সম্বিৎ লেখকের গ্রাহক হোনপর্যালোচনা (রিভিউ) | অ্যালবাম | ১১ মার্চ ২০২১ | ২৯৩৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
২০১৩ সাল। ব্যাঙ্গালোর থেকে পাট গুটিয়ে আবার ফিরে আসছি মার্কিন মুলুকে। কল্লোলদা একদিন এসে "আগুনের ফুল"-এর নতুন বেরোন সিডিটা দিল। এর আগে আমরা এই অ্যালবাম নিয়ে কথা বলেছি। একমত হয়েছি, কী অসামান্য কাজ হয়েছিল। আমার ক্যাসেটটা দেশবদলের চক্করে অনেকদিনই হারিয়ে গেছিল। সিডি পেয়ে দীর্ঘদিনের দুঃখ ঘুচল। কল্লোলদা বলল, "আমি একটা বই করছি গুরুর জন্যে, বাংলা গান নিয়ে। তুই কি আগুনের ফুল নিয়ে লিখবি?" অবশ্যই।
লেখা হল অবশ্য অ্যামেরিকায় ফিরে। প্রথম লেখাটা ছোট ছিল। কল্লোলদা বলল, বড় কর। করলাম। তারপরে সেটা কল্লোলদার মাধ্যমে সুরকার তথা কর্মকান্ডের স্থপতি বিনয় চক্রবর্তী মশাইকেও পড়ান হল। পরে লেখাটা বইয়ের বেরিয়েছিল। একটু বেশি মিউজিকোলজিকাল কচকচি। ও ব্যাপারে উৎসাহ না থাকলে স্বচ্ছন্দে লেখাটা কাটিয়ে দিন। কিন্তু অ্যালবামটা শুনুনু। গানগুলো শুনুন, কবিতা শুনুন। বারবার শুনুন। অবিনীত হয়েই বলছি, আমি দীর্ঘদিন বাংলা গান শোনার চর্চা করছি। বলতে পারি, এরকম কাজ খুব কম হয়েছে বাংলায়।
নীচে লেখাটা। কলেবরে খুবই বেড়ে গেছিল। ইউটিউবে অ্যালবামের পুরোটা একটা ট্র্যাক হিসেবে তোলা আছে। আমি যে গান আর কবিতার কথা লিখেছি, সেগুলোর স্টার্ট টাইম থেকে লিং করে দিয়েছি লেখার মধ্যে। আর এখানে রইলে পুরো অ্যালবামটার লিং।
---------------------
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এক ব্যতিক্রমী কবি। কবিতা লিখে পন্টিয়াক গাড়ি কখনও চেয়েছিলেন কিনা জানিনা,তবে এটুকু জানি,ওনার মতন বিশুদ্ধ ও রাজনৈতিক কবিতা বাংলায় খুব কম লোকই লিখেছেন। কবিজীবনের শুরুতে জীবনানন্দের প্রভাব খুব স্পষ্ট থাকলেও কিছুদিনের মধ্যেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজস্ব স্বর খুঁজে পান এবং সেটি বাংলা কবিতায় এক স্বতন্ত্র স্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ বাংলাদেশের যা দস্তুর,কবি জীবদ্দশায় পান উদাসীনতা ও দারিদ্র্য,মৃত্যুর পরে পরিচিতি ও পুরস্কার। পুরস্কার কী পেয়েছিলেন মনে নেই,তবে পরিচিতির অনেকটাই ঘটেছিল মধ্য-আশিতে কবির মৃত্যুর পরে।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সঙ্গে আমার সত্যিকারের পরিচয় ঘটে একটি গান-কবিতার ক্যাসেটের মাধ্যমে। দিনক্ষণ সঠিক মনে নেই,তবে মনে হয় আশির দশকের মাঝামাঝি হবে। বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে একটা ছোট স্টলে চোখে পড়ে যায় কবির মুখ আঁকা লালচে রঙের ক্যাসেট "আগুনের ফুল"। আমরা যারা তখনকার কলকাতায় বড় হচ্ছি গানের খিদে নিয়ে,তদ্দিনে আমাদের গান সম্বন্ধে মোটামুটি আধা-সিরিয়াস গোছের একটা আকর্ষণ তৈরি হয়ে গেছে । শুধু গান শোনাই নয় তার পেছনের গল্প,নির্মিতির আখ্যানের প্রতি টান এসেছে। হাতের কাছে গান সম্বন্ধে যা লেখা পাচ্ছি,পড়ে ফেলছি। যা গান পাচ্ছি শুনে ফেলছি। রেফারেন্স পেলেও মহীনের ঘোড়াগুলির গান পাওয়া যাচ্ছে না। নগর ফিলোমেলও তথৈবচ। শুনছি গণসঙ্গীত নামের ধূসর সংজ্ঞার এক ধরণের গান। নতুন তৈরি গান মন টানছে না। ডিলানের নাম এই প্রথম শুনছি,কারণ কলেজের ফেস্টে গ্রুপ সঙের লিস্টে "আলোর পথযাত্রী"তে ঢ্যাঁড়া কেটে সিনিয়ার দাদার ডিলান-অনুবাদ জায়গা করে নিচ্ছে। বলে নেওয়া ভাল,তখনও আমরা সুমন চট্টোপাধ্যায়ের নামগান শুনিনি, "নাগরিক" দলের কথাও জানিনা।অন্যধারার গান সম্বন্ধে ধারণা তখনও জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ই সীমিত। আর দেখছি সুব্রত রুদ্রর "গণসঙ্গীত সংগ্রহ" নামের মোটা বইতে হরেকরকম বিষয় নিয়ে অজানা অচেনা অনেক গান। অর্থাৎ রেডিও,টিভি,এইচএমভি,হিন্দুস্তান,সাউন্ড উইং-এর বাণিজ্যিক জগতের বাইরে গান শোনার সুযোগ আমাদের বিশেষ হচ্ছিল না।
এই প্রেক্ষিতটা না দিলে ওই সময়ের বাংলা গানের খরাটা ঠিক ধরা যাবে না। চতুর্দিকে বুভুক্ষু শ্রোতা। জল দেবার কেউ নেই। বাংলা গানের পিতারা সব অস্তমান। চাচা-খুড়োরাও ল্যাংচাচ্ছেন। রিমেকের স্বর্ণযুগ আসতে তখনও দেরি বটে,কিন্তু কন্ঠীদের স্বর্ণযুগ তখন মধ্যগগনে। এরকম একটা সময়ে "আগুনের ফুল"-এর আবির্ভাব। ক্যাসেটের সামনে আর স্পাইনে লেখা ক্যাসেটের প্রযোজকের নাম -School of People's Art।
গান নিয়ে এবার যখন আলোচনা করব,তখন খেয়াল রাখতে হবে মধ্যবর্তী পঁচিশোর্ধ বছরে আমার নিজের গানের কান বদলেছে,রুচি বদলেছে। শুনে ফেলেছি দেশি-বিদেশি অনেক গান। পড়ে ফেলেছি গান সম্বন্ধে ভালমন্দ,রকমারি দিশি-বিদেশি লেখা। থিওরি-টিওরি সম্বন্ধেও আলগোছে কিছু ধারণা-টারনা হয়েছে। সুতরাং এই আলোচনায় হয়তো কৈশোর-যৌবনের শ্রবণের সেই মুগ্ধতা ততটা ধরা পড়বে না। তাই,এ কথাটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই,এ জীবনে যে কটি গান বা গানগুচ্ছ বা অ্যালবাম আমার সঙ্গীতমননকে প্রত্যক্ষভাবে সমৃদ্ধ ও আলোড়িত করেছে, "আগুনের ফুল" সেই তালিকার খুব ওপর দিকে থাকবে। মধ্যের প্রায় তিরিশ বছরে,বিশেষতঃ সুমন চট্টোপাধ্যায় (কবীর সুমন) ও তারপরে ব্যান্ডের হাত ধরে নতুন সাঙ্গীতিক এলিমেন্ট এসে বাংলা গানে বৈচিত্র্যের সম্ভার বাড়িয়েছে অনেকটাই। সেই বৈচিত্র্যে অভ্যস্ত কানে আজ "আগুনের ফুল" শুনলে হয়তো এর নতুনত্ব,বিশেষতঃ মৌলিকতা,তত ধরা পড়বে না। কিন্তু,আমাদের,যাদের অ্যালবামটির প্রথম প্রকাশের সময়ে - যা শাইনিং ইন্ডিয়া ও তৎসহ গান "জীবনমুখী" হবার আগেকার কথা- শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল তাদের এই অ্যালবামটি যে কী পরিমাণ আবিষ্ট করেছিলে,তা আজকের অতি-স্বল্পায়ু গানের বাজারে কল্পনা করা অসম্ভব। মুগ্ধতার আবেশ কেটে গেছে অনেকদিন,কিন্তু তার রেশ বয়ে চলেছি আজও। দীর্ঘ কুড়িবছর ক্যাসেটটা আমার কাছে ছিল না,কোন রেকর্ডিং-ও নয়। অথচ মনে মনে বয়ে গেছি ক্যাসেটের অনেক গান আর আবৃত্তি। আজ এত বছর পরে সিডিতে অ্যালবামটি আবার শুনে খেয়াল করছি খুব সুরছুট বা ভাবছুট তো হইনি। অপেশাদার অ্যালবামটির পক্ষে এটি কম কথা নয়।
ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি,এর কারণ কী। বাংলা গানে একটা কথা-সুরের ওজনের ব্যাপার আছে। কখনও সুর একটু ওজনদার হয়েছে,কখনও কথা - কিন্তু মোটের ওপর বাংলা গান - কী লোকগান,কী নাগরিক সঙ্গীত - সবসময়েই ওজনের এই সমতা রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। আমাদের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতে এই ওজনের এক আশ্চর্য সমতা ঘটেছে। মুশকিল ঘটেছিল,পঞ্চাশ থেকে আশির দশকে। অসম্ভব ক্ষমতাশালী সুরকারদের সঙ্গে পাল্লা দেবার মতন শক্তিশালী গীতিকার এসেছিলেন তুলনামূলকভাবে অনেক কম সংখ্যায়। প্রায় সব শক্তিশালী কলমই চলে গেছিলেন কবিতা বা কথাসাহিত্যের দিকে। অবস্থানটা পরিষ্কার বোঝা যায় তারাশংকরের কলমের গান বা প্রেমেন্দ্র মিত্রর লেখা গান শুনলে। আর এর ফলে যা হল,কবিরা যখন গানের কথা যোগালেন না,শ্রেষ্ঠ সুরকাররা নিজেদের পছন্দমতন কবিতায় সুর বসিয়ে গান বানালেন। সেই জঁরার গান হিসেবে পাল্কির গান বা সাগর-থেকে-ফেরা স্পর্ধিত সৃষ্টিই শুধু নয়,কালের বিচারে রসোত্তীর্ণও। হয়তো সাধারণ সূত্র বের করার মতন অত গান আমাদের ঝুলিতে নেই,কিন্তু খুব ইতস্ততঃ না করেও সম্ভবত এই কথাটা বলে ফেলা যায় যে যেখানে কম্পিটেন্ট সুরকার আর প্রতিষ্ঠিত কবির কথা একজোট হয়েছে,সেখানে বাংলা গানকে কালজয় করতে ও রসের উঁচু মান উত্তরণ করতে বেগে পেতে হয়নি।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গান শুনলে ঠিক এ কথা মনে আসতে বাধ্য। সাধারণভাবে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা যে খুব লিরিকাল - বিশেষতঃ সুর করার দিক থেকে দেখলে - তা একেবারেই নয়। লিরিকাল,সুছন্দবদ্ধ কবিতাও আছে,কিন্তু তুলনায় অনেক কম। কিন্তু কলমের জোর - বিশেষ করে শব্দব্যবহারের মিতব্যয়িতা ও শব্দ দিয়ে দৃশ্য গড়ে তোলার মুন্সিয়ানা - এ তো আর যার-তার হয়না! এই দুটোলাইন দেখুন -
আমার মা যখন মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছ
আপনি তখন মস্কো বা মহেঞ্জোদরোয় তীর্থে বেরিয়েছ।
এই দু লাইনে পরিমিত শ্লেষ দিয়ে যে গল্প বলাটা শুরু হল,সারা কবিতায় সেই শ্লেষকে বয়ে নিয়ে -
আপনার পা-দুটি জড়িয়ে মার জীবন-ভিক্ষা নেব।
সেই পা-দুটিও যে দেশান্তরে।
শুধু শেষ লাইনে এক অমোঘ উচ্চারণ কবিতাকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে -
মোদের খিদের দেবতা কভু যান না দেশান্তরে।
[আমার মা যখন]
কবিতার এই মোচড় গানের সুরে ধরা সোজা নয়। সত্যি বলতে কি বিনয় চক্রবর্তী তাঁর সুরে বা পরিতোষ আচার্য গানে এই মোচড়টা ধরতে পারেননি। সুরে এই শেষ লাইনের যে বেদনা সেটা হয়তো ধরা পড়েছে,কিন্তু যে চোরা শ্লেষ আছে,যে ব্ল্যাক হিউমার আছে সেটা অধরাই রয়ে গেছে। অবশ্য কি করলে যে সেটা ধরা পড়তে,এ প্রশ্ন করলে মুশকিলে পড়তে হয়। অথচ করা যে হয়তো যায় সে আশা সুরকার হিসেবে বিনয় চক্রবর্তীই জাগিয়েছেন "আগুনের ফুল"-এ। "স্বপ্নে আমি দেখেছিলেম তাকে" গানের শেষে স্বপ্নভঙ্গের যে বেদনা,সুর দিয়ে তাকে তো ধরতে পেরেছেন - "স্বপ্ন ভাঙল;তেরো নদীর জলে বুক ডুবিয়ে ক্ষুধার মিছিল চলে।"
এখন মজাটা হচ্ছে,এই শেষ লাইনটা - "মোদের খিদের দেবতা কভু যান না দেশান্তরে" - কিন্তু বিনয় চক্রবর্তীর নিজের গড়েপিঠে নেওয়া। অনুষ্টুপ প্রকাশনীর ১৯৯০ সালে প্রকাশিত বীরেন্দ্র সমগ্রতে কবিতাটির যে পাঠ পাচ্ছি,তাতে ঐ লাইনটা আছে এরকম -
শুধু আমাদের আদিম দেবতা খিদে
তিনি কখনো দেশ ছেড়ে যান না, ...
গানের জন্যে কথার অদল-বদল করতে হয়,ছন্দের বা মাত্রার অদল-বদল করতে হয়। বিনয় চক্রবর্তীকৃত (ধরে নিচ্ছি বদল তাঁরই করা) এই বদল মূলের থেকে বেশি লিরিকাল। সুতরাং এই বদল গ্রহণযোগ্য। যদিও "আদিম দেবতা খিদে" আর "খিদের দেবতা" একই ব্যঞ্জনা মনে আনে কিনা সে তর্ক থেকে যায়,তাহলেও ধরে নেওয়া যায় যে এই পরিবর্তন কবির অনুমোদন পেয়েছিল। কারণ অ্যালবামের শুরুতেই কবিকন্ঠে গানগুলি সৃষ্টির অকুণ্ঠ প্রশংসা আছে।
আবার এর অন্যদিকে,আগে যে গানটার কথা বলছিলাম "স্বপ্নে আমি দেখেছিলেম তাকে",তার একটা পংক্তি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে বাকিটায় মূলের প্রায় হুবহুই অনুসরণ করা হয়েছে। এই দুটো গানের কম্পোজিশনের একটা তুলনা করলে তা কবিতায় সুর করার ব্যাপারে ভাল স্টাডি হতে পারে। কবিতা হিসেবে দ্বিতীয়টা গানের জন্যে অনেক বেশি তৈরি,সুসম মাত্রার কবিতা। তাই সুরে ফেলতে লাইন বদলাতে হয় না। প্রথম কবিতা ভাঙাচোরা লাইনের কবিতা,মাত্রা বিভাজনের সমতা পাওয়া যায় না। কাজেই তাকে সুরে ধরতে গেলে অনেক অদল-বদল করতে হয়েছে। এটা জানতে পারলে ভাল হত,বিনয়বাবু কিসের জন্যে কবিতাটি বাছলেন সুর করার জন্যে।
[স্বপ্নে আমি]
বিপ্লব নন্দীর গাওয়া "স্বপ্নে আমি" সম্ভবতঃ অ্যালবামের অন্যতম সেরা গান। অন্যটা বিনয় চক্রবর্তীর স্বকন্ঠে "একদিন মাকে দিয়েছিলেম দোষ"। গানের কথা,সুর,অ্যারেঞ্জমেন্ট,গাওয়া,রেকর্ডিং এসবের বাইরে কিছু একটা জিনিস থাকে যার জন্যে একটা গান শ্রোতার আবেগে গিয়ে টোকা দিয়ে তাকে উদ্বেল করে তোলে। তাকে কথায় ধরা যায় না। যে কোন পারফর্মিং আর্টেরই শেষ অব্দি বোধহয় এই চেষ্টা থাকে যে ভোক্তার আবেগকে কোনভাবে নাড়া দেওয়া। আর ঠিক এই নাড়া দেবার কাজটাই করেছে "আগুনের ফুল"। শখের গাইয়ে,অচেনা সুরকার,অনামী সঙ্গীতশিল্পী,স্বল্প-পরিচিত আবৃত্তিকার - এই দল নিয়ে এরকম উচ্চমানের প্রযোজনা যেকোন দলের আকাঙ্খার বস্তু।
অ্যালবামের প্রথম গান "অন্ন বাক্য,অন্ন প্রাণ" শুরু হয় প্রার্থনার মত,বলা ভাল ইংরিজিhymn-এর মতন। সমবেতভাবে বিনয় চক্রবর্তী,পরিতোষ আচার্য,বিপ্লব নন্দী,কমল চট্টোপাধ্যায় আর সন্দীপ রাহার গলায়। মাইনর স্কেলের গান। অনেকটা সামগান ধরনের সুরের আভাস রেখে পশ্চিমি কায়দায় বাঁধা। ছ'মাত্রায় বাঁধা গান। লাইনের শেষ অক্ষর একটি সম্পূর্ণ বার (ছ-মাত্রা) নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একটি স্বরে। বিভিন্ন লাইনে এই স্বরের অল্প উঁচু-নীচু করে - কখনও বাদী,কখনও বিবাদী স্বর লাগিয়ে,কাঙ্খিত প্রয়োগ আনা হয়েছে। যন্ত্রানুষঙ্গে পাখোয়াজের ব্যবহার ধ্রুপদী সামগানের আমেজকে গাঢ় করে। গানে টু-পার্ট হার্মনি ব্যবহার খুবই পরিমিত। ফলে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য টেকনিক চমৎকার মিলমিশ খেয়ে এক অনুচ্চকিত পূর্ণ সৃষ্টি পেয়েছে।
[অন্ন বাক্যম অন্ন প্রাণ]
এই গান শুনতে শুনতে খেয়াল পড়বে গানটিতে খাড়া স্বরপ্রয়োগের ব্যবহার। শুধু এই গানেই নয়,অ্যালবামের সব গানেই সাবেক গণসঙ্গীত স্টাইলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মীড়ের ব্যবহার খুব কম। অ্যালবামের শেষ গান "মানুষরে তুই" আবার সমবেত কন্ঠের গান। অ্যালবামের কোন গান সম্বন্ধেই'টিপিকাল" শব্দটা ব্যবহার করা যায় না। যদি যেত,হয়তো এই "মানুষরে তুই" গান সম্বন্ধেই যেত। আশির দশকের সমবেত গায়নের এরকম গান শুনে ফেললেও ফেলা যেতে পারত। কিন্তু এখানেও সুরকারের মুন্সিয়ানা দেখি "রাজেশ্বরী জননী" শব্দদুটোকে সুরে ফেলায়। গানে সুর করা সম্বন্ধে যাঁরই অন্ততঃ অল্পসল্প ধারণা আছে,তিনিই বুঝবেন "রাজেশ্বরী জননী" ধরণের শব্দগুচ্ছকে ছন্দে-তালে বেঁধে সুরে ফেলা কী কঠিন কাজ। অথচ এই কঠিন কাজটাও বিনয় চক্রবর্তী সুচারুভাবে করে দেখিয়েছেন। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে লাইন স্ক্যানিং-এর মুন্সিয়ানা - "মানুষ রে তুই / সমস্ত রাত / জেগে / নতুন করে পড় / জন্মভূমির / বর্ণ / পরিচয়"। গানের শেষ অংশে আবার প্রথম গানের মতন টু-পার্ট হারমনি। এ কথা স্বীকার করে নেওয়া ভাল,ভোকাল হারমনি প্রয়োগের দিক দিয়ে এই অ্যালবামের কোন গানই তেমন নতুন দিশা দেখাতে পারে না। এছাড়াও এ গানে আর একটা জিনিস খেয়াল পড়বে। সেটাই আমার মনে হয় এই গানের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য। এই গানে কোন লাইনই - এমনকি গানের শেষ লাইনও - ষড়জে এসে দাঁড়ায় না। তার ফলে সুরে সবসময়েই টেনশন থেকে যাচ্ছে,কখনই রিজলভড হচ্ছে না। প্রথম গান "অন্ন বাক্য,অন্ন প্রাণ"-এও সেই একই টেকনিক ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলা গানে এই ধরণের প্রয়োগ খুব বেশি হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন পরিমিতভাবে। যেমন ওনার "মধুররূপে বিরাজ হে বিশ্বরাজ" গানে এই মূলত পাশ্চাত্য টেকনিকটি ব্যবহার করেছেন,যদিও গানটি ধ্রুপদাঙ্গের এবং তিলক কামোদে বাঁধা। পরবর্তীতে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের (কবীর সুমন) "চেনা দুঃখ,চেনা সুখ" এই টেকনিক ব্যবহারের আর একটি উদাহরণ।
বিনয় চক্রবর্তী মাথা দিয়ে সুর করেন। এ কথা আরও বোঝা যায় নব্বইয়ের দশকে তাঁর লেখা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরারোপন পদ্ধতির ওপর লেখা একটি প্রবন্ধ পড়লে। সেখানে উচ্চারণ এবং স্ক্যানিং নিয়ে (যদিও স্ক্যানিং কথাটা প্রবন্ধে ব্যবহার করেননি) নিজের চিন্তার যে আলোচনা করেছেন,তাতে জানা যায় কথার গঠন ও গানে উচ্চারণ - ডিকশন শব্দের কোন সহজবোধ্য বাংলা নেই - নিয়ে বিনয় চক্রবর্তী খুঁতখুঁতে। যার ফলে অদীক্ষিত গায়কদের উচ্চারণের সঠিকতা ও পরিচ্ছন্নতা ঈর্ষাযোগ্য।
কিন্তু স্ক্যানিং সম্বন্ধে আমার অভিযোগ আছে। আবার ফিরে যাচ্ছি ক্যাসেটের অন্যতম সেরা গান "স্বপ্নে আমি দেখেছিলেম তাকে"য়। গানটির চলন বদলায় শেষ তিনলাইনে (বই থেকে লাইনদুটি হুবহু তুললে) -
স্বপ্ন ভাঙল;তেরো নদীর জলে
বুক ডুবিয়ে ক্ষুধার মিছিল চলে।
এখানে "স্বপ্ন ভাঙল"-র পরের যতিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যতি-সহ পড়লে স্ক্যানিং হবে এরকম - "স্বপ্ন ভাঙল / তেরো নদীর জলে বুক ডুবিয়ে ক্ষুধার মিছিল চলে"। অর্থাৎ,স্বপ্ন ভেঙেছে। এখন ক্ষুধার মিছিল তেরো নদীর জলে বুক ডুবিয়ে চলে। যতি না থাকলে লাইন বিভাজন যতি হিসেবে কাজ করত,এবং স্ক্যানিং হত - "স্বপ্ন ভাঙল তেরো নদীর জলে / বুক ডুবিয়ে ক্ষুধার মিছিল চলে।" অর্থাৎ,স্বপ্ন তেরো নদীর জলে ভেঙেছে। এখন ক্ষুধার মিছিল বুক ডুবিয়ে চলে। বিনয় চক্রবর্তীর সুরে দ্বিতীয় ব্যাপারটাই ঘটেছে। এই আলোচনা অনেকের কাছে "পাত্রাধার কি তৈল" ধরণের কূটকচালি মনে হতে পারে। কিন্তু বিনয় চক্রবর্তী যেখানে কথার ওজন,বিন্যাসকে তাঁর সুরে এত যত্ন ও শ্রদ্ধার সঙ্গে ধরেছেন,সেখানে এই ছোট ত্রুটিগুলো নিবিষ্ট শ্রোতার কানে লাগতে পারে। বিশেষতঃ এই গানটিকে যখন আমি একটি অসামান্য সৃষ্টি হিসেবে শুনতে পারি,এবং আগেই বলেছি,খুব সম্ভবত অ্যালবামের সেরা গান। তালবাদ্য ছাড়াই এই গান শুরু হয় নাটকের স্বগত কথনের মতন। মিউজিকাল সলিলোকি বলা যেতে পারে কি?যন্ত্রানুষঙ্গ বলতে কীবোর্ডে হাই-পিচ টোন গানের সুরের সঙ্গে সঙ্গে চলে আর লাইনের ফাঁকে ফিলারের কাজ করে। কোরাসে "স্বপ্ন ভাঙল" অংশে হাই-পিচ টোনের জায়গায় ভাইব্রাফোন আসে। আর সারা গানে খুবই অনুচ্চ স্বরে বেজে যায় হারমোনিয়াম,কর্ড ধরে রাখতে।
এ অ্যালবামের গানগুলো শুনতে শুনতে মনে পড়ে যেতে পারে ব্রাহমসের একটি কথা - "It is not hard to compose, but what is fabulously hard is to leave the superfluous notes under the table."বিনয় চক্রবর্তীর সুরে এলেবেলে নোট,টেনটেটিভ সুরের ব্যবহার নেই। শুনলেই মনে হয় কী অসম্ভব পরিচ্ছন্ন সুর। এবং গাইয়েরা,পেশাদার নন,খুব দীক্ষিতও হয়তো নন কেউই। অথচ প্রত্যেকেই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী গানের কথার প্রতি,সুরের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ রেখেছেন।
[এক জোনাকি, দুই জোনাকি]
ধরুন হিমিকা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া "এক জোনাকি,দুই জোনাকি"। ঘুমপাড়ানি সুরের,ইংরিজিতে লালাবাই শব্দটা বোধহয় আরও সুপ্রযুক্ত,গান। প্রতিটা পংক্তির সুর এক। সে সুরও খুব সরল। শুধু সরলই নয়,স্বল্প রেঞ্জেরও। ভেবে দেখুন আমাদের ঘুমপাড়ানি সুরের বৈশিষ্ট্যও তাই। সুরের সেই বৈশিষ্ট্য তুলে এনে আধুনিক প্রেম-বিরহের কবিতায় তা প্রয়োগ করা হল (কবিতাটির নাম "শিউলিঝরা মাসে"। কবি কবিতাটি কাব্যগ্রন্থ থেকে বর্জন করেছিলেন)। কিন্তু কী অব্যর্থ এর প্রয়োগ! ইউটিউবে সার্চ করলে এই গানটির বিভিন্ন গায়ন পাবেন। মূলতঃ বাংলাদেশে কোন কারণে গানটি জনপ্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু এর কথা কার বা সুর কার - সে সম্বন্ধে সবাই হয় অজ্ঞ আর নয় ভুল তথ্য দিয়েছেন। হিমিকা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া মূল গানটিও আমি ইউটিউবে পাইনি। একটি টিভি নাটকে ব্যবহৃত গানটি মূলের সবচেয়ে কাছে,যন্ত্রানুষঙ্গ-সহ।
[তোর কি কোন তুলনা হয়]
কোন গান ছেড়ে কোন গানের কথা বলব?ধরুন মধু মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, "তোর কি কোন তুলনা হয়"। মেজর স্কেলে গান শুরু হয়। দ্বিতীয় "কোন"-য় যে সম্বাদির অবরোহনে সুরের ঝাঁপ তা সলিল চৌধুরীর সুরারোপনের কায়দা মনে করাতে পারে। একই রকম সুরের ঝাঁপ "'হিম" থেকে "সাগর"-এ। "বুকের মধ্যে সমস্ত রাত তুষারে ঢাকা পাহাড় / সমস্ত দিন সূর্য-ওঠার নদী" অংশের চলন মাইনর স্কেলের নোট ফলো করছে,আবার "তোর কি কোন তুলনা হয়" অংশে মেজরে ফিরে আসছে। এ তো সুরকারদের প্রচলিত ডিভাইস। সবাই পারেন না,চেষ্টাও করেন না। একটু ব্যতিক্রমী সুরকারের সুরেই হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানেও তফাত গড়ে দেয় প্রয়োগ। কথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কত সহজে এক অংশ থেকে আর এক অংশে যাতায়াত করছে সুর - তাতেই সুরকারের সুরসিদ্ধি। এখানেও একদম ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে বেরিয়ে যান বিনয় চক্রবর্তীও। দমের খামতি নিয়েও মধু মুখোপাধ্যায় গানটির অসামান্য ট্রিটমেন্ট দিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে এই অ্যালবামের অ্যারেঞ্জমেন্টও মধু মুখোপাধ্যায়ের করা। যারা পরবর্তীতে নচিকেতার (চক্রবর্তী) অ্যালবামে মধু মুখোপাধ্যায়-কৃত উচ্চকিত অ্যারেঞ্জমেন্ট শুনেছেন,তাদের কাছে এই অ্যালবামের পরিমিত অ্যারেঞ্জমেন্ট অন্যরকম লাগবে। কীবোর্ড,গীটার,হারমোনিয়াম,তবলা,ভাইব্রাফোন নিয়ে করা অ্যারেঞ্জমেন্ট সব গানেই সুর ও ভাব-অনুসারী। এই ২০১৩ সালে বসে কীবোর্ডের টোন হয়তো স্টাইলাইজড বা রেট্রো শুনতে লাগে,কিন্তু মনে রাখতে হবে এ গান প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৫ সালে। শুধু যে আজ থেকে আঠাশ বছর আগে কীবোর্ডের টেকনোলজি আজকের তুলনায় প্রাগৈতিহাসিক ছিল তা-ই নয়,প্রাক-উদারীকরণের যুগে ভাল কীবোর্ড কলকাতায় বসে ছোট দলের পক্ষে জোগাড় করাও দুঃসাধ্য ছিল।
বরং গায়নে এবং সুরে তত আপ্লুত করেন না পরিতোষ আচার্যর "আমার মা যখন" - যে গানটি নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি - বা "রাতভোর আগুন জ্বেলে শীত তাড়াস"। শেষের গানটা কবিতায় পাঠ আছে "সমস্তরাত আগুন জ্বেলে শীত তাড়াস"। একটা লাইন গানে জয়গা পায়নি। এছাড়া শব্দবদল হয়েছে। লাইনের পরম্পরাও অদলবদল হয়েছে। বারকয়েক শুনলে সুরের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ধরা পড়বে। প্রথম দু লাইনের কথাগুলোর মাঝে বেশ কয়েক মাত্রার ফাঁক। "রাতভোর / - / আগুন জ্বেলে / - / শীত তাড়াস / - / তোরা মানুষ /"। সুর নয়,যেন স্ক্যানিং দিয়ে একটা টেনশন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে,এবং যেখানেই সুর এক জায়গায় থামছে,পরিতোষ আচার্য্যর গলার অত্যধিক ট্রেমোলো গানের শ্রুতিমধুরতা বাড়াতে সাহায্য করে না।
[রাতভোর আগুন জ্বেলে]
বিনয় চক্রবর্তী নিজের একক গায়নের জন্যে রেখেছেন "একদিন মাকে দিয়েছিলেম দোষ" (কবিতাটির নাম "পূর্ণকুম্ভ-মেলায় ভিক্ষুকের গান",পাঠও কিছু জায়গায় অন্য)। গানটির পূর্ণ পাঠ এরকম -
একদিন মা-কে দিয়েছিলেম দোষ,
মা আমার আধা-ভিখারি।
না-হয় আমরা ঘরে করব উপোস;
তাই বলে কি যাবে রাজার বাড়ি?
ছেলে,আমার ছেলে।
ঘুঁটে কুড়িয়ে পেট তো ভরে না।
দোষ যদি হয় রাজার বাড়ি গেলে,
ছেলের উপোস দেখবে কি তার মা?
একদিন মা-কে দিয়েছিলেম দোষ,
ছিলেন তিনি আধা-ভিখারি।
এখন রাজার সঙ্গে আমার ভাব;
মায়ের সঙ্গে আমার আড়ি!
একটি অসামান্য কবিতা। অসম্ভব সরাসরি বলা হচ্ছে। আধুনিক কবিতার ইঙ্গিতধর্মিতাকে কলা দেখিয়ে সোজাসুজি বলা। তাছাড়া লক্ষ্য করুন,কবিতাটিতে দুটি স্বর। প্রথম ও তৃতীয় পংক্তি কবির,মাঝের পংক্তিটি মা-র। কিন্তু কোনরকম অভিজ্ঞান দিয়ে তা দেখান নেই কবিতায়। সুর করার সময়ে দ্বৈত কন্ঠের ব্যবহার না করলে সুর দিয়ে ধরতে হবে এই দুটি ভিন্ন স্বরকে। সুরকার বিনয় চক্রবর্তী সেই পথটিই নিয়েছেন,দ্বৈত কন্ঠ ব্যবহারের তুলনামূলক সহ্জ পথটি ছেড়ে। সহজ পথটি কবিতার নির্মিতির পরিপন্থী বলেও হয়তো।
[একদিন মাকে দিয়েছিলেম দোষ]
এই গানে আবার সেই সলিলিয় টেকনিক। মাইনর স্কেলে গান শুরু হয়। প্রথম পংক্তি আর তৃতীয় পংক্তির সুর - দুই-ই মাইনর স্কেলে। দ্বিতীয় পংক্তি,যেটা রাবীন্দ্রিক নিয়ম মেনে সঞ্চারি বলে চিহ্নিত করতে পারি (কবিতার অর্থের দিক থেকে। কবিতা বা গানের গঠন অবশ্যই ধ্রুপদী চারতুকের নয়।),এই জায়গায় ভিন্ন স্বরের কারণে সুরের একটা পটবদলের প্রয়োজন ছিল। বিনয় চক্রবর্তী সেই পটবদল করছেন মেজর স্কেলে চলে গিয়ে। শুধু দ্বিতীয় পংক্তির প্রথম দুটো লাইনে। তৃতীয় লাইন থেকে আবার মূল গানের মাইনর স্কেলের ছকে ফিরে যাচ্ছে। এ গানের সুরের আর একটি সৌন্দর্য হল প্রথম ও শেষ পংক্তির শেষ লাইনে সুরের রেজোলিউশন যে ভাবে হচ্ছে। "তাই বলে কি যাবে রাজার বাড়ি" বা "মায়ের সঙ্গে আমার আড়ি" পূরবীর অবরোহণকে মনে পড়ালেও পড়াতে পারে। অথচ পুরো গানটাই লোকসঙ্গীতের আদলে বাঁধা। যন্ত্রানুষঙ্গেও দোতারার ব্যবহার সেই আদলকে প্রতিষ্ঠা করছে। বিনয় চক্রবর্তী,বলে রাখা ভাল,সুগায়কও। হয়ত খুব রেওয়াজি গলা নয়,কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণের জোয়ারি গলায় আত্মবিশ্বাসী সুরপ্রয়োগ।
পুরো অ্যালবামেই গানের মাঝে মাঝে রয়েছে রত্না মিত্রর আবৃত্তি। অ্যালবামের সব কন্ঠশিল্পীদের মধ্যে হয়ত তাঁর গলাতেই পরিশীলনের ছাপ সব থেকে বেশি। "একটা পৃথিবী চাই" কবিতায় গলার যে আবেগ ব্যবহার করছেন তা "রাজা আসে যায়"-এর থেকে আলাদা।
[একটা পৃথিবী চাই]
আবার "হওয়া না-হওয়ার গল্প" ("সে চেয়েছিল একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে") আবৃত্তিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক স্বর শুনতে পাই। এই শেষের আবৃত্তিটি ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রিয়। এই আবৃত্তিতে যে দুঃখী স্বরটি শুনতে পাই,সেটি কেন জানিনা শম্ভু মিত্র মশাইয়ের "অয়দিপাউসের গল্প" কথনের কোন স্বর মনে পড়ায়। এই ব্যক্তিগত যোগাযোগের বাইরে এসেও এই আবৃত্তিটি আমি বার বার শুনতে চাইব।
[সে চেয়েছিল একটি সত্যিকারের প্রেমের কবিতা লিখতে]
শুনতে চাইব এর খুব কাছাকাছি আরেক গভীর স্বরের আবৃত্তি - "লড়াই ছাড়া" ("আমার বসুমতি বড় গরীব")। এই দুটি কবিতাতেই যেন কবির স্বগত স্বরটি খুব একান্তভাবে ধরা পড়ে।
[আমার বসুমতি বড় গরীব]
[রাজা আসে যায়]
"রাজা আসে যায়" কবিতাটা তো মুখে মুখে চালু হয়ে বিখ্যাত হয়ে পড়েছে বহুদিনই - হয়তো প্রথম কয়েকটা লাইন। এই কবিতার আবৃত্তিতেও পরিমিত - হয়তো পরিমিতর চেয়ে একটু বেশিই হবে - নাটক এনে রত্না মিত্র কবিতাটি ও তৎসহ আবৃত্তিটি স্মরণযোগ্য করে রেখেছেন। তবে সম্ভবতঃ অ্যালবামের সবচেয়ে স্মরণযোগ্য আবৃত্তি "ধর্ম যখন বিজ্ঞানকে বলে" কবিতাটির (আশ্চর্য! কবিতাটি সমগ্রতে খুঁজে পাওয়া গেল না)। কবিতাটির বিষয়,তার নির্মিতি,তার স্বধৃত নাটকীয়তা সব মিলিয়ে অসম্ভব আবৃত্তিযোগ্য। রত্না মিত্র তার যথাযোগ্য সুবিচারও করেছেন। এই কবিতায় তাঁর গলার কাজ ও পরিবর্তন যে কোন কন্ঠশিল্পীর অনুশীলনের বিষয়।
[ধর্ম যখন বিজ্ঞানকে বলে]
পরিমিত নাটক রেখে - অথচ অতিনাটকিয়তা বর্জন করে,পরিচ্ছন্ন উচ্চারণে ও ইনফ্লেক্সনে কি করে আধুনিক কবিতা আবৃত্তি করতে হয়,রত্না মিত্র যেভাবে এই অ্যালবামে করে দেখিয়েছেন,তাতে এই খেদ না হয়ে পারে না যে নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে পশ্চিমবঙ্গে যে অতিনাটকীয়,উচ্চকিত,গলা-কাঁপান,মান্য-উচ্চারণকে-কলা-দেখান আবৃত্তির চল হল,এবং আবৃত্তিকাররা প্রায় সেলিব্রিটি হয়ে পড়লেন,সেখানে রত্না মিত্রর মতন আবৃত্তিকারদের জায়গা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল!
কিন্তু তার থেকেও বড় খেদ যেটা,তা হল এমন সৎ,সাহসী ও গুণের প্রয়াসটি মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যেই আটকে রইল। কজন আর সেভাবে শুনলেন এই অ্যালবামটি। এর তো ব্যবসায়িক সেরকম কোন মূল্য নেই। কাজেই যিনিই এর কপিরাইটের মালিক হোন,তাঁর উচিত অ্যালবামটি ইউটিউবে প্রকাশ করে ফেসবুক ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে ছড়িয়ে দেওয়া। যৌথ এই প্রয়াস ও সৃষ্টিকে সম্মান জানানর এর থেকে ভাল উপায় আর হয় না।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
পর্যালোচনা (রিভিউ) | ১১ মার্চ ২০২১ | ২৯৩৬ বার পঠিত
anandaB | 50.125.***.*** | ১১ মার্চ ২০২১ ০৭:১৮103482
বা: , সম্বিৎ আবারো একটা কাজের কাজ করলেন আমাদের মত অভাজন দের জন্য। আপনার জয় হোক :)
লেখা এবং গান দুই ই গভীর মনোযোগ (অতএব সময় ) দাবি করে , কেমন লাগল আশাকরি জানাতে পারব
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কলেজ জীবনে একটা বড়ো অংশ দখল করেছিলেন আর ওনার মৃত্যুর পর পর ই প্রকাশ পেয়েছিলো পাথরে পাথরে নাচে অ্যালবাম টি , এখনো চেষ্টা করলে তার ৮০ শতাংশ গান হুবহু বলতে পারি , এতটাই ইমপ্যাক্টফুল ছিল আমার কাছে .... এপাতায় কেউ একজন সেই অ্যালবাম এর গান গুলি ডাউনলোড করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন , এই সুযোগে তাঁকে আবারো ধন্যবাদ জানাই
এখন এই দীর্ঘ লেখা পড়তে পড়তে বীরেন্দ্রর কবিতা পাঠ ও গান শুনতে শুনতে সাতের দশকের সেই উত্তাল সময়ে যেন মানসভ্রমণ হলো। অপূর্ব সব কবিতা, গান, বিবৃতি, আগুনের ফুল।
এই লেখা ও ভিডিও ক্লিপিংগুলো গুরুচণ্ডালীর অমূল্য সম্পদ।
বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে,
মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা,
কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
আমাদের কথা
আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের
কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি
জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
বুলবুলভাজা
এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ।
দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও
লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
হরিদাস পালেরা
এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে
পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান
নিজের চোখে...... আরও ...
টইপত্তর
নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান।
এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর।
... আরও ...
ভাটিয়া৯
যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই,
সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক
আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
টইপত্তর, ভাটিয়া৯, হরিদাস পাল(ব্লগ) এবং খেরোর খাতার লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব, গুরুচণ্ডা৯র কোন দায়িত্ব নেই। | ♦ :
পঠিত সংখ্যাটি ১৩ই জানুয়ারি ২০২০ থেকে, লেখাটি যদি তার আগে লেখা হয়ে থাকে তাহলে এই সংখ্যাটি সঠিক পরিমাপ নয়। এই বিভ্রান্তির জন্য আমরা দুঃখিত।
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক।
অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি।
যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।
মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি
বার পঠিত
সকলকে জানান
উপরে যে কোনো বোতাম টিপে পরিচিতদের সঙ্গে ভাগ করে নিন
গুরুচন্ডা৯ বার্তা
গুরুতে নতুন?
এত নামধাম দেখে গুলিয়ে যাচ্ছে? আসলে আপনি এতদিন ইংরিজিতে সামাজিক মাধ্যম দেখে এসেছেন। এবার টুক করে বাংলায়ও সড়গড় হয়ে নিন। কটা তো মাত্র নাম।
গুরুর বিভাগ সমূহ, যা মাথার উপরে অথবা বাঁদিকের ভোজনতালিকায় পাবেনঃ
হরিদাসের বুলবুলভাজা : গুরুর সম্পাদিত বিভাগ। টাটকা তাজা হাতেগরম প্রবন্ধ, লেখালিখি, সম্ভব ও অসম্ভব সকল বিষয় এবং বস্তু নিয়ে। এর ভিতরে আছে অনেক কিছু। তার মধ্যে কয়েকটি বিভাগ নিচে।
শনিবারের বারবেলা : চিত্ররূপ ও অক্ষরে বাঙ্ময় কিছু ধারাবাহিক, যাদের টানে আপনাকে চলে আসতে হবে গুরুর পাতায়, ঠিক শনিবারের বারবেলায়।
রবিবারের পড়াবই : পড়া বই নিয়ে কাটাছেঁড়া সমালোচনা, পাঠপ্রতিক্রিয়া, খবরাখবর, বই নিয়ে হইচই,বই আমরা পড়াবই।
বুধবারের সিরিয়াস৯ : নির্দিষ্ট বিষয় ধরে সাপ্তাহিক বিভাগ। ততটা সিরিয়াসও নয় বলে শেষে রয়ে গেছে ৯।
কূটকচা৯ : গুরু কিন্তু গম্ভীর নয়, তাই গুরুগম্ভীর বিষয়াশয় নিয়ে ইয়ার্কি ফুক্কুড়ি ভরা লেখাপত্তর নিয়েই যতরাজ্যের কূটকচা৯। কবে কখন বেরোয় তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।
হরিদাস পাল : চলতি কথায় যাদের বলে ব্লগার, আমরা বলি হরিদাস পাল। অসম্পাদিত ব্লগের লেখালিখি।
খেরোর খাতা : গুরুর সমস্ত ব্যবহারকারী, হরিদাস পাল দের নিজের দেয়াল। আঁকিবুঁকি, লেখালিখির জায়গা।
টইপত্তর : বিষয়ভিত্তিক আলোচনা। বাংলায় যাকে বলে মেসেজবোর্ড।
ভাটিয়া৯ : নিখাদ ভাট। নিষ্পাপ ও নিখাদ গলা ছাড়ার জায়গা। কথার পিঠে কথা চালাচালির জায়গা। সুতো খুঁজে পাওয়ার দায়িত্ব, যিনি যাচ্ছেন তাঁর। কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।
লগিন করে থাকলে ডানদিকের ভোজনতালিকায় যা পাবেনঃ
আমার গুরুঃ আপনার নিজস্ব গুরুর পাতা। কোথায় কী ঘটছে, কে কী লিখছে, তার মোটামুটি বিবরণ পেয়ে যাবেন এখানেই।
খাতা বা খেরোর খাতাঃ আপনার নিজস্ব খেরোর খাতা। আঁকিবুকি ও লেখালিখির জায়গা।
এটা-সেটাঃ এদিক সেদিক যা মন্তব্য করেছেন, সেসব গুরুতে হারিয়ে যায়না। সব পাবেন এই পাতায়।
গ্রাহকরাঃ আপনার গ্রাহক তালিকা। আপনি লিখলেই সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকরা পাবেন নোটিফিকেশন।
নোটিঃ আপনার নোটিফিকেশন পাবার জায়গা। আপনাকে কেউ উল্লেখ করুক, আপনি যাদের গ্রাহক, তাঁরা কিছু লিখুন, বা উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটুক, জলদি পেয়ে যাবেন নোটিফিকেশন।
বুকমার্কঃ আপনার জমিয়ে রাখা লেখা। যা আপনি ফিরে এসে বারবার পড়বেন।
প্রিয় লেখকঃ আপনি যাদের গ্রাহক হয়েছেন, তাদের তালিকা।