এলেবেলে (পর্ব - ৩) : পথ
মায়ের কাছে শোনা, যখন আমাকে নার্সারি ক্লাসে ভর্তি করার জন্য শিলিগুড়ির তিস্তা শিশু বিদ্যাপীঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তপতী দিদিমণি আমাকে মৌখিকে প্রশ্ন করেছিলেন, কোথায় থাকো? আমি বলেছিলাম, "নিচে"। দিদিমণি আবার প্রশ্ন করেছিলেন হেসে, "কার নিচে? মাটির নিচে?" আমিও তাঁর এই কৌতূহল মেটাতে আরো খোলসা করে বলেছিলাম, "না। তিনতলায় মুনিয়া দিদিরা থাকে, দোতলায় বাপ্পা দাদারা, আর নিচে আমরা।"
ধরে নেওয়া যায়, আমার কাছে তখন তিনতলা মানে ওই একটিই তিনতলা, এবং তিনতলা মানেই মুনিয়া দিদিদের বাড়ি। তেমনই, পৃথিবীর যে কোনো দোতলাতেই বাপ্পা দাদারা থাকবে। আর 'নিচে' আমরা। ঠিকানার সংজ্ঞা তখন সরলরৈখিক, সহজ। আরো যার যার কাছে সে বয়সে নিজের বাড়ির কথা বলেছি, প্রতিবারই আমাদের ঠিকানা ছিল 'নিচে'।
তারপর আস্তে আস্তে ওপরে উঠলাম। এখন আমি তিনতলায় থাকি, আর যেখানে চাকরি করতে যাই, সেখানেও বসি তিনতলায়। কিন্তু এখন আমার কোনো একতলা-দোতলাতেই আর মুনিয়া দিদি - বাপ্পা দাদারা থাকে না। আগে রাস্তা বলতে জানতাম, কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে বড় মাঠের পাশ দিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে কিছুটা এগোলে ডানহাতে ইস্কুল, আর সেটা ছাড়িয়ে মহানন্দা। শেষ তিরিশ বছরে আরো হাজার রাস্তা এ' মাথা ও' মাথা কেটে বেরিয়ে গেছে।
রাস্তা, মানে পথ? ঝাঁ ঝাঁ রোদে বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে বেরিয়ে বিজন সেতুর নিচ দিয়ে রাস্তা পেরোলেই দেখি, একটা গলির মুখে কাত হয়ে আছে রাস্তার নাম লেখা বোর্ড -- জামির লেন। বাবারা কলকাতায় এসে প্রথমে বহুদিন এখানেই ছিল, একটা ভাড়াবাড়িতে। কিন্তু সে পথ যতটা তাঁদের, আজও, ততটা আমার নয়। আমি কিছুটা জানা-না-জানার চোখে সেদিকে তাকিয়ে, তারপর এগিয়ে যাই অন্যদিকে। হাঁটি। আমার অপেক্ষারা ছড়িয়ে আছে অন্যদিকে। রাসবিহারীর মোড় থেকে আজ হাজরার দিকে যাওয়াই যেত, কিন্তু সেদিকে আজ কেউ নেই অপেক্ষার উত্তরে। তাই সোজা চেতলার রাস্তায় এগোতে থাকি। একটা গুরদুয়ারা পড়ে, তার একটু পর ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশান। ব্রীজের মুখে দাঁড়ালেই তার ফ্যাটফ্যাটে সাদা চুড়ো দেখা যায়। চুল্লীর ধোঁয়া দেখা যায়। থামি। এরপর বিপথ। ফুটপাথ বদল হয় বিকেল না হতেই। ফিরে আসি পথে।
দিল্লী যাচ্ছি সেবার। একাই, পড়াশুনোর কাজে। এসি চেয়ার-কার ট্রেন। ছিটেফোঁটা ঘুম আসছে না। রাত ১২টা গড়িয়ে ১টা গড়িয়ে ২টো। চারদিকটা অদ্ভুত নিঃশব্দ। শুধু বন্ধ কাঁচের ও'পারে লাইনে চাকা ঘষে যাওয়ার আওয়াজ। কামরার সাদা আলোগুলো আমার চোখে গলে গলে পড়ছে যেন। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, ট্রেন নয়, অপারেশন থিয়েটার। কথা বলার কি কেউ নেই আশেপাশে? সাংঘাতিক অমূলক ভয় করতে শুরু করেছে আমার। এতক্ষণ আমার পাশে গভীর ঘুমে কাদা মানুষটি হঠাৎ জেগে উঠলেন, যেন আমার সঙ্গে কথা বলবেন বলেই। অবাঙালী, কোনো পরিচয়ই নেই। অথচ আশ্চর্য হাসি হাসি মুখে প্রশ্ন করলেন, "এনি প্রবলেম?" আমি ঘাড় নাড়লাম। দিল্লী আসার আগে সময়টা তাঁর সঙ্গে কথা বলেই কাটলো আমার। দিল্লীতে নেমে তিনি চলে গেলেন জয়পুরের কানেকটিং ট্রেনের খোঁজে। আমি, আজমেরী গেটের দিকে। বলে গেলেন, দেখা হবে। কবে, কোথায়, বললেন না। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আবার পথের কাটাকুটি হবে আমাদের। হয়তো আরো চল্লিশ বছর পর, কিন্তু হবে। সেই থেকে আমি সমস্ত সাক্ষাতের শেষে "দেখা হবে" বলি। শুধুই কি পথ? পথের প্রতিশ্রুতি বড় নয়?
রামেশ্বরমে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টির প্রস্তুতি প্রায় শেষ, এবার ঝমঝমিয়ে এলেই হয়। সমুদ্রের গা দিয়ে একটা ভাতের হোটেলে আমরা এসেছি দুপুরের খাওয়া সারতে। হাত-ধোয়ার বেসিনের সামনে দাঁড়ালে, সামনেই সমুদ্র, মেঘের নিচে ফুলে, ফুঁসে উঠছে। বছর আঠারোর একটি ছেলে অর্ডার নিতে এলো। তখন ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবেলেমে আমরা এমন জর্জরিত, যে কোন ভাষায় অর্ডার দেব এই ভেবেই কুলিয়ে উঠতে পারছি না, এমন সময় সে বললো, "সবার জন্য মাছের ঝোল আর ভাত তো?" আমরা তো থ! হাতে চাঁদ পাওয়া বোধ হয় একেই বলে! খাওয়া-দাওয়ার শেষে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, "তোমার বাড়ি কোথায়?" "মেদিনীপুরে ছিল। ছোটবেলায় পাঠিয়ে দিয়েছে এদিকে।" ছেলেটি পশ্চিমবঙ্গের খবর নিতে নিতে আমাদের থালাগুলো তুলে নেয়, টেবিল মুছে দেয় এঁটো ফেলে। প্রথম আমার মনে হয়, বাংলা এখান থেকে বড্ড দূরে! ছেলেটি আর বাড়ি ফেরে না এখন, ফিরবে কিনা জানি না। কিন্তু যদি ফিরতে চায়? কত সমুদ্র শেষে তার বাড়ি? মেঘের নিচে সমুদ্র রং বদলায় বাইরে, আর পথও বদলে বদলে যায়।
এবার হয়েছে সন্ধ্যা। পথকে বছর দিয়ে ভাগ করার সময়। ঠিক যেমন কবিতা আসলে একটাই, আমরা কেবল নাম দিয়ে তাকে ভাঙি, পথকেও আমরা ভেঙে নিই বছরে। নতুন, পুরোনো, ইত্যাদিতে। কিন্তু তাতে পথের মনে হয় বিশেষ কিছু আসে যায় না। এমন সন্ধ্যায়ই আমরা ফোনের এ' পারে ও' পারে অন্তাক্ষরী খেলে কাটিয়েছি কিশোর কুমারের গান নিয়ে। বা, এভাবেই সন্ধ্যা নেমেছে কৌশানীতে ২০০১ সালে, আর অন্ধকারে থুম মেরে থেকেছে বরফমোড়া হাতিপাহাড়। আর ঠিক এর পরেই, রাতের মুখে নীললোহিত বেরিয়ে গেছে বাড়ি ছেড়ে চিরন্তন সাতাশের দিকে, আর তুমি কিনা ভাবলে পারো নি? এক পথ থেকে অন্য পথে পালিয়েছি বলেই আমরা ভালো আছি, জেনো। অনেকের থেকে ভালো আছি। অস্থির হয়ো না। সময় শেষ হয়; পথ নয়।
আমার বিশ্বাস, এই শহরে আলাদাভাবে পথ চলতে চলতে আমরা একসঙ্গে যদি হঠাৎ কি যেন মনে করে পিছন ফিরে তাকাই, দেখবো, বারাণসীর নির্জনতম ঘাটেও একটি প্রদীপ জ্বালা হয়েছে আরতির জন্য, কোনো অরণ্যেই আর মানুষের সন্ত্রাস নেই, ছোটদের আবার 'সহজ পাঠ', 'শিশু' পড়ানো হচ্ছে, আর আরো দূরে, রামেশ্বরমে বৃষ্টি ধরেছে। ছেলেটি ভাবছে, বাড়ি ফিরবে কিনা এই বর্ষায়…
বিশ্বাস রাখো, পথ আছে এখনও।
বেশ সুন্দর ❤️
দুটো জায়গার মাঝে প্রায় apparate করতে হচ্ছিল আর কি! অরণ্যের সন্ত্রাস যেমন গোটা পৃথিবীর, শিশু, সহজ পাঠ তেমন একটা বদ্বীপের... বেশ দ্বৈত্য!
ভালো লাগল।
সোমালী, ধন্যবাদ। ❤️ হ্যাঁ, ঠিকই। তবে কী চাই ভাবতে গিয়ে এই দুটো মনে পড়ছিল, আরও কিছুর সঙ্গে...
ধন্যবাদ, অভ্যু।
এক পথ থেকে অন্য পথে পালিয়েছি বলেই আমরা ভালো আছি, জেনো।
বড় ঠিক কথা।
সুন্দর লেখা।
ধন্যবাদ, অনিন্দিতা দি। মতামত পেয়ে ভালো লাগল।