তারপর একটু কী ভেবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “পদ্মসম্ভব কোথায় ছিলেন যেন?”
“সাহরে। রাজত্ব ছেড়ে শুধুমাত্র রাজকন্যা মন্দরবাকে বিয়ে করলেন।” খেই ধরিয়ে দিলাম।
“রাইট! এদিকে তিব্বতে সম্রাট ঠিস্রোং দেচেন দেশের শান্তি বজায় রাখার জন্য শান্তরক্ষিতকে ফিরে যেতে বললেন। শান্তরক্ষিত ফিরে এলেন নেপালে। কয়েক বছর পর যখন মহামারী, দুর্ভিক্ষ কমল, দেশের অবস্থা একটু থিতু হল সম্রাট ভাবলেন আবার একবার চেষ্টা করা যাক না কেন? আচার্যের উপদেশ তার মনে ছিল। ফলে দূত গেল পদ্মসম্ভবকে আমন্ত্রণ করে আনার জন্য। ওদিকে শান্তরক্ষিতের কাছেও ফের বার্তা গেল। রাজার অনুরোধ নিয়ে। পদ্মসম্ভব আসছেন শুনে আচার্য আবার চললেন তিব্বতের দিকে।”
“আবার সেই হিমালয় পার হয়ে পায়ে হেঁটে?” এই লম্বা পথ অমন বারবার হাঁটার কথা ভেবেই কেমন ক্লান্ত লাগে।
“আর কী উপায়? শান্তরক্ষিত পাড়ি দিলেন লাসার পথে। অন্যদিকে পদ্মসম্ভব নাকি আগেই ধ্যানযোগে জেনে গেছিলেন যে তিব্বতের রাজা তাকে আমন্ত্রণ করার জন্য দূত পাঠাচ্ছেন।”
“ইশ! এমন ধ্যান যোগে যদি আপিসের আপ্রাইসাল রেটিংটা জানতে পারতাম…” শুভ যথারীতি ফুট কাটল। জয়দা শুভর অমন পার্থিব কামনা বাসনাকে পাত্তা না দিয়ে বলে চলল, “যথাসময়ে শালা-ভগ্নীপতি মিলে উপস্থিত হলেন রাজা ঠিস্রোং দেচেনের দরবারে। পদ্মসম্ভবের সাথে মন্দরবাও এসেছিলেন। আগের বারের মত ফের প্রবল বিরোধিতাকে কীভাবে সামলান যায় - সেই নিয়ে রাজার সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলেন দুই জনে।
সম্রাট বললেন, হে আচার্য, হে মহান গুরু আপনাদের সাহায্যে আমি এই আহিমালয় তাকলামাকান তিব্বতদেশে ভগবান বুদ্ধের ধর্মর প্রচার করতে চাই। প্রাচীন বোন ধর্মের কুসংস্কারের অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে আমার দেশের মানুষ। তাদের বৌদ্ধধর্মের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসার জন্য আপনাদের সহযোগিতা কাম্য।
রাজার গৌরচন্দ্রিকা শুনে শান্তরক্ষিত বললেন, সবই তো বুঝলাম, কিন্তু আমার আগেরবারের অভিজ্ঞতা তো বলেনা যে এটা খুব সহজ কাজ। আপনার মন্ত্রী, পারিষদদের মধ্যেই একদল আমায় দেশ ছাড়া হতে বাধ্য করেছিল। এবার তাদের জব্দ করার উপায় কিছু ভেবেছেন? আমি তো আর এই বয়সে যুদ্ধ করতে পারিনা। সেটা আপনাকেই করতে হবে!
সম্রাট বললেন, কিন্তু আচার্য বোধিসত্ত্ব, তিব্বতিরা শান্তরক্ষিতকে আচার্য বোধিসত্ত্ব বলেই ডাকত, আপনি তো প্রাজ্ঞ পুরুষ, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে এই ব্যাপারে আমার হাতপা বাঁধা। নিজের রাজসভার প্রায় অর্ধেক সভাসদের রোষের শিকার হওয়াটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। আমার নিজের প্রাণসংশয় হতে পারে। আমাদের বংশে গুপ্তহত্যার অনেক ইতিহাস আছে। সুতরাং…।
পদ্মসম্ভব এতক্ষণ কথা বলেননি। মন দিয়ে শুনে শান্তরক্ষিতকে জিজ্ঞেস করলেন, আচার্য আপনি ঠিক কী পদ্ধতিতে এই দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বুদ্ধের বাণী বা আপনার মহাযানী ধর্মের গভীর দর্শনকে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন সে ব্যাপারে জানতে আমি ইচ্ছুক।
আচার্য বললেন, দেখুন, অসঙ্গ, নাগার্জ্জুন, বসুবন্ধু বা দিঙনাগের মত মহান দার্শনিকদের মত এই অর্ধশিক্ষিত মানুষের মধ্যে প্রচার করা সম্ভব বলে আমি মনে করিনি। আমি তাই ভগবন বুদ্ধের দশকুশল, অষ্টাদশধাতু, দ্বাদশনিদান ইত্যাদি উপদেশের কথা বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু…
পদ্মসম্ভব স্মিত হেসে বললেন, আচার্য আপনি প্রাজ্ঞ, এইসময়ের সমগ্র ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক - তাই আপনার পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা আমার নেই। তবু আপনার অনুমতি নিয়ে একটি কথা বলতে চাই। আপনি যে পদ্ধতিতে এই তিব্বতবাসীর মধ্যে বৌদ্ধধর্মের আলো ছড়াতে চেয়েছেন - তা হয়ত আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ অথবা সম্রাটের মত বিদ্বান পরম ধার্মিক মানুষের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু এই আপামর তিব্বতবাসী, যারা আদি ধর্মের কুসংস্কারের ছায়ায় নিজেদের জীবনকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে, তাদের কাছে এই দশকুশল বা দ্বাদশনিদানের মূল্য নেই।
সম্রাট বললেন, তবে উপায়?
শান্তরক্ষিত বললেন, আমি সেই জন্যই আপনাকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা সম্রাটকে বলেছিলাম, পদ্মসম্ভব। আপনিই আমাদের একমাত্র ত্রাতা হতে পারেন। আপনার তন্ত্রজ্ঞান এবং বিভিন্ন তন্ত্রপদ্ধতিই হয়ত এদেশের প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাসী মানুষকে বৌদ্ধধর্মের প্রতি উৎসাহিত করতে পারে। কে জানে, হয়ত এ দেশের আদি ধর্মর সাথে মন্ত্রযান মিলিত হয়ে সন্ধান দেবেনা এক নতুন মার্গের? হয়ত শাক্যমুনির তেমনই ইচ্ছা।
আলোচনামাফিক শান্তরক্ষিতের পরিবর্তে গুরু পদ্মসম্ভব দায়িত্ব নিলেন এবার। তার সমস্ত ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনলেন বিরোধী শিবিরকে। সে ক্ষমতা আমার মতে হয়ত তার সাংঘাতিক বুদ্ধি এবং নেতৃত্বের ক্ষমতা। এর সাথে ম্যাজিকও ছিল নিশ্চয়ই। বোকা তিব্বতিদের চোখে সেসব অলৌকিক শক্তি হিসাবে ধরা পড়েছে। সেখানকার ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেছেন যে পদ্মসম্ভব অপার্থিব ক্ষমতাবলে যে সমস্ত বোন দেবতারা তিব্বতকে রক্ষা করতেন - সেই তেনমা, গুর্লহা, গেনিয়েনদেরকে বশ করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এই ঘটনাকে তিব্বতিরা এখনও প্রতি বছর একমাসব্যাপী ‘লিংকা উডস ফেস্টিভ্যাল’-এর মাধ্যমে উদযাপন করে থাকে। পদ্মসম্ভব কিন্তু কাউকে হত্যা করেননি বা বিতাড়িত করেননি - বরং নিজের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা দিয়ে সকলকে বৌদ্ধ ধর্মের আশ্রয়ে নিয়ে আসেন। এই সমস্ত তিব্বতি বোন দেবতারা বৌদ্ধ দেবতারূপে স্বীকৃত হয়। বোন ধর্মকে রক্ষার বদলে তাদের দায়িত্ব পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় বৌদ্ধধর্মকে রক্ষা। এমনকি অনেক বোন আচার চলে আসে বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে। বজ্রযান থেকে উদ্ভূত এই মিশ্র বৌদ্ধধর্মের রূপকে বলা হয়েছে ‘ঞিংমা’। লামাবাদের সূচনাও এইভাবেই হয় - পদ্মসম্ভবের হাত ধরে। সেই জন্য তিব্বতে পদ্মসম্ভবকে ‘দ্বিতীয় বুদ্ধ’ বলে অভিহিত করা হয়। আর সেই জন্যই সিকিমের মোনাস্ট্রিগুলোতে গেলে বুদ্ধের পাশে পদ্মসম্ভবের মূর্তি দেখতে পাস।”
“বোঝ অবস্থা! বুদ্ধদেব কী বলে গেলেন আর তার মৃত্যুর হাজার বছরের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের কী হাল হল।” মঞ্জুশ্রী জিভ দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করে বলে উঠল।
“যস্মিন দেশে যদাচার। ওদিকে শ্রীলংকাতে যা। সেই আদি বৌদ্ধধর্ম এখনও টিকে আছে। ধম্মপদ মেনে চলছে তারা। তবে পরবর্তীকালে অনেক বৌদ্ধ পণ্ডিত এই মিশ্রিত বৌদ্ধধর্মর শুদ্ধিকরণের চেষ্টা করেছেন। তাদের মধ্যে অতীশ অন্যতম।” জয়দা জবাব দিল।
“তাহলে ফাইনালি তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার শুরু হল? সম্রাট ঠিস্রোং দেচেন খুশি হলেন?” শুভর প্রশ্ন শুনে মনে হল সম্রাট বুঝি জয়দাকে হোয়াটস্যাপ করে খুশির খবর শুনিয়েছেন।
“হল। কিন্তু পুরোপুরি হল না। সম্রাটের ইচ্ছে ছিল একটি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ। এখন পদ্মসম্ভবের আশীর্বাদে ডাকিনী, যোগিনী, শত শত নাগিনী সবাই দল পাল্টে বোন থেকে বৌদ্ধধর্মে এসেছে। দেশের প্রতিরোধী শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। তাই সম্রাট কাজ শুরুর ব্যাপারে ভরসা পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা সকলে ভারতবর্ষের স্বনামধন্য পণ্ডিত। ভারতবর্ষের নালন্দা, বিক্রমশীলের নাম শুনেছি। আমিও আমার দেশের ধার্মিক প্রজাদের জন্য অনুরূপ একটি মহাবিহার স্থাপন করতে চাই। আমার এই বিহারটির স্থাপত্য কেমন হবে সে ব্যাপারে যদি কিছু ধারণা দেন। আচার্য বললেন, নালন্দা তো অতি প্রাচীন। আপনি বরং বাংলার সর্বাধুনিক মহাবিহার ওদন্তপুরীর অনুকরণে এই বিহারের নকসা অংকন করাতে পারেন। বল দেখি, বাংলায় তখন কে রাজত্ব করছেন?”
“পাল?” চটজলদি জবাব দেয় মঞ্জুশ্রী।
“গুড। ধর্মপাল। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা। পরম বৌদ্ধ। শোনা যায় ধর্মপালের সময় বাংলায় কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার নির্মান হয়। তারমধ্যে বিক্রমশীল মহাবিহারের কথা কম বেশী সবাই জানিস। ইতিহাসের বইতেও পড়েছিস হয়ত। এ ছাড়াও আরও একটি বিখ্যাত মহাবিহারের নাম ওদন্তপুরী। বিক্রমশীলের মত এই মহাবিহারের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় না। বিহারের ভাগলপুরের কাছাকাছি কোথাও হয়ত এটি অবস্থিত ছিল। তবে এর স্থাপিত হওয়া নিয়ে একটা উদ্ভট গল্প আছে। মানে, সেই তিব্বতি ঐতিহাসিকদের লেখা থেকেই এসব জানা যায়।”
“রাজ্যের গালগল্প লিখে না ভরিয়ে সঠিক অবস্থান বা সঠিক ইতিহাস লিখলে তো কাজে দিত!”
“সেতো দিতই, মঞ্জুশ্রী - কিন্তু তাহলে যে ধর্ম মাহাত্ম্য প্রকাশ পেত না। সাধারণ লোকে কল্কে দিত না। যাই হোক, গল্পটা শোন।
মগধের কাছে নরদ নামে এক তান্ত্রিক বাস করতেন। তাঁর শবসাধনা করার শখ হল। একজন বৌদ্ধ উপাসককে পটিয়ে পাটিয়ে তিনি এই সাধনার পার্টনার বানালেন। যথাসময়ে প্রক্রিয়া শুরু হল। তান্ত্রিক আগেই বলে দিয়েছেন যে, দেখো বাপু, এ বড় কঠিন সাধনা। প্রাণনাশের সম্ভাবনা আছে। সুতরাং সাবধানে। আমার প্রক্রিয়া শেষ হলে এই শবের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হবে। সে তখন জিভ বের করবে তিনবার। তোমায় তক্কে তক্কে থাকতে হবে। জিভটি বের করা মাত্র সেটাকে কামড়ে ধরবে। তাহলেই কেল্লা ফতেহ! প্রথমবারেই ধরতে পার যদি তাহলে মহাসিদ্ধি লাভ, যত দেরী করবে সিদ্ধির অ্যামাউন্ট কমতে থাকবে। তিনবারে যদি ধরতে না পার তাহলে কপালে দুঃখ আছে। ও ব্যাটা শব মহাশক্তিধর হয়ে প্রথমে তোমায় খাবে, তারপর আমায় খাবে - তারপর তামাম দুনিয়াকে খেয়ে ফেলবে। সুতরাং, কনসেন্ট্রেট!”
“কীসব সাংঘাতিক জিনিসপত্র - মরার জিভে দাঁতের কামড়!” শুভ মন্তব্য করল।
“হ্যাঁ। কথা মত কাজ কম্ম শুরু হল। সিদ্ধিলাভের লোভে লোভে আসা এই বৌদ্ধ মরার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ওঁত পেতে বসে রইল। যথসময় শবের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন দেখা দিল। আর সড়াৎ করে জিভ বের করে দিল। কিন্তু ধরতে পারা গেল না। দ্বিতীয়বারও মিস হল। শেষ বারে গিয়ে খপাৎ করে কামড়ে ধরল তাকে। আর সাথে সাথে শবদেহটি সোনার হয়ে গেল। আর কামড়ানো জিভটা তরোয়ালের রূপ নিলো। তান্ত্রিক সেই তরোয়ালটি নিয়ে স্বর্ণদেহটি উপাসকের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই সোনা সৎকাজে ব্যবহার করবে। তাহলে এই সম্পদ অক্ষয় হবে। এই বলে সে তরোয়াল হাতে নিয়ে স্বর্গে চলে গেল। আর ঐ প্রভূত পরিমাণ সোনা ব্যয় করে ওদন্তপুরী মহাবিহার নির্মিত হল।”
“এই ভয়ংকর গল্পের মহাবিহারের অনুকরণে তিব্বতে মহাবিহারের নকশা হল?”
“হ্যাঁ। অবিশ্যি এইসব গল্প পরে তৈরী হয়েছে বলেই আমার ধারণা। তিব্বতিরা বানিয়েছে। তিব্বতের প্রথম মহাবিহারকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্য ওদন্তপুরীর কাহিনীও নির্মিত হয়েছে। যাই হোক, মোদ্দা কথা হল যে লাসার থেকে কিছুটা দূরে ইয়ার্লুং সাংপোর উত্তরপাড়ে সাম’য়ে নামে এক জায়গা নির্দিষ্ট করা গেল বিহার নির্মানের জন্য। সাতশো পঁচাত্তর সালে আচার্য শান্তরক্ষিত এবং গুরু পদ্মসম্ভব সঠিক নিয়ম নিষ্ঠাভরে মহাবিহারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। তারপর শুরু হল নির্মাণের কাজ। কিন্তু একদিনে তো এই বিশাল বিহার নির্মাণ শেষ হল না! - অনেক কাণ্ড করে প্রায় বছর চারেক পর - সাতশো ঊনআশি সালে শেষ হয় কাজ।”
“এর আবার কী গল্প?”
“বিস্তর কাহিনী আছে। যখন এই মহাবিহারের জন্য স্থান নির্বাচন চলছে স্বাভাবিক ভাবেই দায়িত্ব পড়েছিল আচার্য শান্তরক্ষিতের উপর। এক সকালে তিনি দ্রাকমার খেপো পাহাড়ের উপর উঠলেন। সেখান থেকে ব্রহ্মপুত্রের বিস্তৃত উপত্যকা নজরে আসে। সেই উপত্যকার মাঝে একটি শ্বেতাভ অংশ তিনি লক্ষ্য করলেন। সেখানে বিশেষ দুই ধরণের ঘাস হয়ে আছে। আচার্য সেই অংশকে নির্দিষ্ট করলেন বিহারের স্থান হিসাবে। রাজ কর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন ওই ঘাস কেটে আঁটি বেঁধে বেঁধে জমা করতে। সেই আঁটি বাঁধা ঘাস দিয়ে মহাবিহারের চতুঃসীমা নির্দিষ্ট করে ভিত খোঁড়ার কাজ শুরু করার অনুমতি দিলেন। ভিত খোঁড়ার কাজে হাত লাগাল সকলে। এমনকি সম্রাট নিজেও খোন্তা কোদাল নিয়ে গর্ত খুঁড়তে লাগলেন। হাতখানেক খোঁড়ার পর একটা অদ্ভুত জিনিস পাওয়া গেল।”
“গুপ্তধন নাকি?” আমি উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু আমার সমস্ত রোমাঞ্চে জল ঢেলে দিয়ে জয়দা বলল, “নাহ, এক মুঠো চাল আর এক মুঠো যব। একে শুভ লক্ষণ হিসাবে বুঝতে পেরে আচার্য শান্তরক্ষিত হাতে করে মাটি নিয়ে সম্রাটের কপালে লেপে দিয়ে আনন্দে বলে উঠলেন, সিতি সিতি, ফল ফল। অর্থাৎ, সিদ্ধি এবং ফললাভ হয়েছে তোমার। অতঃপর ভিত খোঁড়ার কাজ সুসম্পন্ন হল। বিহারের নির্মাণ কাজও নির্বিঘ্নে চলতে লাগল। পদ্মসম্ভব যেসব দেবদেবী অপদেবতাদের বশে এনেছিলেন, তারাও নাকি এই সাম’য়ে বিহার তৈরীর কাজে সাহায্য করতে লাগল। কিন্তু সমস্যা হল অন্যত্র। মহা সমারোহে মহাবিহারের মন্দির তো তৈরী হল। কিন্তু মন্দিরে থাকবে কী?”
“কেন? বৌদ্ধ দেবদেবীদের মূর্তি।” এতে সমস্যার কী আছে সেটাই মালুম হল না আমার।
“বানাবে কে? আসবে কোথা থেকে? গোটা দেশে বৌদ্ধ মূর্তি বলতে বোধহয় সাকুল্যে দুইখানা। জোখাং আর রামোছে মন্দিরে। সেসবও সম্রাট স্রোংচান গামপোর বিদেশী রাণীদের নিয়ে আসা। এদেশে অমন দেবমূর্তির কারিগর কোথায়? রাজা পড়লেন চিন্তায়। শান্তরক্ষিতকে গিয়ে আবার বললেন যে, আচার্য আপনি একটা উপায় না দেখালে তো চলছে না!
শান্তরক্ষিত বললেন, সে উপায় আছে। আপনার দেশেরই দক্ষিণে নেপাল সীমান্তে ছোংদু অঞ্চলে আমি একজনকে জানি যে এই কাজের যোগ্য কারিগর। তার নাম গ্যাচেল বুচেন। আপনি লোক পাঠান তাকে নিয়ে আসার জন্য।
সম্রাট বললেন, আমি যে আপনার কাছে কী পরিমাণ কৃতজ্ঞ সেকথা প্রকাশের ভাষা জানা নেই।
আচার্য বিনয়াবনত হয়ে বললেন, আমি কেউ নই। সকলই তথাগতর করুণা - তাঁর ইচ্ছা। কিন্তু মহারাজ, আমার একটি প্রশ্ন আছে।
নিশ্চয়ই বলুন।
নতুন যে মূর্তি তৈরি হবে - তার ছাঁদ কেমন হবে? - সেকথা ভেবেছেন কিছু? ভগবন বুদ্ধের অনেক প্রকার মূর্তি আমাদের দেশে আছে। পূর্বে একরকম, সুদূর পশ্চিমে গান্ধারদের নির্মিত বুদ্ধমূর্তির ভিন্ন শৈলী, আবার যদি আপনি উত্তরে চীনদেশে যান সেখানে দেখবেন একেবারে অন্যরকম মূর্তি। এই সকলের মধ্যে কোন ধরণের স্থাপত্যশৈলীকে আপনি আপনার দেশের প্রথম বৌদ্ধ মহাবিহারে রাখবেন - সেটা যে আপনাকেই স্থির করতে হবে, সম্রাট।
সম্রাট ঠিস্রোং দেচেন একটু ভেবে বললেন, আপনি সঠিক কথাই বলেছেন, আচার্য। কিন্তু আমি তো আগে থেকে এ বিষয়ে ভাবিনি সেরকম। তবে আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি এই প্রচলিত কোন শিল্পরীতি মেনেই মূর্তি নির্মান করাতে রাজি নই।
শান্তরক্ষিত একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, তবে?
সম্রাট বললেন, আমার দেশের মানুষের জন্য আমি এক নতুন শিল্পরীতি চাই। ভারতীয়, ব্যাক্ট্রিয়ান বা চৈনিক চেহারার দেবমূর্তিকে এই দেশের মানুষ আপন করতে পারবেনা। ফলে, আমাদের এত কষ্ট করে প্রচারিত বৌদ্ধ ধর্ম তিব্বতবাসীর কাছে বিদেশি ধর্ম হয়েই থেকে যাবে। তাদের আত্মার অংশ হয়ে উঠতে পারবেনা কোনদিন। সুতরাং, আমার ইচ্ছে শিল্পী যেন তিব্বতি গড়নেরই দেবমূর্তি নির্মাণ করেন।
শান্তরক্ষিত মৃদু হেসে বললেন, তথাস্তু।
অতএব তৈরী হতে শুরু হল নতুন দেবমূর্তি। খুঁজে খুঁজে তিব্বতিদের মধ্যে থেকে সবচেয়ে সুন্দর চেহারার তিনজন পুরুষ এবং একজন মহিলাকে মডেল হিসাবে নিয়োগ করা হল। তাদের দেখেই নির্মিত হল সাম’য়ে বিহারের সমস্ত দেবমূর্তি, অঙ্কিত হল সকল ম্যুরাল। এরপর ধীরে বিহারের বাকি অংশগুলি নির্মিত হল। সেই অংশগুলি নির্মাণের সময় রাজা বিভিন্ন স্বপ্নাদেশ লাভ করেন এবং সেই অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করেন। সব মিলিয়ে সাতশো ঊনআশি সালের শীতকালে এই বিশাল কর্মকান্ডের পরিসমাপ্তি ঘটল। তিব্বতের প্রথম মোনাস্ট্রি সাম’য়ের জন্ম হল সম্রাট ঠিস্রোং দেচেনের হাতে এবং আচার্য শান্তরক্ষিত ও গুরু পদ্মসম্ভবের সহযোগিতায়।”
“যাক তাহলে ফাইনালি তিব্বতে ধর্ম কর্ম সুসম্পন্ন হল?” মঞ্জুশ্রী জিজ্ঞেস করল।
“হল। রাজ অনুরোধে শান্তরক্ষিত মহাবিহারের দায়িত্ব নিয়ে বাকি জীবন ওখানেই যাপন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। গুরু পদ্মসম্ভবকেও একই অনুরোধ করা হল। কিন্তু তিনি থাকতে রাজি হলেন না। সম্রাট ঠিস্রোং দেচেন সহ নজনকে খেপো পাহাড়ের উপর হেরুক সাধনার শিক্ষা প্রদান করে বিদায় চাইলেন। সম্রাট বললেন, হে গুরু, আপনার উপকার, আপনার শিক্ষা আমরা ভুলব না। আমার অন্যতমা মহিষী য়েশে চোগিয়াল পরম বৌদ্ধ এবং আপনার অনুগত। আপনাকে আমার প্রদেয় কিছু নেই। তবু, মহিষী য়েশে চোগিয়ালকে তার স্বইচ্ছা অনুযায়ী আপনি যদি আপনার সাধনসঙ্গিনী হিসাবে গ্রহণ করেন, তাহলে আমরা দুজনেই অশেষ কৃতজ্ঞ থাকব।”
“একি! নিজের বৌকে অন্য লোকের সাথে ছেড়ে দিল?” শুভ এসব শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।
“বৌএর নাকি বেজায় আপত্তি ছিল রাজার সাথে বিয়েতে। ধর্ম কর্ম নিয়ে জীবন যাপনের ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাপে জোর করে বিয়ে দেয় সম্রাটের সাথে। ফলে রাজার জীবন তাকে নিয়ে বোধহয় খুব একটা সুখে কাটছিল না। তাই পদ্মসম্ভবের সাথে বিদায় করে দিয়ে হয়ত আনন্দে একটু ‘বজ্রকীলয়’ নেচে নিয়েছিলেন। কিছুই বলা যায়না।”
“সেটা আবার কী নাচ?” মঞ্জুশ্রী জিজ্ঞেস করল।
“পদ্মসম্ভবেরই প্রবর্তন করা একপ্রকার তান্ত্রিক নৃত্য। শিখবি?” জয়দা চোখ মটকে বলল।
“থাক। তাহলে শেষমেশ তিব্বতে বজ্রযানের জয়যাত্রার সূচনা হল?”
“কিছু বছরের জন্য। তারপর আবার গোল বাধল।” জয়দা আরো কীসব বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু মঞ্জুশ্রীর ফোন বেজে ওঠায় বাধা পড়ল। মঞ্জুশ্রী একটু ভ্রু কুঁচকে কলটা রিসিভ করে বারান্দায় চলে গেল। আমি বললাম, “আবার গোলমাল? এবার কে বাধাল?”
“ওটা পরের দিনের জন্য তুলে রাখ। খিদে পাচ্ছে তো। কী ঠাউরেছিস বল তো তোরা আমায়?” বলে জয়দা আড়ামোড়া ভাঙার জন্য দুহাত মাথার উপরে তুলল। আমিও রবি ঠাকুরকে হাঁক পাড়ার জন্য সবে মাত্র ‘র’ উচ্চারণ করেছি - ঠিক তখনই মঞ্জুশ্রী ঘরে ঢুকে বলল, “সর্বনাশ হয়েছে!”
(ক্রমশঃ)
সৈকত বাবু, আপনার লেখা টা খুবই মনজ্ঞ। enjoying it. Hope that you are going to share the next part soon. শুভেচ্ছা রইলো .
অনেক ধন্যবাদ সকলকে।
অপূর্ব বিহার!
শুভর নারকেল মাথার পর্যবেক্ষণ, অধিকাংশ বুদ্ধমূর্তির একটির সংগে আরেকটির চেহারায় কোনো মিল নেই। কিছু মূর্তিতে বুদ্ধকে নাক খাড়া, কিছু মূর্তিতে কোমল ভাব নিয়ে আসতে মেয়েলি ছাঁদ আনা হয়েছে, আবার ইন্দো-চায়না অংশের বুদ্ধ মূর্তি মংগোলয়েড ধাঁচের।
সম্ভবত প্রাচীন গুহাচিত্র ও পুথি-পত্রে ভিক্ষুরা ধ্যানী বুদ্ধের যেসব চিত্র এঁকেছিলেন, তথাগতের মৃত্যুর অনেক পরে ধর্মটিকে টিকিয়ে রাখতে সে সবের আদলে মূর্তি গড়ে বুদ্ধ পূজা চালু হয়। নইলে হিন্দু ধর্মের চাপে বুদ্ধ ধর্ম হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। কিন্তু মূর্তি গড়ার ক্ষেত্রে বিপত্তি বাধান নানান দেশের কারিগর। তারা ধ্যানমগ্ন জ্যোতির্ময় ভাবটি যথাসাধ্য ঠিক রেখে চেহারা গড়েন নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক জ্ঞানে। এই রীতি আজো চলছে, বোধকরি প্রকৃত বুদ্ধের মুখোচ্ছবি হয়তো এখন আর উদ্ধার সম্ভব নয়।
জয় দা যদি এ নিয়ে কিছু আলোকপাত করেন!
অনেক প্রশ্ন জমেছে দেখছি। যদিও সবের উত্তর আমার জানা নেই।
বিপ্লব, বুদ্ধদেব কেমন দেখতে ছিলেন - এই নামে চিত্রা দেবের একটি বই আছে। পড়ে দেখতে পার।
পুরীর ইতিহাস নিয়ে আমার সঠিক জানা নেই। তাই মন্তব্য করতে পারব না। দুঃখিত।
ঞিংমা বৌদ্ধরা অবশ্যই আছেন এখনও। হয়ত ওরিজিনাল রূপে নেই। তবে সিকিম ভুটানে আছেন। ঞিংমা তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সবচেয়ে প্রাচীন মার্গ।