আমি অংশুমান। ঠাম্মা নাম রেখেছিলেন। নামের অপভ্রংশ করে কেউ বলে অংশী, কেউ অংশুমানী। কেউ বা মানী। মানী ডাক দেয় বেশ হেসে হেসে। আসলে আমার চলনে বলনে হিরো হিরো ভাব নেই। আমি কোন মতেই ‘বাপরে কী ডানপিটে ছেলে’ নই। বারবার শুনে থাকি অংশু যেন কেমন! বড্ড ন্যাকা। বাংলার দিদিমণি অনেক চেষ্টা করেছেন সবাইকে বোঝাতে, কিন্তু খুব একটা সফল হননি। তবে হ্যাঁ একদিন অবশ্য সানন্দা দিদিমণিকে বলেছে, ‘ম্যাম সূর্যের আরেক নাম তো সবিতা। তা অংশুকে সবিতা বলি! আ-কারান্ত শব্দ মেয়ে মেয়ে গন্ধ আছে’। বলে হেসেছিল। দিদিমণি কঠিন চোখের জন্য হাসিটা সারা ক্লাসে ছড়িয়ে না পড়লেও আমার থেকে দিদিমণি বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন বুঝেছিলাম।
এইসবে আমার রাগ হয় না, কেমন যেন কষ্ট হয়! ব্যথা লাগে মনে। কী করব আমি! অঙ্ক কষার থেকে আঁকতে ভালো লাগে। ফুল সাজাতে ভালো লাগে। আলপনা দিতে বেশ লাগে। গান গাইতে বেশ লাগে। আঁকতে আঁকতে গুনগুন করে গাইতেও লাগে দিব্বি। গান অবশ্য গেয়ে থাকি মনে মনে। ছুটে বেড়াই মনের সঙ্গে। বেশ লাগে। বাড়িতে অনেকে এইসব নিয়ে কৌতুক করে। তবে মা,বাবা এসে পড়লে চুপ!
আমার মা আঁকতে পারেন, প্রতিমা গড়তে পারেন। মামাবাড়িতে প্রতিমা তৈরি হয়। মা, মাসি, মামা সবাই হাত লাগাতেন শিল্পীর সঙ্গে। সে অভ্যাস মায়ের এখনও আছে। যদিও এখন কিছুই করা হয়ে ওঠে না। ইনটারনেট দেখে আঁকতে ভাল লাগে মায়ের। মাঝেমাঝে তাই আঁকেন। আর আমায় আঁকায় উৎসাহ দিয়ে যান খুব। ভালো লাগে না আমার, যখন মাকে আত্মীয়, পাড়া পড়শীরা বলে ‘অংশু মেয়ে হলে ভালোই হত। আসলে তোমার মতো তো ও অনেকটা’! মা উত্তর দেন না। মনে মনে হয়েতো কিছু উত্তর দেন। তবে আমায় বলেন, ‘আমার অংশু কিসে কম! ওর পড়তে ভালো লাগে না, তো লাগে না। বাবু আমার পাশ তো করে যাচ্ছে’। আবার কখনও মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, ‘আমার বাবুর মতো কেউ আলপনা দিতে পারে’? বাবাকেও নালিশের সুরে মনের কথা বললেন। বাবা তখনই বলে ওঠেন, ‘ছাড় ওসব কথা’।
পুজোতে এবার মামাবাড়ি যাব ঠিক হয়েছে। সোনাদিদি আসছে বিদেশ থেকে। বড়োমাসিও আসতে পারে। সোনাদিদি বিদেশে গবেষণার জন্য গেছে। পুজোর পর আমাদের বাড়িতে থাকবে দু মাস, গবেষণার কাজের জন্য।আমার আঁকার অন্যতম ভক্ত সোনাদিদি।
মহালয়ার পর পরই চলে এলাম দাদুর বাড়িতে। কী আনন্দ! দালানে বসে বসে ঠাকুরের সাজ পরালাম। সোনাদিদিও এলো হাত লাগাল। ঢাকের বাদ্যি বাজল। পাড়ার অনেকে এল। সোনাদিদির প্রশংসা করল। আমারও করল। তবে আমাকে, মাকে আবার শুনতে হল অংশু মেয়ে হলে কত ভালো হত। সোনাদিদি শুনছিল আর হাসছিল। আমায় এইসব শুনতে ভালো লাগে না। তাই একটু পরে আমি চুপ করে ছাদে চলে এলাম। এককোণায় গিয়ে বসলাম। আমার কেমন কান্না পাচ্ছিল। ভালো লাগছিল না একদম। হাঁটুতে মাথা রেখে বসে রইলাম। কান্না আসছে না। বারবার ভাবি কেন সবাই আমায় এই রকম বলে! আমার চলাটা নাকি ছেলেদের মতো নয়, একটু অন্যরকম। আমার গলার স্বর নাকি পুরুষের মতো নয়। কে বলে দিয়েছে এমন স্বরে মেয়েরা কথা বলবে, অমন স্বরে ছেলে। কোথায় লেখা আছে? আর বারবার কেনই বা এমন বলে!
এমন সময় সোনাদিদি এসে চমকে দিয়ে দুটো গরম বেগুনি হাতে দিল। হাত প্রায় পুরে যায়। ‘উ: কী গরম’! বলে উঠতে সোনা দিদি বলতে লাগল বিদেশের কথা। ওকে কত ভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে, ভারতীয় বলে অপমান করেছে। কত দূরে ওর কাজের জায়গা। ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর আমায় সরাসরি বলল, ‘কীরে ভাই, মন খারাপ করেছিস ওদের কথায়? চল একটু ঘুরে আসি। চল না। আমার দরকারও আছে’।
ইচ্ছা না থাকলেও যেতে হল। টোটো ডাকল। এ পথ, সে পথ করে করে টোটো চেপে পৌঁছে গেলাম প্রথমে তাঁতি পাড়ায়। ঘরে ঘরে তাঁত চলছে । খুব কম তাঁত মেয়েরা চালাচ্ছে। শাড়ি বানাচ্ছে পুরুষেরাই। সোনা দিদি জিজ্ঞাসাবাদ করল। এরপর আমায় নিয়ে এল কুমোর পাড়ায়। প্রতিমা বানানো প্রায় শেষ। মেয়েরা ছেলেরা মিলে প্রতিমা গড়ছে। ছেলেদের সংখ্যা এখানেও একটু বেশি। সেখান থেকে বেড়িয়ে চললাম পুতুল তৈরির কারিগরের কাছে। দেখলাম। সোনাদিদি কুনই দিয়ে ঠেলা দিয়ে বলল, ‘কীরে এরা কী তোর মতো মুখ করে আছে? না কাজ করছে’?
আমি কিছু বলার আগে টোটো ডাকল। চলল পটুয়া পাড়ায়। পট আঁছে, লতা পাতা আঁকছে মেয়েরা ছেলেরা। এবার পিঠে মেরে বলল সোনা দিদি, ‘এই যে ভেটকি মাছ, দেখলে তো শিল্পীর কোন জাত নেই। ছেলে মেয়ের কোন ভেদাভেদ নেই। তাদের কাজের মধ্যে কোন ভাগ নেই’।
কী যে বলা উচিত বুঝলাম না। মার খাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি পা চালালাম। উপায় নেই ধরে ফেলল। এর পর নানা কথা বলতে বলতে, মুড়ি খেতে খেতে বাড়ি ফিরে এলাম।
পুজো শেষ, লক্ষ্মী পুজো সেরে কলকাতায় ফেরা হল। দুদিন বাদের স্কুল। স্কুলে যেতে ইচ্ছাই করছে না। বেজার মুখে বসে আছি, এমন সময় গম্ভীর মুখে সোনা দিদি বলে উঠল, ‘ভাই তুই কি লাকি রে! আমরা পড়ি, তারপর মনে রাখার জন্য ছবি আঁকি আর তুই আগেই ছবি আঁকিস’!
বড্ড রাগ হল। বললাম, ‘লাকের কি আছে? তোমরা পড়তে ভালোবাস, আর আমি ভালোবাসি না। তাই আমি খারাপ।তারপরে আবার ছেলেদের মতো ফুটবল খেলি না, পাঁচিলে উঠে দৌড় দিই না, আরও কত কি ছেলেদের মতো পারি না..’
সোনা দিদি কাছে এসে বলল, ‘সাবাস, এইতো চাই, নিজের ইচ্ছার মতো কাজ করিস! নিজের মতো চলিস! নিজের কথা স্পষ্ট করে বলতে পারিস! আর কী চাই! আয় ভাই আমরা আজ একটা খেলা করি’।
‘সোনাদিদি আমায় ছেড়ে দাও। কালকের পড়া করতে হবে’। আমি বলে উঠতেই সোনা দিদি বলল, ‘থাম তো, আজ অন্য কাজ করব, তারপর পড়া’।
সোনাদিদি বুঝতে পারছো না, পড়া না পারলে আবার বকা খাব স্কুলে। আবার শুনব, ‘কী করছিলে মায়ের রান্নায় সাহায্য করছিলে? পড়া না পারলে এইসব কথা কেন বলে বল তো!’
এ কথা সেকথা বলার পর সোনাদিদি বলল, ‘শোন আমি তোকে গল্প বলব, তুই এঁকে যাবি’।
‘সে আবার কেমন? তোমার সব অদ্ভুত কথা সোনাদিদি’।
‘আর কথা নয়, আমার গল্প হল শুরু । সোনাদিদি আমার ইতিহাসের একটি অধ্যায় নিয়ে গল্প বলল। আমি আঁকতে লাগলাম। আমি আঁকছি সোনাদিদি গল্প বলে চলেছে। স্নান খাওয়া সেরে আবার শুরু হল আঁকা আঁকা পড়া। এইভাবে পর্বত, উপত্যকাকেও শেষ করলাম। পরেরদিন স্কুল খুলল। ক্লাসে পড়া পারলাম। আমায় আর দেখে কে!
প্রতিদিনই সোনাদিদির সঙ্গে বসে যাচ্ছি আর পড়ছি। ও পড়ছে আর আমি আঁকছি। দুদিন বাদে স্কুলে অঙ্ক ক্লাসে উপপাদ্য বোর্ডে করছি, আমার ডাক পড়ল আলপনা দেবার জন্য। অঙ্কের স্যার ঠোঁটের কাছে একটু হাসি নিয়ে বললেন, ‘যাও তোমার আসল কাজের ডাক পড়েছে’।
এতদিন এইসব শুনলে গুটিয়ে যেতাম। আজ বললাম, ‘স্যার উপপাদ্যটা করেই যাই’। স্যার বিস্ময় প্রকাশ করলেন,কিন্তু মুখে বললেন ,‘বেশ’।কে যে আমার উপর ভর করল কে জানে, উপপাদ্য সলভ করে নীচে গেলাম। স্যার এবার ভুল ধরতে পারলেন না। মনে মনে লাফালাম।
নীচে যেতেই হেডমাষ্টার বলেন, ‘অংশু পরিদর্শক মহাশয় আসবেন গ্যেটের মুখে আলপনা দেবে আর হলের ভিতরেও। খুব ভালো করে করবে। পাশ থেকে একজন স্যার বলে উঠলেন, ‘সে আর বলতে ওতো এইটাই পারে’।
হেডমাস্টার গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে আপনি একবার আসবেন তো আমার ঘরে’।
আমার আলপনা দেওয়া চলছে। জ্যামিতির ফিগারে আঁকলাম একটা আলপনা গ্যেটের কাছে। হলের ভিতরে আঁকলাম দুটো হাঁস।
পরের দিন স্কুল আরও সেজে উঠল। আমিও চনমনে হয়ে সবার সঙ্গে কাজ করলাম। পরিদর্শক আলপনা দেখে মুগ্ধ হলেন। এই দুটিই আমার হাতের কাজ শুনে হেডস্যারকে বললেন, ‘ওকে যত্ন নিন’।আরে যত্ন কী। আমার মনে হচ্ছে আকাশ ছুঁয়েছি। হঠাৎ দেখলাম আমার কাঁধের কাছে হাত রেখেছেন হেডস্যার। বলছেন, ‘আমি জানতাম তোর কাজের তুলনা হবে না’।
বাড়ি এসে সোনাদিকে বলতেই ও বলে উঠল, ‘শুরু করি আমাদের কাজ’।
কয়েক দিন আগে একটা ছোটদের জন্য পূজাবার্ষিকী পড়ে খুব খারাপ লেগেছিল। তারপর ভাবছিলাম খারাপ তো বুঝতে পারছি , কিন্তু ভালর উদাহরণ আজকের দিনে দিতে হলে কি বলি? এই লেখাটা আর সুস্মিতা কুণ্ডুর গল্পটা পড়ে মনে হল , ঠিক এই রকম গল্পই চাই ছোটদের জন্য। খুব আলো আলো গল্প।
ভালো লাগলো গল্পটা। খুব সুন্দর কনসেপ্ট।
আসলেই আমাদের ছোটোবেলার গল্প। আমার ক্ষেত্রে আঁকার বদলে ছিল গান।
অনুপ্রেরণা মূলক খুব সুন্দর একটা গল্প পড়লাম......