মেয়েমানুষদের মাইকেল ৪ (সীতা পর্ব ২)
অভদতিকার ভাবসাব যেন কেমন কেমন ঠেকছে। সীতা অনুচরীর মুখভাবখানি দেখেই বুঝলেন সে হাসতে গিয়েও কোনমতে হাসি অধরে চেপে রেখেছে। সীতার জিজ্ঞাসায় বেরিয়ে পড়ল আসল কথা। রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষ্যে নাটক হবে। সাজঘরের কর্ত্রী রেবা দেবী মঞ্চসজ্জা সমাপ্ত করলেন। অভদতিকা চাওয়ার মধ্যে চেয়েছিল একখানা অশোকের ডাল। তা দিলে না! বেশ, অভদতিকাও কিছু কম যায় নাকি? সে অমনি বল্কলটি নিঃসাড়ে বগলদাবা করে হাওয়া! বৃত্তান্ত শুনে সীতা তো চোখ পাকিয়ে অভদতিকাকে বল্কল তৎক্ষণাৎ ফেরত দিতে বললেন। এইসব রঙ্গ রসিকতা করে চরিত্র চিত্রণের রসহানি করতে আছে! কিন্তু অবদতিকা যখন বল্কল ফিরিয়ে দেবার জন্য পা বাড়াল তখন সীতা ভাবলেন দেখি তো অঙ্গে দিয়ে বল্কলখানা- কেমন মানায়। একটি আয়না আনিয়ে অনিন্দ্যকান্তা মোহময়ী সীতা অবলোকন করতে লাগলেন নিজেকে। এদিকে নেপথ্যে জয়বাদ্য বেজে উঠেও হঠাৎ থেমে গেল। রাম প্রবেশ করলেন মঞ্চে। জানালেন,অভিষেকের পুণ্যসলিলধারায় স্নাত হতে হতেও হল না তাঁর মস্তক। পিতা দশরথ তাঁকে বিশ্রাম নিতে বললেন। অভিষেক সংক্রান্ত কথাবার্তা হতে হতেই রামের চোখ পড়ল মৈথিলি’র দিকে।
‘- গয়নাগাটি সব খুলে ফেলেছো ?
-পরিইনি।
- কক্ষনো না। এখনো তোমার কানের লতিযুগল নত হয়ে আছে সবে কুণ্ডল খোলার চিহ্নসঙ্কেতে। হাতে বলয়ের দাগ এখনো স্পষ্ট যেন এই সদ্য খোলা হয়েছে।
-তোমার কথা শুনে আমারও তাই মনে হচ্ছে।
- একে একে অলংকারগুলো পর দেখি। আমি আয়না ধরি। আরে! তুমি তো বল্কল পরেছো, ইক্ষ্বাকু বংশের প্রৌঢ় এবং প্রৌঢ়াগণ বনবাসের সময়ে যে বাস পরে থাকেন। আমার তো দেখে খুবই আগ্রহ জাগছে। আন দেখি আমার জন্য একখানা।’
হ্যাঁ।
নাট্যকার ভাস তাঁর ‘প্রতিমা’ নাটকে প্রথম প্রেমের ডুবো ডুবো পানকৌড়ি পেলবতা আর খুনসুটির মাখামাখিতে সীতা আর রামের বল্কল পরিধানের ব্যাপারটা আগেভাগেই সেরে ফেলেছেন। যদিও রামের জন্য যখন সেই বল্কল এল রেবা দেবীর কাছ থেকে ততক্ষণে রাম জেনে গেছেন কৈকেয়ীর অভিপ্রায়। লক্ষ্মণের ক্রোধ শান্ত করে ফেলেছেন। এই বল্কল যেন বনবাস-যাত্রার দ্যোতক হয়েই নরচন্দ্রমার হাতে এল। তিনি পরে ফেললেন। অর্ধেক দিলেন লক্ষ্মণকে তার জোরাজুরিতে।
বাল্মীকী রামায়ণে এমন স্বর্গ খেলনা গড়তে গড়তেই কিন্তু রাম-সীতা বল্কল পরে ফেলেননি।
অতঃপর সীতা চললেন পতিদেবতা আর লক্ষ্মণ দেবরের সঙ্গে বনবাসে। রাজপথ দিয়ে তিনজনকে চলতে দেখে নগরবাসী তাদের দেখে বিলাপ করতে লাগল। সীতার সম্পর্কে তাদের বিলাপটা এরকম, যে সীতাকে পূর্বে আকাশচারী পক্ষীও দেখতে পেত না তাঁকে আজ রাজমার্গের সকল লোকে দেখছে। হায় রে, গ্রীষ্মের উত্তাপ, বর্ষার জলধারা আর দুরন্ত শীত সীতার চন্দনরঞ্জিত অঙ্গকে বিবর্ণ করে ফেলবে।
বিদায় নিতে রাজপুরীতে আসতেই দশরথ বললেন, ‘অন্তত আজ রাতটা থেকে যাও, অন্তত একদিন তুমি থাকলেও আমার ভাল লাগবে।’ রামকে আবার বলতে শুনছি, পিতার সত্যরক্ষার জন্য তিনি রাজ্য বা কোন কাম্য বিষয় বা মৈথিলিকেও চান না, পিতার সত্য রক্ষিত হোক। এই তাঁর সর্বৈব কামনা। দশরথ রামকে বচন চতুরা গণিকা, বণিক, মল্লবীর, ব্যাধ, রাজ্যের রাজ -ভাণ্ডারের বিপুল সম্পদ অর্থাৎ ধনকোষ ও ধান্যকোষ; এক কথায় সর্বস্বই সঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু ছেলের সুরাবিহীন শূন্য কলসির মতো একটা ঠনঠনে রাজ্য নিয়ে পড়ে থাকাটা কৈকেয়ীর না পসন্দ। রাম শুধু চীর খনিত্র ও পেটক চেয়ে নিলেন।
কৈকেয়ী নিজের হাতে তাদের জন্য চীর এনে দিলেন। রাম-লক্ষ্মণ তো পরে নিলেন ঝটপট। কিন্তু ‘কৌষেয়বসনা’ সীতা বাগুরা অর্থাৎ ফাঁদ দর্শনে শঙ্কিতা হরিণীরপারা হয়ে সাশ্রু নয়নে আনমনে রামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বনবাসী মুনিরা কেমন করে চীর পরেন?’ বলে একখণ্ড চীর গলায় দিয়ে আরেক খণ্ড চীর হাতে নিয়ে লজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন রাম সীতার কৌষেয় বস্ত্রের উপরেই চীর বেঁধে দিলেন। কিন্তু সীতার এই চীর পরিহিতা মূর্তি দেখে ওইখানেই ছোটখাটো একটা বিপ্লব হয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে যে ক্ষোভানল ধীরে ধীরে সকলের হৃদয়ে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল তা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিস্ফোরিত হল। অন্তঃপুরিকারা কান্নাকাটি করে বলতে লাগলেন সীতা এখানেই থাকুন। বশিষ্ঠ গেলেন ক্ষেপে। তিনি কৈকেয়ীকে এক হাত নিলেন । বড্ড বাড় বেড়েছে কৈকেয়ীর। সীতা রামের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকবেন, কোথাও যাবেন না। সীতা যদি বনবাসে যান, তাহলে তাঁরাও বনবাসে রামের অনুগমন করবেন। ভরতও এই অনিচ্ছাদত্ত রাজ্য গ্রহণ করবেন না , মাকে মায়ের মর্যাদা দেবেন না। এক্ষুণি সীতার চীর খুলে তাকে উত্তম আভরণ দেওয়া হোক। রাজপুত্রী সীতা উৎকৃষ্ট বস্ত্র, যান এবং পরিচারকবর্গ সঙ্গে নিয়ে গমন করুন। তথাপি জানকী চীর পরে রইলেন। অর্থাৎ কৈকেয়ী কিন্তু বশিষ্ঠের বকাঝকা কানেও তুললেন না। তখন দশরথ তাকে ঝেড়ে গালমন্দ করলেন। রাম কৈকেয়ীর কাছে হয়তো কোন অপরাধ করেছে কিন্তু এই সুকুমারীকন্যা কি করেছে ভরত-মাতার কাছে?
‘পিতৃসত্য পুত্র পালে বধূর কি দায়।
পতিব্রতা সীতাদেবী কেন পিছে যায়।।
নানা রত্নে পূর্ণিত যে রাজার ভাণ্ডার
সুমন্ত্র শুনিয়া আনে দিব্য অলঙ্কার।।
জানকী পরেন তাড় তোড়ন নূপুর।
মকর -কুণ্ডল হার অপূর্ব কেয়ূর ।।
মণিময় মালা আর বিচিত্র পাশুলি।
হীরক -অঙ্গুরী তাতে শোভিত অঙ্গুলি।।
দুই হাতে শঙ্খ তাঁর অদ্ভুত নির্মাণ।
করিলেন যতেক ভূষণ পরিধান।।
পট্টবস্ত্র পরিলেন অতি মনোহর।
ত্রৈলোক্য জিনিয়া রূপ ধরিল সুন্দর।।
কৃত্তিবাস এ ব্যাপারে বাল্মীকীকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছেন।
মাধবকন্দলী বিরচিত অসমীয়া রামায়ণের সীতার ক্ষেত্রেও নিয়তির অন্যথা হয় না।
‘ভণ্ডারীক নৃপতিয়ে করিলা হাঙ্কার।
সীতাক দিয়োক রাজ যোগ অলঙ্কার।।
রাজার বচন মন্ত্রী শিরোগতে লৈয়া।
তেখনে আনিলা দিব্য অলঙ্কার গৈয়া।।
নৃপতি বোলন্ত কুল বোহাবী আমার ।
পরিছেদা দেখোঁ পিন্ধিয়োক অলঙ্কার।।
তেতিক্ষণে সীতা বল্কলক তেজিলন্ত।
সুনিম্মল বস্ত্র পরিধান করিলন্ত।।
শাশু পাঞ্চশতে পিন্ধাইলন্ত অলঙ্কার।
মুকুট কুণ্ডল গ্রীবে সাতেসরি হার।।
কঙ্কণ কুণ্ডল রত্নাঙ্গুলি আরো কাঞ্চি।
সমস্ত শরীর অলঙ্কারে নিলা খাঞ্চি।।’
সুতরাং বাল্মীকীবালা সীতা চীর পরে বনবাসে যাবেন এমন প্রতিজ্ঞা দশরথ কদাচ করেননি। দশরথের আদেশে সীতার জন্য চোদ্দ বছরের মতো উৎকৃষ্ট বসনভূষণ রাজকোষ থেকে আনা হল। সীতা বিচিত্র আভরণে ভূষিত হলেন।
একনাথের শ্রীভাবার্থরামায়ণ বা মারাঠি রামায়ণেও কুললক্ষ্মী সীতাকে দশরথ বস্ত্র অলঙ্কারে সুসজ্জিতা করে বনবাসে পাঠিয়েছেন। চোদ্দ বছরের জন্য শাড়ি গয়নার বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজা গোনবুদ্ধ রচিত তেলেগু রামায়ণ বা রঙ্গনাথ রামায়ণেও সীতা বল্কল ত্যাগ করে রাজেশ্বরী হয়ে বনের পথে পা রেখেছেন।
অথচ টিভি সিরিয়ালে আমরা দেখি, সীতা চীরপরিহিতা। গেরুয়া রঙের শাড়ি পরেই তিনি চোদ্দ বছর কাটিয়ে দিলেন আর চোদ্দ বছর ধরে পরার জন্য যত শাড়িগয়না তাকে দেওয়া হয়েছিল, সেই ট্রাঙ্ক ঘাড়ে করে লক্ষ্মণ বুঝি চোদ্দ বছর বয়ে বয়ে স্পন্ডিলাইটিসের রোগ ধরিয়ে ফেললেন! হয়তো মাঝেমধ্যে কাপড়চোপড় গুলোকে রোদ খাইয়ে ন্যাপথলিন দিয়ে দেওয়া হোত!!
কিন্তু কথা হল…
কথা আরও আছে।
কম্বন রচিত তামিল রামায়ণের সীতা কিন্তু নীরব বিধুরা। তিনি কথা একেবারেই বেশি বলেন না; সরলমতি, পতিগতপ্রাণা। রাম যখন তাঁকে বোঝাচ্ছিলেন বনবাস যাত্রার কায়ক্লেশের কথা, সীতার প্রতিপ্রশ্ন ছিল,মহাপ্লাবনকালে সূর্য্যের তাপ যতই প্রখর হোক, সে কি আমাদের বিচ্ছেদের চেয়েও প্রখরতর? রাম বুঝলেন সীতাকে নিরস্ত করা সহজ নয়। কি করবেন সেকথাই রাম যখন ভাবছেন সেই অবসরে সীতা নিজেই চীর অঙ্গে ধারণ করে রামের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে স্বামীর হাতে হাত রেখে দাঁড়ালেন। অর্থাৎ বাল্মীকী সীতার মতো তিনি অতটা অভিজাত নন যে কেমন করে বল্কল পরতে হয় তা জানেনই না। যারা বল্কলধারিণী সীতাকে দেখলেন, তারা দেখামাত্রই শোকে ভূপতিত হলেন। কিন্তু তারা কেউই মারা গেলেন না। কি করেই বা যাবেন, তাদের আয়ু তো ফুরিয়ে যায় নি এখনও সুতরাং এমন শোক যখন তারা সহ্য করলেন মহাপ্লাবন এলেও তারা ঠিক সহ্য করে নেবেন। সুতরাং তারা কোন বিপ্লব না করেই সীতার চীর পরিধানের ব্যাপারটা সহ্য করে নিলেন। কম্ব-কন্যকা সীতা চীরধারিনী হয়েই বনবাসে যাত্রা করলেন।
রামচরিত মানসেও বনবাস -যাত্রাকালে সীতা বল্কলধারিণী যদিও তিনি নিজে থেকে পরেন নি, কৈকেয়ী নিজের হাতেই তাদের জন্য মুনি – বসন এনে দিয়েছিলেন।
মর্যাদা পুরুষোত্তম তথা পতি পরম গুরু যেখানে বল্কল পরিহিত সেখানে স্ত্রী দামী কাপড়চোপড় গয়নাগাটি পরে ‘শো অফ’ করবে, এই ‘দৃষ্টিকটু’ ঘটনার অপসারণের জন্যই কী বাল্মীকী রামায়ণের প্রাসাদ-বিপ্লবকে অগ্রাহ্য করে সীতাকে বল্কলধারিণী বৈরাগ্য বিধুরা করে বনবাসে পাঠালেন কম্বন আর তুলসিদাস?
উত্তর কালের গর্ভে। তবে ‘শ্রীরামাবতার চরিত’ অর্থাৎ কাশ্মীরী রামায়ণে দিবাকর প্রকাশ ভট্টও তাঁর কন্যকাকে বল্কল পরেই অরণ্যে যাত্রা করিয়েছেন।
‘য়োলুখ তানি বুর্জা ত্রোয়ুখ তাস – মখমল
পকন গয়ে ত্রিনওয়ে আজ – রাহ-ঈ -জঙ্গল’
হায় রে, যাদের গায়ে মখমলও কর্কশ ঠেকত, আজ তাদের যেতে হচ্ছে বুর্জ অর্থাৎ ভূর্জবৃক্ষের বাকল পরিধান করে…
অতঃপর বল্কল বিধুরা বা বস্ত্রালঙ্কারশোভিতা রাজেশ্বরী সীতা সুমন্ত্রের সারথ্যে হৃষ্টমনে রথে উঠলেন পতি ও দেবর সমভিব্যাহারে ।
যাত্রা হল শুরু …
তামিমৌ ত্রমি
অসাধারণ লেখা। এটি যদি গুরু পাবলিশ করে আমি কিনে নেব বলে এখন থেকে ইঁট পেতে দিলাম। ক'মাস আগে বাল্মীকি রামায়ণ পড়েছি, তাই আরো আগ্রহ হচ্ছে; বিশেষ করে অন্য ভাষার রামায়ণের সমান্তরাল আখ্যান তুলে দেয়ায়।
এগিয়ে চলুন।
আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই আমার। এইরকম অনুপ্রেরণাই লেখবার শক্তি যোগায় অনবরত...
পড়ছি, তুলনামূলক বিচার ভাল লাগল। টিভি সিরিয়ালগুলো অখাদ্য। সে প্রসংগ না আনলেও চলতো।
আরও লিখুন
না, আমার পয়েন্ট ওটাই যে, এই অখাদ্যগুলোও কোথা থেকে খাদ্য পায়...