যেদিন মমতার ঘরে ঢোকার কথা সেদিন দুপুরে মধ্যদিনের আহার শেষ করে উপরের ঘরে আমি নিদ্রাছন্ন। হঠাৎ নীচের থেকে শোরগোল ও চিৎকারের শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। মমতা চীৎকার করে বলছে “মিস্টার বিশ্বাস, কাম ডাউন কুইকলি।” আমি তাড়াতাড়ি নিচে গিয়ে দেখি, ছোটন, খোকনের ছেলে, সেই ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ক্যামেরাতে ওদের ছবি তুলছে। আমি যেতে মমতা আমাকে উত্তেজিত ভাবে অভিযোগ করল। বলল, “ দেখুন, এই ছেলেটি আমাদের ঘরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। বলছে এ বাড়িতে মামলা চলছে। তোমরা এ ঘরে ঢুকতে পারবে না। ... ...
অর্জুন বিশ্বস্ত, অনুগত ও করিৎকর্মা ছেলে। অনেক বছর ধরেই কলকাতায় ও-ই আমার সব কাজকর্ম করে দেয়। অর্জুনকে বলে দিয়েছিলাম ও যেন গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে। গাড়ি নিয়ে সল্টলেকের বাড়ির সামনে নেমে অবাক হয়ে গেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ঠিক দেখছি তো? অর্জুন আমাদের ভুল ঠিকানায় নিয়ে আসেনি তো? সল্টলেকের বাড়িটা চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, গ্যারেজের দিকে একটা বড় লোহার গেট, সেই গেট পেরিয়ে সদর দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকতে হয়। দেখি সেই গেটে একটা ভারী তালা ঝুলছে। দিনক্ষণ জানিয়ে খোকনকে একটা মেল করে দিয়েছিলাম। সুতরাং খোকন জানত আমরা আসছি। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে ওকে ডাকলাম, কোনও সাড়া নেই। দেশের টেলিফোন আমার নেই। অর্জুনের ফোন নিয়ে আমার বোন খুকু ও জামাই দিলীপকে ফোন করলাম, বললাম, “মেজদাকে বল দাদারা নিচে অপেক্ষা করছে। দরজা খুলে দিতে।” কিছুক্ষণ পরে দিলীপ ফোন করে বলল, ‘মেজদা বলছে, দরজা খুলবে না।‘ আমি হতভম্ব। খুকু বিচলিত। খুকু দিল্লিতে হাঁদিকে ফোন করল। হাঁদির কথাও শুনল না খোকন। ... ...
নগাধিপতি হিমালয়। তার পাদদেশে ডুয়ার্সের প্রকৃতি যে এত সুন্দর, যে চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয়না। ঢেউ খেলানো জমিতে চা বাগান, মধ্যে মধ্যে কাঁচা মাটির পথ, ছোট ছোট গ্রাম, আর তরাইয়ের জঙ্গল। নীল আকাশ ঝুঁকে পড়ে সবুজ চা বাগানের সঙ্গে কত কী কথা বলে। হাওয়ায় কান পাতলে শোনা যায়। কলেজ থেকে যতবার এদিকে ফিল্ড সার্ভেতে এসেছি, জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে, আকাশ সবসময় মেঘে ঢাকা পেয়েছি। লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ গেলাম দুবার। চারিপাশ শুধু সাদা, হিমালয়ের শ্রেণী দেখা তো দূর, নিজেকে দেখা দায়। সেবার পেলিং গিয়েও একই দশা। পর্বত দুহিতা উমা তো আমাদের ঘরের মেয়ে, আবার মাও বটে। তাই গিরিরাজ আমার একরকম অভিভাবকই হলেন। ... ...
সেই খোকন, আমি দানপত্রে সই করার কিছুদিন পর থেকে আমার সঙ্গে ওর আচার ব্যবহার, কথাবার্তার রূপ বদলে গেল। ও আমার সমকক্ষ, আমার মত ও-ও এ বাড়ির মালিক। এ বাড়িতে কিছু করতে চাইলে ওর সম্মতি নিতে হবে, তা সে নতুন ইলেকট্রিক লাইন হোক বা এয়ারকন্ডিশন মেশিন বসানো হোক। আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। এ কি হল? আমি আর এ বাড়ির একক মালিক নই? ... ...
ইতিমধ্যে আমি ইংল্যান্ডে এসেছি, সল্টলেকের কথা ভুলে গেছি। একদিন হঠাৎ খোকনের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। সরকার জানিয়েছে সল্টলেকে আমি জমি পেয়েছি। আমি ও খোকন একইসময়ে একইসঙ্গে আবেদন পত্র পাঠিয়েছিলাম এবং আমাদের দু’জনেরই আবেদন সফল হয়েছিল। আমরা দুজনেই জমি পেয়েছিলাম। আমি যথাসময়ে নির্ধারিত টাকা জমা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে নিলাম। এ ব্যাপারে খোকন আর অন্যান্য ভাইরা এবং মা যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। সল্টলেকে বাড়ি করার উদ্যোগ ও উৎসাহ সব চেয়ে বেশি মা-র। একবার বাড়ি হারানোর পর আবার যে কোনোদিন নিজের বাড়ি হবে তা বোধহয় মা কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি। ... ...
ট্যুরিস্ট লজ থেকে পাকা সড়ক ধরে গাড়ি চলল মূর্তি নদীর দিকে মুখ করে। পুব থেকে পশ্চিম অভিমুখে চলেছি তাই ডানহাতে হিমালয়ের বরফ ঢাকা শ্রেণীও রয়েছে সঙ্গে। কিন্তু বেশি দূর নয় বড় জোর দু তিন কিলোমিটার পরেই আমাদের গাড়ি কাঁচা রাস্তায় নেমে পড়ল। দুপাশে গাছের সারি। জিজ্ঞাসা করে জানলাম আমরা খয়েরবাড়ি জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। ... ...
ইরান এখন অপেক্ষাকৃত শান্ত। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আস্তে আস্তে ফিরে আসছে। ইউনিভার্সিটি এখনো বন্ধ। ঠিক করলাম এই সুযোগে সকলে মিলে ইরান ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি। দিলীপ দামলে একা থাকে। আমরা যাচ্ছি শুনে ও আমাদের সঙ্গী হল। আমি, অনু, বুবাই, গৌতম ও দিলীপ, আমরা পাঁচজন বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য – ইরানের কয়েকটা শহর দেখা। আকাশপথে যাত্রা নয়। মাটির সঙ্গে মিতালি করে মরুভূমির পথ ধরে চলা। আমরা কোচে করে মরুভূমির মধ্য দিয়ে ইরান ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য শিরাজ। আবাদান থেকে কোচ ছাড়ল সূর্য ডুবে যাওয়ার পর। যেতে যেতে অন্ধকার নেমে এলো। মরুভূমির রাস্তা দিয়ে ঘন কালো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আমাদের কোচ ছুটে চলেছে। চারিদিকে নিকষ কালোর আবরণ। হঠাৎ দূরে কখনো কখনো দেখা যায় দুচারটা টিম টিমে আলোর আভাষ; বোধ হয় কোনো বেদুইনদের তাঁবু। আর মাঝে মাঝে দেখা যায় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে লেলিহান অগ্নিশিখা গগন স্পর্শ করছে। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চারিভিতে আলোর রোশনাই। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। আশ্চর্য, মরুভূমিতে এমন অগ্নিযজ্ঞ কেন? ... ...
আগে গ্রামে চারটে কাগজ আসতো। যুগান্তর দুটো। আনন্দবাজার একটা। সত্যযুগ একটা। সান্ধ্য গণশক্তি আসতো গোপীনাথপুরে বাদশা চাচার বাড়ি হয়ে আমাদের বাড়ি। আর চলতো পাঁচটি সাপ্তাহিক দেশহিতৈষী কাগজ। এই কাগজ আমার খুব উপকার করে। সারা সপ্তাহের খবর এক জায়গায় থাকতো। দেশ রাজ্য এবং আন্তর্জাতিক একটা আলাদা পাতা। স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী সুধাংশু দাশগুপ্ত ছিলেন সম্পাদক। ১৯৮৯ থেকে আমি তাঁর স্নেহ পেয়েছি। অল্প বয়সেই আমাকে দিয়ে বেশ কিছু লেখা তিনি ও হাওড়ার অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিয়েছেন। আগে সব মিলিয়ে দশ। ওভারল্যান্ড একাই হলো এবার ১০টা। যে বাড়িতে কোনওদিন কাগজ ঢুকতো না, সেখানে পড়ার পাতার জন্য কাগজ ঢুকে গেল। মাসে নয় টাকা। ... ...
কয়েক মাসের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া উত্তাল হয়ে উঠল। ক্রমশঃ জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষের সংখ্যা বাড়তে থাকল। বড় বড় শহরগুলোতে শান্তি রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। দোকানে বাজারে সিনেমায় আগুন জ্বলল। রাস্তায় গলিতে এখানে সেখানে মৃতদেহ দেখা যেতে লাগল। সাধারণ নাগরিক আর স্বাধীন ভাবে চলা ফেরা করা নিরাপদ মনে করল না। আস্তে আস্তে সব যানবাহন বন্ধ হয়ে গেল। গুজব ছড়াল এয়ারপোর্টও বন্ধ হয়ে যাবে শীঘ্রই। তবুও তখনো দেয়াল ঘেরা আবাদানে তেমন কিছু অশান্তির আঁচ পড়েনি। ... ...
বল্লরীদি বলল দাঁড়াও আমি পুরোনো কলিগদের ফোন করি। তেমনই একজন চলভাষের ওপার থেকে জানালেন, জায়গাটার নাম উত্তর পানিয়ালগুড়ি। ব্যাস, কেল্লা ফতে। ঐ একটা নাম সম্বল করে আমরা সকলে যে যার চলভাষে আন্তর্জালের অলিগলিতে খোঁজাখুঁজি শুরু করি। বেশি চেষ্টা করতে হয়না। একটু পরেই নদীর নাম বেরিয়ে পড়ে : সিকিয়া ঝোরা। ... ...
আরও অনেক পরে সারদা ইত্যাদি গড়ে উঠবে। ২০০০ এর পর। গ্রামে বা ছোট শহর বাজারে ব্যাঙ্ক না থাকা, থাকলেও অ্যাকাউন্ট খোলা একটা বিরাট সমস্যা ছিল। তারচেয়েও বড় কথা, এই সঞ্চয় সংস্থার এজেন্টরা বাড়ি বাড়ি এসে টাকা নিয়ে যেত। দিয়েও যেত প্রথম দিকে। ঋণ পাওয়া যেত সহজে। এর সঙ্গে ছিল চড়া সুদের প্রলোভন। আজও ব্যাঙ্কগুলো দৈনিক ১০/২০/৩০ টাকা করে সংগ্রহ করে ব্যাঙ্কে জমার ব্যবস্থা করতে পারল না। মানুষকে যেতে হচ্ছে। মানুষের কাছে ব্যাঙ্ক পৌঁছে যাচ্ছে না। ইদানীং অবশ্য কিছু কিছু এলাকায় এজেন্ট নিয়োগ হয়েছে। ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত তোলা যায়। আধার কার্ডের বায়োমেট্রিক ব্যবহার করে। তবে দৈনিক ১০/২০/৩০ টাকা জমার ব্যবস্থা হয়নি। হয়নি বলেই আবার কোনও চিট ফান্ড গড়ে উঠবে। উঠবেই। ... ...
এখান থেকে আবাদানের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় নেই। অনুকে খবর দেওয়া যাবে না। আর একবার এই অরাজকতা শুরু হলে কবে যে তার শেষ হবে তা কেউ জানে না। আমি তো অনুকে জানি! ও দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে। স্টিভ বলল, “তুমি এখনই বেরিয়ে পড়। চারটের সময় আবাদানের একটা ট্রেন আছে। চেষ্টা করে দেখ, যদি সেটা ধরতে পার। ট্যাক্সি যদি পাও ভাল, তা না হলে হেঁটেই যেতে হবে।" ... ...
ইন্দিরা গান্ধী জীবিত থাকতে আমার ফুফু কোনওদিন কংগ্রেসকে ভোট দেননি। অমানবিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দিলেন। এটা শুনে আমার আব্বা বললেন, এবার আর রক্ষা নেই। ময়না পর্যন্ত কংগ্রেসের হাত চিহ্নে ছাপ দিলে। তখন ব্যালট পেপারে ভোট হতো। স্ট্যাম্প মারতে হতো পছন্দের প্রার্থীর নামের পর চিহ্নের পাশে। ইভিএম তখন কল্পনাতেও আসেনি। সেবার ৪২টার মধ্যে কংগ্রেস ১৬ টা আসন পেল পশ্চিমবঙ্গে। আর জ্যোতি বসু বললেন, জীবিত ইন্দিরার চেয়ে মৃত ইন্দিরার শক্তি বেশি। একথাও বললেন, জনগণও মাঝে মাঝে ভুল করেন। আবেগের বশে। এই শক্তি বৃদ্ধির কারণেই কিনা জানি না, আর ভুল পরামর্শদাতাদের প্ররোচনায় বামফ্রন্ট সরকারের ওপর খড়্গহস্ত হয়ে উঠলেন রাজীব। সেই পরামর্শদাতাদের অধিকাংশই এখন বিজেপির সঙ্গে। সংসদে শাউটিং ব্রিগেড নামে রাজীবের বন্ধু বান্ধবের একটা দল ছিল। ... ...
সত্তর আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় যাত্রা প্রতিযোগিতা হতো। বাবার কাছে নানা যাত্রার বই আসতো। 'বেগম আসমান তারা'য় দেড় পাতা ব্যাপী একটা সংলাপ ছিল। কী অসম্ভব গভীর অথচ কাব্যিক উচ্চারণ। আমার মতো কিছু তরুণ তখন এইসব মুখস্থ করার চেষ্টা করতো। যাত্রা প্রতিযোগিতা শুনে মনে পড়ল, শ্যামসুন্দর আর নাড়ুগ্রামের মাঝখানে দেবীবরপুর গ্রামে দিনের বেলায় যাত্রা হতো। কেন? সেটা জানতে হবে। আমাদের স্কুলের এক সহপাঠী সেলিম সেদিন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লিখল, রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়ায় দিনে যাত্রা হয়েছে বাদুলিয়ায়। ... ...
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম জঙ্গলের চারটে স্তর। জঙ্গলের মেঝে আগাছায় ভর্তি। এটা হলো প্রথম স্তর। তার ওপরে মাঝারি উচ্চতার গাছ। সেটা হলো দ্বিতীয় স্তর। একেবারে ওপরে আছে অনেক উঁচু উঁচু গাছের সারি। সেটা হলো তৃতীয় স্তর। আর এই তিন স্তরকেই জড়িয়ে আছে নানা রকম লতাপাতা আর অর্কিড। সেটা হলো চতুর্থ স্তর। ... ...
কথাবার্তা শুরু হল। বেশীরভাগই কম্পিউটার বিষয়ক, উন্নয়ন ও পরিবর্তনের গতি, ভবিষ্যতে কি হবে বা হতে পারে ইত্যাদি। প্রফেসর অত্যন্ত ভদ্রলোক, সদালাপী, কথা বলতে ভালোবাসেন। ড্রিঙ্ক ও স্ন্যাক্সের সঙ্গে গল্প কথায় মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম। সব মিলে বেশ ভালো লাগছিলো, নরম পরিবেশ, শিথিল চিন্তাহীন মস্তিষ্ক। হালকা আমেজে ভরেছে মন। “শ্যাল আই গেট ইয়ু এনাদার ড্রিঙ্ক।“ গ্লাসের উপর হাত রেখে বললাম, আর না, এবার উঠব। আচমকা হঠাৎ প্রোফেসর কালিজুরি জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা খাম বার করে আমার হাতে দিল। এতক্ষণ পরে কাজের কথা, বুঝলাম কি উদ্দেশ্যে এই মিটিং। বলল, “দেখো, তুমি যা যা চেয়েছিলে তা সব আছে এখানে। সই করে দাও।” আমি অবাক। কন্ট্রাক্ট পড়ে দেখি, সত্যি তাই। একটু চিন্তা করে বললাম, “আমি আমার ওয়াইফ-র সঙ্গে কথা না বলে সই করতে পারব না।" প্রফেসর বলল, “আর সময় নেই, কাল ভোরেই আমি চলে যাচ্ছি। এখন সই না করলে আর হবে না।” প্রফেসর নাছোড়বান্দা। ... ...
তখনো আই সি এল পুরোপুরি ভারতীয়করণ হয়নি। আই সি এল-স্বার্থ লন্ডনের হেড অফিসই দেখাশুনা করত। ভারতীয়করণের পর একদিন ভারতবর্ষের আই সি এল স্বাধীন হল। ম্যানেজমেন্ট সব ভারতীয়, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এক পার্সী ইঞ্জিনীয়ার, প্রেম শিবদাসানী। কিন্তু লন্ডন আই সি এল তখনও ভারতীয় ব্যবসায়ের বড় অংশীদার এবং ভারতীয় আই সি এল দেখাশুনা করে। লন্ডনে আই সি এল-র ইন্ডিয়া অফিসের ডাইরেক্টর মিঃ জ্যাকসন। ইন্ডিয়া অফিস বা ইন্ডিয়া ট্রেডিং-র ম্যানেজার অমলেন্দু বিশ্বাস, আমি। এই পদের ক্ষমতা বেশি ছিল না কিন্তু মর্যাদা ছিল অনেক। সেই সঙ্গে ছিল অনেক দায়িত্ব ও কাজ। দুই দেশের ব্যবসায়িক আদান প্রদান এই অফিস তথা আমার মাধ্যমেই হত। ... ...
আসলে আমাদের সামনে তেমন ভালো এবং নিয়মিত পাঠচক্র ছিল না। কয়েক বছরের ব্যবধানে একটা দুদিন বা তিনদিনের রাজনৈতিক ক্লাস হতো। তাতে বক্তারা মিনিট পনেরো পরই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এইসব ছেড়ে সহজ টার্গেট কংগ্রেসে চলে যেতেন। তবে বিনয় কোঙার আধ ঘণ্টা পর্যন্ত বিষয়ে ছিলেন। আর একটা উপকার করেছিলেন, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে। পড়ি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা নীললোহিত খুব টানতো। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভালো লাগে, বলা অন্যায় মনে হতো। নয়ের দশকের শুরুতে সুভাষ চক্রবর্তী টাউন হল ময়দানের এক সমাবেশে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যরচনার খুব প্রশংসা করলেন। মনোভাব বদলাল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ছিল খুবই প্রিয়। যেকোনো প্রতিযোগিতায় তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো। আমি এই বই, শিবনারায়ণ রায়ের বই, একাধিক সংখ্যায় পেয়েছি। যদিও এই দুজন ছিলেন পার্টিতে অপ্রিয়। ... ...
মধুসূদনের প্ল্যান অনুযায়ী মাদারিহাটে সমীক্ষা ও জরিপের ফাঁকে একদিনের আধবেলা রাখা হয়েছিল জলদাপাড়ার জঙ্গল ঘোরার জন্য। ঠিক একমাস আগে এই অরণ্যে এসেছিলাম বাড়ির লোকের সঙ্গে। সেবার হাতির পিঠে চড়ে ঘুরেছিলাম। কিন্তু এবারে আর হাতি সাফারি নয়, জিপে করে ঘোরা। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষিকা সব মিলিয়ে দলের সদস্য একচল্লিশ। একদিনে ভোর থেকে তিনবার হাতি সাফারি হত তখন। তখন মানে সালটা ২০১৮। ... ...
একদিন সন্ধ্যায় আমার শ্বশুর মহাশয়ের মৃত্যুর খবর এল। অনু কান্নাকাটি করছে, আমার মনটাও ভারাক্রান্ত। পর দিন সকালে অফিসে গেছি– মুখে একটা বিষাদের ছায়া আছে যা লুকানো যায় না। মিস্টার ফ্রেন্ড প্রতিদিন সকালে সকলকে “গুড মর্নিং” করেন, সেদিনও করলেন। আমার ডেস্কের কাছে এসে একটু দাঁড়িয়ে বললেন, “কী হয়েছে তোমার? মুখটা এত শুকনো কেন?” আমি বললাম কী হয়েছে। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তারপরে দুঃখ প্রকাশ করে চলে গেলেন। লাঞ্চের পর তিনি আবার এলেন আমার কাছে। বললেন, তিনি আমার স্ত্রী ও দুই পুত্রের জন্য তিনটি টিকিটের ব্যবস্থা করেছেন, কলকাতা যাওয়ার জন্য। বলা বাহুল্য এর জন্য আমায় কোনো মূল্য দিতে হবে না। সে যুগে সদ্য-আসা আমার মতো কোনো বঙ্গসন্তানের তিনটি টিকিট কেনার মতো সামর্থ্য থাকত না। খবরটা শুনে আমার চোখে প্রায় জল আসে। কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাবো তা ভেবে পেলাম না। ভারি গলায় শুধু বললাম, “থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার ফ্রেন্ড।” আশ্চর্য মানুষ! নতুন কাজে আমার তখনও ছ’মাস হয়নি সুতরাং আমার কোনো ছুটি নেই। অনুকে তাই দুটি ছেলেকে নিয়ে একাই যেতে হবে। ... ...