এলেবেলে (পর্ব - ২) : ডাকনাম
দিদির আট-দশটা ডাকনাম ছিল। ঠাকুরদা বলতেন বুড়ি। ঠাকুরদার এক বোন, আমাদের পিসিদিদা ডাকতেন তিতা বলে। সম্ভবতঃ দিদি বেশি ছোটবেলায় দিদা না বলে তিতা বলতো, সে থেকেই। মাসি-পিসিদের দেওয়া গুচ্ছখানেক নাম ছিল -- রুপুল, বড়মা, ঝুমুর, প্রভৃতি -- শুনলেই আমার হিংসেয় গা জ্বলে যেত। বাবা-মা মেজাজ মর্জিমতো এক এক নামে ডাকতেন। একমাত্র আমার দেওয়া কোনো নাম ছিল না; দিদিকে নিয়ে সবার এই সোহাগের ভরা-কোটালে আমার অবদান বলতে শুধু 'দিদি'। দিদি নয় অবশ্য; দি।
শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় এসে আমাদের বড় হয়ে ওঠা। বড় যে হচ্ছি, বুঝতে পারতাম, বাড়ি থেকে রাস্তায় আমাদের দুজনকে একা ছাড়ার সীমানা দিয়ে। শিলিগুড়ির ক্যাম্পাসজোড়া খেলার মাঠ কলকাতায় হারিয়ে গিয়েছিল। সবেধন নীলমণি এক পার্ক ছিল বাড়ির কিছুটা দূরে, কিন্তু সেখানে গিয়ে স্লিপ-দোলনা চড়ে বিকেল কাটানোর প্রবৃত্তি আমাদের জাগত না বিশেষ। বরং, আমাদের আব্দার ছিল, আমাদের দুজনকে ঘুরে ঘুরে পাড়া বেড়াতে দিতে হবে। এই পাড়ার সীমানা ক্রমশঃ বড় হতে হতে বেপাড়া ছাড়িয়ে রাজপথে নেমে গিয়েছিল, আর আমাদের পাড়া-বেড়ানো নগরচারণ হয়ে গিয়েছিল বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
লম্বা একমাসের পুজোর ছুটিতে আমরা বিকেল-সন্ধে করে পাড়া ঘুরে আসতাম রোজই প্রায়, ছোটবেলায়। কাজ ছিল, নতুন নতুন রাস্তায় গিয়ে সে রাস্তার নাম দেওয়া দেশের মতো করে। তখন মাথায় সবে সবে কলম্বাস! একটা কানাগলির নাম ছিল বারান্দাপুরী, সে গলির বাড়িগুলোর বারান্দা আমরা কিনে নেব, শলাপরামর্শ হতো প্রায়ই। ঝিলের পাশের যে ঘরোয়া আলোছায়া রাস্তা, তার নাম দি রেখেছিল দীঘিনগর। এই দীঘিনগর নাকি অভিশপ্ত। দীঘিতে যারা যারা আজ অব্দি ডুবে গেছে, রাত্রে ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁলে জলে নাকি আজও বুদবুদ ওঠে, জলে কি যেন ভেসে ওঠে … দিদির গলা ধরে আসতো কল্পনায়, আমার গায়ে কাঁটা দিত। তবু রোজই আমরা যেতাম সে রাস্তায়, কারণ তার শেষ মাথায় ছিল আরেক রাস্তার আহ্বান, ছাতিমপাড়া। যার নামে এই নামকরণ, সেই নিরীহ ছাতিম গাছটা ছিল আমাদের এই দীঘিনগর আর ছাতিমপাড়া যে মোড়ে একে অন্যকে কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেইখানে। কোনো বাড়ির সম্পত্তি নয় সে। মোড়ের মাথায় একাকী, কালো পিচের উপর দাঁড়িয়ে থাকতো। তার মাথায় জ্বলতো হলুদ গ্যাসবাতি।
আশ্বিনের বারবেলায় দি'র সঙ্গে সে পথে গেলেই আচ্ছন্ন এক গোধূলিতে তারা-খসার মতো নেমে আসতো ছাতিম ফুল আমাদের পায়ে, যেন ভাই-বোনের আসার অপেক্ষাতেই ছিল তারা। দি আর আমি আমাদের ছোট ছোট দুই মুঠোয় যতটা ধরে, ফুল ভরে নিতাম, তারপর আঁজলার মতো ধরে শুঁকতাম সেই গন্ধ। কিসের তার টান, জানতাম না। আজও জানি না। শুধু মনে আছে, সে গন্ধ নিলে আমার হাতের পাতা, পায়ের পাতা ঘেমে উঠতো, ঘাড়-পিঠ শিরশির করে উঠতো, হঠাৎ মনে হতো শীত এসে পড়েছে কিচ্ছুটি না জানিয়ে। দি আরেকটু বড়, ও বলতো, "আমরা বড় হচ্ছি, বুঝছিস? এরপর তুই আরও বড় হয়ে যাবি আর তখন আমাদের আর এরকম আসা হবে না।" দুজনের হাত থেকে ফুলগুলো ঝরঝরিয়ে পড়ে যেত মাটিতে আবার, ম্লান হয়ে আসতো দূরের বাড়িঘর। সবে সন্ধের মুখ। হলুদ গ্যাসবাতি তখন মরা আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে। আমি দি'কে বলতাম, "আমি বড় হলে আসা হবে না কেন? তুইও তো বড় হবি!" ও বলতো, "সবসময় কি আর তুই এখনের মতোই হয়ে থাকবি? বড় হয়ে অন্য কাজ থাকবে না?" দূরের গাড়ির হর্ন মিলিয়ে যেত ঝিলের ও'পারে, কোনো বাড়িতে সন্ধের শাঁখ বাজতো। ছাতিম গাছটা কোন এক অজানা হাওয়ায় একটু তিরতির করে কেঁপে আরও কিছু ফুল ঝরাতো আমার বুক হুহু করে ওঠা বুঝে।
আমাদের সেই পাড়া হারিয়ে গেছে, দি'র কথামতো, বড়বেলায়। আমাদের ঘুরতে যাওয়াও গেছে। আমাদের আবিষ্কৃত ছোট ছোট রাস্তায় যে বড় বড় দেশ, তাদের হাতবদল হয়ে গেছে। বারান্দাপুরী কিনে নিয়েছে প্রোমোটার। শুধু রয়ে গেছে বলতে সেই মোড়ের মাথার ছাতিমগাছ। বুড়ো হয়েছে সে। গাছের বয়স হলে সে আরও নত হয়, অপেক্ষমান হয় স্মৃতির জন্য। সে পথ দিয়ে কালেভদ্রে হেঁটে ফিরি আমি বাড়ির দিকে। দি দূরে থাকে এখন। ছাতিমগন্ধে স্থির হয়ে দাঁড়াই একটুক্ষণ। পাশের বাড়ির ছোট বাচ্চা অবাক হয়ে জানলা দিয়ে দ্যাখে। আমার হাত-পা ঘেমে ওঠে, পিঠ শিরশির করে। মনে পড়ে, বড় হয়ে যাচ্ছি, একা হয়ে যাচ্ছি। আশেপাশের মানুষেরা বুড়ো হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ঠাকুরদা-পিসিদিদা কেউ নেই আর। আমাদের ছোট ছোট দেশগুলোর নামও সবসময় আর অত স্পষ্ট মনে পড়ে না। ফুল ঝরে পড়ে, অতীতে।
ভালো লাগল।
Abhyu
অনেক ধন্যবাদ। :)
এই এপিসোডের মায়াবী গদ্য স্মৃতিমেদুর করে তোলে। টের পাই সন্ধ্যা নামছে।