এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • হারিয়ে যাওয়া থলে

    Anindita Roy Saha লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১১ জুন ২০২০ | ৪৬৯৬ বার পঠিত
  • মায়াদি নিয়ে আসতো আমাদের প্রতি সপ্তাহের রেশন, নীল রঙের থলেতে। গম নিয়ে আবার যেত ভাঙাতে, সেও নীল রঙের থলেতে। তারপর বোধ হয় থলেটা তুলে রাখা হত, আবার পরের বার ব্যবহার করা হবে বলে। ছোটবেলায় এইরকমই দেখেছি। আমাদের ইস্কুলের পোশাক ছিল সাদা জামা আর নীল স্কার্ট। সেই স্কার্ট দিয়ে তৈরি এই থলে। ছোট হয়ে গেলে কিংবা রং চটে গেলে, স্কার্টগুলোর গতি হত থলেতে। মা সেলাই করতেন। তখনকার দিনে মায়েদের সকলেরই প্রায় সেলাইয়ের মেশিন থাকত। মা সব ছেঁড়া জামাকাপড় নিয়ে সেলাই করতে বসেছেন, এ এক খুব চেনা ছবি ছিল। আমরাও শিখে গিয়েছিলাম- ববিন, ছুঁচ, মেশিনের তেল।

    তখন প্লাষ্টিকের ব্যাগ আসে নি। আমাদের সকলের বাড়িতে বাজারের থলে নামের একটা জিনিস থাকত। শুধু একটা কেন, বেশ কয়েক ধরণের কয়েকটা। সবজির থলে আর মাছের থলে ছিল আলাদা। রেশনের থলে তো আলাদা বটেই। চট বলে যে জিনিষটা অনেকদিন উধাও হয়ে গেছে, তখন সেই ছিল প্রধান। চটের থলে ছিল আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পাটের জায়গা বাংলা, চটের ব্যবহারই তো স্বাভাবিক। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, বাঙাল বাড়ির একটি অতি পরিচিত পদ ছিল পাটপাতা ভাজা। মায়েদের সেলাইকলের মতোই আজ হারিয়ে গেছে সেই উপাদেয় পদটি। যাই হোক, থলের কথায় ফেরা যাক। মধ্যবিত্তের জীবনে চটের ব্যাগ ছাড়াও ছিল ক্যাম্বিসের ব্যাগ, ভারী সওদা করার জন্য। পুজোর বাজারের মতো বিশেষ একটা বিপণন কাজও হত এভাবেই। মনে আছে, হঠাৎ একটা দারুন রকমের ব্যাগের উদয় হলো, যার নাম বিগ শপার। সেও কিন্তু আসলে চটের তৈরী, কেবল সুদৃশ্য হাতল জোড়া বাঁশের। কোনো কোনো বড়ো দোকানে বেশী জিনিস কিনলে পাওয়া যেত। তাই নিয়ে আবার পরের বার যাওয়া। ছোটোখাটো জিনিস ভরে রেলযাত্রাতেও সঙ্গী এই ব্যাগ। কাপড়ের আর চটের থলে নিয়েই চলতো মধ্যবিত্ত বাঙালির দৈনন্দিন বাজারসদাই। মুদি দোকানের ঠোঙার সুতলি থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রির চুনকামের তুলিটি- সবই পাট, স্বর্ণতন্তু। আর চুন-সিমেন্টের বস্তা থেকে আরম্ভ করে মাসকাবারি চালের বস্তা- সেও চটেরই তৈরি। এইসব আমাদের ছেলেবেলা, মানে সত্তর আর আশির দশকের কথা।

    একটু পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে যে, চটশিল্প বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। দেশের মোট উৎপাদনের শতকরা ৮০% চট আজও আসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। বাংলা থেকে কাঁচা পাট রপ্তানি শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে আর স্কটল্যান্ডের ডান্ডী হয়ে উঠেছিল চটশিল্পের প্রধান কেন্দ্র। প্রায় সারা পৃথিবীর জন্য চটের বস্তা তৈরি হত সেখানে। পাটের সুতো কাটার স্বয়ংক্রিয় কলও প্রথম তৈরি হয় ওখানেই । ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সেই কল আমদানী করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বাংলার চটশিল্প। হুগলী নদীর দুই তীরে বাঁশবেড়িয়া থেকে বিড়লাপুর, একের পর এক চটকল। যেমন ছবিটি আমরা দেখেছি, ‘মহেশ’ গল্পের শেষে গফুর আমিনার হাত ধরে রওনা দেয় ফুলবেড়ে চটকলের দিকে। ১৯০৮ সালের মধ্যে কলকাতা হয়ে ওঠে বিশ্বের সর্বপ্রধান চট উৎপাদন কেন্দ্র। প্রথম ভারতীয় মালিকানায় চটকল স্থাপিত হয় ১৯১৭ সালে, শেঠ হুকুমচাঁদের উদ্যোগে। ঠিক তার পরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলার চটকলের ভূমিকা আরো গুরুত্ব লাভ করে এবং সেই যাত্রা অব্যাহত থাকে বহুদিন।
    দেশভাগের প্রভাব পাটশিল্পের ওপর অবশ্যই পড়েছিল। ৭৫% পাটক্ষেত পূর্ববঙ্গে আর সব চটকল পশ্চিমবঙ্গে । কাঁচা পাট ও চট নিয়ে স্বাক্ষরিত হয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম বাণিজ্য চুক্তি। ফলে পাটচাষ এবং চটের উৎপাদন অক্ষুন্ন থাকে। চটের ব্যবহার চলতে থাকে বিভিন্ন শিল্পে, আর আমাদের ঘরে ঘরে ব্যবহার হতে থাকে চটের থলে।

    স্বাধীনতার পর কাঁচা পাটের উৎপাদন কম না হলেও পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদন কিন্তু সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি। ১৯৫০-৫১ থেকে ১৯৯০-৯১ সাল পর্যন্ত সময়ে কাঁচা পাটের বার্ষিক উৎপাদন বেড়েছে ৩৩ লক্ষ বেল থেকে ৮০ লক্ষ বেল (১ বেল = ১৭০ কিলোগ্রাম)। অথচ পাটজাত দ্রব্যের বার্ষিক উৎপাদন ৮.৭ লক্ষ টন থেকে বেড়ে হয়েছে মাত্র ১৪.২ লক্ষ টন। অর্থাৎ পাটের উৎপাদন আড়াই গুণ বাড়লেও পাটের জিনিসের উৎপাদন বেড়েছে মাত্র দেড়গুণ। এই বৃদ্ধির হার আরো বেশি পড়তে থাকে ১৯৯০ সালের পর। ১৯৯১-৯২ সালে পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদন আদতেই কমে যায় (১২.৭ লক্ষ টন) এবং উৎপাদন আগের মাত্রায় পৌঁছতে লাগে বেশ অনেক দিন, ১৯৯৬-৯৭ সাল। তারপর আর কখনই এই বৃদ্ধির হার আগের মতো হয়ে ওঠেনি। ১৯৫০-৫১ থেকে ২০০০-০১, এই পঞ্চাশ বছরে কাঁচা পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির হারের চেয়ে পাটজাত দ্রব্যের বৃদ্ধির হার অনেকটাই কম।

    এই পতনের কারণ খুঁজলে দেখা যাবে সেকেলে যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ সমস্যা ইত্যাদি থেকে শুরু করে কাঁচা পাট মজুত করা, পাটজাত দ্রব্য বিক্রি করা, সব কিছুর খরচই বেড়েছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশে চটশিল্পের উন্নতির ফলে প্রতিযোগিতাও ক্রমশ বাড়তে থাকে। এইসবের অবশ্যম্ভাবী ফল মূল্যবৃদ্ধি। সমস্যা আরো বড়ো হয়ে দেখা দেয় যখন ক্রমশ পাটজাত জিনিসের চাহিদা কমতে থাকে। আর এর পেছনে রয়েছে বিকল্প সামগ্রীর অনুপ্রবেশ।

    ঠিক এই সময়েই প্লাস্টিক চুপটি করে ঢুকে পড়ে বাজারে। প্রথমে সিমেন্টের বস্তা হিসেবে চটের বদলে চালু হয় প্লাষ্টিক। তারপর ধীরে ধীরে তার সর্বত্র গমন। বস্তা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে প্লাষ্টিক চিপসের আমদানীর জন্য যে ধরণের সরকারি ছুট সে সময় দেওয়া হয়, তাতে আরো সহজ হয়ে ওঠে প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের উৎপাদন। তারই সঙ্গে গড়ে উঠতে থাকে আমাদের প্লাষ্টিক ব্যবহারের অভ্যেস। বলা যেতে পারে, ১৯৯০ এর দশক থেকেই চটের থলের হারিয়ে যাওয়ার শুরু।

    আজ থেকে একশো বছরের কিছু বেশি আগে, ১৯০৭ সালে লিও বেকল্যান্ড আবিষ্কার করেন ব্যাকেলাইট। এই জাদুর জিনিসটিকে বলা হয় একটি ‘ঐতিহাসিক রাসায়নিক আবিষ্কার’। আমেরিকান কেমিকাল এসোসিয়েশন ১৯৯৩ সালে এটিকে পৃথিবীর ‘প্রথম কৃত্রিম প্লাষ্টিক’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই থেকে আজও অব্যাহত প্লাস্টিকের জয়যাত্রা। ব্যাকেলাইট, নাইলন, প্লাষ্টিক- দৈনন্দিন জীবনে একটা বিপ্লব। মাছের থলে হয়ে গেলো নাইলনের, সবজির থলে হলো শক্ত মজবুত প্লাষ্টিকের (আমরা বলতাম বালতি ব্যাগ) আর জামাকাপড় আসতে লাগলো নরম প্লাস্টিকের ব্যাগে (পোশাকি নাম ক্যারি ব্যাগ)। এইতো সেদিনের কথা, আমরা সবাই প্লাস্টিকের মহিমায় মুগ্ধ, যেমন হালকা, তেমনি কাজের। নরম, ছোট্ট, ভাঁজ করলে একটুখানি, ব্যাগের এক কোণে পড়ে থাকতে পারে। আরো ভালো, ব্যাগ নিয়ে না গেলেও চলে, দোকানে গেলেই পাওয়া যায়। ফর্দ না করলেও অসুবিধা নেই, হঠাৎ মনে পড়লেই রাস্তা চলতে যে কোনো জিনিস কিনে ফেলা যায়। গৃহিণীর সুখ বাড়লো, বাজারে যাওয়া ভদ্রলোকেরও। হারিয়ে যেতে লাগলো আমাদের প্রাচীন থলে।

    প্রগতির নামে আজ যে ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি করেছি আমরা, তার জন্য এই প্লাষ্টিক বহুলাংশে দায়ী। প্লাষ্টিক প্রদূষণ আজ সবার পরিচিত একটি বিষয়- ইস্কুলের পাঠ্যবই থেকে বিজ্ঞানের গবেষণাপত্র, সব জায়গাতেই এর আলোচনা। এই পরিবেশ-বিরোধী বস্তুটি আজ প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অনেক শিল্পে প্লাস্টিকের ব্যবহার সুবিধাজনক এবং অপরিহার্য। চিকিৎসাবিজ্ঞানেও আছে এর অতি প্রয়োজনীয় ভূমিকা। কিন্তু এ ছাড়াও যে জিনিষগুলি আমরা রোজ হাতে নিচ্ছি, তাতেও তো প্লাষ্টিক। কমাতে হবে সেগুলোই । ছেড়ে দিই না প্লাস্টিকের ব্যাগ, আসুক ফিরে পুরোনো দিনের থলে !

    আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৫,৯৪০ টন প্লাষ্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে ৪,০৫৯ টন আসে ৬০টি বড় শহর থেকে। সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, প্রতিদিন ভারতবর্ষে মোট যে পরিমাণ প্লাষ্টিক বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয়, তার ৩০% আসে বিভিন্ন প্রকার ব্যাগ থেকে। এর মধ্যে আছে খুচরো বেচাকেনা, জামাকাপড়, উপহার সামগ্রী, খাবার, এমন কি আমাদের বাড়ির ময়লা ফেলার ব্যাগও। এই বিপুল পরিমাণ প্লাষ্টিক বর্জ্য পদার্থের মাত্র ৬০% পুনর্ব্যবহার (রিসাইক্লিং) করা হয়। মনে রাখা ভাল যে, এই পুনর্ব্যবহারের উপযুক্ত করে তোলার পদ্ধতিটিও কিন্তু পরিবেশের পক্ষে উপযোগী নয়। যে কোনো শিল্পের মতোই এরও প্রদূষণ বৃদ্ধির ক্ষমতা আছে। তবুও প্লাস্টিকের ব্যবহার চলতে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ এটি সস্তা। এর উৎপাদনের মাত্রা বেশি হওয়ায় এর উৎপাদনের একক খরচ নামমাত্র। সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের উপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমিয়ে দিয়েছে এই কৃত্রিম বস্তুটি। তাই এর এতো ব্যবহার।

    আজকের দুনিয়ায় চারিদিকে প্লাষ্টিক বর্জ্য বিষয়ে অনেক চর্চা হচ্ছে। এতো আলাপ-আলোচনায় আমাদের সচেতনতা কি বাড়েনি? অবশ্যই আমরা এই নিয়ে ভাবছি, বিকল্প খুঁজছি। আমরা কাপড়ের আর কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করছি আজকাল, পরিবেশ সচেতনতার পরিচয় দিচ্ছি। আসুন, একটু তলিয়ে দেখা যাক, কেমন এই বিকল্প দুটি।

    নতুন কাপড়ের সুদৃশ্য ব্যাগ আজকাল বেশ বাজারচলতি। তবে তার গতিবিধি অনেকটাই স্বচ্ছল সমাজে সীমিত কারণ কাপড় খুব সস্তা নয়। সেই সঙ্গে মনে রাখা ভালো যে, কাপড়ের একটি পরিবেশগত দিকও আছে। কার্পাস চাষে জলের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি। প্রতি কিলোগ্রাম তুলো, যা কিনা তুল্যমানে এক জোড়া জিন্স ও একটি টি-শার্টের সমান, চাষ করতে জলের প্রয়োজন প্রায় ২০,০০০ লিটার। এ ছাড়াও আছে জমি, বিদ্যুৎ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যবহার, যা পরিবেশের ওপর নানা ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। অতএব, এই ‘তৃষ্ণার্ত ফসল’টিকে ব্যবহার করা দরকার অতি সাবধানে। এর মানে নতুন ব্যাগ সেলাই তো বটেই,, সম্ভব হলে আমাদের জামাকাপড়ের পরিমাণও কমানো দরকার। একটি অতি পরিচিত মার্কিন বিপণন সংস্থা কাপড় পুনর্ব্যবহার (রিসাইক্লিং) করে নতুন পোশাক তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তাদের হিসেবও বলছে, সংগৃহিত কাপড়ের মাত্র ২০% আবার ব্যবহার করা যায়। তাহলে তো অধিকাংশই অপচয়।

    হ্যাঁ, আরেকটা বিকল্প আছে। কাগজের ব্যাগ। কাগজ জৈবিক পদার্থ, অতএব সহজেই মিশে যায় মাটিতে। উন্নত বিশ্বে পেপার ব্যাগ বেশ কিছুদিন ধরেই প্রচলিত। কিন্তু সত্যি কি কাগজের ব্যাগ পরিবেশ সমস্যার এতো সহজ একটি সমাধান? হিসাব করে দেখা গিয়েছে, সারা পৃথিবীর কাগজ শিল্পে মোট শক্তি ব্যয় হয় বার্ষিক ৬.৪ এক্সাজুল। এর মানে পৃথিবীর ২০% কার্বন ফুটপ্রিন্টের সূত্রও এই কাগজ শিল্প। তাছাড়া, কাগজ তৈরির জন্য বিপুল সংখ্যক গাছ কাটা হয়। যে অরণ্যাঞ্চল প্রতিবছর এভাবে কমে যাচ্ছে, তার বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি হেক্টর। যদি যুক্তি দেওয়া হয় যে, কাগজের ব্যাগ তো অনেকটাই পুনর্ব্যবহৃত কাগজ (রিসাইকেলড পেপার) থেকে তৈরি হয়, তবে কি সমস্যাটা এড়ানো গেলো? না, তাহলেও নয়। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে যে গাছগুলি কাটা হয়েছে, তা তো ক্ষতির হিসেবের মধ্যে রয়েই গেল। আমাদের কমাতে হবে সেই শুরুর পর্ব থেকে, অর্থাৎ কাগজের ব্যবহার গোড়াতেই কমানো দরকার, ঠিক যেমন কমানো দরকার কাপড়ের বিপুল সম্ভার।

    কাপড় আর কাগজের ব্যাগ, দুইই যদি প্লাস্টিকের পরিবর্তে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের প্রকৃষ্টতম উপায় না হয়, বা পরিবেশ সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে আমাদের হাতে রইলো কী? চটের থলেতেই ফিরে এলাম যে! কিংবা সেই মায়ের হাতের সেলাই করা হারিয়ে যাওয়া নীল রঙের থলে। মৃতপ্রায় পাটশিল্পকে চাঙ্গা করা যায় না! পাট আর চটের সঙ্গে আমাদের তো নাড়ির টান, আদি ও অকৃত্রিম স্বর্ণতন্তু। চটকে ফিরিয়ে আনতে প্রয়াস নিতে হবে কারণ এর গুণ বিস্তর। জৈব পদার্থ হওয়ায় এটি প্রকৃতিতে গলে যেতে ৪০০ বছর লাগবে না, প্রাণীজগতের ক্ষতি করবে না। কৃষিবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, পাট চাষে জল ও জমি দুইই লাগে কম। পাট চাষ করা যায় ফসলের পর্যায়ক্রম (ক্রপ রোটেশন) বজায় রেখে, তাতে বাড়ে জমির উর্বরতা। উপরন্তু, পাটগাছ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অন্যান্য গাছের চেয়ে বেশি। ১ হেক্টর পাটের ক্ষেত দৈনিক প্রায় ১৫ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে ১১ টন অক্সিজেন তৈরি করতে পারে । তাহলে আমরা ফিরে যাই না কেন পাট ও চটের জগতে! আজও তো পৃথিবীর ৬০% পাট উৎপন্ন হয় ভারতে। শিল্পে চলতে পারে চটের বস্তা ও অন্যান্য পাটজাত জিনিসের ব্যবহার। আর আমরা ফিরে পেতে পারি ফেলে আসা চটের থলে কিংবা বিগ শপার। চটের থলে তো অনেক বেশি মজবুত, বারে বারে ধুয়ে নেওয়া যায়, গৃহস্থের সাথী হয়ে থেকে যেতে পারে বহুদিন।

    সেই সঙ্গে চালু থাক পুরোনো কাপড় থেকে নতুন কিছু বানিয়ে নেওয়ার পরম্পরা। আজ কি আর ঘরে ঘরে সেলাই হয় রেশনের থলে? ইস্কুলের স্কার্ট ছোট হলে আজ কী হয় তা দিয়ে? মায়েরা কি সেলাই করেন? বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার? না, আমরা স্বচ্ছল হয়েছি। মহিলারা ঘরের ভেতর বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করার থেকে মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে যে চাই জৈবিক পদার্থ দিয়ে তৈরি জিনিস। আমরা আবার শুরু করে দেখি না, পুরোনো কাপড়ের থলে বানাতে পারি কিনা, পর্দা, বিছানার চাদর আর ইস্কুলের স্কার্ট দিয়ে! মানুষকে বাঁচতে হলে ফিরে যেতেই হবে আগেকার অভ্যাসে, বারবার একই জিনিসের ব্যবহারে, একটা থেকে আর আরেকটা কাজের জিনিস তৈরী করার নিয়মে । আজ কি মায়াদিরা আর থলে নিয়ে আমাদের রেশন ধরতে যায়? না। এখন তো দারিদ্রসীমার ওপরে রেশনই নেই। কিন্তু কেনাকাটা তো আছে। সেই সওদার পরিমাণটিও বিপুল ও ক্রমবর্ধমান। তাই বেরোতে হবে আমাদের সবাইকে থলে হাতে, সুস্থ পৃথিবীর রাস্তা ধরে, আগামীর দিকে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১১ জুন ২০২০ | ৪৬৯৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মো. রেজাউল করিম | ১১ জুন ২০২০ ২২:১১94227
  • আইন করে প্লাস্টিক ব্যাগ আপসারণ করা অনেকটাই সম্ভব হয়েছে, বিশেষ করে বড়ো দোকান গুলোতে বাংলাদেশে। কিন্তু মাছ আর মাংসের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। যেহেতু সুপার শপগুলোতে মাছ-মাংসও কাগজের ঠোঙায় দিয়ে সেটা আবার কাপড়ের থলেতে ভরা হচ্ছে, সেহেতু কাঁচাবাজারেও এটা সম্ভব। প্রয়োজন সদিচ্ছা আর আইনের কড়াকড়ি।   

  • Pinaki | 188.148.***.*** | ১২ জুন ২০২০ ১৪:০৪94239
  • সুইডেনে দেখছি প্লাস্টিক প্যাকেটের দাম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে রিসেন্টলি। সব্জির পাশে কাগজের ঠোঙা রেখে দিচ্ছে ক্রেতাদের বিনা পয়সায় ব্যবহারের জন্য।

    কাপড়, চট, কাগজ - এগুলোর তুলনায় প্লাস্টিকের একটা কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ হল জলে না ভেজা। এই বিষয়টায় কোনো অল্টারনেটিভ প্রযুক্তি এসেছে? মানে ধরুন চটের থলের ভিতর দিকের দেওয়ালে কোনোভাবে একটা জল নিরোধক কোটিং দিয়ে দেওয়া হল। এরকম কোনো শস্তা অল্টারনেটিভ কি বেরিয়েছে?
  • pi | 14.139.***.*** | ১২ জুন ২০২০ ১৪:০৯94241
  • ভাল লাগল লেখাটা। আমার ট্রাইবাল গ্রামের দিকে হাট বা ছোটখাট বিক্রিবাটায় একটা রেওয়াজ ভাল লাগে, কলাপাতায় মুড়িয়ে বঁধে দেওয়া। আমি নিজে জংগলে গেলে, এমনকি ঘরের পাশের জংগলের বড়বড় পাতা নিয়ে তাতে মুড়িয়ে টুকটাক জিনিস আনা নেওয়া করেছি। এসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করলেও কিছুটা তো কাজে দেয়। এগুলোকে ঠিকঠাক আকারে এনে ফেলতে পারলে তো আরোই ভাল।
  • কৌশিক সাহা | 146.196.***.*** | ১২ জুন ২০২০ ১৯:৫৩94247
  • চটের উপরে polyethylene প্রলেপ দিয়ে জল নিরোধক কাপড় তৈরী করা যায় যা দিরে বাজারের থলে বানানো হচ্ছে।  দাম কিছু  বেশিই।  নিচে নমুনা দেওয়া গেলো 

    https://www.amazon.com/dp/B07PZCCG8M/ref=olp_product_details?_encoding=UTF8&me=

    মাঝারি আকারের থলের দাম  প্রায় US$ 20 অর্থাৎ ভারতীয় ১,৪০০-১৫০০ টাকা। 

    বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড:  মুবারক আহমেদ খান চট তন্তু থেকে jute polymer প্রস্তুত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এই polymer  দ্বারা তৈরী ব্যাগকে  "সোনালী ব্যাগ" বাণিজ্যিক নাম দেওয়া হয়েছে এবং এখন এটি Bangladesh Jute Mills Corporation এ পরীক্ষাধীন। এই polymer এর ভাঁড় বহন ক্ষমতা ভালো এবং ৩-৪ মাসের মধ্যে গলে গিয়ে পরিবেশে মিশে যায়।  নীচের URLএ বিস্তারিত খবর পাওয়া যাবে।   

    https://www.textiletoday.com.bd/will-jute-polymer-production-project-sealed-1-7-billion-taka/ 

  • | ১৪ জুন ২০২০ ১০:১৭94305
  • বাহ এটা বেশ মনের মত বিষয়।

    চট কাগজ কাপড়।এই সবকিছুর ব্যাগই অলাস্টিকের বিকল্প। আর রিসাইক্লিং খুবই জরুরী। আমার মা বরাবর ওড়না শাড়ির আঁচল এইসব দিয়ে ছোটবড় নানা সাইজের ব্যাগ বানিয়ে ভাঁজ করে ব্যাগের মধ্যে রাখত। সে ইস্কুল ফেরত টুকটাক বাজার থেকে আত্মীয়বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে ঢোকা সব সময়েই কানে লাগত।

    মহারাষ্ট্রে প্লাস্টিক আর থার্মোকলের বাটি থালা ব্যান করেছে বেশ কবছর হল। এখন মিষ্টির দোকান বা খাবারের দোকানে এক্রকম অযাল্মুনিয়াম ফয়েল জাতীয় জিনিষের ঠোঙায় দেয়। আর শাকসবজির জন্য নিজে কাপড় বা চটের ব্যাগ নিয়ে যেতে হয়। বিগ বাস্কেট অবশ্য একরকম ঠোঙায় দেয় যেটা বায়োডিগ্রেডেবল। কটন টিস্যুর তৈরী ব্যাগও দেয় কেউ কেউ।

    প্ল্যাস্টিকের জিনিসপত্র দুধের প্যাকেট কান খোঁচানোর কাঠি ইত্যাদি দিয়ে পলি ফুয়েল বানানো যায়।
  • | ১৪ জুন ২০২০ ১০:১৮94306
  • *প্ল্যাস্টিকের
    **কাজে
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন