সেটা বোধ হয় ১৯৫৮ সাল। ঠিক মনে নেই, দু এক বছর এদিক ওদিক হতে পারে। মহম্মদ আলি পার্কে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের বিরাট আয়োজন। বোধহয় তৃতীয় দিন। সে দিন এক দুর্ঘটনা ঘটল। সারা প্যান্ডেল আগুনের গ্রাসে ধুলিসাৎ হয়ে গেল। কর্মকর্তাদের মাথায় হাত। আবার নতুন করে সাজাতে হবে সব- প্রচুর অর্থেরও প্রয়োজন। একটা আকর্ষণীয় কিছু করা দরকার যা সেই সময় অভাবনীয় এবং অর্থাগমের উপায় হবে। ওঁরা শিশির ভাদুড়ীর দ্বারস্থ হলেন। ভাদুড়ী মহাশয় তখন বৃদ্ধ- অভিনয় প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন, স্টেজে নামেননি অনেক কাল। ওঁদের অনুরোধে রাজী হলেন। কাগজে খবরটা দেখে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। শিশিরবাবুর কথা এত পড়েছি এত নাম শুনেছি। নিউ ইয়র্কে সীতা নাটক করে সাড়া ফেলেছিলেন। কিন্তু ওঁর অভিনয় কখনো দেখিনি। নিজের চোখে শিশির বাবুকে দেখব, নিজের কানে শিশির বাবুর কন্ঠস্বর শুনব সে তো ভাবতেই পারিনি। এমন লোভ সামলাতে পারলাম না। ... ...
কলকাতা থেকে, মধ্যবয়স্ক এক শৌখিন অ্যাডভোকেট একবার সস্ত্রীক বক্সা জয়ন্তী বেড়াতে আসেন। দুদিন ঘোরার পরে, তাঁর তরুণী প্রগলভা স্ত্রী মুকুলকে বলেন তোমাদের জঙ্গল ফালতু, একটাও জন্তু দেখা যায়না। কথাটা মুকুলের আঁতে লাগে। সে বোঝানোর চেষ্টা করে, জন্তুরা আড়ালে থাকতে পছন্দ করে, তাদের কথা বেশি না ভেবে ঘন গাছপালা, যারা আশ্রয় দেয়, অক্সিজেন দেয়, তাদের সঙ্গ উপভোগ করুণ। তরুণী সে কথায় আমল না দিয়ে তর্ক চালিয়ে যান। ... ...
সারাদিনের অতিরিক্ত পরিশ্রমে যাত্রা শুরু হওয়ার কিছু পরেই চোখ খুলে রাখা দায় হতো। বড়দের বলে রাখতাম, যুদ্ধের দৃশ্য, আমাদের ভাষায়, সিন, এলেই জাগিয়ে দিতে। কেরিচু কেরিচু ক্যাঁ বলে একটা বাজনা বাজতো। আর তলোয়ার নিয়ে সে কী লড়াই। একটু পড়তে পারার পর থেকেই যাত্রার বইগুলো আমার মুখস্থ হয়ে যেতো। কোন বই ( যাত্রা) এবার ধরা হবে, সে-নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে যেত মাঘ মাসের যাত্রা শেষ হওয়ার পরদিন থেকেই। কিন্তু মহলা সেই আশ্বিন কার্তিক মাসে। তার আগে কত পালা দেখা পড়া চলতো। বই পড়া আর তার সঙ্গে রোজ সন্ধ্যায় মহলা দেখা-- এই নিয়ে বই তো মুখস্থ হবেই। ... ...
আমি আমার ভাগ্যের কেরামতি দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। হঠাৎ কোথাও কিছু নেই কে এক বন্ধু ফোন করে খবর দিল এবং একটা নতুন চাকরি জুটলো। ভাগ্যের মোড় ফিরলো। অথচ এতদিন ধরে কত চেষ্টা করেছি কত ইন্টারভিউ দিয়েছি কিন্তু কোথাও কিছু হয়নি। আমেরিকান রেফ্রিজারেটরও ঠিক এমনি করে হঠাৎ চাকরি পেয়েছিলাম। বাবা তাঁর মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়নি। ঘটনা ক্রমে দেখা হলো তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি তখন বেড়াতে বেরোচ্ছিলেন, আমিও তাই ওঁর সঙ্গে রাস্তায় নামলাম। পথে পড়ল তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি যিনি আমেরিকান রেফ্রিজারেটররের ম্যানেজার। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তারপর চাকরি হয়ে গেল। ইন্ডিয়া ফয়েলসের চাকরিও প্রায় একই ভাবে তেমনি করে। আমি তখন কলকাতার বহুবাজার অঞ্চলে ক্ষেত্রদাস লেনে এক মেস বাড়িতে থাকি। আমাদের রাস্তা পেরিয়ে দু’পা হাঁটলেই ছোট মামার চেম্বার। ... ...
একপাশে দেখলাম বসার জায়গা করা আছে। তার ধারে পুজোর বেদী, কিছু ঘিয়ের প্রদীপ। ধাপ কাটা বেদীটি বৌদ্ধ ভক্তদের পুজোর জন্য। প্রতি বুদ্ধ পূর্ণিমায় ভক্তরা আসেন। আর ত্রিশূল দিয়ে সাজানো বেদীটি হিন্দুদের জন্য। সেখানে হর পার্বতী - পুরুষ/প্রকৃতির পুজো হয় মাঘী পূর্ণিমায়। কিন্তু কী এমন মাহাত্ম্য আছে এই জলাশয়ের যে এই দুর্গম অঞ্চলে আজও মানুষ পাহাড় ডিঙিয়ে আসেন! ... ...
চাকুরীর সন্ধানে আসানসোলে গিয়েছিলাম। তখন আলাপ হল। এই পাঁচ বছরে সম্বন্ধটা আরো গভীর হয়েছে, সহজ হয়েছে। অনেকদিন থেকে ভেবেছি ওর কথা লিখে রাখবো। কেননা আমার জীবনের অনেকখানি, বিশেষ করে চরমতম ট্রাজেডি ও হতাশার সেই দিনগুলোতে ও আমাকে জুগিয়েছে অনেক কিছু --- সাহসের মতো দুর্লভ কিছু, সাহচর্যের মতো ভরাট কিছু এবং অত্যন্ত স্থুল কিন্তু সেকালে নিতান্ত প্রয়োজনীয় যা সেই-- অভাবে অর্থ সাহায্য। লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়নি। প্রত্যেকবার ভেবেছি ধীরে সুস্থে, প্রচুর সময় নিয়ে খুঁটিনাটি সবকিছু লিখে রাখবো। শুধু ঘটনা নয় আমার মানসিক চিন্তার সব আলোড়ন, স্থিতি এবং টানাপড়েন। কিন্তু লেখা হয়ে ওঠেনি। যেহেতু সেই সুস্থতা ও সময় কখনো পাইনি। আজও লেখা হবে না সবটুকু। তবু সূচনাটুকু লিখে রাখি, কি জানি আর যদি কখনো সময় না পাই, তবে হয়তো লেখাই হবে না কোনদিন। অন্তত এই মুখবন্ধ টুকুই আমাদের পরিচয়ের অভিজ্ঞান হয়ে থাকবে, ভবিষ্যতে যদি কখনো লেখা নাই হয় আর। ... ...
মানুষ গায়ের জোরে কেড়ে নেয়। গোরু মোষ ছাগল ভেড়ার দুধ লুঠ করে নেয়। ক্ষমতার জোরে। সামান্য খাবার দিয়ে। প্রাণীরা তাঁদের সন্তানের জন্য এসব রাখতে চান। আমি তো দেখেছি, বাছুরকে বেঁধে রেখে পিতলের বালতিতে দুধ দুয়ে নিতে। এই দুধ হতো গরম ফেনাময়। মুরগি হাঁস তেমন ডিম পেড়ে তা দিত, যাতে বাচ্চা জন্মায়। ... ...
মাদারিহাটে দিন তিনেক চলল সার্ভের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস মেনে ছাত্রছাত্রীরা দুরকম সার্ভেই শেখে - অর্থাৎ একদিকে যন্ত্র সহযোগে প্রাকৃতিক পরিবেশের জরিপ, আর অন্যদিকে কোন গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে নানা বিষয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব। সাংবাদিকেরা কারোর জীবন সম্পর্কে জানতে হলে টেপ রেকর্ডার অন করে মানুষের সঙ্গে গল্প করেন - আর সেই গল্প থেকেই উঠে আসে প্রয়োজনীয় তথ্য। ... ...
আরেকজন মাস্টারমশাই ছিলেন লক্ষ্মীবাবু। তখন তাঁকে তাঁর গ্রামের নাম ধরে বলা হতো। মাস্টারমশাইদের নাম ধরে বলা আমাদের গ্রামের সংস্কৃতি ছিল না। শম্ভুনাথ থান্দার কাষ্ঠকুড়ুম্বার মাস্টারমশাই। আমাদের গ্রাম থেকে বহু দূরে। মনে মনে কতবার যে ওই গ্রামে গিয়েছি। মাস্টারমশাইয়ের ছায়াসঙ্গী ছিলাম। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় স্যারের বিয়ে হয়। আমাদের গ্রামেই। মনে মনে আশা ছিল, আমাকে অন্তত নেমন্তন্ন করবেন। সঙ্গত কারণেই করতে পারেননি। করলে সব ছেলে মেয়েকেই করতে হতো। কিন্তু আমার এই দুঃখ বহুদিন ছিল। ... ...
মুসলিম এলাকাগুলোতেও তবলিগ জামায়াতের শুক্রবার শুক্রবার ঘোরা শুরু হল। দ্বীনের পথে আসুন। মসজিদে শুক্রবার অন্তত চলুন। জুম্মার নামাজ পড়তে। তাঁদের সঙ্গে বাইরে থেকে আসা নানা উচ্চবর্গের লোকজনদের দেখা যেতে লাগল। চল্লিশ দিন জামাতের সঙ্গে নিজের পয়সায় ঘোরাকে চিল্লা বলা হতো। তাতে কিছু সংখ্যা যোগ হল। এই দুটো বিষয় নিয়েই না ছাত্র সংগঠনে না পার্টিতে কোনও হেলদোল দেখা গেল! দুর্গাপূজার সংখ্যা ও চাকচিক্য বাড়ল। চন্দননগরের শ্রীধরের আলোর সুনাম ছড়াচ্ছে। সেই মতো চমকানো আলো এবং প্যান্ডেল হলে ভিড় বাড়ছে। পুরাতন দেবী শীতলা ওলাইচণ্ডী দেবী ওলাবিবিরা পিছু হঠতে লাগলেন। ... ...
মনে পড়ছে সত্তর দশকের ১৯৭১-এ ইনফ্যান্ট বা শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হই। আমরা বলতাম ইনফিন। ক্লাস টু পর্যন্ত নিজেদের বসার আসন বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে হতো। ইনফিনে ছিলাম ১৫৭ জন। বেশিরভাগ জন স্কুলে আসতো না। শুধু শনিবার খুব ভিড় হতো। ওইদিন আমেরিকার সরবরাহ মাইলো গম রান্না করে খাওয়ানো হতো। কখনও গুড় থাকতো কখনও নয়। বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে থালা নিয়ে আসতো খাবার বাড়ি নিয়ে যাবে বলে। পরে অবস্থা বুঝে আমার প্রধান শিক্ষক মামা মাইলো রান্না না করেই বাড়িতে দিতে থাকেন। কত গরিব পরিবার যে মাইলো খেয়ে বেঁচেছে। ... ...
মনে পুরোনো দিনের কথা আসে। আমার কন্যা স্কুলে যাবে। তার ভবিষ্যত ভালো হবে, অনেক আশা নিয়ে বেসরকারী ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে তাকে ভর্তি করেছি। পড়ানোর অনেক খরচ। সকালে খুব তাড়াহুড়োয় স্কুল ব্যাগে বই গোছাতে বসি। রুটিনে আজ ভূগোল আছে দেখে স্কুল অ্যাটলাসটা ব্যাগে পুরে দিই। ... ...
হোস্টেলের মন্টুদা বিডিও হয়েছিল। গণিতের। দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে ইংরেজির নামী শিক্ষক। সদ্য অবসর নিল। প্রজিত পড়ায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাস। অনাথ ইংরেজিতে ভালো ছাত্র। আমার জীবনে বহু মানুষের অবদান। দেবাশিসদা আমার শক অ্যাবজরবার। অনাথ আমি খেতে না গেলে খাবার নিয়ে এসে থাকতো। আমি ওদের সঙ্গে খেতাম। টিউশন করে আমি পাঁচ লিটারের একটা হকিন্স প্রেসার কুকার কিনেছিলাম ১৯৮৪ তে। ২২০ টাকা দামে। কিস্তিতে। প্রথমে ৬০ টাকা তারপর প্রতি মাসে ২০ টাকা। ... ...
আমি ভূগোলের প্রেমে পড়েছিলাম পঞ্চম শ্রেণীতে, সেই যেবার নিবেদিতা ইস্কুলের ছোট বাড়ি মানে প্রাথমিক বিভাগ পেরিয়ে বড় বাড়িতে অর্থাৎ মাধ্যমিক বিভাগে এলাম। কাকলিদি ভূগোল পড়াতেন। সেই সময় প্রথম জানলাম ক্লাসের ঘণ্টা পড়লেই দিদি আসার আগে ব্ল্যাকবোর্ডের হুকে মানচিত্র টাঙিয়ে রাখতে হয়। আর ভূগোল ক্লাসে খাতা আনতে ভুলে গেলে তাও কোনোদিন ক্ষমা পেতেও পারি, কিন্তু চণ্ডীচরণের ম্যাপ বই না আনলে ক্ষমা নেই। ... ...
নদীর নাম ইছামতী। খুব বড় নদী নয়, খুব ছোটোও নয়; এপার ওপার দুপারই পরিষ্কার দেখা যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে এই শান্ত নদী মাতাল হয়ে উঠে। কালবৈশাখী ঝড়ে এর রূদ্র রূপ চমক লাগায়। বর্ষায় এ হয়ে উঠে ভয়ংকর – পাড়ের জমি ভেঙ্গে পড়ে নদীর বুকে, গাছপালা বাড়ী ঘর কারো রেহাই নেই। বসিরহাটে আমাদের বাড়ী ছিল এই নদীর ধারে। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়ীর সামনে বেশ বড় একটা বাগান, গাছ পালা ভর্তি। সেই বাগানে আমরা খেলাধুলা করতাম। বাগানের শেষে নদীর পাড়। প্রতি বছরই ইছামতী এই বাগানের ভাগ নিত একটু একটু করে। প্রতি বর্ষায় নদীর পাড় ভাঙত; ইছামতী গ্রাস করত জমি। নদীর ধারে একটা বকুল গাছ ছিল। গ্রীষ্ম কালে প্রচণ্ড গরমে গুমোট ঘরে থাকা যেত না; পড়ায় মন বসত না। সন্ধ্যাবেলা এই বকুল গাছের নীচে মাদুর বিছিয়ে হারিকেনের আলোতে পড়শুনা করতাম। নদীর ধারে মৃদু হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দিত --- কি অভাবনীয় প্রশান্তি! একদিন সকালে উঠে দেখি সেই বকুল গাছটার শিকড় উপড়ে গেছে; পদচ্যুত বৃক্ষ মুখ থুবড়ে ইছামতীর জলে পড়ে আছে। মনটা আমার খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। পরে সরকার নদীর পাড় বাঁধাবার কাজে উদ্যোগী হয়েছিল। ইছামতী করুণা করে আমদের বাড়ী গ্রাস করে নি; কিন্তু মানুষ করেছিল। মানুষের হাত থেকে আমরা রেহাই পাই নি। ... ...
আমার দাদুকে বেশ ভাল মনে আছে । দাদু দীর্ঘায়ু ছিলেন , এক শত বছর এ ধরাধামে জীবন কাটিয়ে দেহ রেখেছিলেন । দাদু ছিলেন সুপুরুষ এবং সৌখীন । আমি যখন দেখেছি বার্ধক্য তখন দাদুকে ছুঁয়েছে । ধবধবে ফর্সা পক্ককেশ কালোপাড় শান্তিপুরী ধুতি পাঞ্জাবীতে ভূষিত সেই মানুষটিকে দেখলে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে । মায়ের কাছে দাদুর গল্প শুনেছি । দাদুর যখন বয়স পনেরো-ষোল তখন পিতা আনন্দ মোহন পরলোকগমন করেন । দাদু বংশের জ্যেষ্ঠ সন্তান ও উত্তরাধিকারী । ভায়েরা সব অল্পবয়সী নাবালক । একান্নবর্তী পরিবারের দায় দায়িত্ত্ব ও রক্ষণাবেক্ষণের গুরুভার দাদুর উপরেই । সেই সঙ্গে জমিদারি ও তার তত্বাবধান । বিত্তবান অল্পবয়সী জমিদারের তথাকথিত শুভাকাঙ্ক্ষী ও উপদেস্টার অভাব হয় নি । আমাদের সে সময় কলকাতার ট্যাংরা অঞ্চলে একটি বড় বাগানবাড়ি ছিল । বাড়িটি প্রধানত: জমিদারের বিনোদনের জন্যই বব্যহৃত হত । মোসাহেবের অভাব ছিল না --- তাদের নিয়ে নাচ গান বাজনার আসর বসতো । সেই বাড়ি দেখাশুনাআর জন্য এক দম্পতি ছিল । বাবা তাদের বাগানের খুড়িমা বাগানের খুড়ো বলতেন । দাদুর সঙ্গে বেশী নগদ টাকা থাকত না । নাচ গানের আসরে বখশিস বা মুজরো দেওয়ার দরকার হলে বাগানের খুড়োর কাছ থেকে তৎক্ষণাৎ টাকা নিতেন । টাকা দিয়ে খুড়ো এক টুকরো কাগজ দিত এগিয়ে দাদুর দিকে । দাদু তখন আসরে মশগুল , সরল মনিবের মত সেই কাগজে সই করতেন । কিছুকাল পরে সেই বাগানের খুড়ো খুড়িমা বাগান বাড়িটা দখল করে নিল । অজুহাত দিয়েছিল দাদু নাকি অনেক টাকা ঋণ নিয়েছিলেন । প্রমান স্বরূপ তদের কাছে দাদুর সই করা কাগজগু্লো আছে । ... ...
কলকাতার রয়াল হোটেলে লোকে খুব শখ হলে বিরিয়ানি খেতে যায় বা নিউ মার্কেটে আমিনিয়ায়। রয়াল হোটেল তখন খুব নামী। সেখানে ত্রিশ টাকা প্লেট খাসির বিরিয়ানি। লোকে মাটন বিরিয়ানি বলতো না। চিকেন তখনও মুরগি ছিল। কথায় কথায় এত ইংরেজিয়ানা ছিল না। আমরা পরিকল্পনা করলাম, ত্রিশ টাকা দাম নিচ্ছে! হোস্টেলে তখন মিল চার্জ এক টাকা আশি পয়সা হলেই ধুন্ধুমার বেধে যায়। অডিট হয়। এত কী করে হলো? ... ...
অমলেন্দু বিশ্বাস সেই প্রজন্মের লোক যাদের সম্পর্কে ঠাট্টা করে বলা হতো যে তাঁদের জীবনের সংকল্প ছিল ‘আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন ওই দেশেতেই মরি’। কিন্তু ঠাট্টায় যেটা ধরা পড়ে না তা হলো এই জন্ম আর মৃত্যুর ঠিকানা আলাদা হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা সহজ নয়। যাঁরা এর মধ্যে দিয়ে গেছেন, এবং যাবার সময়ে ভেবেছেন যাওয়াটা কিরকম, কোথায় যাচ্ছি, যেতে যেতে আমার আমিটার কি হচ্ছে - তাঁদের নিজের জীবন সম্পর্কে লেখার, আমাদের জগতে, একটা বিশাল প্রয়োজন আছে। একশো বছর আগে যা লেখা হতো সেগুলো ইউরোপ যাত্রীর পত্র, বা স্বল্প প্রবাসের কথা, সে প্রবাস যে বাসিন্দা তার সত্তাকেই পরিবর্তিত করে দেয় না। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে এই প্রবাস অতি সাধারণ; অনেক সময় মনে হয় মধ্যবিত্ত ব্যক্তিদের জীবনের প্রথমটা এই প্রবাসেরই সুদূর ভূমিকা বা প্রস্তুতি। মনে রাখতে হয় অবশ্যই এই প্রবাসও পরিবর্তনশীল - ষাট-সত্তরের পাশ্চাত্য সমাজ এখনকার পাশ্চাত্য সমাজের মতো ছিল না; ষাট সত্তরের মধ্যবিত্ত বাঙালি সত্ত্বাও তার এখনকার অবতারের থেকে আলাদা ছিল। তার থেকেও বড়ো কথা, প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষ এই প্রবাসের ইতিহাসকে নিজের মতো করে তৈরী করে নেয়। এই সততভিন্নতার জন্যেই একজন ব্যক্তির এক বিশাল ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে যাত্রার কাহিনী আমাদের পড়তে ভালো লাগে। ... ...
গেরস্তের ঘরে ধান উঠচে, ঘরে ঘরে আমোদ আল্লাদ। বরের গলা জড়িয়ে নতুন পুরনো সব বউয়ের বায়না, এবার কিন্তু ওই গয়না/ শাড়িটা দিতে হবে। কতা দিয়েচো, ধান উটলে। ছেলে মেয়েরা খুশি। পরীক্ষা শেষ। যত খুশি খেলো। লুকোচুরি খেলার আদর্শ সময়। খামারে খামারে ধানের খড়ের, কুটির মেলা। লুকনো সোজা। তারপর সাঁঝবেলায় বাড়ি থেকে এটা সেটা এনে নিজেরাই রেঁধে বেড়ে ফিস্টি। ... ...