এলেবেলে (পর্ব - ৭) : শেষ পারানির কড়ি
সুবীর কুমার বসুকে কেউই চিনবেন না। পারিবারিক সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের সময়ে আমি তাঁকে চিনেছিলাম একজন বৈজ্ঞানিক-অধ্যাপক হিসেবে। অনেক, অনেক পরে, বড় হয়ে, কবিতায় উৎসাহ জন্মানোর পর, হঠাৎই একদিন দাদুর ঘরের তাকে সুবীর বসুর লেখা ৬-৭টা কবিতার বই পেয়ে আমার দ্বিতীয়বার পরিচয় হয় তাঁর সঙ্গে। কেউ চিনবেন না এ' কারণেই বললাম যে আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউই তাঁর ছাত্র ছিলেন না, এবং দ্বিতীয়ত, কবি হিসেবে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
সুবীর বসুর কবিতার বইগুলো যখন আমার হাতে আসে, দাদু আর নেই। কবি নিজেও বয়সের ভারে স্মৃতিভ্রষ্ট। খুবই খসখসে, পাতলা কাগজে ছাপা কিছু কবিতা, আদ্যোপান্ত রবীন্দ্র-বাংলায় লেখা। লাল-নীল-সবুজ, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই তিন রঙের কোনো একটির এক-কালারের মলাট। দাদুর কাছে তাঁর যাতায়াত ছিল, সেই সূত্রে দাদুকে দিয়েছিলেন বইগুলো। তাকে সমস্ত বইয়ের পিছনে পড়ে ছিল। আর কারুর কাছে সে বই থাকা তো দূরস্থান, তাদের উল্লেখও আমি শুনিনি।
আমি বইগুলো খুঁজে পাওয়ার পর আরো মাস আটেক বেঁচেছিলেন সুবীর বসু। এই ক'মাসে আমার তাঁর কাছে যাতায়াত একটু বাড়ে। কবিতাগুলো ভালোবেসে, এমন নয়; আমাদের প্রজন্মের চেতনায় সেই কবিতাগুলোকে ঠিক বুকে বেঁধে রাখা হয়তো যায় না। কিন্তু যে মানুষটাকে এতদিন শুধু আত্মীয়তা ও বিজ্ঞানের সূত্রে চিনতাম, আজ তিনি কবি, সাফল্য-ব্যর্থতার ঊর্ধ্বে একজন কবি যিনি কলম ধরেছিলেন ছন্দের জন্য, এটুকুই আমায় তাঁর কাছে আবার নিয়ে গিয়েছিল। তাঁকে আবার কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে করেছিল।
সে সময়ে বৃদ্ধ মানুষটি সম্পূর্ণ আনমনা বসে থাকতেন নিজের বাড়ির ছোট্ট, সরু বারান্দায়। একমাথা টাকের শেষে শনের মতো চুল সামান্য হাওয়া দিলেও উড়ত। স্ত্রী গত হয়েছেন বছরখানেক আগে। এখন পরিচারিকা নিত্য স্নান-খাওয়ার ব্যবস্থা করে, রাতেও থেকে যায় প্রায়দিনই। সুবীর বসু বহুদিন রাতে ঘুমোন না; কারণ, তিনি এখন আর দিন-রাতের তফাৎ বোঝেন না।
সকালের দিকে আমি গেলে অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তাঁর লেখা বইগুলো ব্যাগ থেকে বার করে দেখাই তাঁকে। অনেকক্ষণ ধরে দেখেন। তারপর খুব আস্তে, প্রায় সংকোচে, বলেন, "পাণ্ডুলিপিটা দেওয়ার মতো নয়।" একটু ভেবে, আরো এক দুবার বলেন, "নয়। একদমই নয়।" তারপর বাইরের দিকে তাকান। সব ভুলে যান। আমি তার পাশে বসে থাকি। পরিচারিকা চা করে আনেন। কবিতাগুলো উল্টে পাল্টে দেখি। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ ছায়ায় এরকম হারিয়ে যাওয়া অনেক কবির একজন আমার পাশে বসে; বয়স ৯৫। রবীন্দ্রনাথের ছায়া আর বড় হয়ে ওঠে না এখন। মনে হয়, তবু তো লিখবেন বলে কেউ কেউ কলম ধরেছিলেন। বিরাট সমুদ্রে খড়কুটোর হারিয়ে গেলেও, তখন লিখতে লিখতে নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, হারিয়ে যেতে দেবেন না নিজেকে। এটাই কি অনেক নয়?
সুবীর বসু কখনো কখনো আমার সঙ্গে বিকেলে হাঁটতে বেরোতেন। শেষ বয়সের কুঁচকে যাওয়া, চকচকে চামড়া, টলোমলো পা। হাত ধরে ধরে কিছুটা নিয়ে গিয়ে ফিরিয়ে আনতাম আবার। যাওয়াতেও যে তাঁর খুব আপত্তি ছিল, এমন নয়; আবার ফিরেও আসতেন লক্ষ্মী হয়ে, কিচ্ছুটি না বলে।
এমনই একদিন বিকেলে পাড়ার বড় ঝিলের ধারের বেঞ্চিতে বসে আছি তাঁকে নিয়ে। গ্রীষ্মের সন্ধের মুখ, আলো স্থির হয়ে আছে বহুক্ষণ, অন্ধকার এসেও আসছে না। এমন সময় তিনি বললেন, "লেখা হয় না বহুদিন।"
অন্যমনস্ক ছিলাম; তা ছাড়া ওপর প্রান্ত থেকে এমন কোনও কথা শোনার জন্য প্রস্তুতও ছিলাম না সম্ভবত। চমকে বলে উঠলাম, "হ্যাঁ?"
একইরকম নির্লিপ্ত, হয়তো বা সামান্য দ্বিধামেশানো কণ্ঠে সুবীর বসু আবার বললেন, "লিখবো। একটা লাইন... মনে..."
খরমড়িয়ে ব্যাগ হাতড়ে একটা পুঁচকে ডায়রি আর কলম বার করে এগিয়ে দিলাম। ধরলেন না প্রথমটায়। একটু অপেক্ষা করে হাতে ধরিয়ে দেওয়ায়, ওভাবেই অনেকক্ষণ বসে রইলেন। আমিও অধীর আগ্রহে বসে, এক কবিকে লিখতে দেখবো, ক' যুগ পর কে জানে! তাঁর হাত কাঁপতে লাগলো কলম ধরে, কলমের ঢাকনিও খুললেন না। অনেক, অনেক পরে, খুব অপ্রস্তুত একটা সঙ্কোচের আধো-হাসি হেসে আমার দিকে তাকালেন।
- কিছু বলবেন?
ঘাড় নাড়লেন। থেমে থেমে বললেন, "কেউ পড়বে?"
আমি একটু হেসে বললাম, "এই যে, আমি।"
তিনি আবার একটু সময় নিয়ে বললেন, "আর লিখতে পারি না ..."
সুবীর বসু আমায় কলম ফিরিয়ে দেন। ডায়রিও। এবার সন্ধে নেমে আসে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক কবি জলের ধারে সব ভুলে বসে থাকেন। তাঁর শেষ একটি কবিতার জন্মের সাক্ষী থাকতে না পারার সাময়িক হতাশার শেষে আমারও মনে হয়, কবিতা লেখার মতো গভীর ব্যক্তিগত মুহূর্তে কবিকে দেখতে হলো না, সেই অনাগত থেকে কেবল তাঁরই রয়ে গেল, এটুকু আড়াল বোধ হয় ভালোই।
খুব ভালোলাগলো পড়ে...
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। :)