতা রাখে – দে আর দেয়ার ওন বস। নিজেরা ক্লায়েন্টদের সাথে দরদাম এবং ঠিক কি পরিসেবা দেবে সেটাও নিজেরা ঠিক করত। আমরা সাধারণ ভারতীয় কনসেপ্টে এই ব্যবসার সাথে যেমন মালকিন/মালিক বা দালালরা সব কিছু চালায় ভাবি – তেমনটা আমষ্টারডামে খুব একটা প্রকট নয়।
বেশ কিছুদিন আগে একটা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল আই-অ্যাম-এক্সপ্যাত এই ওয়েবসাইটের তরফে আমষ্টারডামে ঘুরতে আসে এমন পর্যটকদের মধ্যে। তো সেই সমীক্ষায় ৬৬% পর্যটক বলেছিল যে তাদের আমষ্টারডাম ঘুরতে আসার প্রধান কারণ এখানকার ইতিহাস এবং সংস্কৃতি। আর ১৭% ভাগ পর্যটক বলেছিল তাদের আমষ্টারডাম ঘুরতে আসার মূল কারণ ‘কফিশপ’ এবং সফট-ড্রাগস। বাই দি ওয়ে এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি আমষ্টারডামে ‘কফিশপ’ অর্থে কিন্তু গাঁজার দোকান যেখানে কফিও বিক্রি হয়। আপনি যদি শুধুই কফি খেতে চান তাহলে আপনাকে ঢুকতে হবে ‘ক্যাফে’-তে, কফিশপে নয়! আর ইন্টারভিউ নেওয়া পর্যটকদের প্রায় অর্ধেক জানিয়েছিল যে ‘রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট’ ঘুরে বেরিয়ে এবং দরকার হলে আরো বেশী এক্সপ্লোর করার ইচ্ছে তাদের আছেই।
আমষ্টারডামে ট্যুরিজিমের সমীক্ষায় দেখা গেছে এই শহরে বাইরের দেশ থেকে যে সব পর্যটকেরা আসেন তাঁদের থাকার মেয়াদ গড়ে মোটামুটি ৩ থেকে ৪ রাত। তো এত কম সময়ের মধ্যে রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট সম্পর্কে বিশাল কিছু জ্ঞান সঞ্চয় করা সম্ভব নয় যদি না আগে থেকে এই বিষয়ে ইন্টারেষ্ট নিয়ে পড়াশুনা করে থাকেন। হাতে খুব বেশী ঘুরে ফিরে দেখার সময় নেই, কিন্তু এদিকে ইচ্ছে আছে আমষ্টারডামের এই বিখ্যাত এলাকার সম্পর্কে কিছু জানতে এবং ঘুরে দেখতে। তাহলে কি করবেন? বেশীর ভাগ পর্যটক যেটা করে সেটাই – একটা রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট হেঁটে দেখার গাইডেড ট্যুর নিয়ে নেবেন!
এমনিতে আমষ্টারডাম শহরের মিউনিসিপ্যালিটি বেশ কিছু ফ্রী ট্যুর অর্গানাইজ করে শহরের ট্যুরিজিম প্রমোট করতে – নানা দ্রষ্টব্য জায়গা ঘুরিয়ে দেখায়। কিন্তু রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট নিয়ে এমন ফ্রী ট্যুর আমার জানা নেই – মনে হয় না কেউ অফার করে। গাইডেড ট্যুরের মধ্যে বেশ ইন্টারেষ্টিং হল ‘আমষ্টারডাম আন্ডারগ্রাউন্ড’ বলে নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন যেগুলো অ্যারেঞ্জ করে – খুব বেশী চার্জ করে না ট্যুর গুলোর জন্য এবং মূলত এগুলোর গাইড হয় হোমলেস লোকজন। এই সব পাবলিক একসময় এই শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে ফিরে নানাবিধ বেআইনী কাজকর্মে জড়িত থাকত – কিন্তু এখন ভালোভাবে সৎ পথে বাঁচার চেষ্টা করছে। এরা হয়ত আপনাদের ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে তার নিজের জীবনের গল্প বলবে – এই এলাকায় ড্রাগ বিক্রী করত বা এখানকার অনেক মেয়ের কাছে নিয়মিত কাষ্টমার ছিল, যদি মেয়ে গাইড হয় তাহলে হয়ত দেখা যাবে সে নিজেই একসময় ওই জানালার ওধারে বসত – ইত্যাদি ইত্যাদি। যেই ট্যুরই নিন না কেন মোটামুটি ঘন্টা দুয়েক লাগবে ঘুরতে সেই গাইডেড ট্যুরে।
এমন ট্যুরে যখন যাবেন তখন সবসময় পলিটিক্যাল কারেক্টনেশ আশা করবেন না গাইডের কথা বার্তায়। আমি একটি মেয়ের এমন ট্যুরের অভিজ্ঞতা পড়ছিলাম যেখানে সে গাইড-কে জিজ্ঞেস করেছিল, “আচ্ছা এই রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট এলাকায় ছেলে সেক্স ওয়ার্কার দেখা যায় না কেন”? একদম পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট উত্তর এসেছিল, “পুরুষ সেক্স ওয়ার্কারের এখানে তেমন কোন মার্কেট নেই। মেয়েদের যদি সেক্সের দরকার হয়, তাহলে তারা তো জাষ্ট বার-এ গেলেই হবে – খামোকা মেল সেক্স ওয়ার্কারের পিছনে পয়সা খরচা করতে যাবে কেন!”
রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট ট্যুরের সময় সবচেয়ে বেশী বার জিজ্ঞেস করা প্রশ্ন গুলি এমনঃ
- সেক্স করতে গেলে কি রকম খরচ পরে?
- কি কি অন্তর্ভুক্ত থাকে সার্ভিসে?
- সেক্স-ক্লাব, পীপ-শো বা পর্ণ থিয়েটারের মধ্যে পার্থক্য কি?
- সেক্স ওয়ার্কার দের আয় কেমন? অনেক টাকা উপায় করে কি এরা?
- কাষ্টমার পেলে এরা কি জানালা বন্ধ করে? নাকি কিছু পর্দার ব্যবস্থা আছে?
- এরা সবাই কি স্বেচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছে নাকি হিউম্যান-ট্রাফিকিং এখানে চলে? বা দালাল রাজ?
- বিবাহিত সেক্স ওয়ার্কাররা কি এখানে দেখা যায়? তারা কি এখানে ফ্যামিলি নিয়ে থাকে?
- গড়ে কতগুলি কাষ্টমার পায় এরা দিনে?
- কাষ্টমার প্রত্যাখান বিষয়ক কি কোন নিয়ম আছে? মানে সেক্স ওয়ার্কাররা কি নিজের ইচ্ছে মত কাউকে প্রত্যাখান করতে পারে?
- এদের সার্ভিস চার্জ (অনেকে রেট বলে উল্লেখ করে) কি নিয়ন্ত্রিত? নাকি এরা নিজেদের ইচ্ছে মত চার্জ করে?
তো যেটা আবার বলা আমষ্টারডাম এমনিতেই জনপ্রিয় শহর, তার উপর এই রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট তাকে আবার কুখ্যাত বা বিখ্যাত যাই বলেন না কেন করে তুলেছে সেক্স ট্যুরিজিমের জন্য। তবে এখানে এটা আইনত স্বীকৃত ব্যবসা বলে এর থেকে নেদারল্যান্ডেস এর ইনকাম কিন্তু কম নয়! ২০১০ সালের হিসেব মত এই সেক্স ইন্ডাষ্ট্রি থেকে ডাচ সরকারের আয় ছিল বছরে প্রায় ১.১ বিলিয়ন ইউরো মত, মানে জি ডি পি-এর দিক থেকে দেখতে গেলে ডাচ জি ডি পি-র ৫%! সংখ্যাটা এই ভাবে হয়ত আপনাকে অত চমকে দেবে না – কিন্তু একটা হালকা তুলনা করলে হয়ত একটু বুঝতে সুবিধা হবে – ভারত সরকার আমাদের দেশের জি ডি পি-র ৫% এর মতই শিক্ষা খাতে খরচা করে প্রতি বছর।
প্রথম পর্বে লিখেছিলাম আমার সেই বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টের পাশেই খুব সকালে এক স্থানীয় ভদ্রলোককে লাল দরজার সামনে খাড়া হতে। লাল দরজার কাষ্টমার বিষয়ে আমার প্রথম দিকে একটু বিভ্রান্তি ছিল – প্রথমে মনে করতাম রেড লাইট এলাকার বেশীর ভাগ কাষ্টমারই বুঝি টুরিষ্ট। এই আপাত ভ্রান্ত ধারণার পিছনে ছিল শুক্রবার অফিস ফেরার পথে আমষ্টারডাম স্টেশনে টুরিষ্টের উপচে পরা এবং তাদের প্রায় সরাসরি রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্টের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম প্রপার রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট-ই হোক বা সেই বৃত্তের বাইরে আমষ্টারডামের অন্য জায়গার লাল জানালাই হোক, একটা সিংহভাগ খদ্দের কিন্তু স্থানীয়। আজকাল অবশ্য টুরিষ্ট কাষ্টমারদের অনুপাত বেড়েছে অনেক – ১৯৯৩ সালের একটা রিপোর্টে দেখতে পাচ্ছি তখন কাষ্টমারদের প্রায় অর্ধেক ছিল ডাচ। তবে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে আমরা আজকে যেটাকে নেদারল্যান্ডে প্রষ্টিটিউশন লিগ্যাল বলে দাবী করি সেটা চালু হয় ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে বা ২০০০ থেকে। লিগ্যাল কাকে বলে, বর্তমানের আইনে ঠিক কি লেখা আছে সেই সব নিয়ে পরে এক পর্বে আলোচনা হবে।
আগেকার দিনে রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট ঘুরে দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা এখানকার কাষ্টমারদের উপর চালানো সমীক্ষা খুঁজে বের করা বেশ কঠিন ছিল, কারণ সবই ছিল বই বা রিপোর্ট হিসাবে। কিন্তু ইন্টারনেটের আগমনের সাথে বিশেষ করে স্যোশাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তের পর রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা পড়ার জন্য আপনাকে খুব বেশী কষ্ট করতে হবে না। গোছা গোছা পার্সোনাল ব্লগ বা ট্রাভেল/ট্যুরিজম ওয়েব সাইট পেয়ে যাবেন সেখানে বিস্তারে পাবলিক বর্ণনা করেছে রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট ঘিরে তাদের অভিজ্ঞতা। এমন বহু ব্লগ আমি পড়ে লক্ষ্য করেছি যে যারা কেবল ৩-৪ দিন ঘুরতে এসে আমষ্টারডামের রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট দেখছে তাদের দেখাটা বেশ কিছুটা আলাদা তাদের থেকে যারা আমষ্টারডামে বেশ কিছু মাস/বছর থেকে তাদের দেখাটার সামগ্রিক উপস্থাপনা করেছে। এমনই কয়েকটা অভিজ্ঞতার কথা পড়ি আমষ্টারডামে এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসাবে পড়াশুনা করতে এসে ইউরোপেরই অন্য দেশের মেয়েদের। এদের মধ্যে একটা ইতালির মেয়ে এতই বেশী ফ্যাসিনেটেড ছিল রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট নিয়ে যে সে উইক এন্ডে সুযোগ পেলেই রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট এলাকার আশেপাশে ইউথ হোষ্টেল গুলিতে থেকে আমষ্টারডাম ঘুরতে আসা টুরিষ্টদের ইন্টারভিউ নিত বা তাদের পর্যবেক্ষণ করে নিজের অনুসন্ধিৎসা মেটাবার চেষ্টা করত। দেখলাম যে এই মেয়েটির বা এর মত যারা আমষ্টারডামে বেশী দিন বসবাস করে নিজেদের অভিজ্ঞতা লিখেছে তাদের পর্যবেক্ষণের সাথে আমার নিজের পর্যবেক্ষণ বেশ মিলে যাচ্ছে।
অর্জিত অভিজ্ঞতার পার্থক্য থাকবেই – তা যেমন ৩-৪ দিন বনাম কয়েক মাস/কয়েক বছরের মধ্যে হতে পারে তেমনি হতে পারে কয়েক মাস/কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার সাথে আমষ্টারডাম শহরেই বেড়ে ওঠা স্থানীয় লোকজনের সাথে। তাই ভেবে দেখতে গেলে সেই অর্থে ‘অথেন্টিক’ অভিজ্ঞতা এক অলীক জিনিস – প্রত্যেকেই তার নিজের মতন করে, নিজের সাধ্য/সামর্থ/ইচ্ছের উপর নির্ভর করে অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার পূর্ণ করে। তথ্যের ভুল – ঠিক বিচার করা যায়, অভিজ্ঞতার নয়। আমি সেই জন্যই চেষ্টা করেছি লোকজনের সাথে কথা বলে প্রাপ্ত তথ্য যতটা পারি যাচাই করে নিতে, কিন্তু যাদের সাথে কথা বা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি তাদের অভিজ্ঞতাকে বিচার করার চেষ্টা করি নি বরং ভাবার চেষ্টা করেছি কি অন্তর্নিহিত কারণে দুজনের অভিজ্ঞতার ফারাক হতে পারে একই জিনিস দেখে।
রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট গাইডেড ট্যুর অভিজ্ঞতাও যে বিভিন্ন লোকজনের বিভিন্ন রকম হবে সেটা অনুমান করেছিলাম আগে থেকেই। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিল একটা ব্যাপার যে প্রায় কেউই রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট গাইডেড ট্যুরকে খারাপ বলে দেগে দেন নি। বেশীর ভাগই বলেছেন – এক্সেলেন্ট, কিছু ভেরী গুড এবং বাকিরা গুড রেটিং দিয়েছেন মুক্ত হস্তে। মনে রাখতে হবে এখানে কোন বিশেষ ট্যুর কোম্পানী বা গাইডের রেটিং দেওয়া হচ্ছে না – বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতার ব্যাপারটিকে। এবং তারা প্রায় সকলেই বলেছে বাকি টুরিষ্টদেরও তারা হাইলি-রেকমেন্ড করবে এমন ট্যুরটা নেবার।
তাহলে এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট ট্যুরের কি কোন বিশেষ ব্যাপার আছে যার জন্য পর্যটকেরা সেই ট্যুরকে খুব ভালো বলেছেন? এই নিয়ে তলিয়ে দেখে যা বুঝলুম, খুব বেশী টুরিষ্টের রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট নিয়ে বিশাল কিছু পূর্ব জ্ঞান ছিল না। এরা বেশীর ভাগই শুনেছিল আমষ্টারডামে এমন একটা জায়গা আছে যেখানে লিগ্যালী সেক্স ওয়ার্কাররা কাজ করে এবং লিগ্যালী সেক্স সার্ভিস কেনা যায়। ডাচ সরকার এই ব্যাপারে উদার, তারা ট্যাক্স পায় – আর লাল জানালায় মেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকে কাষ্টমারদের জন্য। কম বেশী এই হল সিংহভাগ পর্যটকের জ্ঞান এই ট্যুর নেবার আগে পর্যন্ত। ফলে হয় কি এরা খুব তাড়াতাড়ি গাইডের জ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে – এমন বলছি না যে গাইডরা ভালো নয় বা জানে না সত্যি করে কিছু। বরং তার উল্টোটাই – এই গাইডরা অনেকে এই অঞ্চলের সাথে এমন ভাবে জড়িত যে আপনি কোন বই পড়ে সেই সব উপকথা বা ঘটনা জানতেও পারবেন না। কিন্তু আমি বলছি ওই চমকে যাবার ব্যাপারটা। আমি যখন কয়েক বছর আমষ্টারডামে থাকার পর বন্ধুদের সাথে এমন ট্যুর নিয়েছিলাম স্বাভাবিক ভাবেই খুব বেশী আশ্চর্য হবার মত কিছু অবশিষ্ট ছিল আমার কাছে। আর এটা ব্যাপারে অনেক টুরিষ্টরাই একমত হয়েছেন – মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেছেন এত কিছু তাঁরা জানতেন না, এমন ভাবে ইন্টারঅ্যাকটিভ ট্যুর তাঁদের সাহায্য করেছে কিছু সময়ের জন্য হলেও রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট-এর ইতিহাস এবং বিবর্তনে নিমজ্জিত হয়ে যেতে।
একটু বিতর্কিত মনে করলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আমার দেখা সবচেয়ে কনফিউজিং আচরণ আমি এই এলাকায় দেখেছি ভারতীয় টুরিষ্টদের। খুব খুব কম ভারতীয় স্বামী-স্ত্রী বা কাপল-কে দেখেছি লাল জানালাগুলোর পাশ দিয়ে স্বচ্ছন্দে হেঁটে যেতে। কম বয়ষ্ক হলেও তবু ঠিক আছে, অনেক ইয়ং কাপল-কে দেখেছি এই এলাকায় স্বাভাবিক ভাবে ঘুরে ফিরে এক্সপ্লোর করতে। কিন্তু একটু বয়ষ্ক হলেই কেমন যেন আমাদের মধ্যে সেক্স ব্যাপারে ভিক্টোরিয়ান ট্যাবু মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট-এ কয়েকটি বেশ ভালো আইসক্রীমের দোকান আছে – মিষ্ট্রি প্রতি আমার অমোঘ আকর্ষণের জন্য প্রায়ই এই দোকানগুলি থেকে আইসক্রীম কিনে খেতাম – এই এলাকার রাস্তা ও গলি খুবই সরু হবার জন্য পাবলিক গিজগিজ করে বেশীর ভাগ সময়েই – তাই রাস্তা দিয়ে আইসক্রীম খেতে খেতে চলার থেকে একটা ব্রীজের উপর দাঁড়িয়েই লোক জন দেখতে দেখতে খাওয়াই বেশী পছন্দ করতাম। তেমন ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বহু ভারতীয় স্বামী-স্ত্রী-র আলোচনার সাক্ষী থেকেছি আমি – “এ্যাই যাবে নাকি ওদিকটায়”, “না গো, না যাওয়াই ভালো মনে হয় – মেয়েরা উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেহ বিক্রীর জন্য ভাবলেই কেমন গা গুলিয়ে উঠছে”, “আরে না – এখানে এটা লিগ্যাল, চাকুরীর মত – কেউ জোর করছে না এদের”, “তোমাকে বলতে গেছে, নিজের ইচ্ছেয় কেউ দিনের পর দিন অচেনা লোকেদের সাথে শুচ্ছে”, “জাষ্ট একটু ঘুরেই বেরিয়ে যাব ওদিক দিয়ে”, “এই তো এদের কালচার – আমাদের দেশের সাথে তুলনা হয়?” ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব আলোচনার শেষেও যারা রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট এর গলি গুলিতে ঢুকত, তারা এমন ভান করত যেন লাল-জানালার দিকে তাদের কোন ইন্টারেষ্ট নেই। কিন্তু ফাঁক পেলেই টুক করে দেখে নেওয়া চোখ তুলে!
ভারতীয়দের উপর আলাদা করে চোখ চলে যেত দেশের টানের জন্য – এমন নয় যে আর কোন দেশের স্বামী-স্ত্রী এমন ভাবে আলোচনা করত না ব্রীজে দাঁড়িয়ে! কিন্তু আমি তো তাদের ভাষা বুঝতে পারতাম না! ভারতীয় ছাড়া আর যেটা বেশী নজর করেছি তা হল বয়স ভিত্তিক ছেলে-ছোকরাদের আচরণের উপর। অনেক ছেলে ছোকরা দল বেঁধে ঘুরতে আসত – স্বাভাবিক ভাবেই দলের সব ছেলে সমান সো কলড্ ‘ফরোয়ার্ড’ হত না – প্রত্যেক দলে একজন আলফা মেল এর মত থাকত যে দলটাকে গাইড করত। সে হয়ত আগে ঘুরে গেছে এই এলাকায় বা পড়াশুনা করে এসেছে বা কিছু না জেনেই হামবড় ভাব। এদের অনেকে এগিয়ে যেত লাল-জানালার দিকে – মেয়েটি দরজা খুলে বেরিয়ে আসত। দুই-তিন ছেলে মিলে সেই মেয়েটির সাথে কথা বলত – বেশীর ভাগ সময়েই দুই পক্ষই হাসি মুখে কথা বলত। কিন্তু যারা এই ভাবে দল বেঁধে দিয়ে দরজায় কড়া নাড়ত তাদের খুব কম জনকেই আমি ভিতরে ঢুকতে দেখেছি মেয়েটির কাষ্টমার হয়ে। এবং এটা শুধু আমি নয়, বাকি অন্যদের পর্যবেক্ষণের বই/ব্লগ পড়েও দেখেছি এমন সিদ্ধান্ত তাঁদেরও। যারা আসল কাষ্টমার তারা মনে হয় দল বেঁধে গিয়ে হ্যাজায় না মেয়েটির সাথে। কম বয়েসী মেয়েদের টুরিষ্ট দলও দেখেছি অনেক ঘুরতে এই এলাকায় – তাদের সেক্স শপ, কন্ডোমের দোকান বা সেক্স-টয়ের দোকানে ঢুকে টাইম পাশ করতে গিয়ে দেখলেও, লাল জানালার কাছে গিয়ে তারা সেক্স ওয়ার্কারের সাথে কথা বলছে এমন দৃশ্য আমি প্রায় দেখিই বলতে গেলে। যদিও তাদের দেখেছি লাল জানালার পাশ দিয়ে হাঁটার সময় জানালার ওধারের মেয়েগুলিকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে।
বহু বহু বিদেশী কাপল-কে দেখেছি হাত ধরে এই এলাকায় সময় নিয়ে এক্সপ্লোর করতে। এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে একদমই মনে হয় নি যে ছেলেটির সাথের প্রেমিকা বা স্ত্রী কোন রকম জেলাসী অনুভব করছে যখন দুজনে মিলে তারা লাল জানালার মেয়েটির পাশ দিয়ে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছিস। তবে ছেলেদের মধ্যে একটা চোরা চাউনি দেবার অনেক উদাহরণ তো নিজের চোখেই দেখেছি – সব কাপল-ই যে লাল জানালার দিকে তাকাতে তাকাতে যায় এমন নয়। অনেক কাপল আছে যারা এই এলাকাটা ঘুরে দেখছে – সাথের প্রেমিকা/স্ত্রী-এ হয়ত ইন্টারেষ্ট নেই লাল জানালার দিকে, কিন্তু সুযোগ পেলেই ছেলেটি মাথা তুলে দেখে নিচ্ছে স্বল্পবাস মেয়েটিকে। নীচের ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া, দেখলাম একটা ইন্টারেষ্টিং ক্যাপশন দেওয়া “নন-কনট্যাক্ট চীটার”! আমি অবশ্য জানি না অচেনা কাউকে একবার চোখ তুলে লাল জানালার ওধারে মেয়েটিকে দেখার জন্য একেবারে ‘চীটার’ বলে দাগিয়ে দেওয়া যুক্তিযুক্ত কিনা!
যদি টুরিষ্ট হিসাবে রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট-এর গাইডেড ট্যুর নেন তাহলে আপনি মূলত ঘুরে দেখবেন – কিছু বিখ্যাত কন্ডোমের দোকান, দ্যা ওল্ড চার্চ (The Oude Kerk), বেলে (Belle’s Statue) স্ট্যাচু, নানাবিধ সেক্স শপ, কিছু বিখ্যাত ক্যাফে, রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট-এর প্রাণ কেন্দ্রের গলি-ঘুঁজি, আশেপাশের বিখ্যাত কিছু কফি শপ, হয়ত এখনকার বিখ্যাত সেক্স শো-পীপ শো দোকান গুলি, ইরোটিক মিউজিয়ামের ঝলক। এদের প্রত্যকেরেই নিজস্ব গল্প আছে – ধীরে ধীরে সেই সব গল্প আসবে পরের পর্বগুলিতে
আজকে শুধু উল্লেখ করব ওল্ড চার্চ স্কোয়ার (যেখান থেকে সাধারণত রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট ট্যুরগুলি শুরু এবং শেষ হয়) এর সামনে রাস্তায় প্রোথিত নীচের আর্ট-টির ব্যাপারে। কেউ জানে না এর শিল্পী কে! ১৯৯৩ সালের কোন এক সকালে কেউ হঠাৎ আবিষ্কার করে এই শিল্পটি মাটিতে কেউ গেঁথে দিয়ে গেছে। সেই থেকে এই শিল্পটি এই ভাবেই আছে – আপনি রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট ট্যুর নিলে নির্ঘাত আপনাকে এটা দেখাবেই। যেহেতু এটার শিল্পী কেউ জানে না আর শিল্পী নিজে ঈঙ্গিত দিয়ে যান নি তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য কি ছিল এই আর্টটির পিছনে, তাই লোকজন এখন এই সিদ্ধান্তে পৌছেছে যে এটার মূল উদ্দেশ্য হল “সমগ্র মানব ইতিহাসে পতিতা-দের অবদানের জন্য তাদের সম্মানার্থে”।
এই আর্ট ওয়ার্কের প্রায় কাছাকাছি ২০০৭ সালে স্থাপিত হয় ‘বেলে’ স্ট্যাচু, তবে এখানে আর কনফিউশন নেই কারণ মূর্তির তলায় খোদিত আছে “সারা পৃথিবীর সেক্স ওয়ার্কার-দের সম্মান জানান”। এখনো পর্যন্ত আমার জানা মতে সমগ্র পৃথিবীতে এই একটাই স্ট্যাচু আছে যা সেক্স-ওয়ার্ক উদযাপন হেতু বানানো। সেক্স-ওয়ার্কারদের প্রতি দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টানোর জন্য আমষ্টারডামের অবদান অনেক – সেই কোন ১৯৯৪ সালে ওল্ড চার্চ স্কোয়ার অঞ্চলেই প্রতিষ্ঠা হয় ‘প্রসটিটিউশন ইনফরমেশন সেন্টার’ যাদের প্রধান বার্তা ছিল এই যে পতিতাবৃত্তি কোন অর্থেই অসম্মানজনক কাজ নয়। এই সংস্থা সেক্স ওয়ার্ক করতে চায় এমন মেয়েদের সাহায্য করে আসছে এখনো – এবং এদের উদ্যোগেই ২০০৭ সালে স্থাপিত হয় বেলে স্ট্যাচু।
অন্য পৃথিবীর অনন্য ভাবনা, আমি সম্মান জানাই তাদের।
আমস্টারডামের ওপরে জন গ্রীনের মন্তব্যটি শুনে আলবের কামুর অসাধারণ নভেল পতন ( দি ফল ) যেখানে ক্লেমেন্স এক অদৃশ্য শ্রোতার সঙ্গে কথা বলে যান (সর্বদা তাকে তুমি বলে নাম নেই ): আমস্টারডামের সমকেন্দ্রিক ( konsentrik) কানাল গুলিকে নরকের বৃত্তের মতো মনে হয় না তোমার ? বুর্জোয়া নরক যেখানে মানুষেরা অসম্ভব বিশ্রী স্বপ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ? আরেক জায়গায় ক্লেমেন্স বলেন আমস্টারডাম একটা ঠান্ডা শহর কুয়াশার কম্বলে ঢাকা ।
আমার বার বার দেখা আমস্টারডাম সহজ সুন্দর হাসিতে বারে সাইকেলে ভরা শহর একমাত্র শহর যেখানে সবচেয়ে ছোট গ্লাসে বিয়ার পরিবেশিত হয় !
আমার ছবির সঙ্গে কামু মেলে না কিন্তু জন গ্রিনের প্রসঙ্গে মনে পড়লো ।