এলেবেলে (পর্ব - ৫) : মুখোমুখি
ধরে নাও, সমুদ্রতীরের কোনও শহরে আমার আর তোমার দেখা হয়ে গেল, বহুদিন পর, প্রথমবারের মতো।
দু'জনেই অন্তরে বেশ অবাক, কিছুটা ক্ষুণ্ণই হলাম একে অন্যকে ভালো থাকতে দেখে, কারণ, আমরা তো ভাবিনি ভালো থাকবে অন্যজন আমাদের ছাড়া। ভালো তো কারুরই থাকার কথা নয়, ভেবেছিলাম, কারণ প্রত্যেকে কারুর সঙ্গে যেমন আছে, কাউকে ছেড়েও তো আছে? তাই মুখে শুধু বলি, "ভালো তো? কতদিন পর...!"
আসলে আমরা কে না জানি, সময় চলে গেলে ছাড়ার বা ছেড়ে যাওয়ার মূল্য নেই আর! আমি আপ্রাণ বিনাশ ও নষ্ট চেয়েছি তোমার, কিন্তু সময় চলে গেলে, বুঝেছি, বিনাশেরও ধার কমে আসে। ছেড়ে যাওয়া, ছেড়ে থাকা সহজ হয় ক্রমে। কঠিন শুধু পাশে থাকা, সাহচর্য, একজীবন শূন্যতার কেন্দ্রে রাখা প্রেম।
সমুদ্রতীরের কোনও শহরে আমার আর তোমার দেখা হয়ে গেল, প্রথমবারের মতো। তোমার বাড়ি ছিল কোনও নদীর উৎসে, আমার মোহনায়। অথচ সমুদ্রের কাছে আমাদের অনেক ঋণ।
ডানদিকে তাকালে লাইটহাউস, মাইলখানেক দূরে জনপদ। তবু আমরা জানি, বলো -- জানি না, যে এই আমাদের শেষ দেখা নয়? সমুদ্রের পথে আমাদের আবার দেখা হবে। এরকমই, অনেক দিন পর। তুমি কোনও কাজে, আমি অকাজে। তখন না হয় আমরা কেবল ভালো চাইব একে অন্যের; ভাববো, একসঙ্গে যদি বা থাকতাম আমরা, কী এমন বেশি পাওয়া যেত!
****
সাধারণ কোনও শহরে পথচলতি দিনে ভুল করেও আমরা একে অন্যের মুখ দেখি না; ভাবি, আমাদের পথ আলাদা। অথচ, সত্যি বলো তো, কখনও ভেবেছো, এত দূরের সমুদ্রের শহরে সেই পথই এক হয়ে যায় কিভাবে? বিজনে আমার দু’ দণ্ড শান্তি তুমি, স্বজনে অচিন।
সমুদ্রতীরে সন্ধে বাড়ে, ফাঁকা তট-জুড়ে সারাদিনের পায়ের ছাপ লেগে থাকে, আর কিছু মানুষ তখনও গর্জন ও হাওয়ার আড়ালে বাড়ি ফেরে, আর দূরের মন্দিরচূড়ায় আলো পড়ে। কোনও গমগমে রাস্তায়, ধরো, হঠাৎ দেখা হয়ে যায় আমার আর তোমার। দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, হইচইয়ের মাঝেই এই দেখা হওয়া বিষয়ে তুমি অস্ফুটে বলে ওঠো, “ভালো লাগলো”। আমি উত্তরে শুধু হাসি, ভালো লাগে না আমার। মন খারাপ হয়। মনে হয়, এই দেখা তো ফুরিয়েই এল। এর পরে আবার কবে কে জানে!
তুমি বোঝো?
আমাদের বোঝা আর না-বোঝার মাঝে অনেক অন্তর। সে কথা আমরা বুঝি। তুমি মানুষকে বোঝো স্তব্ধতায়; আমি সখ্যে। আমি তোমাকে চাওয়া বুঝি, তোমাকে চাওয়ার পরিধি বুঝি না। তাই আমাদের কথা শুরু হয়েও দিক পায় না, বা হারিয়ে যায় সমুদ্রবাতাস আর সুরের আড়ালে। আমি বুঝি না, তোমার সাহচর্যের ভাষা হয়তো আলাদা; বুঝি না, আমার ইতিহাসে যা-কিছু উত্তরণ, তা হয়তো তোমার ইতিহাসে শোক! আমাদের বোঝায় অনেক না-বোঝার ভুল রয়ে যায়।
রাত হয়েছে। জানি তুমি ক্লান্ত এবং তোমার উত্তর আমার অপছন্দই হবে, তবু, যদি জানতে চাই, এক্ষুনি, এক্ষুনি একবার সমুদ্রে যাবে? জোয়ারের মুখে একবার দাঁড়াই দুজনে মিলে? থাক না আমাদের গুচ্ছের না-বোঝা একে অন্যকে। একবার আসবে? না হয় একটু দূরেই দাঁড়িও আমার থেকে! সেই ব্যবধানের মাঝে ঢেউ ভেঙে পড়ুক। টলিয়ে দিক আমাদের। পায়ের তলা থেকে বালি সরে যাক। শক্ত করে এবার আমরা আঁকড়ে ধরি একে অন্যের হাত, প্রয়োজনে। মনে মনে গেয়ে উঠি, “এই দীনতা ক্ষমা করো...”
এক রাস্তা হ্যায় জিন্দেগি যো থাম গয়ে তো কুছ নহি
ইয়ে কদম কিসি মোকাম পে জো জম গয়ে তো কুছ নহি।
যে গেছে সে গেছে, সামনের দিকে এগিয়ে চলাই জীবন।
গানটা মনে পড়ে গেল, অনেকদিন পর। :) ধন্যবাদ।
"ছেড়ে যাওয়া, ছেড়ে থাকা সহজ হয় ক্রমে। কঠিন শুধু পাশে থাকা, সাহচর্য, একজীবন শূন্যতার কেন্দ্রে রাখা প্রেম।"
হা প্রেম! অনবদ্য লেখা।
ছবিটি বাহুল্য মনে হয়েছে
বিপ্লব বাবু, আপনার মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। :) আচ্ছা, ছবি দেওয়ার ব্যাপারে পরবর্তীতে খেয়াল রাখব।
আমার ছবিটা খুবই ভালো লেগেছে। এমনিতেও নির্জন সমুদ্রতীর আমার খুব ভাল্লাগে। মনে হয় কাছেই কোথাও লেগোলাস আর গিমলি নৌকো ভাসালো, আনডাইং ল্যান্ডস এর উদ্দেশ্যে।