দীর্ঘদিন স্কুলে পড়িয়েছি।তাই অভ্যাসবশত হাতের কাছে বাংলা পাঠ্যবই পেলেই দেখতে বসে যাই। ভালোও লাগে। তবে মনে মনে একটু আপসোসও হয়। কারণটা বলি। এক ক্লাসে সবার জন্য এক সিলেবাস। সেটাই নিয়ম। কিন্তু বুঝতে পারি, পড়াতে বসে, সবার কাছে পৌঁছতে পারি না। কারণ অনেক সময়ই ক্লাসে দু’এক জন থাকে যারা হয়তো অন্যদের থেকে একটু ধীরে ধীরে শেখে। তাদের জন্য আজকাল অনেক স্কুলেই বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু একই সঙ্গে মনে হয়, সিলেবাসের মানের ক্ষতি না করে সিলেবাসের ভার হয়তো আরেকটু কমানো সম্ভব। তাতে আমরা শিক্ষকরা হয়তো আরও একটি বেশি ‘সবার’ হয়ে উঠতে পারব। এই নিয়ে ভিন্ন মত, তর্ক থাকতে পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক। তবু মনে হয় এই নিয়ে কথা তো শুরু হোক। সেটাই আমার এই প্রতিবেদনের বিষয়। আমার প্রশ্ন, শিক্ষা সবার জন্য, সিলেবাস কি সবার জন্য হয়ে উঠতে পেরেছে? না কি এই নিয়ে আরও দরদী ভাবনার প্রয়োজন আছে!
প্রাথমিক ভাবে বিভিন্ন বোর্ডের বাংলা সিলেবাসের নির্মিতি অংশ নিয়েই আমার মনে এমন প্রশ্ন জাগে। ধরা যাক, সমার্থক শব্দ পড়াতে গিয়ে জলের প্রতিশব্দ শিখিয়েছি- অপ, সলিল,অম্বু, উদক, তোয়, পয়ঃ, নীর, পানি, ইলা ইত্যাদি। বা কন্যা শব্দের প্রতিশব্দ শেখাতে হয়েছে তনয়া, দুহিতা, আত্মজা, নন্দিনী, মেয়ে, দারিকা, ইত্যাদি। বা পৃথিবীর প্রতিশব্দ শেখাতে গিয়ে শিখিয়েছি- ধরা, ধরণী, বসুধা, ভূ, ধরিত্রী, মেদিনী, ক্ষিতি, জগত ইত্যাদি। এত সমার্থক শব্দ মুখস্থ করিয়ে পড়ুয়াদের লাভ কী! কিন্তু আমরা যারা পড়াই তাদের শেখাতেই হবে। অন্ধের মতো মুখস্থ করা ছাড়া ছোটোদের কাছেও কোন উপায় থাকে না!
জলের প্রতিশব্দ উদক, পয়ঃ, অম্বু, সলিল, তোয়। ছোটোরা কি সব সময় ব্যবহার করে জল বলতে এই শব্দগুলি? একেবারেই না। এই সব শব্দ বড়ো হয়ে জানলেও ক্ষতি নেই। জলের একটি প্রতিশব্দ বারি। গানে শব্দটা মাঝে মধ্যে শুনে থাকতেও পারে ছোটরা। তবে সাধারণভাবে কখন আমরা বলি না বারি দিয়ে স্নান করলাম। পরে যখন রবীন্দ্রগানে শুনবে বারিধারা, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বারির অর্থ যে জল তা তখনও না জানা থাকলে জেনে নিতে, বুঝে নিতে কোনও অসুবিধাই হবে না।
তাছাড়া যখন ক্লাসে পড়বে, এক কথায় প্রকাশ, ‘বারি দান করে যে- বারিদ’, তখনও জেনে যাবে বারির অর্থ। যেমন জলদ যে মেঘের প্রতিশব্দ, ছোটোরা বুঝে যায়, শব্দটির মধ্যেই সেই ইঙ্গিত দেওয়া আছে। আলাদা করে পড়ানোর দরকার নেই। আবার ধরা যাক ঢেউ এর প্রতিশব্দ শিশুটি জানলো তরঙ্গ, ঊর্মি, লহরী, তুফান, কল্লোল, হিল্লোল। কিন্তু লেখার সময়ে কল্লোলে নৌকাটাই ভেসে গেল, লিখলে আমরা বিরক্ত হব। শব্দ জানলেই হয় না তার জন্য চাই ক্লাসে ক্রমাগত আলোচনা, যেখানে বইয়ের বাইরের অনেক কথা আসবে, সেও শেখা, হয়তো অন্যরকম করে শেখা। পৃথক পৃথক শব্দ দিয়ে বাক্য পড়িয়ে তা দিয়ে গল্প বানিয়ে শিশুদের শোনালে হয়েতো অনেকটা সুবিধা হতে পারে বলে মনে হয়। তাতে শেখা হবে, সিলেবাসের চাপ কমবে। তবে হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে সব কিছুই পরীক্ষার কথা মাথায় রেখে চললে ভুল হবে। গল্প, আলোচনা থেকে কেউ, বেশি নেবে, কেউ কম নেবে। তাতে ক্ষতি নেই। এই ভাবে সিলেবাসের চাপ কিছুটা হাল্কা করে তার জানলা-দরজার সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দেওয়া যায় কি না আমরা ভাবতে পারি।
অবসর নিয়েছি স্কুল থেকে, এখন খুদে পড়ুয়াদের সঙ্গে যোগাযোগটাই বেশি। ফলে প্রতিদিনই নতুন করে শিখছিও অনেক কিছু। সম্প্রতি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের কয়েকজন মা নির্মিতি পড়ানোর সহজ বইয়ের খোঁজ করাতে আসেন আমার কাছে। আমি যেন একটু নড়ে চড়ে বসলাম। বই তো আছেই। প্রতিশব্দ, এককথায় প্রকাশ সবই আছে। তবে সে বই হাতে তুলে দিলে সমস্যা সমাধান হচ্ছে না!
এই বিষয়ে দু চারজন শিক্ষিকের সঙ্গে কথা বললাম, জানতে চাইলাম কেন এই প্রতিশব্দ ইত্যাদি পড়াতে হবে? অনেকেই বললেন শিশুর word power এর কথাটা ভেবেই শেখানো উচিত। কেউ বললেন, ‘আলাদা সিলেবাস করা সম্ভব নাকি বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য? এটা ঠিক, আমরা যাদের পড়াই তাদের ৯৯ শতাংশকে একটা ভাগে রাখা গেলে বাকি প্রায় একাংশ মতো কি তার চেয়েও একটু কম সংখ্যক এমন পড়ুয়া আছে যাদের এই সিলবাস ভারী লাগে। নিয়ম অনুসারে একই সিলেবাস তাদের পাঠ্য। একথা সত্যি, এই ছাত্রছাত্রীরা শারীরিক ভাবে একই বয়সের হলেও তাদের মানসিক বয়সের তারতম্য আছে। ফলে অসুবিধাও আছে। কারণ, বয়সটা একটা মাপকাঠি ঠিকই, অন্যতম মাপকাঠি, কিন্তু মানতে হবে একমাত্র মাপকাঠি নয়। সমস্যাটা এখানেই। এই সংখ্যালঘুদের শিক্ষার অধিকার পূরণ নিয়ে। কিছু শিশু আছে, যারা পড়তে পারে না, শুনে শুনে শেখে, তাদের কি গল্পের মধ্যে দিয়ে, গান, ছড়ার মধ্যে দিয়ে আরো সহজ করে শেখানো যায় না? এই আলোচনাটা সামনে আসুক। একথা সত্যি আমাদের মত গরিব দেশে একই ক্লাসে আলাদা সিলেবাস করা কঠিন, তবে বিশেষ চাহিদার শিশুদের জন্য সরকার ভাবুক সিলেবাস কিছু পরিবর্তন আনা সম্ভব কি না। worksheet-এ কিছু বদল আনা যায় কি না। করলে ‘সেই’ শিশুদেরও উপকার হয়।
কিছু স্কুল আছে যেখানে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা পড়েল সেই সব স্কুলে স্পেশাল এডুকেটরদের সাহায্যে বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের শেখান হয়। এমন সুযোগ বহু জায়গাতেই নেই।
আরো একটা কথা। অনেক মায়েরা বলেন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের কাছে বই বেশি ছিঁড়ে যায়। তাই ওদের অভিভাবকদের বইয়ের বাঁধাই খুলে পাতাগুলি ল্যামিনেশন করে স্পাইরাল বাণ্ডিং করে নতুন বই তৈরি দিতে হয় অনেককেই। বিদ্যালয়ের বই ছাপানোর জন্য সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য অতি সামান্য সংখ্যক বই ল্যামিনেট করে প্রকাশ করা যায় কি না, সেটাও ভেবে দেখা উচিত। এছাড়াও কয়েকজন অভিভাবক মনে করেন বিশেষ চাহিদার শিশুদের জন্য যে বই হবে সেখানে হরফগুলি যদি আরেকটু বড়ো হয় তাদের পড়তে সুবিধা হয়। বুঝলাম তাঁরা চান, সহজ কথায়, সোজা ভাষায় ওদের আলাদা বই হোক। সে কাজ কি অসম্ভব?
খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে চর্চা হয়েছে l সুদেষ্ণা দি কে অসংখ্য ধন্যবাদ l
বাংলা ভাষা শিক্ষার ব্যপারে বেশ প্রয়োজনীয় চর্চা। আমার ধারণা, বাংলা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা সমস্যা রে দৈনন্দিন ভাষা ব্যবহার আর ভাষা শিক্ষার মধ্যে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে।
সবশেষে, একটা হালকা চালের কথা, এই লেখা পড়ে বুঝলাম যে আমিও বিশেষ ভাবে সক্ষম ছিলাম ছোটবেলায়। আমার বেশীর ভাগ বই মাস দুত্তিনের মধ্যে ছিঁড়ে যেতে - মাস চার- পাঁচের মধ্যে নতুন বই কিনতে হোত।
সত্যিই এতগুলো সমার্থক শব্দ বাচ্চাবয়সে মুখস্থ করিয়ে কী লাভ? ওয়ার্ড পাওয়ার? যে পাওয়ারের শিশু র জীবনে ইউজ নেই সেতো বোঝা।
ইন্দ্রলুপ্ত মানে টাক- সেটা জেনেও (ঠিক জেনেছি কি ম্যাম?) আমার টাকপড়া আটকায়নি। এই ধরণের আরও লেখা আসুক, আলোচনা /বিতর্ক হোক।
“এই সব শব্দ বড়ো হয়ে জানলেও ক্ষতি নেই। জলের একটি প্রতিশব্দ বারি। গানে শব্দটা মাঝে মধ্যে শুনে থাকতেও পারে ছোটরা। তবে সাধারণভাবে কখন আমরা বলি না বারি দিয়ে স্নান করলাম। পরে যখন রবীন্দ্রগানে শুনবে বারিধারা, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বারির অর্থ যে জল তা তখনও না জানা থাকলে জেনে নিতে, বুঝে নিতে কোনও অসুবিধাই হবে না।”
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। বিশেষ চাহিদার শিশু বা অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিশুদের ওপর একই পাঠক্রম অবশ্যই চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু মেধাবী ছাত্রদের জানার জন্য ছোটবেলায় কিছু মুখস্হ করাটা কিন্তু অনেকটা হার্ড ডিস্কে সেভ করার মতো। সারাজীবন থাকে। যেমন নামতা। পরে শেখা জিনিস মস্তিষ্কে বসানো ততটা সহজ নয়। পরে শুনে ‘বারি’ শব্দের অর্থ বোঝার মানে ছোটবেলায় না বুঝে গান গাওয়া। এই স্বভাব পরেও থেকে যেতে পারে। যায়। তা অনেক শিল্পীর গানে শুনতে পাই।যেমন, বিস্মরণ হয়ে যায় বিশ্বরণ , অপরশ হয়ে যায় অপরস। আবার আমাদের অনেক বন্ধু স্কুলের প্রার্থনায় গাইতো “তোমার অভয় স্পদস্পর্ষে”। ছোটবেলায় শেখানো এবং বুঝিয়ে দেওয়াটা জরুরী। ‘কোনো অসুবিধাই হবে না’ এটা বোধহয় এতোটা সহজ নয়।
কত কিছু যে জানলাম।খুব ভাল লাগলো লেখাটি
আরে স্কুলে পাঠ্য বইয়ে যা শিখেছি, তার চেয়ে ঢের বেশি শিখেছি পাড়ায় ও স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী করতে গিয়ে। গান তো না, যেন গান! কামানের গোলা একেকটা। সেইগুলো সাতজনে মিলে রিহার্সাল দিয়ে দিয়ে তোলা, সাতজনের গলা সাতরকম। দুরমুশ করে করে মোটামুটি কাছাকাছি আনা হত। ওদিকে গানের বাণী! সে আরেক পাহাড় ডিঙানো। পুরো ব্যাপারটা কঠিন গ্রুপ প্রোজেক্টের চেয়ে কম কিছু না। তবে সত্যি বলতে কি, ওইগুলো থেকেই সত্যিকার জিনিসগুলো শেখা যায়।
পৃথিবীতে যা কিছু আমাদের কাজে লাগে বা প্রয়োজন হয় ।..তাই শুধু যদি জানতে হবে তাহলে তো জ্ঞানের পরিধি টা ছোটো হয়ে যাবে আর অজানা কে জানার আগ্রহ টা শেষ হয়ে যাবে , তাই না ??ভাষা যত জানা যাবে তত ভালো বলেই তো মনে হয় ।তাহলেতো এখন শুধু স্মার্ট ফোন হোয়াটস্যাপ , ফেইসবুক ।..এই কয়েকটা জিনিসজানলেই চলবে ।..তাই কি ??
সত্যিই ছোটদের ওপর হাবিজাবি কতো কি মুখস্ত বিদ্যা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে!
আলোচনাটি গুরুত্বপূর্ণ