সত্তর আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় যাত্রা প্রতিযোগিতা হতো। বাবার কাছে নানা যাত্রার বই আসতো। 'বেগম আসমান তারা'য় দেড় পাতা ব্যাপী একটা সংলাপ ছিল। কী অসম্ভব গভীর অথচ কাব্যিক উচ্চারণ। আমার মতো কিছু তরুণ তখন এইসব মুখস্থ করার চেষ্টা করতো। যাত্রা প্রতিযোগিতা শুনে মনে পড়ল, শ্যামসুন্দর আর নাড়ুগ্রামের মাঝখানে দেবীবরপুর গ্রামে দিনের বেলায় যাত্রা হতো। কেন? সেটা জানতে হবে। আমাদের স্কুলের এক সহপাঠী সেলিম সেদিন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লিখল, রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়ায় দিনে যাত্রা হয়েছে বাদুলিয়ায়। ... ...
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম জঙ্গলের চারটে স্তর। জঙ্গলের মেঝে আগাছায় ভর্তি। এটা হলো প্রথম স্তর। তার ওপরে মাঝারি উচ্চতার গাছ। সেটা হলো দ্বিতীয় স্তর। একেবারে ওপরে আছে অনেক উঁচু উঁচু গাছের সারি। সেটা হলো তৃতীয় স্তর। আর এই তিন স্তরকেই জড়িয়ে আছে নানা রকম লতাপাতা আর অর্কিড। সেটা হলো চতুর্থ স্তর। ... ...
কথাবার্তা শুরু হল। বেশীরভাগই কম্পিউটার বিষয়ক, উন্নয়ন ও পরিবর্তনের গতি, ভবিষ্যতে কি হবে বা হতে পারে ইত্যাদি। প্রফেসর অত্যন্ত ভদ্রলোক, সদালাপী, কথা বলতে ভালোবাসেন। ড্রিঙ্ক ও স্ন্যাক্সের সঙ্গে গল্প কথায় মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম। সব মিলে বেশ ভালো লাগছিলো, নরম পরিবেশ, শিথিল চিন্তাহীন মস্তিষ্ক। হালকা আমেজে ভরেছে মন। “শ্যাল আই গেট ইয়ু এনাদার ড্রিঙ্ক।“ গ্লাসের উপর হাত রেখে বললাম, আর না, এবার উঠব। আচমকা হঠাৎ প্রোফেসর কালিজুরি জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা খাম বার করে আমার হাতে দিল। এতক্ষণ পরে কাজের কথা, বুঝলাম কি উদ্দেশ্যে এই মিটিং। বলল, “দেখো, তুমি যা যা চেয়েছিলে তা সব আছে এখানে। সই করে দাও।” আমি অবাক। কন্ট্রাক্ট পড়ে দেখি, সত্যি তাই। একটু চিন্তা করে বললাম, “আমি আমার ওয়াইফ-র সঙ্গে কথা না বলে সই করতে পারব না।" প্রফেসর বলল, “আর সময় নেই, কাল ভোরেই আমি চলে যাচ্ছি। এখন সই না করলে আর হবে না।” প্রফেসর নাছোড়বান্দা। ... ...
তখনো আই সি এল পুরোপুরি ভারতীয়করণ হয়নি। আই সি এল-স্বার্থ লন্ডনের হেড অফিসই দেখাশুনা করত। ভারতীয়করণের পর একদিন ভারতবর্ষের আই সি এল স্বাধীন হল। ম্যানেজমেন্ট সব ভারতীয়, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এক পার্সী ইঞ্জিনীয়ার, প্রেম শিবদাসানী। কিন্তু লন্ডন আই সি এল তখনও ভারতীয় ব্যবসায়ের বড় অংশীদার এবং ভারতীয় আই সি এল দেখাশুনা করে। লন্ডনে আই সি এল-র ইন্ডিয়া অফিসের ডাইরেক্টর মিঃ জ্যাকসন। ইন্ডিয়া অফিস বা ইন্ডিয়া ট্রেডিং-র ম্যানেজার অমলেন্দু বিশ্বাস, আমি। এই পদের ক্ষমতা বেশি ছিল না কিন্তু মর্যাদা ছিল অনেক। সেই সঙ্গে ছিল অনেক দায়িত্ব ও কাজ। দুই দেশের ব্যবসায়িক আদান প্রদান এই অফিস তথা আমার মাধ্যমেই হত। ... ...
আসলে আমাদের সামনে তেমন ভালো এবং নিয়মিত পাঠচক্র ছিল না। কয়েক বছরের ব্যবধানে একটা দুদিন বা তিনদিনের রাজনৈতিক ক্লাস হতো। তাতে বক্তারা মিনিট পনেরো পরই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এইসব ছেড়ে সহজ টার্গেট কংগ্রেসে চলে যেতেন। তবে বিনয় কোঙার আধ ঘণ্টা পর্যন্ত বিষয়ে ছিলেন। আর একটা উপকার করেছিলেন, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে। পড়ি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা নীললোহিত খুব টানতো। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভালো লাগে, বলা অন্যায় মনে হতো। নয়ের দশকের শুরুতে সুভাষ চক্রবর্তী টাউন হল ময়দানের এক সমাবেশে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যরচনার খুব প্রশংসা করলেন। মনোভাব বদলাল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ছিল খুবই প্রিয়। যেকোনো প্রতিযোগিতায় তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো। আমি এই বই, শিবনারায়ণ রায়ের বই, একাধিক সংখ্যায় পেয়েছি। যদিও এই দুজন ছিলেন পার্টিতে অপ্রিয়। ... ...
মধুসূদনের প্ল্যান অনুযায়ী মাদারিহাটে সমীক্ষা ও জরিপের ফাঁকে একদিনের আধবেলা রাখা হয়েছিল জলদাপাড়ার জঙ্গল ঘোরার জন্য। ঠিক একমাস আগে এই অরণ্যে এসেছিলাম বাড়ির লোকের সঙ্গে। সেবার হাতির পিঠে চড়ে ঘুরেছিলাম। কিন্তু এবারে আর হাতি সাফারি নয়, জিপে করে ঘোরা। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষিকা সব মিলিয়ে দলের সদস্য একচল্লিশ। একদিনে ভোর থেকে তিনবার হাতি সাফারি হত তখন। তখন মানে সালটা ২০১৮। ... ...
একদিন সন্ধ্যায় আমার শ্বশুর মহাশয়ের মৃত্যুর খবর এল। অনু কান্নাকাটি করছে, আমার মনটাও ভারাক্রান্ত। পর দিন সকালে অফিসে গেছি– মুখে একটা বিষাদের ছায়া আছে যা লুকানো যায় না। মিস্টার ফ্রেন্ড প্রতিদিন সকালে সকলকে “গুড মর্নিং” করেন, সেদিনও করলেন। আমার ডেস্কের কাছে এসে একটু দাঁড়িয়ে বললেন, “কী হয়েছে তোমার? মুখটা এত শুকনো কেন?” আমি বললাম কী হয়েছে। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তারপরে দুঃখ প্রকাশ করে চলে গেলেন। লাঞ্চের পর তিনি আবার এলেন আমার কাছে। বললেন, তিনি আমার স্ত্রী ও দুই পুত্রের জন্য তিনটি টিকিটের ব্যবস্থা করেছেন, কলকাতা যাওয়ার জন্য। বলা বাহুল্য এর জন্য আমায় কোনো মূল্য দিতে হবে না। সে যুগে সদ্য-আসা আমার মতো কোনো বঙ্গসন্তানের তিনটি টিকিট কেনার মতো সামর্থ্য থাকত না। খবরটা শুনে আমার চোখে প্রায় জল আসে। কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাবো তা ভেবে পেলাম না। ভারি গলায় শুধু বললাম, “থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার ফ্রেন্ড।” আশ্চর্য মানুষ! নতুন কাজে আমার তখনও ছ’মাস হয়নি সুতরাং আমার কোনো ছুটি নেই। অনুকে তাই দুটি ছেলেকে নিয়ে একাই যেতে হবে। ... ...
ইন্দিরার জেল হল কদিনের জন্য। এবং এই ঘটনাই মানুষের মধ্যে সহানুভূতির বান ডাকল। তার কিছুদিন আগে, আমিও পোস্টার মেরেছি, স্বৈরাচারী ইন্দিরা গান্ধীর শাস্তি চাই। সেটা মারতে দেখে আমার কংগ্রেস নেতা বড় মামা বলেন, বড়ভাই ম্যাট্রিক পাস করেছে, এটা তাও করবে না। বাপের মতো পার্টি করে বেড়াবে। এবং আমার প্রিয় বন্ধু বড় মামার বড় ছেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল, মেশা যাবে না। এতে ফল উল্টো হল। আমার মামাতো ভাই বাবাকে খুব ভয় পেলেও মনে মনে এবং কাজে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক হয়ে গেল। এবং এতে ক্ষুব্ধ বড় মামা মেরে পা ভেঙ্গে দিলে সে ১৯৭৮ এ পঞ্চায়েত ভোটের দিন মামার প্রিয় বন্ধু কংগ্রেস প্রার্থীর বিরুদ্ধে আমাদের বুথে সারাদিন বসে রইল। ইতিহাস আশ্চর্য। ... ...
বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি সারা হল। বেশি জিনিসপত্র নেওয়ার ইচ্ছা নেই – আমার কিছু নেইও। দু-একটা শীতের জামাকাপড় আর আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। একটা বড় স্টিলের ট্রাঙ্ক আর আমার বন্ধুদের দেওয়া সেই স্যুটকেস। অনু বলল ওর হারমোনিয়াম আর তানপুরাও নিতে হবে। বুবাই তখন একেবারে শিশু। বললাম, এত সব আমি সামলাব কী করে? অনু বলল, তানপুরা আর হারমোনিয়াম না নিয়ে গেলে ও-ও যাবে না। বুঝলাম হারমোনিয়াম-তানপুরা ছাড়া ও স্বর্গে যেতেও রাজি নয়। সুতরাং একরাশি গানের খাতা, বই আর তানপুরা, হারমোনিয়ামও আমাদের সঙ্গী হল। ... ...
নতুন দেশ, নতুন জীবন। আবার সব প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। জীবন ধারণের জন্য অর্থ উপার্জন, আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণ, মা-ভাই-বোনদের সংসারের চিন্তা -আমার সমস্ত সময় ও শক্তি লুটে নিয়েছিল। দেশের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেল। তবু মাঝে মাঝে দু-একজনের চিঠি পেতাম। আর দেশে গেলে দেখা হতো। শুধু দীপু একমাত্র ব্যতিক্রম। চিঠি, টেলিফোন ও নিয়মিত সাক্ষাৎকার মিলিয়ে আমাদের হৃদ্যতা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকল যা জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসেও অটুট আছে। দীপুকে প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। দেশ ছাড়ার পর দেশে যাইনি অনেক বছর। ও কেমন আছে, কী করছে কিছু ভালো করে জানতাম না। কফি হাউসের সেই অনার্সের বই বিক্রি করার ঘটনার পর দীপুর বিষয়ে কোনো সঠিক ধারণা ছিল না। কিছুদিন পরে শুনেছিলাম দীপু বাচ্চুকে (রীণা) বিয়ে করেছে। ... ...
চুনিয়া নদীর নুড়ির উপর অনেক ময়ুর নাচছে। ছেলেমেয়েরা ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নদী পেরিয়ে এইবার একটা এবড়ো খেবড়ো বনবিভাগের রাস্তা পাওয়া যায়। রাস্তা ধরে চলেছি চুনিয়াবস্তি ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। কাছাকাছি ভুটান বস্তি এলাকায় হিমালয়ের গা সাত রঙে রঙীন। ওখানে আগে পিকনিক হত। কিন্তু হৈ হল্লা, প্লাস্টিক দূষণের কারণে বনদপ্তর সেসব বন্ধ করে দিয়েছে। খুব ভালোই করেছে। ... ...
আমরা তখন রোমান্টিক শব্দ শুনেছি। রোমান্টিকতা মানে যে নিজের মনের বাইরে আরেকটি গুহামন তৈরি-- জানতাম না। রোমান্টিক রিভাইভাল এইসব শব্দবন্ধও শুনিনি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স পরস্পরের শত্রু এটা ভেবে বেঁচে থাকার বিরোধী তাও জানতাম না। ফ্রান্সের বিপ্লবকে সম্মান জানিয়ে লিখেছেন 'সলিটারি রিপার' কবিতা, তাও অজানা। ... ...
ইতিমধ্যে ভারতীয়করণের ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর পরিচালনা ভারতীয়দের হাতে চলে আসে। (এ বিষয়ে আমি অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করেছি)। সেদিনের বাংলায় বড় বড় বিদেশি কোম্পানিদের মধ্যে ছিল জেসপ, ডানলপ, জি কে এন, ব্রেথওয়েট, বার্ড এন্ড কো প্রমুখ সংস্থাগুলি। নানা কারণে সেই সময়ে টিটাগড় ও বাংলার জুটমিলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ভারতীয় শিল্পপতিরা সেগুলো কিনে নিচ্ছিল। সেই জুটমিলগুলো রূপান্তরিত হয়ে অন্য পণ্য উৎপাদন করতে শুরু করেছিল। এইরকম একটা রূপান্তরিত জুটমিলের নতুন মালিকেরা এক ইংরেজ কোম্পানির কোলাবোরেশনে সেখানে স্প্রিং ও নানা রকম ওজনের যন্ত্র নির্মাণ শুরু করল। সে কোম্পানি জর্জ সল্টার। এই কোম্পানির এক গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করতাম আমি। আমি তাই খুব কাছ থেকে অনেক কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। ... ...
সেটা বোধ হয় ১৯৫৮ সাল। ঠিক মনে নেই, দু এক বছর এদিক ওদিক হতে পারে। মহম্মদ আলি পার্কে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের বিরাট আয়োজন। বোধহয় তৃতীয় দিন। সে দিন এক দুর্ঘটনা ঘটল। সারা প্যান্ডেল আগুনের গ্রাসে ধুলিসাৎ হয়ে গেল। কর্মকর্তাদের মাথায় হাত। আবার নতুন করে সাজাতে হবে সব- প্রচুর অর্থেরও প্রয়োজন। একটা আকর্ষণীয় কিছু করা দরকার যা সেই সময় অভাবনীয় এবং অর্থাগমের উপায় হবে। ওঁরা শিশির ভাদুড়ীর দ্বারস্থ হলেন। ভাদুড়ী মহাশয় তখন বৃদ্ধ- অভিনয় প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন, স্টেজে নামেননি অনেক কাল। ওঁদের অনুরোধে রাজী হলেন। কাগজে খবরটা দেখে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। শিশিরবাবুর কথা এত পড়েছি এত নাম শুনেছি। নিউ ইয়র্কে সীতা নাটক করে সাড়া ফেলেছিলেন। কিন্তু ওঁর অভিনয় কখনো দেখিনি। নিজের চোখে শিশির বাবুকে দেখব, নিজের কানে শিশির বাবুর কন্ঠস্বর শুনব সে তো ভাবতেই পারিনি। এমন লোভ সামলাতে পারলাম না। ... ...
কলকাতা থেকে, মধ্যবয়স্ক এক শৌখিন অ্যাডভোকেট একবার সস্ত্রীক বক্সা জয়ন্তী বেড়াতে আসেন। দুদিন ঘোরার পরে, তাঁর তরুণী প্রগলভা স্ত্রী মুকুলকে বলেন তোমাদের জঙ্গল ফালতু, একটাও জন্তু দেখা যায়না। কথাটা মুকুলের আঁতে লাগে। সে বোঝানোর চেষ্টা করে, জন্তুরা আড়ালে থাকতে পছন্দ করে, তাদের কথা বেশি না ভেবে ঘন গাছপালা, যারা আশ্রয় দেয়, অক্সিজেন দেয়, তাদের সঙ্গ উপভোগ করুণ। তরুণী সে কথায় আমল না দিয়ে তর্ক চালিয়ে যান। ... ...
সারাদিনের অতিরিক্ত পরিশ্রমে যাত্রা শুরু হওয়ার কিছু পরেই চোখ খুলে রাখা দায় হতো। বড়দের বলে রাখতাম, যুদ্ধের দৃশ্য, আমাদের ভাষায়, সিন, এলেই জাগিয়ে দিতে। কেরিচু কেরিচু ক্যাঁ বলে একটা বাজনা বাজতো। আর তলোয়ার নিয়ে সে কী লড়াই। একটু পড়তে পারার পর থেকেই যাত্রার বইগুলো আমার মুখস্থ হয়ে যেতো। কোন বই ( যাত্রা) এবার ধরা হবে, সে-নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে যেত মাঘ মাসের যাত্রা শেষ হওয়ার পরদিন থেকেই। কিন্তু মহলা সেই আশ্বিন কার্তিক মাসে। তার আগে কত পালা দেখা পড়া চলতো। বই পড়া আর তার সঙ্গে রোজ সন্ধ্যায় মহলা দেখা-- এই নিয়ে বই তো মুখস্থ হবেই। ... ...
আমি আমার ভাগ্যের কেরামতি দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। হঠাৎ কোথাও কিছু নেই কে এক বন্ধু ফোন করে খবর দিল এবং একটা নতুন চাকরি জুটলো। ভাগ্যের মোড় ফিরলো। অথচ এতদিন ধরে কত চেষ্টা করেছি কত ইন্টারভিউ দিয়েছি কিন্তু কোথাও কিছু হয়নি। আমেরিকান রেফ্রিজারেটরও ঠিক এমনি করে হঠাৎ চাকরি পেয়েছিলাম। বাবা তাঁর মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়নি। ঘটনা ক্রমে দেখা হলো তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি তখন বেড়াতে বেরোচ্ছিলেন, আমিও তাই ওঁর সঙ্গে রাস্তায় নামলাম। পথে পড়ল তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি যিনি আমেরিকান রেফ্রিজারেটররের ম্যানেজার। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তারপর চাকরি হয়ে গেল। ইন্ডিয়া ফয়েলসের চাকরিও প্রায় একই ভাবে তেমনি করে। আমি তখন কলকাতার বহুবাজার অঞ্চলে ক্ষেত্রদাস লেনে এক মেস বাড়িতে থাকি। আমাদের রাস্তা পেরিয়ে দু’পা হাঁটলেই ছোট মামার চেম্বার। ... ...
একপাশে দেখলাম বসার জায়গা করা আছে। তার ধারে পুজোর বেদী, কিছু ঘিয়ের প্রদীপ। ধাপ কাটা বেদীটি বৌদ্ধ ভক্তদের পুজোর জন্য। প্রতি বুদ্ধ পূর্ণিমায় ভক্তরা আসেন। আর ত্রিশূল দিয়ে সাজানো বেদীটি হিন্দুদের জন্য। সেখানে হর পার্বতী - পুরুষ/প্রকৃতির পুজো হয় মাঘী পূর্ণিমায়। কিন্তু কী এমন মাহাত্ম্য আছে এই জলাশয়ের যে এই দুর্গম অঞ্চলে আজও মানুষ পাহাড় ডিঙিয়ে আসেন! ... ...
চাকুরীর সন্ধানে আসানসোলে গিয়েছিলাম। তখন আলাপ হল। এই পাঁচ বছরে সম্বন্ধটা আরো গভীর হয়েছে, সহজ হয়েছে। অনেকদিন থেকে ভেবেছি ওর কথা লিখে রাখবো। কেননা আমার জীবনের অনেকখানি, বিশেষ করে চরমতম ট্রাজেডি ও হতাশার সেই দিনগুলোতে ও আমাকে জুগিয়েছে অনেক কিছু --- সাহসের মতো দুর্লভ কিছু, সাহচর্যের মতো ভরাট কিছু এবং অত্যন্ত স্থুল কিন্তু সেকালে নিতান্ত প্রয়োজনীয় যা সেই-- অভাবে অর্থ সাহায্য। লিখবো লিখবো করেও লেখা হয়নি। প্রত্যেকবার ভেবেছি ধীরে সুস্থে, প্রচুর সময় নিয়ে খুঁটিনাটি সবকিছু লিখে রাখবো। শুধু ঘটনা নয় আমার মানসিক চিন্তার সব আলোড়ন, স্থিতি এবং টানাপড়েন। কিন্তু লেখা হয়ে ওঠেনি। যেহেতু সেই সুস্থতা ও সময় কখনো পাইনি। আজও লেখা হবে না সবটুকু। তবু সূচনাটুকু লিখে রাখি, কি জানি আর যদি কখনো সময় না পাই, তবে হয়তো লেখাই হবে না কোনদিন। অন্তত এই মুখবন্ধ টুকুই আমাদের পরিচয়ের অভিজ্ঞান হয়ে থাকবে, ভবিষ্যতে যদি কখনো লেখা নাই হয় আর। ... ...