এলেবেলে (পর্ব - ৬) : উঁকি মারে আকাশে
ছোটবেলায় আমাদের বাড়ি ছিল দেড়তলা। পিসিদের বাড়ি তিনতলা। মাসিদের কোয়ার্টার তিনতলা। ইস্কুলবাড়ি তিনতলা। তিনতলা বাড়ি দেখলে মাথা-ঘাড় পিছনে হেলিয়ে দিতে হতো। মনে হতো, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বাড়ি তিনতলা।
তারপর চোখের সামনে একদিন যোধপুর পার্কেরই একটা তিনতলা বাড়ি ভেঙে দিয়ে তৈরি হলো ছ'তলার ফ্ল্যাটবাড়ি। গৃহস্থবাড়ির নিভৃতি ভেঙে একইরকম দেখতে খুপরি তৈরি হলো, ছোট দরজা - ছোট জানলা - ছোট বারান্দা - বড় দর নিয়ে। ঘাড় আরও একটু পিছনে হেললো। পিছনে সায়নদীপ থাকতো সবসময়ই, সামলে নেওয়ার জন্য। উল্টে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তেমন ছিল না আমার।
তারপর একদিন বিবিসিতে দেখলাম, দুটো প্লেন মিলে ১১০ তলার দুটো বাড়িকে মাটিতে মিশিয়ে দিল। লো-অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরা রাখা। তাতে বারবার ধরা পড়ছে, কালো আর ছাই-ছাই ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে আমেরিকা, বিল্ডিংদুটো রংমশালের ফুরিয়ে আসার মতো নেমে আসছে।
তারপর আরও কত বহুতলের গল্প শুনেছি, চোখে দেখেছি, টিভিতে দেখেছি। কলকাতায় গেরস্থালীর নিভৃতি পেরিয়ে প্রায় সবাইই মাথা গুঁজেছে ফ্ল্যাটে। আমাদের বাড়ি তবু বাড়িই আছে, দেড়তলা থেকে তিনতলা হয়েছে শুধু। আমার ছোটবেলার সবচেয়ে উঁচু বাড়ির সমান।
এখন আর আসা-যাওয়ার পথে মাথা তুলে বাড়ির তলা গুনি না। গুনলেও কিছু একটা অবাক হই না। একটা সংখ্যা আসবে। ৬, ৮, ২১, ৩৬, যা খুশি। যতই আসুক, একটু উঁকি মারলেই তার পিছনে আরও উঁচু কিছু দেখতে পাবো। একগাদা বহুতলের দিকে তাকানোর মধ্যে তাদের ফাঁক দিয়ে দিয়ে আকাশ দেখতে পাওয়ার যে একটা প্রচ্ছন্ন আনন্দ ছিল, আজকাল তাও হারিয়েছে।
আছে শুধু হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে যাওয়া একফালি গ্রামবাংলা। যাওয়ার পথে, ফেরার পথে। সবুজ, শ্রাবণের জলভরা প্রান্তর। এক মাথায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটা তালগাছ। ভাদ্র আসন্ন। তাল পড়বে। মুখের ঠুলি, শহুরে ভালোবাসার চর্যাপদ সরিয়ে রেখে আবার আমি মুখ তুলি, ছোটবেলার মতো।
মেঘ-ভাঙা রোদ। প্রকৃতির আদি, অকৃত্রিম বহুতল, তালগাছ। যেন হু-হু করে আরও লম্বা হয়ে যাবে শূন্যের দিকে। হোক। দুঃখ নেই। ইঁট-পাথরের বহুতলের মতো নয় ওরা। একসময় ঠিক বুঝবে, "মা যে হয় মাটি তার"...
খুব খুব সুন্দর ...
বজ্রপাতে নিহত যেন অন্তিম নিয়তি!
ভালো থাকিস, সুদীপা। :) ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
বিপ্লব বাবু, ধন্যবাদ আপনাকে। :)