ত্রিবেণী তীর্থপথে
না।
সেই অনন্তগঙ্গাপ্রবাহমধ্যে, বসন্ত বায়ুবিক্ষিপ্ত বিচিমালায় আন্দোলিত হইতে হইতে কপালকুণ্ডলা প্রাণত্যাগ করে নাই। চৈত্রবায়ুতাড়িত যে বিশাল তরঙ্গ কপালকুণ্ডলাকে নদীগর্ভে নিক্ষেপ করিয়াছিল, তাহারই ন্যায় অপর এক প্রভঞ্জনাঘাতে নবকুমার পুণ্যসলিলা স্রোতস্বিনীর অন্তরে নিমজ্জিত হইলেন, বা বলা ভালো স্বেচ্ছানির্বাসন লইলেন, কারণ সন্তরণ প্রক্রিয়া তাঁহার অবগত ছিল।
কিন্তু কপালকুণ্ডলার ললাটে মরণ নাই। এক দুর্বার অশালীন স্রোত তাহার মৃত্যুকামনাকে তুচ্ছ করিয়া রাবণের ন্যায় বলপূর্বক হরণ করিয়া ভাসাইতে ভাসাইতে অচৈতন্য অবস্থায় তাহাকে ফেলিয়া গেল গঙ্গার অপর ঘাটে।
ক্রমে বেলা বাড়িলে তরঙ্গ স্ফুলিঙ্গের দু চারটি
চুম্বন যখন তাহাকে অধীর করিয়া তুলিল, অংশুমালী যখন কপালকুণ্ডলার সর্বাঙ্গ রুদ্ররসধারায় সিক্ত করিয়া দিলেন, ক্রমে ক্রমে তাহার সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিল।
অলকচূর্ণ ললাট হইতে সরাইয়া কপালকুণ্ডলা তাহার স্নিগ্ধ উদ্ভাসিত আঁখি- বিহঙ্গ দুটি ভাসাইয়া দিল অনন্ত নীলাভ স্বর্ণালী সমারোহে। তাহার আজানুলম্বিত কেশরাজি গভীর অরণ্যে ঘনায়মান সন্ধ্যার ন্যায় পৃষ্ঠদেশে বিরাজ করিতে লাগিল।
সেই সময়ে একটি নৌকা ঘাটে আসিয়া ভিড়িল। কপালকুন্ডলা দেখিল, দুজন সম্ভ্রান্ত থান পরিহিতা স্ত্রীলোক কর্তিত কেশবিশিষ্ট মস্তকে ঘোমটা টানিয়া নৌকা হইতে ফেলা কাষ্ঠের তক্তা বাহিয়া ঘাটে অবতরণ করিল।
নিখিলেশের মৃত্যুর পর বিমলার আর মন টেকে না সংসারে। উপস্থিত সে তাহার বড় জাকে লইয়া গঙ্গার তীরে তীরে তীর্থ করিয়া বেড়াইতেছে ।
পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গার সুশীতল স্রোতস্পর্শ তাহাকে কিছুমাত্র স্বস্তি দেয় নাই। পরন্তু নদীবক্ষ হইতে উৎসারিত উদাসী বাতাস তাহার অন্তরে নিখিলেশের যে চিতা অহরহ জ্বলিতেছে তাহার সর্বগ্রাসী অগ্নিসত্ত্বাকে উসকাইয়া দেয়। আবার গঙ্গার অপর পারের দৃশ্য যেমন আবছায়া অবভাসরূপে প্রতীয়মান হয় সেইরূপ অস্পষ্ট ও অসমীচীন আরেক ব্যক্তির মুখাবয়ব তাহার মানসপ্রতিমায় মধ্যেমধ্যে
প্রতিভাত হয়। সে যতবার সেই চিত্রকে কালিমালিপ্ত করিয়া নষ্ট করিতে চায়, ততবার এক অদৃশ্য তুলি তাহার মানসচিত্রপটে লিখিয়া যায়- ' মক্ষী...'
দুই বিধবা ধাপে ধাপে উঠিয়া আসিয়া কপালকুণ্ডলার সমীপবর্তী হইল। রতনে রতন চেনে, অভাগী চেনে অভাগীকে। যে শাশ্বত শোকসায়রের ত্রিতারে তাহারা বাঁধা, সেই বাদ্যের করুণ বিলাপে এক দণ্ডে তাহারা পরস্পরকে চিনিতে পারিল।
বিমলা তাহার ব্যথাতুর আঁখিদুটি কপালকুণ্ডলার পলাশ- নয়নে স্থাপন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল- ' অনন্ত অসীম নীলাম্বুরাশির তীরে বাড়িয়া উঠিয়া পরম বাহির থেকে ঘর - সংসারের ক্ষুদ্র পিঞ্জরে অর্গলবদ্ধ হইয়া তুমি কী পাইলে?'
কপালকুন্ডলা তাহার নেত্র বিন্দুমাত্র না সরাইয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া উত্তর করিল, ' ঘর- সংসারের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ থেকে বাহিরের অনন্ততরঙ্গিণী বিশ্বে চরণ রাখিয়া তুমি যাহা পাইলে, আমিও ঠিক তাহাই পাইয়াছি।'
উত্তর পাইয়া বিমলা অল্প একটু শব্দ করিয়া হাসিল। তাহার জা হাসিল নীরবে মুখ টিপিয়া। সে ভাগ্যবিড়ম্বিতা নারীর বাকযন্ত্র হইতে কোনপ্রকার শব্দ বা কথা বহুদিন হইল উত্থিত বা উচ্চারিত হয় নাই । তাহার কথার প্রয়োজন ফুরাইয়াছে। সে তাহার সাধারণ বুদ্ধিমত্তায় আজীবন পিঞ্জরাবদ্ধ জীবনে একটি সত্য বর্ণে বর্ণে উপলব্ধি করিয়াছিল, জগৎ সংসারের সমুদয় বিড়ম্বনা সহ্য করিবার একটিই সহজ পন্থা আছে-
নীরবতা
তাহারা তিনজনেই তিনপ্রকারে হাস্য করিল, কিন্তু তাহাদের অক্ষিকোটর হইতে বুভুক্ষু সর্পের ন্যায় নয়নলোর উথলিয়া উঠিল। গণ্ডদেশে পিছলাইয়া চিবুক চুম্বন করিয়া সেই গঙ্গা যমুনা সরস্বতীর ত্রিধারা তাহাদের বক্ষদেশ বাহিয়া অন্তরের অন্তরালে বিলীন হইয়া গেল...
তবু অনন্তগঙ্গাপ্রবাহে জল এতটুকু বাড়িল না।
তামিমৌ ত্রমি
ছবি নেট থেকে প্রাপ্ত
যদ্দুর জানি তরঙ্গ বা ওয়েভ = বীচি আর সীড অর্থে বিচি। বীচিমালা বোধহয় ঠিক বানান। একটু কেউ কনফার্ম করবেন?
বানান ঠিকই আছে। কপালকুণ্ডলায় তাই ছিল। 'বীচি' 'বিচি'ও হয়। বিচিত্র ব্যাপার।