স্কুল কলেজে পড়ুয়াদের তো বন্ধুত্ব ছিলই তবে খেটে খাওয়া মানুষদের বন্ধুত্বও ছিল দেখার ও বলার মতো। হরিহর আত্মা। দুগোদার দোকানে দুজন এসে বসতেন। দুজনের এক নাম। একজন ব্রাহ্মণ একজন তপশিলি জাতির। দুজনে মুখোমুখি বসে থাকতেন। একটা কথাও হতো না। দু ঘন্টা তিন ঘন্টা একসঙ্গে বসে থাকাটাই ছিল তাঁদের হৃদয়ের আন্তরিক বিনিময়। ঝড় জল বৃষ্টি কাদা দুজন আসবেনই। বসবেন। এবং কোনো কথা না বলে উঠে যাবেন। আর দুজন ছিল টগরভাই ও ভাদুভাই। প্রতিদিন দেখা হওয়া চাই। ... ...
তখন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রামনারায়ণ গোস্বামী। কৃষক নেতা। দুর্দান্ত লড়াকু গরিব দরদী সৎ নেতা। তাঁর খুব কাছের মানুষ ছিলেন মন্টুদা। সেই সূত্রে বা তাঁর ভালো ব্যবহারের জন্য পিজির সুপার তাঁকে ভালোবাসতেন। মন্টুদা বলে দিলেন সুপারকে। পরদিন অ্যাম্বুলেন্স করে নিয়ে এলাম। সেই কলকাতায় প্রায় ২০ দিন টানা থাকা। পিজির এমার্জেন্সির দক্ষিণ দিকে এম ( মার্টিন) ওয়ার্ডে নেনো ভর্তি হল। আমি আর আমাদের পাশের বাড়ির একজন রাতদিন ওখানেই থাকলাম। গাছতলায় বহু রোগীর বাড়ির লোক শুতেন। আমরাও শুতাম। খাওয়া দাওয়া হোটেলে। একদিন সামনে মাসির হোটেলে খেতে গেলাম। শুনলাম ডাক্তার ছাড়া খেতে দেওয়া হয় না। একজন জুনিয়রও এমন চোখে তাকালেন, রাগ হল। কিন্তু চুপ। পেশেন্ট আছে। এখানেই প্রথম রোগীর বদলে পেশেন্ট এবং পেশেন্ট পার্টি শুনি। এটা অবজ্ঞা করে বলা হতো। আর আমরা গেলেই বলা হতো, ক্যাচ পার্টি এসেছে। মানে ধরে ভর্তি করানো। সেসময় জুনিয়র ডাক্তার ধর্মঘট চলছে। ... ...
এমন মাইক অন্ত প্রাণ খুব কম দেখা যায়। হাতে ঘোরানো কলের গান থেকে শুরু করে আধুনিক এল পি রেকর্ড সব কেনা চাই শিবু ভাইয়ের। মাইক বাজানো তাঁর যত না পেশা, তার চেয়ে বেশি নেশা। তখনকার দিনে দিন প্রতি ২৫ টাকা। আমার কাছে নিত দিন প্রতি ১৫ টাকা। একবার শিবু ভাই বলল, পূজার সময় মাইক বাজাবে না। ... ...
গুলি ডাং? সে আবার কী? ৫০ বছর পর হয়তো এ-জন্য টীকাকারের প্রয়োজন হবে। জানতে চাইবে, গুগল বা বুগুল খুলে, হোয়াট ইজ গুলি ডাং, বুড়ি বসন্তী, ভাটা খেলা, নুনচিক/ গাদি/ জাহাজ খেলা। তাই লিখে দেওয়া সমীচীন। বন্ধুরা কেউ সাহায্য করবেন? গুলি মানে বন্দুকের নয়, দুদিক ছুঁচলো একটা কাঠের দু ইঞ্চি থেকে চার ইঞ্চি একটা সরু টুকরো। ডাং হচ্ছে কাঠেরই একটা দুফুট থেকে তিন ফুটের একটা ডান্ডা। মাটিতে শোয়ানো গুলিকে ছুঁচলো দিকে ডান্ডা পিটিয়ে মাটির উপরে তুলে বা রেখে এক বা একাধিক বার ড্রিবল করে যত দূরে পাঠাবে, ততো পয়েন্ট জুটবে। হাতের ওই ডান্ডা বা গুলি দিয়ে মাপ হবে। গুলিকে শূন্যে যতবার পেটানো হবে মাপ হবে ততোগুণ। অনেকটা ক্রিকেটের বড়দা। উইকেটের বদলে পেছনে একটা গর্ত থাকবে। বিপক্ষের লোক একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে গুলি ছুঁড়বে ওই গর্তে ফেলার জন্য। ডাং খেলি সেটিকে মেরে সপাটে দূরে পাঠাবেন। মাঝে যদি দুই বা ততোধিক বার শূন্যে পেটাতে পারেন তাহলে ততোগুণ পয়েন্ট হবে। আর ক্রিকেটের মতো ফিল্ডার বা বিপক্ষের খেলোয়াড় থাকবে ক্যাচ ধরার জন্য। ধরলেই খেলি / খেলোয়াড় আউট। ... ...
বাবা এবার খাতা টেনে নিয়ে দুই দেয়ালের দূরের প্রান্তের খাড়া দাগগুলো উপরে নীচে একটু করে মুছে দিল। সামনের দেয়ালের দূরের প্রান্ত-দাগ একটু বেশি মোছা হল। মাটির আর উপরের শোয়ানো দাগগুলোও এবার মুছে যেমন দরকার সেইভাবে খাড়া দাগগুলোর সাথে জুড়ে দেওয়া হল। এতক্ষণে আমি তফাৎটা বুঝে গেছি। কেমন ঠিক ঠিক দেখাচ্ছে এখন! এবার এর সাথে মিলিয়ে দরজা-জানালা, বাড়ির মাথার চাল, এসব বসিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। - রেল লাইন দেখেছিস কখনো? - হ্যাঁ, মামাবাড়ি যাওয়ার সময়। - প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে লাইন বরাবর তাকিয়ে দেখেছিস? - মনে পড়ছেনা। - আবার কখনো সু্যোগ পেলে তাকিয়ে দেখবি, মনে হবে লাইনদুটোর মাঝে ফাঁক সমানে কমে গেছে। অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেলে দেখবি একসময় লাইনদুটো গায়ে গায়ে মিশে গেছে। আসলে তাদের মাঝে সব সময় একই দূরত্ব থাকে কিন্তু আমরা দেখি অন্য রকম। ছবি আঁকার সময় কোথা থেকে, মানে কোথায় দাঁড়িয়ে জিনিষটাকে দেখে ছবিটা আঁকছ, সেইটা ইম্পর্ট্যান্ট। তেমনভাবে ধরা একটা ডিমকে দেখে আঁকলে সেইটা ডিমের মত নয়, একেবারে একটা বলের মত দেখাবে। একদম উপর থেকে সোজাসুজি দেখলে বাড়িটারে দেখাবে স্রেফ একটা চারকোণা ছাদ, আর কিছুনা। ... ...
স্বাধীন দেশে রাজা এবং প্রজার ধারণা এক মানসিক দাসত্ববৃত্তি থেকে আসে। তাই সাধারণতন্ত্র না বলে প্রজাতন্ত্র দিবস বলেন কেউ কেউ। । আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খুব ঘটা করে পালন হতো ২৬ জানুয়ারি ও ১৫ আগস্ট। প্রধানশিক্ষক ছিলেন আমার বড়োমামা। কংগ্রেসের বড়ো নেতা। বোঁদে দেওয়া হতো। পতাকা তোলার পর গোটা গ্রাম মিছিল করে ঘোরা শেষে। মাঝপথে কেউ যাতে না পালায়, তাই শেষে মিষ্টি। আমরা সিপিএম বাড়ির ছেলে। পিছনের দিকে থাকতাম। বন্দে বলে আওয়াজ উঠলেই আলতো করে বলে উঠতো কেউ কেউ, বোঁদে ছাগলের পোঁদে। তবে বোঁদে খাওয়ার সময় এ-সব কারও মনে থাকতো না। আমার মনে পড়ে না জুনিয়র হাইস্কুলে এ-সব পতাকা উত্তোলনের রেওয়াজ ছিল কি না! তবে সেহারা স্কুলে পড়ার সময় বেশ ভিড় হতো। ছাদে। বক্তৃতাও হতো। মিল মালিকের ছেলে কংগ্রেসের অবদান বললে, তেড়ে আধঘন্টা বক্তৃতা করে ধুইয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ইয়ে আজাদি আধা হ্যায়। টাটা বিড়লা গোয়েঙ্কারা দেশ লুঠছে। তখন তো আদানি আম্বানিদের দেখি নি। তাহলে কী বলতাম জানি না। তখন বলেছিলাম, মাথাপিছু ৬০০ টাকা ঋণ। ... ...
বাবা বারান্দায় বসে একধাপ নিচের সিঁড়িটায় একটা যুৎসই উচ্চতার কাঠের টুকরো রেখে তার উপর বাঁশের টুকরোটা দাঁড় করিয়ে দা দিয়ে সেটাকে লম্বালম্বি কয়েকটা টুকরোয় চিরে ফেলল। তারপর তাদের একটার গা থেকে দা দিয়ে কয়েকটা ছিলকা বার করে নিয়ে ছুরি দিয়ে সেগুলোকে চেঁছে চেঁছে কয়েকটা মসৃণ এবং নমনীয় কাঠি বানিয়ে নিল। এরপর রঙিন কাগজের বান্ডিল থেকে একটা কাগজকে টেনে নিয়ে সেটাকে ভাঁজ করে, ভাঁজ বরাবর ছুরি টেনে তার থেকে একটা বর্গাকার টুকরো বার করে আনল। এরপর ঐ কাঠিগুলোর একটাকে সেই কাগজের টুকরোটার উপর রেখে কাঠির গোড়া যদি এক নম্বর কোণায় রাখা হয়েছে ধরি, তবে অন্য প্রান্তকে তিন নম্বর কোণার দিক করে বসিয়ে কোণা ছাড়িয়ে দুই কি তিন ইঞ্চি দূরে ছুরি দিয়ে কাঠির গায়ে দাগ কেটে তারপর দাগ বরাবর দু’ টুকরো করে, দাগের প্রান্ত আর গোড়ার প্রান্তকে একটা সুতো দিয়ে আলগা করে বেঁধে একটা ধনুক বানিয়ে ফেলল। সুতোটা তখনো ঢিলা রেখে ধনুকটাকে এবার চৌকো কাগজের উপর বসিয়ে ঠিকমত আকারে এনে সুতোর সেই ছিলা টাইট করে বেঁধে ফেলা হল। ধনুকের দুই মাথা কাগজের এক আর তিন নম্বর কোণা ছুঁয়ে আছে। আমরা ভিতরে ভিতরে উত্তেজনায় ছটফট করলেও শান্তভাবে বসে দেখে যাচ্ছি। ... ...
বড়ো শখ করে এক দহলিজ/ কাছারি/ খানকা/ বৈঠকখানা বানিয়েছিলেন হেকিম সাহেব। সেটা আমিও দেখতে পেয়েছি। খড়ের বদল পাট দিয়ে পাঠ। দেওয়াল শোনা কথা, ডিমের লালা দিয়ে পালিশ করা। বেতের চাল। তারপরে খড়। আর দামি কাঠের হরেক কাছ। প্রতিটা খুঁটি বরগায় কাজ। লোকে দেখতো আসতো, এই শখের কাজ। দরজাও সেকালের মতো কারুকার্যময়। ঝাড়বাতি ঝুলতো। পাঙ্খাটানার ব্যবস্থাও ছিল। দহলিজের দখিন দিকে নিমগাছ। নিমের হাওয়া খাবেন, তাই। ... ...
একটা কথা আছে, শিশুরা ফুলের মতো সুন্দর। অবশ্যই। মিষ্টি হাসি, আধো আধো কথা। প্রিয়জনকে দেখলেই ছুটে আসা। কিন্তু ছোটদের মধ্যে নিষ্ঠুরতাও থাকে। সময় ও সমাজের প্রভাবে মানবিক হয়ে ওঠে। মানবিক নয়, বলা উচিত প্রাণবিক। পৃথিবীর সকল প্রাণীর মধ্যে নিষ্ঠুরতা কাদের মধ্যে বেশি? ... ...
ঝুনুদির বাবা শান্তি চক্রবর্তী এবং উমাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। উমাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম দুই মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে দিলেও ছোট মেয়ের দেননি। সে অবশ্য আমার সেজদি এবং ছোটবোনের ক্ষেত্রেও খাটে। সেজদির বিয়ে হয় ২১+ বয়সে। ছোটবোন এম এ বিএড পাস করার পর ২৪ বছর বয়সে। মেজদির সহপাঠিনী ও প্রাণপ্রিয় সই ঝুনুদি গ্রামের প্রথম মেয়ে যে কলেজে ভর্তি হয়। ঝুনুদি পঞ্চম শ্রেণি থেকেই বাবার স্কুলে পড়তে যেতেন। তিন কিলোমিটার দূরে, পলাশনে। সেখান থেকে মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে যান ছয় কিলোমিটার দূরে শ্যামসুন্দর কলেজে। ... ...
মায়ের সঙ্গে ছেলের প্রবল মতাদর্শগত অমিল। অথচ এই অবিবাহিত ছেলেকে ঘিরেই মায়ের গোপন আবেগ। ভালোবাসা। ছেলে সূর্যকুমার যখন সংসার ভেঙ্গে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, মানতে না পেরে এবং অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করে। আমাদের ছোটবেলায় অভাবের জ্বালায় সংসার চালাতে না পেরে পুরুষ বা নারীর আত্মহত্যার চেষ্টা দেখেছি। তবে এক 'মুসলিম' তরুণীর প্রেমে এক 'হিন্দু' তরুণের আত্মহত্যা গ্রামে খুব আলোড়ন তোলে। ... ...
হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মুরগি পালন করতেন না। তাঁদের ঘরের মেয়েরা হাঁস পালন করতেন। কোনও হিন্দু বাড়িতেই মুরগি ঘরে রান্না করা যেত না। ফিস্টিতে খেতে হতো। মুরগিকে বলা হতো রামপাখি। মুরগির ডিমকে রামফল। জ্বর সর্দি হলে শরীর দুর্বল হলে প্রেসার লো হলে গ্রামের ডাক্তার মুরগির হাফ বয়েল ডিম খেতে নিদান দিতেন। তখন মুসলিম বাড়িতে গিয়ে মুরগির ডিম কিনে আনতে যেতো। এখন তো মুরগির মাংস জলভাত পোল্ট্রির কল্যাণে। এই পোল্ট্রি আমাদের গ্রামে আসে বামফ্রন্টের বেকার ভাতা দেওয়ার কল্যাণে। বেকার ভাতা পেতেন তিনজন। তিনজনই কংগ্রেসি। এঁরা ম্যাট্রিক পাস করে কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্রে নাম লিখিয়েছিলেন। নাসির চাচা ও সালাম চাচা ছিলেন উদ্যোগী মানুষ। দুজনেই আমার খুব পছন্দের মানুষ। তাঁদের রাজনীতি আমাদের পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে কোনও বাধা হয়নি। বামপন্থী রাজনীতির কারণে ২০০৯ থেকে আমাদের পরিবারকে বয়কট করা হলেও সালাম চাচা, ধনা চাচা ও মাদু চাচা নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। এসেছেন। আর এসেছেন ব্রাহ্মণ সন্তান পীরে কাকা। সালাম চাচা ও নাসির চাচা কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্র থেকে বামফ্রন্ট সরকারের দেওয়া ঋণ নিয়ে গ্রামে প্রথম পোল্ট্রি করলেন। গ্রামের বাইরে মাঠে। তখন ঘরোয়া মুরগির মাংসের দাম ২০ টাকা। ছাগলের মাংসের নাম তখন মাটন হয়নি। দশ টাকা কিলো। এবার পোল্ট্রি এসে দাম হল ১৫ টাকা কেজি। ... ...
আর কয়েকটা পরিবর্তন হয়েছে। ফুটবল খেলার মাঠে লোক নেই। সেখানে কিছুটা ঘিরে ঈদগাহ তলা। বেনে পাড়া বামুনপাড়ায় খেলার জায়গা ছিল না। দুটি পরিবার হাওড়া প্রবাসী হওয়ায় জায়গা মেলে। ছোটখাটো খেলার মাঠ হতেই পারতো। সেখানে এখন বড় দুর্গামন্দির। শিবমন্দির ছিল আগে মাটির। এখন শিব আর ওলাইচণ্ডীর আলাদা ঘর হয়েছে। আগে দুর্গাও ওখানে আসতেন। শিব লিঙ্গ সারা বছর থাকে। ওলাইচণ্ডীর বিসর্জন হয়। দুর্গারও। তবু আলাদা দুটি মন্দির। ... ...
যে বাড়িতে সত্যপীরের পালা, সে বাড়ির ছেলে মেয়েরা লোকেদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসতো। সত্যপীরের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করতেন তাঁর হাতে থাকতো একটা বিরাট সাদা চামর। সেটা মাথায় বুলিয়ে তিনি আশির্বাদ করতেন। হিন্দু মুসলমান সবাই সেই আশির্বাদ নিতেন। ১০-২০ পয়সা করে দিতেন মায়েরা সত্যপীরের পালায়। কিশোর ঘোষালদা লিখেছেন, ১৯৮০ র মাঝামাঝি সত্যপীর সত্যনারায়ণ হয়ে গেল। তা, সত্যপীরের পালায় হিন্দু মুসলমান একতার কথা থাকতো। ... ...
উত্তরবঙ্গে কয়েকটি সপ্তাহ কাটিয়ে বুঝে গেলাম এইবারে এক সম্পূর্ণ আলাদা দুনিয়ায় এসে হাজির হয়েছি। এবং এখান থেকে আর আগের জগতে ফিরে যাওয়ার কথা বড়োরা কেউ ভাবছে না। মন বসাতে সময় লেগেছিল। তারপর একটু একটু করে সেই নতুন জগৎ আমায় ঘিরে নিল। ... টান এক মজার অনুভূতি। যে তিন বছর উত্তরবঙ্গে ছিলাম, যখন তখন ভাবতাম কবে আমাদের দমদম ক্যান্টনমেন্টের ভাড়াবাড়ির ঘরে ফিরব। আর উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার কয়েকবছর পর থেকে কি যে এক চোরাটান ছেয়ে থেকে অস্তিত্ব জুড়ে – সেই তোর্সাতীর-এর জন্য! ... ...
রণোভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশ জমে গেল। আমার বাবার মতো দিলদরিয়া গোছের মানুষ। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চাইলে বললেন, কাল বাসায় আসুন ১২ টা নাগাদ। ধানমন্ডিতে বাড়ি। দেখলাম সবাই চেনেন বাড়িটি। কথা শেষ ঊঠছি। বললেন, আরে যাবেন কোথায়? খেয়ে যাবেন। একসঙ্গে বের হবো। তাঁর মা, স্ত্রী, ভাই, ভাইয়ের বৌ, মেয়ে রাণা, ভাইঝি পুতুল--সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। মেয়ে রাণা তখন দশম শ্রেণিতে পড়েন। আস্তে আস্তে অনুচ্চস্বরে টেলিফোনে কথা বলতেন। খাওয়ার টেবিল দেখি নানান খাবারে ভর্তি। এটা কিন্তু ঘোষিত দাওয়াত না। এত খাবার বাড়ির টেবিলে আগে দেখিনি। আমাদের এখানে তখন তো জামাইকেও আট দশ পদের বেশি খাওয়াতে দেখিনি। আইবুড়ো ভাত হলে আলাদা। ভাত, পোলাও, বিরিয়ানি, ইলিশ, কাঁচকি--সব আছে। এই প্রথম আমার কাঁচকি খাওয়া। খেতে ভালোবাসি। তাও সংকোচ হচ্ছিল। বললেন, আরে এই বয়সে এত ভেবেচিন্তে খেলে হবে, খান। ... ...
এই ঘটনা হতবাক করে দিল গ্রামকে। ইটপূজা হল গাজন তলা তথা ওলাইচণ্ডী পূজার বারোয়ারি তলায়। বারোয়ারি তলায় বর্ষার পর একটা বাঁশের মাচা করা হতো আড্ডার জন্য। দুগোদার মুদি দোকান বড়দের দখলে থাকতো বেশিরভাগ সময়। ১৫-২৫ ভিড় করতো বাঁশের মাচায়। হিন্দু মুসলমান একসঙ্গেই আড্ডা। বন্ধুদের আবার হিন্দু মুসলমান কী? কিন্তু সেই বন্ধুদের কেউ কেউ ইটপূজার উদ্যোক্তা। কদিন আগেই একসঙ্গে কার্তিক ঠাকুর ফেলেছে নতুন বিয়েওলা বাড়িতে। তাঁদের কেউ কেউ পূজা না করে ঠাকুর ফেলে দেওয়ায় একসঙ্গে সেই ঠাকুর তুলে এনে খিচুড়ি খাওয়া হয়েছে। আর তাদের কেউ কেউ বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির গড়ার জন্য ইট পাঠাচ্ছে গ্রাম থেকে! ... ...
এমন একটা দিন যায় না যেদিন অন্তত একবার তাঁর গানের কোন কলি, কবিতার কোন পংক্তি, নাটকের কোন সংলাপ বা কোন চিত্রকর্মের কথা স্মরণ করা হয়নি। অথচ এমন ত নয়, তাঁর বিপুল সৃষ্টির এক কুচির বেশী কিছু পড়া হয়েছে আমার! আবার তাঁকে বাদ দিয়ে আর কিছুই পড়িনি, শুনিনি, দেখিনি এমনও ত নয়! তবু তাঁর কাছে না এসে উপায় থাকে না। তবে তাঁর যে সৃষ্টি সেই শৈশব-কৈশোর-প্রথম যৌবনে আদৌ সেভাবে বুঝিনি তা হচ্ছে তাঁর গান। যত দিন গেছে, জীবন যত পাক খেয়েছে, তলিয়ে গেছে, আর ভেসে উঠেছে, তত বেশী করে আমার আশ্রয় মিলেছে তাঁর গানে। ছোট বেলায় গানের চরণগুলি আসত-যেত, হাওয়া যেমন আসে, যায়, সহজ-সরল, সাবলীল, একান্তই পরিচিত। যত দিন গেল, গানগুলি বয়ে আনতে লাগল অনাঘ্রাত সুগন্ধ, অশ্রুত বাণী, অদেখা রূপ। একেক বিকেলে, সন্ধ্যায়, মোহন সিংয়ের কন্ঠে যখন অমৃত-বাণী ছড়িয়ে পড়ে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার চেতনা, আমার শরীর বসে থাকে চুপটি করে, আর অঝোর ধারে কোথা হতে উপচে আসে শ্রাবণ, বন্ধ দু চোখ বেয়ে। নাই থাকল আমার কোন জীবনদেবতা। আমার নিজস্ব বেদনা আরও কোন বৃহত্তর বেদনায় মিলেমিশে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ... ...
প্রকৃতি একটু একটু করে খুলে দিচ্ছিল তার জাদু-দরজা। ঘরের একদিকের দেয়ালের পাশে ছিল লম্বা লম্বা পাতার কিছু গাছ। তাতে অদ্ভুত দেখতে কিছু কলি। ধীরে ধীরে কলিরা বড় হচ্ছিল। হঠাৎ এক সকালে দেখি, কলি নয়, ফুল। কি অবিশ্বাস্য সুন্দর ফুল! বাবাকে গিয়ে ধরলাম, কি ফুল বাবা? বাবা বলল, কলাবতী। এমন ও ফুল হয়, এমন ও নাম হয়! আমার চেতনার কূল ভাসিয়ে বাজতে থাকে কলাবতী, কলাবতী, কলাবতী। তারপর একদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে। গায়ে সেদিন অল্প অল্প জ্বর। মা বলে, – আজ আর দুজনের কারো, স্কুলে গিয়া কাজ নাই। আমি চাদর মুড়ি দিয়ে হাত-পা ঢেকে বিছানায় বসে থাকি, জানালার পাশে। দেখি, কলাবতী বৃষ্টিতে স্নান করে। পাতার গা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে – টুপ – – টুপ, টুপ টুপ। ফুলের গা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে – টুপ – – টুপ, টুপ টুপ। ঠাকু’মা এসে পাশে দাঁড়ায়। – কেমন আছ অহন? – ভালো। – জলীয় বাতাস লাগাইও না। জ্বর বাড়ব। জানালার পাল্লা অনেকটা বন্ধ হয়। একটু ফাঁক রাখা থাকে–নাতির জন্য, কলাবতীর জন্য। ছোট দু’ ভাই এবার ঘিরে আসে, – ঠাকুমা গল্প বলো। ... ...
রবিবুড়োর ডাকঘর থেকে একটা ছোট অংশ ছিল আমাদের পাঠ্যবইয়ে, অমল ও দইওআলা শিরোনামে। দিদিমণিরা সেটাই বেছে নিলেন মঞ্চস্থ করার জন্য। সম্ভবত: প্রচুর পটর-পটর করার যোগ্যতায় আমি মনোনীত হলাম অমল-এর ভূমিকায়। চতুর্থ শ্রেণীর এক শ্রীমান হল দইওআলা।সেই প্রথম জেনেছিলাম রিহার্সাল কাকে বলে। শেষ ক্লাস-এর পরে শুরু হত। ভাল লাগত, তবে একটু ক্লান্ত হয়ে যেতাম – আমার তো কবে সব মুখস্ত হয়ে গেছে, ভাব ভঙ্গী সহ! দিদিমণিরা মাঝে মাঝে আলোচনা করতেন কেমন করে মঞ্চসজ্জা করলে বা আর কি কি করলে নাটকটা একেবারে সত্যির মত করে তোলা যায়। সেই সব কিছু কিছু শুনে আমার ধারণা হয়েছিল যে আসল অনুষ্ঠানের দিন আমাকে দইওআলা ছেলেটির হাত দিয়ে একটা সত্যি দই-য়ের ভাঁড় দেওয়া হবে। আমার কাছে নাটকের আসল আকর্ষণ ছিল সেটা এবং সেই নিয়ে ভিতরে ভিতরে খুব উৎফুল্ল থাকতাম। ... ...