“...আমি জহ্লাদ, কিন্তু /
কাহাকেও বধ করিবার আদেশ যেন দীর্ঘদিন আসে না।” (বিতর্ক প্রস্তাব, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল)
সাইকোলজি নিয়ে আমার বিস্তর কম পড়াশোনা আছে, কিন্তু সামান্য হলেও আগ্রহ আছে। এই প্রশ্ন শুধু আমার নয়, এই প্রশ্ন সাইকোলজির খুব গোড়ার প্রশ্ন, মানুষের যে কাল্টিভেটেড চরিত্র, তারমধ্যে ঠিক কী ভাবে বা কোন শেপে রয়ে গেছে বেসিক অ্যানিম্যাল ইন্সটিঙ্কট? কী ভাবে এই মূল প্রবৃত্তিগুলি পুনরুজ্জীবিত হতে পারে? আমি তো নিজেকে ‘নিরীহ’ মানুষ ভাবি, দু’ চার কী-বোর্ড কবিতাও লিখি, আমিও কী, হতে পারে, অবচেতনে বা 'গোপনে হিংসার কথা বলি’?
১৯৬১ সালে, মনোবিজ্ঞানী স্ট্যানলি মিলগ্রাম (ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর থেকেই প্রায়-সবাইকে বিস্মিত ও হতচকিত করে রেখেছিল এমন একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে, নাৎসিরা কীভাবে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যা করতে পেরেছিল? কী-ভাবে তবে সাধারণ মানুষ এই হত্যাযজ্ঞে সামিল হয়েছিলেন? সবাই তো আর সাইকোপ্যাথ ছিলেন না! তাহলে বিপুল ও বীভৎস এই নির্যাতন-যজ্ঞে কোনো অপরাধ-বোধ ছাড়াই সাধারণ মানুষ কীভাবে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন?
মিলগ্রাম একটা স্টাডি সেট-আপ করেন, যা পরবর্তীতে ‘মিলগ্রাম অবিডিয়েন্স স্টাডি’ নামে বিখ্যাত হবে। এই স্টাডিতে বহিরাগত অংশগ্রহণকারীরা থাকবে শিক্ষকের ভূমিকায়।এই ‘শিক্ষক’দের বলা হয়েছিল তারা ছাত্রদের ‘পরীক্ষা’ নেবেন। এই পরীক্ষায় ছাত্ররা যখনই ভুল উত্তর দেবে, শিক্ষকরা ইলেকট্রিক শক দেবে, এবং ক্রমে ইলেকট্রিক শকের মাত্রা বাড়তে থাকবে। অর্থাৎ যত ভুল উত্তর, ততই শকের তীব্রতা বাড়তে থাকবে। এবং এই ইলেকট্রিক শকের তীব্রতা হ্রাস-বৃদ্ধির জিম্মেদার, এক এবং একমাত্র ওই ডেজিগনেটেড শিক্ষক।
শিক্ষার্থীরা ছিল সব ভাড়াটে অভিনেতা, এবং বৈদ্যুতিক শকটাও সত্যি ছিল না। কিন্তু স্টাডিতে অংশগ্রহণকারী ‘শিক্ষক’-রা এর কিছুই জানতেন না। তারা বিশ্বাস করেছিলেন যে তারা ক্রমবর্ধমান বেদনাদায়ক ইলেকট্রিক শক দিচ্ছেন অর্থাৎ ছাত্ররা ভুল উত্তরের জন্য শাস্তি পাচ্ছে এবং এই শাস্তির তীব্রতা বেড়েছে ভুলের মাত্রার উপর নির্ভর করে। ছাত্রদের বসানো হয়েছিল নকল বৈদ্যুতিক চেয়ারে, হাত-পা বেঁধে, যেরকমভাবে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসানো হয় আর কী। ওদিক অংশগ্রহণকারী শিক্ষকরা ছিল অন্য একটা ঘরে, যেখান থেকে শিক্ষকরা ছাত্রদের দেখতে পাবে না, কিন্তু শুনতে পাবে।
প্রথমদিকে, শিক্ষার্থী বেশিরভাগ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিল, সম্ভবত স্টাডিটিকে একটা বিশ্বাসযোগ্য রূপ দেওয়ার জন্যই এবং শিক্ষকরাও এমন মাইল্ড শক দিয়েছিলেন, যে তাতে কেবলমাত্র হালকা অস্বস্তি হতে পারে।
তারপরে শিক্ষার্থীরা ক্রমে আরও প্রশ্নের ভুল উত্তর দিতে শুরু করে আর শকের তীব্রতাও বাড়তে থাকে।ক্রমে এমন হয় যে প্রতিটি শক দেওয়ার পরে শিক্ষার্থীরা চিৎকার করতে থাকে এবং শক দেওয়া থামানোর জন্য অনুনয় করতে শুরু করে। এমনও হল যে শক আরও তীব্র হওয়ার সাথে সাথে ছাত্রটি অবশেষে চুপ করে গেল। এমনকি প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও বন্ধ করে দিল— এটা বোঝাতে যে সে বৈদ্যুতিক শকের আঘাতে অচেতন হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া মানে ভুল উত্তর দেওয়া। ফলে বিদ্যুতের ঝলক এমনভাবে বাড়তে থাকল যে, তা পৌঁছে গেল প্রাণঘাতী স্তর (যদি সত্যিই ইলেকট্রিক শক দেবার ব্যবস্থা থাকত) পর্যন্ত।
মিলগ্রাম মূলত ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে প্রায় একশ লোকের মধ্যে অন্তত একজন নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, যিনি ভুল উত্তর দেবার জন্য প্রাণঘাতী বিদ্যুতের ঝটকা প্রয়োগ করে একজন শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলবেন, কারণ তাকে বলা হয়েছিল এমন করতে। কিন্তু দেখা গেল প্রায় শতাধিক অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় সত্তর জন বিশ্বাস করলেন যে তারা কাউকে নির্মমভাবে বৈদ্যুতিক মরণ-শক দিচ্ছেন শুধুমাত্র এই কারণে যে তাদের এরকম করতে বলা হয়েছিল।অর্থাৎ তিন জনের মধ্যে অন্তত দুজন রীতিমতো জহ্লাদ হয়ে উঠতে পারলেন, সামান্য ম্যানিপুলেট করার ফলে। বাঙ্গালি হিসেবে আমি জানি, অনেকেই খাসির-মাংসের দোকানে দাঁড়িয়ে মাংস-বিক্রেতার দিকে তাকিয়ে ভেবেছেন, লোকটাকে কী নিষ্ঠুর দেখতে! কিন্তু এই স্টাডি বলে, সামান্য স্টিমুলেটর আমাদের তিনজনের মধ্যে অন্তত দুজনকে খুনি বা হত্যাকারী করে তুলতে পারে সুবিধেজনক পরিবেশে।
হুঁ , তাহলে এটাই থাক,
"এটাই" নয়, "এটাও"