জ্যান্ত ইতিহাসের গল্প শুনুন। ইতিহাসের গল্প যেরকম হয়। কিছু প্রামাণ্য তথ্য আর কিছু পুরনো লোকেদের গালগল্প।
দার্জিলিঙে একটি স্যানেটরিয়াম আছে। তার নাম লাউইস জুবিলি স্যানেটরিয়াম। লিউইস নয় কিন্তু, লাউইস। L-o-w-i-s. অন্তত আমি তাইই জানতাম। গুগুল ম্যাপে দেখছি বলছে লুইস - L-u-i-s. বাবা-কাকাদের চিরদিন বলতে শুনেছি লাউইস। কিন্তু এখনও কোন কোন জায়গায় লাউইস নাম পাওয়া যাবে।
আদতে দার্জিলিং-এর পত্তনই বলা যায় একটি স্যানেটরিয়াম টাউন হিসেবে। ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে, সাহেবদের যেরকম দস্তুর, দার্জিলিঙের পাহাড়চুড়োয় একটি স্যানেটরিয়াম টাউনের পত্তনি হয়। করেন ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসের আর্থার ক্যাম্বেল সাহেব। এই বললাম সাহেবদের দস্তুর, এটা কিন্তু বাড়িয়ে বলা নয়। শুধু বিলিতি সাহেব নয়, কন্টিনেন্টাল সাহেবদেরও দস্তুর ছিল তাই। সুইস আল্পসের একটি বিখ্যাত স্যানেটরিয়াম এবং সেখানে যাওয়া নিয়ে মুজতবা আলী সাহেবের একটি চমৎকার লেখা আছে। দেশেও মুসৌরি, সিমলা প্রভৃতির ইতিহাসও একইরকম। বা মালয়ের পেনাঙ।
এর অনেক পরে ১৮৮২ সালে শুধু সাহেবদের জন্যে দার্জিলিঙে তৈরি হয় ইডেন স্যানেটোরিয়াম। এখানে সেই "ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড ডগস ক্যাননট এন্টার"-এর গল্প। কুকুরদের প্রবেশাধিকার ছিল কিনা জানিনা। কিন্তু এ স্যানেটোরিয়ামে নেটিব ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার ছিলনা, সেটা ঘটনা। কারণ গল্পকথা এই যে কুচবিহারের মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়াণের মতন লোকের এখানে ঢুকতে বাধা পেয়ে নীলরক্ত টগবগিয়ে ওঠে। এ তো আর আমার-আপনার রাগ নয়, রাজা-মহারাজাদের রাগ। হলেনই বা নেটিব স্টেটের রাজা। সে টগবগানি এমনই যে নৃপেন্দ্র নারায়ণ আরও সব রাজা-মহারাজাদের জুটিয়ে নিজে স্বয়ং জমিদান করে ভারতীয়দের জন্যে একটি স্যানেটোরিয়াম তৈরি করান। এই সে লাউইস জুবিলি স্যানেটোরিয়াম। সে ১৮৮৭ সালের কথা। মানে ইডেন তৈরি হবার বছর পাঁচেকের মধ্যে। স্যানেটোরিয়ামের প্রথম বিল্ডিং-এর নাম নৃপেন্দ্র নারায়ণ হল। কিন্তু দ্বিতীয়টি এডওয়ার্ড হল। এই হল অপমানের স্থায়িত্ব। তবে শুধু অপমানিত হলেই নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভাল কাজ করতেন, এটা ভাবলে ভুল হবে। স্যানেটোরিয়াম ছাড়াও ওনার অনেক ভাল কাজ আছে।
হিলকার্ট রোড থেকে ডঃ শিশির পাল রোড বলে একটা রাস্তা নেবে গেছে লাউস জুবিলির দিকে। এই শিশির পাল ছিলেন লাউস জুবিলি স্যানেটোরিয়ামের প্রথম সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও মেডিক্যাল অফিসার। আমার ঠাকুমার বাবা। ফলে এই শিশির পাল রোড, লাউস জুবিলি স্যানেটোরিয়াম ইত্যাদি আমার বাবা-কাকা-পিসিদের এবং উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদের ব্র্যাগিং রাইটস। গুগুল ম্যাপে যদিও শিশির পাল রোড বলে কোন রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না। অবশ্য সেখানে লাউস জুবিলিকে লুইস জুবিলি বলে মার্ক করা আছে। কিন্তু অন্যত্র দেখলাম লাউস জুবিলির ঠিকানায় এস কে পাল রোড।
শিশির পাল মশাই যে ঠিক কী কর্মফলে জীবনের শুরুর দিকেই এমন হাই-প্রোফাইল চাকরিটি পেয়েছিলেন, সেটি বোঝা দুষ্কর। দার্জিলিঙে যাবার আগে হাওড়া-নিবাসী শিশির পাল পাশ-করা ডাক্তার হিসেবে বিরাট যুগান্তকারী কিছু করে যে দেখিয়েছিলেন এমনও নয়। তবে শিশির পালের মেজদাদা বসন্ত কুমার পাল সে যুগে রসায়নে এমএ, সফল আইনব্যবসায়ী ও ছোটমাপের সাহিত্যিক, এবং তার থেকেও বড় কথা, সাহিত্যযশোলোভী ছিলেন। তাঁর লেখা "স্মৃতির অর্ঘ্য" নামক স্মৃতিকথাটির একটি ছেঁড়াখোঁড়া কপি বাড়িতে ছিল। যে বয়েসে পাঁজি পর্যন্ত পড়ার প্রকোপ থেকে রেহাই পেতনা, সে সময়ে এই বইটাও পড়েছিলাম। এবং ভুলেছিলাম। ১৪১৩ বঙ্গাব্দের শারদীয় অনুষ্টুপে "স্মৃতির অর্ঘ্য" ফের প্রকাশিত হওয়ায় তৎকালীন সমাজচিত্রের দলিল হিসেবে বইটার দাম বুঝি। আচার্যিমশাই একটা ভাল কাজ করেছিলেন।
বসন্ত কুমার পাল সম্বন্ধে এত কথা বলার কারণ এই যে ওনার পরিচিতির পরিধির মধ্যে সুনীতি চাটুজ্জে, শরৎচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ছিলেন। শুধুমাত্র মুখচেনা নয়, তার ওপরেও নিশ্চয়ই খাতির এগিয়েছিলে, কারণ শিবপুরের পৈতৃক "অমৃতবাটী"-তে এনাদের পদার্পণও ঘটত। আর শুধু সাহিত্য নয় নিশ্চ্য়ই অন্য ক্ষেত্রেরও বিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে বসন্তকুমারের ভালই খাতির ছিল। আর, আমার অনুমান, এই খাতিরের সূত্র ধরেই শিশিরকুমারের লাউস জুবিলির সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদলাভ। তবে শিশিরকুমার কাজ ভালই করতেন। কারণ তিনি এই পদে বহু বছর আসীন ছিলেন। আমার বাবা-কাকাদের ছেলেবেলার স্মৃতির একটা বড় অংশ দার্জিলিঙের স্মৃতি।
আমরা ঠাকুমাকে ডাকতাম ওম্মা বলে। ওম্মার মুখে শোনা একটা গল্প বলি। কোন একবার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঠাকুমার দার্জিলিং যাবেন। দাদু যেতে পারবেন না। সে সময়ে, খুব সম্ভবতঃ কোন স্বদেশী আন্দোলনের কারণে, দার্জিলিং যাওয়ায় কড়াক্কড়ি চলছিল। দার্জিলিং তো বাংলার সামার ক্যাপিটাল। শিশির পালমশাই প্রিয় কন্যাকে বলেছিলেন, চিন্তা করিস না। আমি পুলিশের সুপারিটেন্ডেন্টকে বলে রাখব। তো তার ওপর ভরসা করে ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওম্মা দার্জিলিং পাড়ি দিয়েছেন। কথা আছে দার্জিলিঙে গাড়ি থামলে স্বয়ং পুলিশের সুপার এসে এনাদের নিয়ে যাবে। গাড়ি থেমেছে। কিন্তু কেউ আর আসেনা। শেষে পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করেছে। কেন এসেছ? পার্মিট কোথায়? পার্মিটহীন এক শ্যামলা, বাঙালি তরুণী সঙ্গে ছেলেমেয়ে নিয়ে বলছে পুলিশ সুপার তাদের রিসিভ করতে আসবে - এ কথা সেই রাজনৈতিক আবহাওয়ায় শুনলে শুধু লাল-পাগড়ি কেন ঘোড়ায়ও হাসত। কাজেই যখন জেলের লপসি খাওয়া প্রায় নিশ্চিত তখন প্যান্টের চেন টানতে-টানতে পুলিশ সুপারের অকুস্থলে দৌড়ে আগমন এবং অনেক ক্ষমা-টমা চেয়ে শিশুসহ অবলার উদ্ধার। বেটাইমে বাত্থুম পেয়ে যাওয়ার কারণেই নাকি যত গোলমাল। ডঃ পাল যেন কিছু মনে না করেন। এ গল্প ছেলেবেলায় শুনতে খুবই ভালবাসতাম। অনেকদিন না শোনার কারণে ডিটেলগুলো স্বভাবতই আবছা।
তো সেই লাউস জুবিলি তো এখন সরকারি বিশ্রামাগার। আমি নিজেও কলেজে পড়ার সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে সেখানে থেকেছি।
অন্য একটা কথা দিয়ে শেষ করি। মধ্যবিত্ত বাঙালি জন্মের শোধ দার্জিলিং যেত জীবনে একবার হয়ত। বড্ড সাহেবী পরিবেশ। কিন্তু স্বাস্থ্য ফেরাতে যাবার জায়গা ছিল পশ্চিম - মধুপুর, দেওঘর, শিমূলতলা। মজার কথা হল এই মধুপুর-দেওঘর বেল্টকে মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বাস্থ্যোদ্ধারের জায়গা হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে দার্জিলিং ও বাঙালির ক্লাস কনশাসনেস। দার্জিলিঙে যখন মধ্যবিত্ত বাঙালির আগমন বেড়ে গেল, তাদের পকেটানুসারী থাকার জায়াগা হিসেবে অনেকে স্বল্পবিত্তের সরাইখানা গজিয়ে উঠেছিল দার্জিলিঙে। আর তার ফলে সাহেবী দার্জিলিঙের এক্সক্লুসিটিভিটি নাকি ভয়ানক আঘাত পায়। বিচলিত হয়ে বর্ধমানের মহারাজা, কৈলাস বসু, নীলরতন সরকার প্রমুখের সাহায্য নিয়ে বিহার প্রদেশের সাঁওতাল পরগণাকে অল্পব্যয়ের স্বাস্থ্যোদ্ধারের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। পুরো ব্যাপারটাই যে এতটা নগ্ন "আমরা যাব জামতাড়াতে, চড়ব কেমন ট্রেইনে" কেস ছিল তা' নয়। মধ্য ও স্বল্পবিত্ত বাঙালির রেস্তোর প্রতি সদয় নজরও অবশ্যই একটা ছিল, কারণ সাহেবী দার্জিলিং যাতায়াত ও থাকাখাওয়া নেহাৎ সস্তার ব্যাপার ছিলনা।
অনেক তথ্য পেয়েছি উইকি থেকে। দার্জিলিঙের ইতিহাস সম্বন্ধে আগ্রহী হলে অবশ্যই এই প্রবন্ধটি পড়বেনঃ https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3837203/. তথ্যের আকর একটি। আর পেয়েছি পারিবারিক বুজর্গদের সঙ্গে গল্পগাছায়, বিশেষতঃ ঠাকুমার মুখে।
দ-দির কথায় এটা এখানে দিলাম।
থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কুউ।
খুব ভালো লাগলো
খুব ভাল লাগল। বসন্ত বাবুর "স্মৃতির অর্ঘ্য"কোথায় পাব জানেন?
"স্মৃতির অর্ঘ্য" রিপ্রিন্ট হয়েছে বলে শুনিনি। সময় পেলে অনুষ্টুপ থেকে ডিজিটাইজ করা ইচ্ছে রাখি। করতে পারলে এখানে খবর দেব।
ঝুলি থেকে আরও সব মণিমুক্তো বের করুন।
স্মৃতির অর্ঘ্যঃ
https://u.pcloud.link/publink/show?code=XZN6hLXZG0MmQuC8QFkdOye5KeVp8XxY8hF7