এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  মনে রবে

  • শতবর্ষে সুকুমারী ভট্টাচার্য (১৯২১-২০১৪) : মনুবাদী স্থবিরতা নয়, বেদে আছে নিরন্তর প্রশ্ন তোলার শিক্ষাও

    কণাদ সিংহ
    পড়াবই | মনে রবে | ২৩ মে ২০২১ | ২৯৯৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • স্মরণাতীত কালে ফ্যাসিবাদের এমন দাপট এ দেশে দেখা যায়নি। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে সেই আশঙ্কাতেই উতলা হয়েছিলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। প্রাচীন ভারতীয় সমাজের স্বরূপের নিরন্তর অন্বেষণে অপরিহার্য তো বটেই, অধ্যাপক ভট্টাচার্যের যাবতীয় লেখালিখি ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লড়াইয়েরও জরুরি হাতিয়ার। শতবর্ষে গুরুচণ্ডা৯-র ‘পড়াবই’ বিভাগের শ্রদ্ধা। রইল তাঁর নিজের সাক্ষাৎকার, কন্যা তনিকা সরকারের স্মৃতিচারণ, বিজয়া গোস্বামী, রণবীর চক্রবর্তীকণাদ সিংহ-র তিনটি লেখা।
    ঋগ্‌বেদে কবি নেম ভার্গব ঘোষণা করেছেন, ইন্দ্র নেই, কারণ কেউ তাঁকে দেখেনি। চার্বাক দর্শন বস্তুজগৎকেই একমাত্র অস্তিত্ব বলে মনে করেছে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ বলে, যতদিন জীবন আছে যজ্ঞ ক’রে যাওয়া উচিত, কারণ মৃত্যুর পর মানুষের কী হয় তা অজ্ঞাত। ‘বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য’ গ্রন্থে সুকুমারী ভট্টাচার্য তুলে ধরেছেন বৈদিক সাহিত্যে প্রশ্ন, সংশয়, অবিশ্বাসের উত্তরাধিকার। লিখছেন ইতিহাসের অধ্যাপক কণাদ সিংহ


    ভারতীয় সভ্যতা কি ধর্মকেন্দ্রিক? ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদেরা অবশ্য সেরকমই মনে করতেন। জেম্‌স মিল যে ভারত ইতিহাসের যুগবিভাজন করেছিলেন হিন্দু, মুসলিম ও ব্রিটিশ যুগে, তার মূল প্রতিপাদ্যই তো ছিল প্রাক-ব্রিটিশ ভারতীয় সভ্যতার ধর্মকেন্দ্রিকতা, যেখানে ক্ষমতাসীন শাসকের ধর্মই ছিল ইতিহাসের মূল নির্ধারক, ধর্মীয় অনুশাসন ছিল প্রশ্নাতীত। ঔপনিবেশিক আমলের এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনমূলক অতীত-ব্যাখ্যার চরম মূল্য চুকিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের রক্তক্ষয়ী পরিণতিতে।



    জেম্‌স মিল


    মিলের ধারণার ঐতিহাসিক ভিত্তি যে দুর্বল, মূলস্রোতের ইতিহাসচর্চায় তা সহজেই ধরা পড়েছে। দেশভাগ-উত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের ঘটনাবলিও সাম্প্রদায়িক বিভাজন তত্ত্বের অন্তঃসারশূন্যতাই প্রমাণ করে। স্বাধীন ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন ক’রে একটি সচল ও আপেক্ষিক ভাবে সফল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র পাকিস্তান ব্যর্থ হয় পঁচিশ বছরও তার ঐক্য ধরে রাখতে। তাই ভারতবর্ষে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রবল পুনরুত্থান নতুন ক’রে প্রশ্ন জাগায় ভারতীয় সভ্যতার স্বরূপ নিয়ে। ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অজুহাতে যখন কখনও শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাসের ভিন্নতার কারণে গণপিটুনিতে একের পর এক সংখ্যালঘু-হত্যার ঘটনা উঠে আসে খবরের শিরোনামে, প্রাণের বিনিময়ে নাস্তিকতা বা ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রশ্ন করার মূল্য চোকাতে হয় অধ্যাপক কালবুর্গি থেকে গৌরী লঙ্কেশের মতো মানুষদের, ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিকেই বাদ দেওয়ার দাবি ওঠে, তখন নতুন ক’রে প্রশ্ন ওঠে ভারতীয় সভ্যতায় ধর্মের ভূমিকা নিয়ে। সত্যিই কি ভারতীয় সভ্যতা এমন এক ধর্মকেন্দ্রিক সভ্যতা যেখানে শাস্ত্রীয় অনুশাসন প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, প্রশ্ন বা সংশয়ের অর্থ ধর্মীয় সংবেদনশীলতায় আঘাত, অবিশ্বাসের অর্থ ধর্মদ্রোহিতা এবং ধর্মদ্রোহিতার অর্থ রাষ্ট্রদ্রোহিতা? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই ফিরে পড়তে হয় সুকুমারী ভট্টাচার্যের বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য, যেখানে সুকুমারী ভারতীয় ধর্মচর্যার প্রামাণ্য ইতিহাসের একেবারে গোড়ার কথায়, বৈদিক সাহিত্যে, তুলে ধরেছেন প্রশ্ন, সংশয়, অবিশ্বাসের উত্তরাধিকার।

    তত্ত্বগত ভাবে, বেদ অপৌরুষেয়, দেবতাদের সৃষ্টি। কাজেই বৈদিক সাহিত্য নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকার কথা নয়। কিন্তু বেদ নিজেই বিভিন্ন মন্ত্রের দ্রষ্টা ঋষি-কবিদের নাম ও পরিচয় সযত্নে সংরক্ষিত রেখেছে। অর্থাৎ বৈদিক সাহিত্য রচনায় মানুষের ভূমিকাকে বেদ অস্বীকার করেনি। ভিন্ন ভিন্ন রচয়িতার স্বরের বিভিন্নতা তাই বৈদিক সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সুকুমারী দেখিয়েছেন এর মধ্যে সংশয়বাদী বা নিরীশ্বরবাদী স্বরও বিরল নয়। বেদবিরোধী বিভিন্ন প্রস্থান, যেমন জৈন, বৌদ্ধ, চার্বাক, আজীবিক প্রভৃতি নিরীশ্বরবাদী হওয়া অবশ্যই প্রমাণ করে যে বৈদিক সমাজে বৈদিক ঈশ্বরবাদে অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না।



    কল্পসূত্রের বর্ণনা অনুসারে অঙ্কিত তীর্থঙ্কর মহাবীরের জন্ম। গাউশ অন পেপার। ১৩৭৫-১৪০০। সৌজন্য: ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়।


    কিন্তু, যাঁরা বৈদিক ধর্মে আস্থাশীল ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও ছিল সংশয়ের অবকাশ। মনে রাখা উচিত, বেদে বিশ্বাসী যে আস্তিক ষড়দর্শন, তার অনেকগুলিই (হয়তো বেদান্ত ও ন্যায় ব্যতীত প্রতিটিই) ছিল মূলত নিরীশ্বরবাদী। সংশয়বাদ ও নিরীশ্বরবাদ ভারতীয় দর্শনে অত্যন্ত প্রভাবশালী। কিন্তু নাস্তিক্য? কোন্‌ বিচারে নিরীশ্বরবাদী দর্শনও ‘আস্তিক’ দর্শনের আখ্যা পায়? নাস্তিকতা কি তবে ঈশ্বরে অবিশ্বাসের সমার্থক নয়? সুকুমারী উল্লেখ করেছেন, প্রাচীন গ্রিসে ‘এথেইস্ট’ বা নাস্তিক বলতে সার্বিক ভাবে দেবতায় অবিশ্বাসী বোঝাত না। বোঝাত সেই নগররাষ্ট্রের নিজস্ব দেবতাদের উপর অবিশ্বাসী। প্রাচীন রোমে রাষ্ট্রীয় ধর্মে অবিশ্বাসী খ্রিস্টানরা ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়েও নাস্তিক বলে অভিহিত হতেন। নাস্তিকতা তাই নিছক ঈশ্বরবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়, ক্ষমতাসীন রাষ্ট্র বা জনসমাজের বিশ্বাসে আস্থার প্রশ্ন। প্রাচীন ভারতে যে বিশ্বাসের ভিত্তি বেদ। নাস্তিকতার মাপকাঠি তাই বেদ, ঈশ্বর ও পরলোকে অবিশ্বাস। এই তিনটি বিশ্বাস আপাত-সম্পৃক্ত হলেও অবিচ্ছেদ্য নয়। তাই বেদে অবিশ্বাসই নাস্তিক্যের প্রধান নির্ধারক। ঠিক এই কারণেই আত্মা ও পরলোকে বিশ্বাসী হয়েও বেদবিরোধী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম নাস্তিক দর্শন, কিন্তু বেদে আস্থাশীল হওয়ায় নিরীশ্বরবাদী, পরলোকে অবিশ্বাসী সাংখ্য আস্তিক দর্শন হিসেবে স্বীকৃত। তাই, বেদের প্রামাণ্যতাকে প্রশ্ন না ক’রে বৈদিক সাহিত্যের কাঠামোর মধ্যেই ঈশ্বর, আত্মা, পরলোকের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়ে গেছে। সেই প্রশ্নের ভাষা কখনও জিজ্ঞাসার, কখনও সংশয়ের, কখনও অজ্ঞেয়বাদের, আবার কখনও সম্পূর্ণ অবিশ্বাসের। আলোচ্য গ্রন্থের মনোজ্ঞ ভূমিকায় এই প্রতিটি অবস্থানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা ক’রে সুকুমারী দেখিয়েছেন বিশ্বাসের পাশাপাশি বৈদিক সাহিত্যে সংশয়ের প্রবহমান স্বর যা কখনো-কখনো নাস্তিক্যের রূপ নিয়েছে। অজ্ঞেয়বাদী অবস্থানের (অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব সম্পর্কে জানার অসম্ভাব্যতার ধারণা) দৃষ্টান্ত বরং কম। সংশয়বাদের প্রাবল্যকে সুকুমারী দেখেছেন বৈদিক সমাজের বুদ্ধিবৃত্তির সজীবতার নিদর্শন হিসেবে। আস্তিক (ঈশ্বর, পরলোক, বেদে পূর্ণ বিশ্বাসী) ও নাস্তিক (উক্ত বিষয়গুলির অনস্তিত্ব বা অপ্রামাণ্যতায় যার নিশ্চিত বিশ্বাস) উভয়েরই দার্শনিক অবস্থান সুনিশ্চিত। এমনকি এই বিষয়গুলির নিশ্চিত উত্তর পাওয়া যে অসম্ভব, এ বিষয়ে নিশ্চয়তা রয়েছে অজ্ঞেয়বাদীরও। শুধু সংশয়বাদীর অবস্থানই অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয় তাই তাকে প্ররোচিত করে প্রশ্ন করতে। এই প্রশ্ন নিছক কৌতূহলের ফসল নয়, নিজস্ব অস্তিত্বের রহস্য ও অনুত্তরিত আত্মজিজ্ঞাসার গভীর যন্ত্রণার প্রকাশ। যে-কোনো চিন্তাশীল সমাজে এই জিজ্ঞাসা স্বাভাবিক। একইরকম মর্মযন্ত্রণা সুকুমরী খুঁজে পেয়েছেনওল্ড টেস্টামেন্ট- এর এজরার আকুতিতে।



    এজ়রা জনসাধারণকে আইন পড়ে শোনাচ্ছেন। শিল্পী গুস্তাভ দোরে। ১৮৬৬


    প্রশ্নই উন্মোচিত করে জ্ঞানান্বেষণের নতুন পথ। সেই পথ কখনও আস্তিক্যের নতুন ব্যাখা দিয়েছে। বৈদিক সংহিতা-ব্রাহ্মণের ক্রিয়াকাণ্ডের পরিবর্তে অবতারণা ঘটেছে উপনিষদের জন্মান্তরবাদ, কর্মফলবাদ ও আত্মব্রহ্ম তত্ত্বের। কখনও সেই পথ নিয়েছে সুস্পষ্ট নাস্তিক্যের ভাষা। কখনও বা শুধু প্রশ্নই উচ্চারিত হয়েছে, সন্ধান মেলেনি নতুন উত্তরের। তবু ক্রমাগত এই সমস্ত প্রশ্নের উচ্চারণই প্রমাণ দেয় সেই সমাজের চিন্তার গতিশীলতা ও প্রবহমানতার।

    সংশয়ের উৎস কী? একদিকে রয়েছে সংশয়ের তত্ত্বগত অনিবার্যতা। একমাত্র বেদান্ত ছাড়া ভারতীয় দর্শনের প্রায় সমস্ত শাখায় সর্বোচ্চ প্রমাণ প্রত্যক্ষ। কিন্তু ঈশ্বর, আত্মা, পরলোক তো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ নয়। ঋগ্‌বেদ সংহিতা-য় যে দেবতাদের স্তব-স্তুতি সংকলিত, যাঁদের উদ্দেশে যজ্ঞানুষ্ঠান, কে তাঁদের দেখেছে? যে বৈদিক দেবতারা প্রাকৃতিক শক্তির প্রতিভূ, যেমন অগ্নি বা সূর্য, তাঁদের কিছুটা প্রত্যক্ষ করা যায় বটে। অগ্নিকে প্রোজ্জ্বলিত অবস্থায় দেখা যায়, অনুভব করা যায় তাঁর দহনক্ষমতা। কিন্তু যখন অগ্নি প্রোজ্জ্বলিত নন, তখন কোথায় থাকেন তিনি? কোথায় থাকেন অন্য দেবতারা? আদৌ কি রয়েছে প্রত্যক্ষের অগম্য কোনো দেবলোক? কী ক’রে মানুষ বুঝবে কোন্‌ মন্ত্রে দেবতারা প্রীত হন? কোন্‌ ধরনের যজ্ঞ, কোন্‌ ধরনের আহুতি তাঁদের পছন্দ? স্তব-স্তুতি কি আদৌ দেবতারা শোনেন, গ্রহণ করেন যজ্ঞের আহুতি? আদৌ কি আছেন তাঁরা? সুকুমারী দেখিয়েছেন, ঋগ্‌বেদ-এর সময় থেকেই এইসমস্ত প্রশ্ন উচ্চারিত হয়েছে বারবার। কখনও তা নিছক প্রশ্ন, কখনও গভীর সংশয়, কখনও বা নাস্তিক্যের ঘোষণা। যেমন, ঋগ্‌বেদ-এর প্রধানতম দেবতা আর্যদের প্রাচীন যুদ্ধাভিযানের দেবায়িত নায়ক ইন্দ্র। কিন্তু কে তাঁকে দেখেছে? তাই ঋগ্‌বেদ-এর কবি নেম ভার্গব ঘোষণা করেছেন, ইন্দ্র নেই, কারণ কেউ তাঁকে দেখেনি। অবশ্যই এর বিপরীত মতও রয়েছে, বৈদিক ঋষিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মত সেটাই। কবি গৃৎসমদ বলিষ্ঠ ভাবে উচ্চারণ করেছেন সেই বিশ্বাস—যিনি শত্রু সৈন্যদের দমন করে এনে দিয়েছিলেন বিপুল ধনসম্পদ, তাঁর অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারে কে? যিনি অতীতে এই কাজ করে দেখিয়েছেন তিনি ভবিষ্যতেই বা পারবেন না কেন? ইনিই তো সেই ইন্দ্র! কিন্তু নেম ভার্গবের উক্তিও যে ঋগ্বেদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, গৃৎসমদকে যে বারংবার মনে করিয়ে দিতে হয়েছে ইনিই সেই ইন্দ্র, তা প্রমাণ করে আদি বৈদিক সমাজে সংশয়বাদী ও নাস্তিক্যবাদী অবস্থান অগ্রাহ্য করার মতো ছিল না।



    ঐরাবতে আসীন ইন্দ্র। বান্তেয়ি শ্রেয়ি মন্দিরগাত্রে ভাস্কর্য। কাম্বোডিয়া। দশম শতক


    গৃৎসমদের উক্তি স্পর্শ করে যায় বৈদিক বিশ্বাস ও সংশয়ের আর-এক গুরুত্বপূর্ণ পরিসরকে। আগে যিনি ছিলেন, যাঁর কীর্তি এখন প্রত্যক্ষ করা না গেলেও পূর্বপুরুষেরা প্রত্যক্ষ করেছেন, তিনি কি এখন নেই? মৃত্যুই কি অস্তিত্বের শেষ? পৃথিবীর সর্বত্র এই সংশয় মানুষকে ভাবিয়েছে। ঋগ্‌বেদ–এর ঋষিরা মূলত ঐহিক জগতেই আগ্রহী। শতায়ু হয়ে ইহলোকের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করাই তাঁদের প্রার্থিত। কিন্তু সেই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অর্থ কী, যদি মৃত্যু নিমেষেই তা ছিনিয়ে নেয়? মৃত প্রিয়জন কেমন আছে, কোথাও কি আছে, এই উদ্‌বেগ বারবার কণ্টকিত করে ঐহিক সুখকে। মানুষের কাছে এর উত্তর নেই। আদি বৈদিক যুগ এর উত্তর খুঁজেছে প্রথম মৃত মানুষ, পরলোকের দেবায়িত অধিপতি যমের কাছে। মৃত্যুর পরের যাত্রাপথ দুর্গম, বিপদসঙ্কুল। প্রথম মৃত মানুষ যম সেই পথে আগে গেছেন, চেনেন সেই পথ। মৃত প্রিয়জনের বিদেহী আত্মাকে আত্মীয়েরা তাই যমের হাতে সমর্পণ ক’রে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। যম তাকে পথ দেখাবেন। যমের তত্ত্বাবধানে সে মোটামুটি সুখেই থাকবে পরলোকে। কিন্তু এই সমাধান কি আশ্বস্ত করতে পেরেছে সকলকে? প্রত্যক্ষই সর্বোচ্চ প্রমাণ। কে প্রত্যক্ষ করেছে যম, আত্মা, পরলোক? সংশয়ের অবকাশ তাই রয়েই যায়। প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ ব’লে মনে করা চার্বাক দর্শন তাই বস্তুজগৎ-কেই একমাত্র অস্তিত্ব বলে মনে করে। দেবতা, আত্মা, পরলোক কোনো কিছুকেই চার্বাক দর্শন স্বীকার করে না। এই অবস্থান নাস্তিকতার। কিন্তু পরলোক নিয়ে সংশয় কি দানা বাঁধেনি আস্তিক্যবাদী বৈদিক পুরোহিতের মনেও? যে যজুর্বেদ বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রধান নিয়ামক, তারই অন্তর্গত তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-এ বলা হয়েছে, যতদিন জীবন আছে নিয়মিত যজ্ঞ ক’রে যাওয়া উচিত, কারণ মৃত্যুর পর মানুষের কী হয় কেই বা জানে?

    মৃত্যু রহস্যের মতোই সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কেও মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার ধারণা আদি বৈদিক যুগের শেষ পর্যায় থেকেই সংশয়ান্বিত করেছে মননশীল ঋষিদের। কে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা? দেবতারা? কিন্তু তাঁদের সৃষ্টি করলকে? তবে কি দেবতাদেরও ঊর্ধ্বে রয়েছেন কোনো আদি সৃষ্টিকর্তা? কে তাঁকে জন্মাতে দেখেছে? প্রশ্ন উঠেছে ঋগ্‌বেদ–এর নবীনতম অংশ দশম মণ্ডলের ‘অস্যবামীয় সূক্ত’-তে। কেউ কি জানে এই রহস্যের উত্তর? ‘নাসদীয় সূক্ত’-র ঋষি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে দেবতারাও এসেছেন সৃষ্টির পরে, তাই তাঁরাও কি জানেন এই রহস্যের উত্তর? একমাত্র যে আদি স্রষ্টা ঈশ্বর তিনি হয়তো জানেন এর উত্তর, হয়তো তিনিও জানেন না! সৃষ্টিরহস্যের মূলে প্রাকৃতিক শক্তির প্রতিভূ দেবতাদেরও ঊর্ধ্বে একমাত্র আদি স্রষ্টার ধারণা একদিকে বিশ্বজগতের সৃষ্টির একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু প্রচলিত বৈদিক ধর্মের কাঠামোকে আরও সংশয়ের মুখে ফেলে। কে এই একেশ্বর? সুকুমারী দেখিয়েছেন, ‘হিরণ্যগর্ভ সূক্ত’-এর শেষে এই দেবতাকে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের অন্যতম প্রধান দেবতা প্রজাপতির সঙ্গে এক ক’রে দেখানো হলেও, সমগ্র সূক্তটি পাঠ করলে সহজেই বোঝা যায় উদ্দিষ্ট হিরণ্যগর্ভ কোনো পরিচিত বৈদিক দেবতা নন, তাঁদের সকলের ঊর্ধ্বে এক আদি স্রষ্টা ঈশ্বর। এই ঈশ্বরই যখন সর্বশক্তিমান একক, তবে কোন্‌ দেবতাদের উদ্দেশে অর্পিত হয় যজ্ঞের আহুতি—বারবার এই প্রশ্ন তুলেছেন এই সূক্তের কবি।

    তবে বৈদিক সমাজে সংশয় ও নাস্তিক্যের উৎস শুধু বৌদ্ধিক নয়। সুকুমারী সংশয়কে স্থাপন করেছেন মানুষের বস্তুগত প্রয়োজনের জগতে, বাস্তব জীবনের চাওয়া-পাওয়ায়। যে ঐহিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আকাঙ্ক্ষায় যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন, কিছু যজ্ঞ কাকতালীয় ভাবে সেই ফল প্রদানে সফল হলেও, ব্যর্থ যজ্ঞ বারবার মানুষকে সংশয়ান্বিত করেছে যজ্ঞের সঠিক পদ্ধতি নিয়ে, অভীষ্টসাধনে যজ্ঞের সার্থকতা নিয়ে, এমনকি যজ্ঞে উপাস্য দেবতাদের অস্তিত্ব নিয়ে। ব্যর্থ যজ্ঞের সংখ্যা যত বেড়েছে তত ব্যাপ্ত হয়েছে সংশয়। অবশেষে যজ্ঞপন্থী মীমাংসা দর্শনের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকর্তা কুমারিলকেও স্বীকার করতে হয়েছে প্রত্যক্ষ ফলপ্রদানে যজ্ঞের অক্ষমতা। সংহিতা-ব্রাহ্মণের যজ্ঞকেন্দ্রিক ধর্মের বদলে আরণ্যক সাহিত্য যজ্ঞকে দেখতে চেয়েছে রূপকার্থে, বৈদিক দেবতাদের স্থান গ্রহণ করেছেন এক সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বর। কিন্তু, সর্বশক্তিমান কল্যাণকর ঈশ্বরের উপস্থিতির সঙ্গে বাস্তবজীবনের অভাব, অনটন, বিপর্যয়, রোগ, অকালমৃত্যু তৈরি করে এক চরম অসংগতি। এই অসংগতি আরও বৃদ্ধি পায় পরবর্তী বৈদিক যুগের স্থিতিশীল, শ্রেণিবিভক্ত, বর্ণবিভক্ত সমাজে, যেখানে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাগ্যে ছিল দারিদ্র্য, অনাহার, শোষণ, বৈষম্য, অত্যাচার। সংশয় ও নাস্তিক্য তখন হয়তো জনমানসে এতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল বলেই লোকমানসের প্রতিনিধি স্থানীয় সংশয়বাদী দার্শনিকদের প্রশ্নও বৈদিক সাহিত্যে স্থান পেয়েছে, নাস্তিক্যধর্মী বস্তুবাদী চার্বাক দর্শন অভিহিত হয়েছে ‘লোকায়ত’ নামে, বৈদিক বা অবৈদিক কোনো দর্শনের আলোচনাই শুরু হতে পারেনি লোকায়ত দর্শনকে খণ্ডন না করে। আদি বৈদিক যুগের ঐহিক সুখময় শতায়ু জীবন যখন অধিকাংশেরই কষ্টকল্পনা, বরং জীবন নামক অস্তিত্বটাই যন্ত্রণার নামান্তর, তখন বৈদিক যাগযজ্ঞে অনাস্থাশীল বুদ্ধের মতো দার্শনিকেরা খুঁজেছেন দুঃখময় জীবন থেকে মুক্তির পথ।



    প্রলোভনের সামনে বুদ্ধ। উত্তর তোরণ। সাঁচি স্তূপ


    ঐহিক ও দৈহিক সুখ নিশ্চিত করতে বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানের অপারগতা ক্রমশ দেহের পরিবর্তে দেহ-বহির্ভূত সত্ত্বাকে স্থাপন করেছে চিন্তার কেন্দ্রে। এই নতুন দার্শনিক তত্ত্ব জন্ম দিয়েছে বহু প্রশ্নের, যার পরিচয় বহন করছে উপনিষদগুলি। দেহাতীত আত্মা, যা দেহকে আশ্রয় করে মাত্র, আসলে সর্বব্যাপী একক অস্তিত্ব ব্রহ্মের স্বরূপ, এই উপলব্ধি আত্মাকে দেবযানের পথে মুক্ত করে জন্মমৃত্যুর বন্ধন থেকে। বাকি আত্মা পিতৃযানের পথে ফিরে আসে পৃথিবীতে, আবার জীবনযন্ত্রণা ভোগ করতে। বাস্তবজীবনের দুর্ভোগের কারণ তাই অজ্ঞানতা। যন্ত্রণামুক্তির উপায় যন্ত্রণার আধার বস্তুগত দেহকে অস্বীকার করা। এই আত্মব্রহ্মতত্ত্ব হয়তো জীবনের যন্ত্রণাময় অস্তিত্বের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে, বাতলেছে মুক্তির পথ—শোষণ ও বৈষম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও একটা সুস্থিতি প্রদান করেছে নিপীড়িত মানুষের জীবনযন্ত্রণার জন্য তারই পূর্বজন্মের কর্মফল ও অজ্ঞানতাকে দায়ী ক’রে। কিন্তু তাতেই কি সংশয়ের অবসান ঘটেছে? কী প্রমাণ মৃত্যুর পরে দেহ-বহির্ভূত আত্মার অস্তিত্বের? কঠোপনিষদ-এ বালক নচিকেতা এই প্রশ্নই করেছেন স্বয়ং যমকে। যম এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ইতস্তত করেছেন, জানিয়েছেন মৃত্যুরহস্য নিয়ে সংশয়ান্বিত ছিলেন স্বয়ং দেবতারাও। অবশেষে উপযুক্ত পাত্র নচিকেতাকে তিনি শুনিয়েছেন আত্মার কথা, দেবযান ও পিতৃযানের কথা, ঔপনিষদিক দর্শনের কথা। কিন্তু এর পিছনে কোনো প্রমাণ যম দেননি, জানাননি কোন যুক্তিতে দূর হয়েছিল দেবগণের সংশয়। বরং বুঝিয়েছেন এই তত্ত্ব যুক্তিতর্কের অগম্য, বিশ্বাসী শ্রোতাই এর অধিকারী। বৈদিক ধর্ম নিয়ে সংশয়ের পরিসর থেকেই উপনিষদের নতুন তত্ত্বের সৃষ্টি। কিন্তু এক বিশ্বাসের পরিবর্তে উপনিষদ এক নতুন বিশ্বাসের অবতারণা করে। সংশয়ের নিরসন তাতে হয় না। ঔপনিষদিক তর্কবিতর্কের বিবরণে তাই প্রায়শই দেখা যায় প্রশ্নগুলি খুব স্পষ্ট, কিন্তু উত্তর বহুক্ষেত্রেই সাঙ্কেতিক, অপ্রাসঙ্গিক বা অস্পষ্ট। বৃহদারণ্যক উপনিষদ-এর নায়ক আত্মব্রহ্মতত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা যাজ্ঞবল্ক্য বিদেহরাজ জনকের আয়োজিত ব্রহ্মোদ্যে (ব্রহ্মজ্ঞান-সংক্রান্ত বিতর্কসভা) বা জনকের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এভাবেই প্রশ্নের মোকাবিলা করেছেন। বিতর্কের মাঝেই গার্গীকে সতর্ক করেছেন অতিপ্রশ্ন না করতে, যে সতর্কবাণী না মানায় মাথা খসে পড়েছে শাকল্যের। অনেক প্রশ্নই তাই রয়ে গেছে অনুত্তরিত। দূর হয়নি সংশয়ের অবকাশ। চিন্তাশীল ব্রহ্মজ্ঞানী নিজেও কি হতে পেরেছেন নিঃসংশয়? শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মজ্ঞানী নির্বাচনের সভায় যাজ্ঞবল্ক্য স্বয়ং স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছেন যে প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানী প্রণম্য, কিন্তু সভাস্থ সকলেই এসেছেন পুরস্কারের গাভীর লোভে। ব্রহ্মজ্ঞানের আলোচনার বিনিময়ে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন জনকের দেওয়া বিভিন্ন পারিতোষিক। আত্মব্রহ্মতত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হয়েও তাই তিনি বলতে দ্বিধা করেননি যে মৃত্যুর পর চেতনা থাকে না। প্রকৃতপক্ষে সংশয়ী কোনো নির্দিষ্ট বিশ্বাসের কাছে নিজস্ব চিন্তার স্বাধীনতা বিসর্জন দেন না বলেই স্বীকার করতে পারেন বিভিন্ন সম্ভাবনাকে। এই কারণেই শতপথ ব্রাহ্মণ-এ গোমাংস ভোজনের বিপক্ষে বিভিন্ন অনুশাসন দিয়েও যাজ্ঞবল্ক্য বলতে পারেন, তিনি কিন্তু গোমাংস খাবেন, যদি রান্না ভালো হয়। চিন্তার এই স্বাধীনতা, বিভিন্নতার, সংশয়ের, প্রশ্নের এই স্বীকৃতিই সংশয়বাদী এমনকি নাস্তিক্যবাদী উচ্চারণকেও বৈদিক সাহিত্যে স্থান দিয়েছে। সুকুমারীর কাছে মুক্তচিন্তার এই প্রাচীন ঐতিহ্য এক গর্বের উত্তরাধিকার।

    অমর্ত্য সেনের বিখ্যাত প্রবন্ধ সঙ্কলনের মতোই সুকুমারী ভট্টাচার্যের এই বইটি আমাদের ফিরে পড়ায় ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ মনীষার পরিচয়। বৈদিক সাহিত্যে সুকুমারীর বিপুল বৈদগ্ধ্য তুলে ধরে বেদের এক অভিনব, বিকল্প পাঠ। এই পাঠেরও সমস্ত সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রশ্নাতীত নয়। নিপীড়িত নিম্নশ্রেণি ও নিম্নবর্ণের জীবনবিমুখতাই কি জন্ম দিয়েছে সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিকামী দর্শনের—উপনিষদের আত্মব্রহ্মতত্ত্ব বা বুদ্ধের দুঃখবাদের? উপনিষদের তাত্ত্বিকরা কিংবা বুদ্ধ, পার্শ্বনাথ, মহাবীর—সকলেই তো উচ্চবর্ণের, উচ্চশ্রেণির মানুষ। ভোগবিলাসের প্রাচুর্যের অভিজ্ঞতাই কি জীবন, সুখ, সম্পদের অনিত্যতা সম্পর্কে সচেতন ক’রে তোলেনি সমাজের উপরতলার একাংশকে? আড়ম্বরপূর্ণ যজ্ঞের ব্যয়ভার যাঁদের বহন করতে হয়েছে, যজ্ঞফলের অনিশ্চয়তা তাঁদেরকেই কি ক’রে তোলেনি সংশয়ান্বিত? জীবনসংগ্রামের সহস্র যন্ত্রণা সত্ত্বেও জীবনের থেকে মৃত্যু কি প্রীতি করছিল জনসাধারণের কাছে, নাকি আরও একটু ভালোভাবে বাঁচার আকুতিতেই সাধারণ মানুষ ফিরে গেছে সরলতর বিশ্বাসে, প্রাগ্বৈদিক পূজার্চনায়? প্রশ্ন উঠতে পারে, যে সমাজ সংশয়ী যুক্তিবাদের ঐতিহ্যকে সমর্যাদায় রক্ষা করেছে, সেসমাজে আস্তিক্যবাদী প্রস্থান কি সম্পূর্ণই বিশ্বাস ও অন্ধ আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল? প্রাচীন ভারতে বস্তুবাদী চিন্তা ও লোকায়ত দর্শনের অন্যতম গবেষক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় যাঁকে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানচর্চার পুরোধা বলে মনে করেছেন, সেই উদ্দালক আরুণি কিন্তু আস্তিক্যবাদী দার্শনিক, ছান্দোগ্য উপনিষদ-এ যিনি একের পর এক পরীক্ষার মাধ্যমে পুত্র শ্বেতকেতুকে শিখিয়েছিলেন আত্মব্রহ্মতত্ত্বের বিভিন্ন প্রতিপাদ্য।

    প্রতিটি মৌলিক গবেষণাই জন্ম দেয় নতুন প্রশ্নের, সংশয় আর প্রশ্নই খুলে দেয় জ্ঞানচর্চার নতুন পথ। সুকুমারী আমাদের মনে করিয়ে দেন সেই কথাই। সজীব জ্ঞানচর্চার যে-কোনো ধারাই তাই প্রশ্নকে সম্মান করে। বৈদিক পরম্পরাও ব্যতিক্রমী নয়। সংশয় বিচলিত করে ক্ষমতাসীন ধর্ম ও তার অনুমোদনপ্রাপ্ত রাষ্ট্রকে। কারণ সংশয় ও অবিশ্বাস নাড়া দেয় স্থিতাবস্থার ভিত্তিকে। সামাজিক-রাজনৈতিক রক্ষণশীলতার ব্রাহ্মণ্য প্রচারক মনু তাই বিরোধিতা করেন আণ্বীক্ষিকী নামক যুক্তিনির্ভর জ্ঞানচর্চার ধারার। মনুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ধারক ও বাহকদের কাছে আজও তাই চিন্তার স্থবিরতাই কাম্য, সংশয় বা অবিশ্বাস ধর্মদ্রোহিতা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এই মানসিকতা সবচেয়ে আঘাত করে প্রশ্ন, তর্ক, যুক্তিনির্ভর ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যকে, যে ঐতিহ্যেরই পরিচায়ক নেম ভার্গব ও গৃৎসমদ, যাজ্ঞবল্ক্য ও উদ্দালক আরুণি, নচিকেতা ও জনক, চার্বাক ও বৃহস্পতি, বুদ্ধ ও মহাবীর।



    বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য
    সুকুমারী ভট্টাচার্য
    পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
    মূল্য ৪০ টাকা




    সুকুমারী ভট্টাচার্যের স্কেচটি এঁকেছেন হিরণ মিত্র।

    গ্রাফিক্স: মনোনীতা কাঁড়ার
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ২৩ মে ২০২১ | ২৯৯৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২৩ মে ২০২১ ১২:০৩106342
  • @ কণাদ সিংহ, স্যার,


    আপনার অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং সুলিখিত প্রবন্ধটি পড়ে কয়েকজনকে রেকো করেছি। বিশেষ করে সংশয়বাদ নিয়ে আপনার আলোচনাটি।


    আর গৌতম, পার্শ্বনাথ ও মহাবীরের সংসারে অনীহা নিয়ে আপনার সম্ভাব্য ব্যখাটিও ভাবায়। লেনিনের ইসক্রা পত্রিকার ফাইনান্সিয়ার সাশা মরোজভ একজন সম্পন্ন পুঁজিপতি। কিন্তু লেনিন অনুসারে তার ছিল নিজের শ্রেণীর প্রতি বিতৃষ্ণা।


    দুটো প্রশ্ন ছিল, অন্যথা নেবেন না। আমার ভুল হতে পারে।


    এক, "এই কারণেই আত্মা ও পরলোকে বিশ্বাসী হয়েও বেদবিরোধী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম নাস্তিক দর্শন,"


    --প্রাচীন বৌদ্ধ (মহাযানীদের বাদ দিয়ে)এবং জৈন দর্শন কি দেহের অতিরিক্ত আত্মার এবংপরলোকের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী নয়? এজন্যেই কি এদের 'অনাত্মবাদীন' বলা হয় না? 


    দুই, পূর্ব মীমাংসার কুমারিল ভট্টের পরের দিকে যজ্ঞের কার্যকারিতায় সন্দেহ হওয়ার যদি কোন রেফারেন্স দিতে পারেন তো বড় ভাল হয়।

  • Kanad Sinha | 45.25.***.*** | ২৩ মে ২০২১ ২২:৩০106380
  • রঞ্জনবাবুর প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। মীমাংসা দর্শনে যজ্ঞবিষয়ক সংশয়ের রেফারেন্স সুকুমারীদেবীর আলোচ্য বইতেই পেয়ে যাবেন। তাই আপনার অন্য প্রশ্নটির উপরেই মূলতঃ গুরুত্ব দিচ্ছি। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মে গোড়া থেকেই জন্মান্তরের ধারণা রয়েছে। এই জন্মান্তর হয় কার ? দেহের তো নয়। অতএব দেহাবহির্ভুত অস্তিত্বের ধারণা বা পরলোকের ধারণা এই দুই ধর্মেই রয়েছে। এদের 'অনাত্মবাদী' বলার কারণ 'আত্মা' শব্দটিতে এদের আপত্তি। এরা তার বদলে এই দেহাতীত অস্তিত্বকে 'জীব' বলে অভিহিত করে। এই জীবের দেহ থেকে দেহান্তরে জন্ম থেকে জন্মান্তরে এমনকী লোক থেকে লোকান্তরে যাত্রা তারা স্বীকার করে। তাহলে 'আত্মা' শব্দটিতে আপত্তি কেন ? কারণ উপনিষদের আত্নব্রহ্মতত্ত্বে অবিশ্বাস। উপনিষদের আত্মা শুধু দেহাবহির্ভুত অস্তিত্ব নয় পরমাত্মা বা পরব্রহ্মের অংশ। তাই এই আত্মা ব্রহ্মের মতই অপরিবর্তনশীল শাশ্বত। নিরীশ্বরবাদী দর্শন স্বাভাবিকভাবেই এই ব্রহ্মস্বরূপ আত্মাকে স্বীকার করে না। বৌদ্ধধর্মের মতে জগতে কোনো স্থায়ী অস্তিত্বই নেই। জৈনধর্মে জীবের মধ্যে স্থায়ী ও অস্থায়ী উভয় অবস্থার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় বলে মনে করা হয়। তাই এরা অনাত্মবাদী। ব্রহ্মস্বরূপ স্থায়ী আত্মায় অবিশ্বাসী। কিন্তু দেহাবহির্ভুত আত্মার/জীবের অস্তিত্ব, পরলোকবাদ, জন্মান্তরবাদ, ও কর্মফলবাদের ধারণা বৌদ্ধ ও জৈন দুই ধর্মেই রয়েছে। 

  • Ranjan Roy | ২৩ মে ২০২১ ২৩:৪৪106381
  • অনেক ধন্যবাদ স্যার।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন