এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • তিব্বতে তথাগত (পর্ব - ৯)

    সৈকত ভট্টাচার্য লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১৬ মে ২০২০ | ১৮৮৩ বার পঠিত
  • । সাক্ষরতা অভিযান - ২ ।

    “সেই লিপি নিয়ে যেতে তোনমি ভারতে এলেন?”
    “হ্যাঁ। তিব্বতের লিপির জন্ম এক্স্যাক্টলি কোন লিপি থেকে হয়েছিল সেটা নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব আছে। সেসবে যাওয়ার আগে গল্পটা বলি। রাজা স্রোংচান যখন বুঝলেন যে লিপি নাহলে সমস্যা - তখন নাকি ষোলো জন্ম অমাত্যকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পাঠালেন বিভিন্ন পণ্ডিতের সাথে কথা বলে লিপির ব্যাপারে একটা হেস্ত নেস্ত করতে। কিন্তু তারা শীতের দেশের মানুষ। ভারতবর্ষের গরমে নাকি অসুস্থ হয়ে সবাই মারা গেল। ষোলজন অমাত্যকে হারিয়ে রাজা যখন মুষড়ে পড়েছেন তখন তোনমি এসে বললেন, আমি একবার ট্রাই নেব নাকি? রাজা পড়লেন মুশকিলে। যাকে বলে শাঁখের করাত। একেবারে ‘না’ও বলতে পারেন না - লিপি প্রয়োজন, আবার ‘হ্যাঁ’ বলতেও মন চায় না। তোনমির মত পণ্ডিত বন্ধুকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়াটা কি ঠিক! ওদিকে তোনমি নাছোড় - তিনি যাবেন। শেষমেশ তোনমির জয় হল। ছশো তেত্রিশ সাল নাগাদ তোনমি পা রাখলেন ভারতের মাটিতে। এসে সটান হাজির হলেন ‘লি জিন’ নামে এক ব্রাহ্মণের বাড়ি।”
    “ভারতীয় মানুষের নাম ‘লি জিন’?" মঞ্জুশ্রী প্রশ্ন করে।
    “হেঁহেঁ। ওটা সম্ভবত তিব্বতিদের দেওয়া নাম। আসল নাম কী ছিল সেটা নিয়ে একটু সন্দেহ আছে। কোনও ঐতিহাসিক বলেছেন আসল নাম ‘কংসদত্ত'। আবার কেউ কেউ বলেছেন তার আসল নাম ‘দেববিদ্যাসিংহ’।”
    “তাহলে এসব থেকে ‘লি জিন’ হল কী করে?”
    “তিব্বতিতে পুরো নাম ‘লি জিন তি কা’। এই শব্দটি এসেছে ভারতীয় শব্দ ‘লিপিকার' থেকে। মানে দেববিদ্যাসিংহ বা কংসদত্ত যে হোন না কেন তিনি প্রফেশনালি বিভিন্ন পুঁথি হাতে লিখে নকল করতেন। ছাপাযন্ত্র আবিষ্কার হওয়ার আগে ‘লিপিকার' একটি প্রফেশন ছিল। গুপ্তযুগে এমন অনেক লিপিকারের সন্ধান পাওয়া যায়। সে যাই হোক, তোনমি সেই ব্রাহ্মণের কাছে হাজির হলেন। সাথে ছিল রাজার পাঠানো সোনা। ব্রাহ্মণকে সেই সোনা গুরুদক্ষিণা হিসাবে দিয়ে তোনমি জিজ্ঞেস করলেন, আমি সেই হিমালয়ের ওপারের দেশ তিব্বত থেকে আসছি। আমাকে লেখার পদ্ধতি শেখালে আমি, আমার দেশের সম্রাট এবং আমার দেশের মানুষ আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। ‘লিপিকার' সেই শুনে বললেন, ওহে তিব্বতি ছোকরা, সে এদ্দূর থেকে এসেছ যখন আমার না শেখাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু কোন লিখন পদ্ধতি শিখবে সেটা ভেবেছ কী? আমি কুড়ি রকমের লিপি জানি। তোনমি পড়লেন মহা বিপদে। তার গোটা দেশের লোক একটাও লিপি জানেনা - আর এ নাকি কুড়ি ধরণের লিখন প্রণালী জেনে বসে আছে। মাথা টাথা চুলকে বললেন, বেশ তো, এই কুড়ি ধরণের লিপির স্যাম্পল দেখা যায়? তাহলে নাহলে পছন্দ টছন্দ করে একখানা বাছা যেত। ‘লিপিকার' বললে, যায়। এস আমার সাথে। - এই বলে তোনমিকে সাথে করে নিয়ে গেল এক হ্রদের তীরে।”
    “লিখন প্রণালী শেখানোর জন্য হ্রদের ধারে!” আমার অদ্ভুত লাগে।
    “জ্ঞান সাগরের পারে নুড়ি-টুড়ি কুড়নোর ইচ্ছে ছিল হয়ত। ঘরে বসে কাগজ কলমে না লিখে সেই হ্রদের ধারের মাটিতে একটি বিশাল লাঠির সাহায্যে আঁচড় কেটে কুড়ি ধরণের বিভিন্ন লিখন প্রণালীর স্যাম্পল দেখালেন। এসব গল্প অবিশ্যি ‘টেস্টামেন্ট অফ বা’-তে লেখা আছে। আসলে নিশ্চয়ই তোনমি এই কুড়ি রকমের বিভিন্ন লেখার কায়দা শিক্ষা করেন। তারপর তিব্বতে ফিরে আসেন। অনেকের মতে ‘লি জিন’ তোনমির সাথে তিব্বতে এসেছিলেন। সাথে ছিল বেশ কিছু সংস্কৃত পুঁথি। বেশ কিছু বইপত্র তোনমি নিয়ে এসেছিলেন - তাতে সন্দেহ নেই - কিন্তু ‘লি জিন’ তিব্বতে গেছিলেন কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে।”
    “তাহলে এই যে কুড়ি রকমের লিপি শিখে ফিরলেন তোনমি তার কোনটার থেকে তিব্বতি লিপি এলো?” মঞ্জুশ্রী আম-দই হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
    “সে ব্যাপারে এই সব প্রাচীন পুঁথিগুলো কিছু লিখে যায় নি।” জয়দা মাথা নাড়ল।
    “যাহ্‌! তালে?” মঞ্জুশ্রী হতাশ।
    “হতাশ হোস না! আমাদের আগে অনেক ঐতিহাসিক বিস্তর গবেষণা করে গেছেন এই নিয়ে। তিব্বতে ফিরে আসার পর তোনমির জন্য রাজা স্রোংচান আলাদা একটি নির্জন জায়গা দিয়ে দেন। সেখানে বসে তোনমি এই কুড়ি রকমের লিপি থেকে তিব্বতের লিপি নির্মাণ করেন। এবার প্রশ্ন হল এই কুড়ি রকমের লিপির কোনটি থেকে জন্ম নিলো তিব্বতি লিপি?”
    “তোনমির সৃষ্ট লিপির স্যাম্পল দেখে বোঝা যায় না?”
    “সে আর এত বছর পরে খুঁজে পাওয়া যায় না। যেটা পাওয়া যায় সেটা হল লাসার পোতালা প্রাসাদের সামনে একটি স্তম্ভ। এখনো সেটা বর্তমান। একে লাসা ‘জোল' স্তম্ভ বলা হয়। তোনমির লিপি প্রবর্তনের প্রায় একশো বছর পরে এটি তৈরী হয় সম্রাট ত্রিসোং দেচেনের রাজত্বকালে। এর গায়ে সমসাময়িক কিছু ঘটনার কথা খোদিত আছে। এবং এটাই হল তিব্বতের লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন। আশা করা যায় তোনমির সৃষ্ট লিপির থেকে এ লিপি আলাদা নয় - কারণ তিব্বতে তারপর লিপির পরিবর্তন সেভাবে হয়নি।”
    “ওই একরকমই এখনও চলছে?”
    “হ্যাঁ। তিব্বতে দুরকমের লিপির চল আছে। তোনমিই দুরকমের লিপির প্রবর্তন করেন। একদল হল মাত্রাযুক্ত বা ‘ঊচেন' আর অন্যটি হল মাত্রাহীন অথবা ‘ঊমে’। অনেক গবেষণা করে প্যালিওগ্রাফাররা…” জয়দাকে বাধা দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি, “প্যালিওগ্রাফার মানে?”
    “প্যালিওগ্রাফি হল প্রাচীন লিপি নিয়ে পড়াশোনা। অর্থাৎ যারা এই প্রাচীন লিপিবিদ্যায় পারদর্শী - তাদের বলা হয় প্যালিওগ্রাফার। জাঁ-ফ্রাঁসোয়া শাপোলিয়ঁর নাম শুনেছিস?”
    “সেই ফ্রেঞ্চ ভদ্রলোক না যিনি ইজিপশিয়ান হিয়েরোগ্লিফের মানে উদ্ধার করেন?” মঞ্জুশ্রী চটপট জবাব দেয়। আমি তো জন্মে নামই শুনিনি। জয়দা বেশ একটা খুশির হাসি হেসে বলল, “এই তো! গুড গার্ল! একদম ঠিক নেপোলিয়ঁর লোকজন যখন সেই বিখ্যাত রোসেত্তা স্টোন নিয়ে দেশে ফিরল - রোসেত্তা স্টোনের উপরের হিয়েরোগ্লিফকে স্টাডি করে আঠারশো কুড়ি একুশ সাল নাগাদ হিয়েরোগ্লিফের সঠিক অর্থ বের করেন। তিনি ছিলেন প্যালিওগ্রাফার। সেরকম তিব্বতের লিপির উৎস সন্ধান করার জন্যও অনেক প্যালিওগ্রাফাররা তাদের সময় এবং শ্রম ব্যয় করেছেন। অনেকে মনে করেছেন যে মাত্রাহীন কারসিভ যে তিব্বতি লিপি অর্থাৎ 'ঊমে'র জন্ম প্রাচীন তামিল লিপির থেকে।”
    “তামিল? তিব্বতেও আন্না-আক্কা চলে নাকি?” শুভর কান জায়গা মত খাড়া হয়ে যায়। ফুট কাটল।
    “ভাষা নয় লিপি। তুই বরং এদিকে মন না দিয়ে আর একটা আম-দই খা।” জয়দা বকে দিল।
    “থাকলে তো খেতাম। রবি তো গুনে গুনে পাঁচটাই এনেছে। এনে নিজে একটা সাঁটিয়ে দিয়েছে।” বুঝলাম মনে ইচ্ছে আছে ছেলের - কিন্তু উপায় নেই।
    “তাহলে খাস না। মোবাইলে আম-দই বানানোর রেসিপি দ্যাখ। আমরা গল্পটা শেষ করে নিই ততক্ষণে।” জয়দা আর শুভর কথোপকথনে মঞ্জুশ্রী খুব মজা পেয়ে একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়ল। আমি এদের দুজনের ‘তুই-বেড়াল না মুই-বেড়াল’ থামানোর জন্য তাড়াতাড়ি জয়দাকে বললাম, “আরে ও পোলাপানের কথা ছাড়। তামিল থেকে তিব্বতি লিপির জন্ম?”
    “নট অ্যাকচুয়ালি। অনেকে এইদিকে ভেবেছেন। প্রাচীন তামিল ‘ভাট্টেলুট্টু' স্ক্রিপ্ট থেকে ‘ঊমে'র জন্ম বোধহয়। এদের ভাবনার পিছনে কারণ ছিল কিছু বর্ণ। যেমন ‘ভাট্টেলুট্টু’র ‘প' ‘ব’ ‘ল' ‘ইয়' ইত্যাদি বর্ণগুলির সাথে ‘ঊমে' স্ক্রিপ্টের তিব্বতি বর্ণের বেশ কিছুটা মিল লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু পরবর্তীকালের প্যালিওগ্রাফাররা লেখার টান, বিভিন্ন টানের অনুপাত ইত্যাদি পরিমাপ করে এই থিয়োরিটা বাতিল করেছেন।”
    “তাহলে? কোথা থেকে এলো?”
    “একটা মজার জিনিস দেখবি?” জয়দা চকচকে চোখে তাকায়।
    “কী?" আমরা ব্যাগ্র।
    “একটা কাগজ আর পেন দে। আচ্ছা তার আগে হাত ধুয়ে নিয়ে ঘরে গিয়ে বসি চল।” বলে জয়দা টেবিল ত্যাগ করল। আমাদেরও হাত শুকিয়ে গেছিল। সবাই মিলে হাত ধুয়ে ঘরে এসে আরাম করে বসি।
    আমি ব্যাগ থেকে আপিসের প্যাডটা আর একটা ডট পেন নিয়ে জয়দার হাতে দিই। “এই নাও। মজার জিনিস কী দেখি?”
    শুভও দেখলাম গলা উঁচু করে জয়দ্রথর মত উঁকি দিয়ে ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করছে। জয়দা প্যাডের একটা পাতায় পেন দিয়ে যেটা লিখল সেটা অবিকল বাংলার ‘ব'। লিখে বলল, “এটা কী?”
    আমরা সমস্বরে বললাম, “‘ব’!"
    “কী লিপি?”
    “বাংলা।”
    “শুধু বাংলা নয়। অসমীয়া লিপিতেও ‘ব’ এরকম করে লেখা হয়। তাই না?” জয়দা জিজ্ঞেস করল।
    আমরা মাথা নেড়ে বললুম “হ্যাঁ”।
    “মজার কথা যেটা সেটা হল তিব্বতি লিপিতেও ‘ব’ বর্ণটি এরকম। বিশেষ করে প্রাচীন তিব্বতের সামরিক বার্তার যা নিদর্শন দেখা গেছে সেখানের ‘ব’ আর আমাদের বাংলা বা অসমীয়া ‘ব' একেবারে এক। ‘ম’ এর ক্ষেত্রেও তাই।”
    “এরকম কেন? বাংলার সাথে তিব্বতির কী সম্পর্ক?”
    “ভাই বোন। দুই জনের জন্ম একই লিপি থেকে। সেটাকে বলা হয় ‘সিদ্ধমাতৃকা’। গুপ্ত যুগে ব্রাহ্মি লিপির যে প্রকারটা চালু ছিল - সিদ্ধমাতৃকা তারই একটি রূপ। তোনমি সম্ভোট লিজিনের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া বিভিন্ন লিপির নমুনা থেকে ‘সিদ্ধমাতৃকা'কেই বেছে নেন তিব্বতি লিপির জন্ম দেওয়ার জন্য। অবিশ্যি অন্যান্য লিপিগুলিকে একেবারে ফেলে দেন নি। লিপির প্রয়োজন পরে মুখের ভাষাকে প্রকাশ করার জন্য। এই যে তোরা যখন কোড লিখিস, সেই কোডটা হচ্ছে কম্পিউটারকে তুই কী করাতে চাস সেই নির্দেশের একটা লিখিত প্রকাশ। কিন্তু কম্পিউটার ইংরিজি বোঝে না। সে বোঝে মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ। তাই তোদের ইংরিজিতে লেখা কোডকে নিজের বর্ণমালা অনুযায়ী পাল্টে নেয়। ঠিক সেভাবে ‘সিদ্ধমাতৃকা' লিপিকে তিব্বতি ভাষার বিভিন্ন উচ্চারণ অনুযায়ী যখন তিব্বতি লিপিতে ট্রান্সফার করতে গেলেন, তোনমি দেখলেন যে অক্ষর কম পড়িতেছে। তিব্বতে এমন কিছু বর্ণ উচ্চারণ করা হয় যার ব্যবহার সংস্কৃতে বা কোন ভারতীয় ভাষায় নেই।”
    “তামিল ‘zh’এর মত?”
    “ঠিক বলেছিস। আমি বাংলায় ‘zh’ এর সমতুল কোন বর্ণ নেই। ইংরিজিতেও নেই। জোর করে ‘zh’ দিয়ে ওটাকে প্রকাশ করে। ঠিক সেরকমই তোনমি দেখেন প্রায় ছটি বর্ণের প্রয়োজন যা ‘সিদ্ধমাতৃকা’য় নেই। তখন তিনি আরও অন্যান্য লিপি স্টাডি করেন। এবং সেখান থেকে ওই ছয়টি বর্ণ তিব্বতি বর্ণমালায় যুক্ত করেন। সেরকমই ‘সিদ্ধমাতৃকা’তে এমন অনেকগুলি বর্ণ ছিল যার প্রয়োজন ছিল না তিব্বতি শব্দোচ্চারণে। তাই তিনি ‘ত’ ‘থ’ ‘দ’ ‘ঢ’ ‘ধ’ ‘ণ’ ‘ঘ’ এবং ‘ঝ’ - এই আটটি বর্ণকে সযত্নে বাদ দেন তিব্বতি বর্ণমালা থেকে।”
    “এটা কোন বর্ণমালা? মাত্রাযুক্ত না মাত্রাহীন?” 
“দুটোতেই। আসলে দুটি বর্ণমালাই একই। শুধু লেখার স্টাইলের তফাৎ। যদিও এই দুই ধরণের বর্ণমালার উৎপত্তিস্থল একই না পৃথক - সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। একটা উদাহরণ দিলে ভাল বুঝতে পারবি। যেমন তোরা রোমান লিখিস…”
    “রোমান লিখি? রোমান কী করে জানব?” শুভ জিজ্ঞেস করল।
    “আহা! এই যে প্যাডের উপর কোম্পানির নাম লেখা - এটা কীসে লেখা?”
    “ইংরিজি।” শুভ উত্তর দেয়।
    “ইংরিজি তো ভাষার নাম। লিপিটা কী?” জয়দা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় আবার।
    “এই রে। সেটা বুঝি ইংরিজি নয়?” আমিও বিপদে পড়ি।
    “না স্যার! ইউরোপের অধিকাংশ ভাষার লিপি হল ‘রোমান’। প্রাচীন রোমে চলত এই লিপি। সেইটাই বাকি ইউরোপ ফলো করেছে।” জয়দার বদলে মঞ্জুশ্রী বলে ওঠে।
    কত কিছু জানিনা ভেবে একটু মাথা চুলকালাম - তারপর মঞ্জুশ্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই এতসব জানিস কী করে?”
    “পড়তে হয় - নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়! বই পত্র পড় - তুইও জানবি। সারাদিন ফেসবুক দেখলেই বড় হওয়া যায় না… ” বলে হাসল। আমিও অপমানটা হজম করে নিলাম - হক কথাই বলেছে। জয়দা আবার হাল ধরল গল্পের - “যেটা বলছিলাম, রোমান লিপি। রোমান লিপি তিন রকমের হয় - তাই তো?”
    “হ্যাঁ। বড় হাতের, ছোট হাতের আর… আর… কারসিভ। তাই না?” আগের বারের না জানার খেদ মেটাতে তড়িঘড়ি বলি।
    “গুড! এবার বল ‘ডাক্টাস' কাকে বলে?” জয়দা একেবারে ক্যুইজ মাস্টার হয়ে গেছে!
    এই প্রশ্নটাতে মঞ্জুশ্রীও সারেন্ডার করে দিল।
    “ডাক্টাস হল ক্যালিগ্রাফির একটা টার্ম। মনে কর তুই ‘A’ লিখছিস। লিখে দেখা…” বলে প্যাড আর পেনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি পেন দিয়ে বড় করে ‘A’ লিখলাম। জয়দা খাতা পেন ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “লক্ষ্য করলি যে ও পেনটা কীভাবে চালাল? কোনদিকে কতগুলো স্ট্রোক দিল? ক্যাপিটাল A লেখার জন্য তিনটে আলাদা স্ট্রোক লাগে - তিনটে দাগ। তিনটে তিনদিকে মুখ করে। এই যে একটা লেটার লেখার জন্য কতগুলো এবং কোন কোন অভিমুখে দাগ দিতে হচ্ছে - এই পরিমাপটাকে ক্যালিগ্রাফির পরিভাষায় বলা হয় ‘ডাক্টাস'। লিপিবিশারদরা হাতের লেখা থেকে এই ‘ডাক্টাস’ পর্যবেক্ষণ করেই বিভিন্ন ধরণের সিদ্ধান্তে উপনীত হন। সে মনস্তত্ত্বই বল বা জাল সই ধরা। ঊনিশশো পঞ্চাশ সালে জিওরজিও সেনসেত্তি নামে এক প্যালিওগ্রাফার প্রাচীন রোমান লিপির ক্যাপিটাল এবং কার্সিভ এই দুই ধরণের বর্ণের ‘ডাক্টাস' পরীক্ষা করে বলেন যে কার্সিভ লিপি আদতে ক্যাপিটাল রোমান থেকেই উদ্ভূত। ক্যাপিটাল লেটারকে তাড়াতাড়ি যদি বারবার লিখতে হয়, তবে সেটা ধীরে ধীরে ‘ডাক্টাস' পাল্টে কার্সিভের দিকে চলে যায়। যেমন ক্যাপিটাল ‘A’ তে তিনটি স্ট্রোক; কিন্তু কার্সিভ ‘A’ পেন একবারও না তুলেই লেখা যায়। তিনটি আলাদা স্ট্রোক একটি স্ট্রোকে পরিণত হল। একে বলা হয় ‘লিগাচা’। এছাড়াও যেমন বাংলাতে আমরা টানা হাতে লিখি যখন অনেক সময়ই মাত্রা দিই না - এটাও এক ধরনের কার্সিভ। আবার ‘ক' যখন হাতে লিখি বর্ণের কোণ গুলো অনেক মসৃণ হয়ে যায় - অনেক সময় দুটো বর্ণ একসাথে জুড়ে যায় - এই সবই বিভিন্ন ভাষার কার্সিভ লিখন পদ্ধতির জন্ম দিয়েছে। - এই এতগুলো কথা বললাম এই কারণেই যে তিব্বতি বর্ণের যে দুই প্রকারের কথা বলেছি ‘ঊচেন' আর ‘ঊমে' এদেরও ‘ডাক্টাস' দেখে বোঝা যায় যে এরা একে ওপরের সাথে সম্পর্কিত। মাত্রাহীন কার্সিভ ‘ঊমে' আসলে মাত্রাযুক্ত ‘ঊচেন'এর থেকেই উদ্ভূত। এর উৎস হিসাবে প্রাচীন তামিল বাঁ অন্যান্য দক্ষিণ ভারতীয় গোল গোল গঠনযুক্ত লিপি মনে করা ভুল।”
    “বাপরে! এই যে রোজ এত কিছু লিখি সেসব নিয়ে মানুষ এত গবেষণা করে! তুমি না বললে জানতামই না!” মঞ্জুশ্রী জয়দার ফ্যান হয়ে গেছে।
    “আরে। এসব সবই তিব্বত নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে জানা। সে তুই চাইলে আমি কিছু বইপত্র দিতে পারি। পড়ে দেখিস ইন্টারেস্ট লাগলে।”
    “নিশ্চয়ই দেবে।” মঞ্জুশ্রী খুব উৎসাহী হয়ে বলল।
    “আচ্ছা। বেশ। আমরা মূল গল্পে ফিরি। তোনমি লাসার মারুমন্দিরে বসে মূলতঃ ‘সিদ্ধিমাতৃকা'র সাহায্যে তিব্বতি ভাষার বর্ণমালা তৈরী করলেন। তিরিশটি ব্যাঞ্জনবর্ণ, চারটি স্বরবর্ণ এবং আরও সাতটি চিহ্ন - মানে আমরা যেমন ‘র'ফলা, ‘য’ফলা দিই। মোট একচল্লিশ। সাথে রচনা করলেন ব্যাকরণ। রচনা করলেন বেশ কয়েকটি বই যাতে এইসব বর্ণের প্রয়োগবিধি সম্পর্কে বিস্তারিত লেখেন। তিরিশটি শ্লোকে তোনমির লেখা একটি ব্যাকরণ বই ‘সুম্‌চুপা’ আধুনিক তিব্বতেও নাকি খুব বিখ্যাত।”
    “তারপর এই লিপি তো শিখতে হল সবাইকে?”
    “অবশ্যই। বিশেষ করে রাজকর্মচারীদের। রাজা নিজে সবার আগে নাকি প্রায় চারবছর তোনমির কাছে থেকে এই লিপি এবং ব্যাকরণ শিক্ষা করেন। এই চারবছরে নাকি রাজ্যের দায়িত্ব মন্ত্রীদের উপড়েই ন্যস্ত করে রেখেছিলেন। লিপি সৃষ্টির পাশাপাশি তোনমি আর যে কাজটি করেন সেটি হল ভারত থেকে নিয়ে আসা সংস্কৃত সব বইয়ের তিব্বতি অনুবাদ সাধন। এগুলি মূলতঃ বিভিন্ন বৌদ্ধশাস্ত্র। রাজা স্রোংচান গামপোর উৎসাহে ভারত, নেপাল ও চীন থেকে পণ্ডিতদের নিয়ে এসে এই আনুবাদের কাজ সম্পূর্ণ করেন তোনমি।”
    “কী ইউনিক ঘটনা - তাই না? শিক্ষার প্রতি কতটা অনুরক্ত হলে তবে এরকম একটা কাজ করা যায়!” মঞ্জুশ্রী নিজের মনেই বলে উঠল।
    “সত্যিই তাই। অশিক্ষার অন্ধকারে থাকা একটা জাতিকে শিক্ষার আলো দেখানোর প্রচেষ্টা। অবশ্য রাজার দরকার না পড়লে এত কিছু হত কিনা সন্দেহ। তবুও… আচ্ছা এবার তোদের সমস্যার কোথায় আসা যাক। লেডি তোনমি করোনার মারের পার হয়ে কাদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছতে যাবি বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নাকি?”
    “হাহাহাহা। লেডি তোনমি! রিদমস উইথ লেডিকেনি।” শুভ নিজের জোকে নিজেই হেসে উঠল। মঞ্জুশ্রী জিভ ভেঙিয়ে বলল, “ভেরি ফানি। হ্যাঁ, জয়দা একটা উপায় বের করতে হবে।”
    “হুম।” বলে জয়দা কয়েক মিনিট চুপ করে রইল। তারপর বলল, “শোন, এই তেরো বছর এখানে থেকে কিছু তো কন্ট্যাক্ট আছে! আমার এক পুরনো কলিগের বাবা চেন্নাই পুলিশের বড়কর্তা ছিলেন। দেখি, তার সাথে যোগাযোগ করে তোকে একটা পাসের ব্যবস্থা করে দিতে পারি কি না!”
    “ওয়াও! তাহলে তো দারুণ হয়!” মঞ্জুশ্রী উচ্ছ্বসিত।
    “কিন্তু তা বলে প্রতি সপ্তাহে ওই কন্টেইনমেন্ট জোনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া চলবেনা।” জয়দা বলে দিল।
    “তাহলে কী করে হবে?”
    “আমার একটা পুরনো ল্যাপটপ আছে। বহুকাল ব্যবহার হয়না। বেচেই দেব ভাবছিলাম। সেটা যদি একটা উপকারে লাগে ক্ষতি কী? আমি ফরম্যাট করে স্কাইপ ইন্সটল করে দেব। সাথে আমার ডোঙ্গলটাও নিয়ে যাস। ওদের দিয়ে আসিস। কটাদিন আপাতত স্কাইপেই পড়া। তারপর নাহয় আবার যাবি… ”
    “উফ! জয়দা! ইউ আর গ্রেট!” মঞ্জুশ্রী লাফিয়ে উঠল।
    “কিন্তু যাবি কী করে?”
    মঞ্জুশ্রী এবার আড়চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে মাঝপথে ছেড়ে যাওয়া গানটা গেয়ে উঠল -

    “পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়–
    আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী, এই শুধু মোর দায়।
    দিন ফুরালে, জানি জানি, পৌঁছে ঘাটে দেব আনি
    আমার দুঃখদিনের রক্তকমল তোমার করুণ পায়ে॥”

    (ক্রমশঃ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৬ মে ২০২০ | ১৮৮৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১৬ মে ২০২০ ১৭:৩২93399
  • খাইছে, তিব্বতি লিপির এত্তো প্যাঁচ? সত্যিই অনেক শিখছি। উড়ুক।    

  • b | 14.139.***.*** | ১৬ মে ২০২০ ২০:২৫93403
  • লেখাটি শেষ হলে একটু তথ্যসূত্র দিয়ে দেবেন।
  • গবু | 223.223.***.*** | ১৬ মে ২০২০ ২১:২০93405
  • দুর্দান্ত হচ্ছে | b র কথা আমারও | বিবলিওগ্রাফিটা একটু ... হেঁ হেঁ |
  • সৈকত ভট্টাচার্য | ১৬ মে ২০২০ ২১:২৭93406
  • সমস্ত তথ্যসূত্র দিয়ে দেব। ইনফ্যাক্ট এটা বই করার ইচ্ছে আছে। সেক্ষেত্রে আরো কিছু যুক্ত করব। দেখা যাক... :) 

  • বিপ্লব রহমান | ১৭ মে ২০২০ ২২:৫৭93425
  • অবশ্যই বই হোক! দুই হাত তুলে সমর্থন জানাই।   

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন