জলপথে ডোভার থেকে ক্যালের দূরত্ব তিরিশ কিলোমিটার। ফ্রান্সের বাড়ি যাবার সময়ে গাড়ি সহ চ্যানেল টানেল দিয়ে সাগর পার হতে লাগে ৩৫ মিনিট। কোন উজ্জ্বল দিনে ফ্রান্সের কাপ গ্রি নেজ থেকে ডোভারের ঝকঝকে হোয়াইট ক্লিফস দেখে ভেবেছি, এই তো এতো কাছে ! দুই দেশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব এখানে সবচেয়ে কম, রোমেল সহ অনেক জার্মান জেনারেল ধরে নিয়েছিলেন আক্রমণ আসবে অন্য কোথা নয়,এই পা দে ক্যালেতে। এরউইন রোমেল একদিন এইখানে দাঁড়িয়ে তাঁর বাইনোকুলার বাগিয়ে ইংল্যান্ডের দিকে চেয়েছিলেন – ভেবেছিলেন এই শান্ত সমুদ্রের ওপারে হয়তো তৈরি হচ্ছে কোন মারণ ফৌজ? তিনি বলেছিলেন, যেদিন শত্রু এই জলসীমা পার হয়ে তার হাওয়াই জাহাজ ও নৌ বহর নিয়ে ইউরোপীয় মূল ভূখণ্ডের কিনারায় আক্রমণ শুরু করবে, সেই দিন, সেই প্রথম চব্বিশ ঘণ্টা হবে আমাদের জার্মানদের ও শত্রু সৈন্যের পক্ষে সমান গুরুত্বপূর্ণ, নির্ণায়ক দিন, কেননা সেটাই হবে দীর্ঘতম দিন, দি লংগেস্ট ডে (ডের লেঙ্গস্টে টাগ, যা থেকে প্রযোজক ডারিল এফ জানুক তাঁর ছবির নাম রাখেন)। ... ...
রিমিনি থেকে ইমোলার ট্রেন নন স্টপ নয়, পঞ্চাশ মিনিটে আটটা স্টেশনে থামে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাভিনানো সুল রুবিকোনে, এখানেই কোথাও সিজার সেই নদীটি পার হয়ে রোমান রিপাবলিকে তুলকালাম বাধিয়েছিলেন। ইমোলা স্টেশন দেখে হতাশ হলাম। বোলপুর তার তিনগুন বড়ো। টেলিভিশনে আহরিত তথ্য অনুযায়ী দিনো এ এনজো ফেরারি ইপোদ্রোমে প্রায় এক লক্ষ দর্শক বসতে পারেন তবে স্টেশন এত ছোট কেন? কারণ শহরটি খুবই ছোট, মাত্র সত্তর হাজার লোকের বাস; বছরে তিন দিন লোকে লোকারণ্য হয় মাত্র! ... ...
আজ রিমিনিতে যেখানে উত্তর-দক্ষিণ পথ (কারদো) আর পূর্ব-পশ্চিম পথ (দেকামেনুস) এসে মিলেছে, সেখানে ছিল আরিমিনুম শহরের রোমান ফোরাম। রুবিকন পেরিয়ে সিজার তাঁর ফৌজ সহ ঘণ্টা দেড়েক বাদে সেইখানে পৌঁছুলেন। তিনি জানতেন রোমের আইন তিনি একা ভাঙেননি, তাঁর সঙ্গে ছ-হাজার লিজিওনেয়ার রোমের চোখে সেই একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে। রোমের শপথ নিয়ে তাঁরা সৈন্য বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, এবার সিজারের সাথি হয়ে রোমের বিরুদ্ধেই বিশ্বাসঘাতকতা করবেন (আমাদের আজাদ হিন্দ ফৌজের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল)। সেদিন আরিমিনুম ফোরামে পৌঁছে একটি প্রস্তরখণ্ডের ওপরে দাঁড়িয়ে তাঁর লিজিয়নকে সম্বোধিত করে বলেছিলেন, আমাদের অভিযান রোমের পানে, গৃহ যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী কিন্তু আমরা বিজয়ী হবো। ... ...
হঠাৎ একদিন কিছু বদলাতে শুরু করল। ১৯৭৯ সালে জুলিয়ানো গ্রামের কিছু উদ্যোগী মানুষ একটি মেলার আয়োজন করলেন। কোনও খোলা মাঠে নয়, সেটি বসবে এই গ্রামের গলিতে, বাসিন্দারা তাঁদের ঘরের দুয়োর খুলে দেবেন। ভালোবাসা এবং সাদর অভ্যর্থনা ছাড়া দেওয়ার কিছু নেই, তবে হাতে হাতে বানাবেন পাস্তা, পিৎজা, গ্লাসে ভরে দেবেন কিয়ান্তি। একেই আজকাল স্ট্রিটফেয়ার বলে। রিমিনির সভ্য মানুষজন সেতু পেরিয়ে এই অবধি আসতে কুণ্ঠিত হয়েছিলেন; দিনে ডাকাতি না হোক পকেটমারের অভাব কি! সব দুশ্চিন্তা কাটিয়ে আগস্ট মাসের এক উজ্জ্বল দিনে দেখা গেল সান জুলিয়ানোর অলিতে গলিতে সুখী জনতার ভিড়, শিশুদের কলরব। গ্রামের লোকেরা যে যেখানে পেরেছেন দুটো চেয়ার পেতে দশজন মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যদি হও সুজন তেঁতুল পাতায় কত জন! ... ...
যাত্রার উদ্দেশ্য যাই হয়ে থাক না কেন, রিমিনি শুধু সান মারিনো পৌঁছানোর পথের হাওড়া স্টেশন নয়। তার ইতিহাস দু হাজার বছরের বেশি পুরনো, আদ্রিয়াতিকের কূলে রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্য বন্দর। সাম্রাজ্যের উত্তরাপথ মিশে যায় দক্ষিণাপথের সঙ্গে। সেই সম্মানে তৈরি হয়েছিল সম্রাট আগাস্টাসের তোরণ, সেখান থেকে শহরের মাখখান দিয়ে চলে যায় করসো দা’ গুসটো, শেষ হয় টিবেরিয়াসের পাঁচ খিলানের সেতু পেরিয়ে। ... ...
চার দশক আগে প্রথমবার বার্সেলোনা আসি তার সত্তর কিলোমিটার উত্তরে কাতালুনিয়ার বিচ রিসর্ট ইওরেত দে মার হতে। ইংল্যান্ডে বুক করা স্প্যানিশ প্যাকেজ হলিডে - আহা কি দিন ছিলো, আমাদের টাকায় আসা যাওয়া দু সপ্তাহ থাকা খাওয়া সহ খরচ মাথা পিছু পাঁচ হাজার টাকা, তার সঙ্গে কিছু বাড়তি ব্যয়ে সাইট সিইং - যেমন বার্সেলোনার বাস ট্রিপ, সে অনেক রুক্ষ পাহাড় পেরিয়ে। ... ...
জাদুঘরে নয়, আন্তনি গাউদি প্রকৃতি, আলো এবং ঈশ্বরকে নিয়ে তাঁর খেলাঘর, তাঁর বৈঠকখানা সাজিয়ে রেখেছেন বার্সেলোনায়; দেখি তাঁর হাতে গড়া বাড়ি, তরঙ্গের মতন ব্যালকনি, ছাদে চীনেমাটির গোল চিমনি, বারান্দার ধাতব রেলিংকে মনে হয় নধর, পেলব, কোমল; যেন অবহেলে এক শিল্পীর আঙ্গুলের মোচড়ে টানা, সিঁড়ি আমাদের একতলা থেকে দোতলা নয়, নিয়ে যায় এক অলৌকিক উচ্চতায়, বসার ঘর অবারিত আলোকের ঝরনাধারায় ভেসে যায় না, আলোর বর্শা আসে কোনাকুনি বল্লমের ফলার মতো, আবিষ্কার করে গৃহকোণের গহন গৌরব। ... ...
লন্ডনের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক লোন সিন্ডিকেশন বিভাগের অধিপতিদের মাসে একবার সমবেত হয়ে গল্প-গুজব মতান্তরে পারস্পরিক এস্পিওনাজ করার জন্য একটি আনঅফিশিয়াল সংস্থান দীর্ঘদিন যাবত ধুনো জ্বালিয়ে রেখেছে, যার নাম সিন্ডিকেট ম্যানেজার’স ফোরাম। আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হতো পালা করে এ মাসে এক ব্যাঙ্কের অফিসে পরের মাসে আরেক ব্যাঙ্কের খাবার ঘরে। যে বার যাদের ব্যাঙ্কে মিটিং তারা সেদিন আমাদের বরযাত্রী সুলভ আদর আপ্যায়ন করতো, দেখে শুনে হাম ভি কম নহি বলে একাধিকবার আমাদের বোর্ড ডিরেক্টরদেরও হাজির করেছি! এই এ বাড়ি ও বাড়ি আসা যাওয়ার ব্যাপারটা ক্লান্তিকর হয়ে গেলে একবার স্থির হলো আমাদের একটা আউটিং হোক, দূরে কোথাও চলে যাই। স্যান্ট্যান্ডার ব্যাঙ্কের আউসিন্দে বললে, “চলো বার্সেলোনা!” গৌরি সেনের পয়সায় দু’দিন চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে, সেই সঙ্গে শহর ঘুরে দেখা। ততদিনে আমার বার্সেলোনা বার তিনেক ঘোরা হয়ে গেছে। তাতে কি, এক গুনাহ আউর সহি! ... ...
মধ্যযুগীয় ডাবলিন দেওয়াল সীমার বাইরে, লিবার্টিজের প্রায় লাগোয়া ফিনিক্স পার্ক আয়তনে নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কের ডবল, কলকাতার ফুসফুস গড়ের মাঠের তিন গুণ, লন্ডন হাইড পার্কের পাঁচগুণ বড়ো। এগারো কিলোমিটারের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা পরিসীমার ভেতরে এই ফিনিক্স পার্কের কোন তুলনা ইউরোপে নেই। কোথাও নাগরিক জীবনের মাঝখানে এমন সবুজের সৌরভ দেখিনি; এটি একাধারে নেচার পার্ক, বনস্থলী, এখানে দিগন্ত বিস্তৃত শান্তি, প্রসন্ন উদার। কোথাও ফুটবল রাগবির গোল পোস্ট দেখবেন না, হাঁটতে পারেন এ মুড়ো হতে ও মুড়ো (ঘণ্টা তিনেক লাগে) দিনে রাতে যখন খুশি। হরিণের আনাগোনা আছে, সাক্ষাৎ হবে পথে, লন্ডনের রিচমন্ড পার্কের মতো। এই শান্ত নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে বোঝার উপায় নেই মাত্র দশ মিনিট দূরে রাজধানী ডাবলিনের জন ও যানযাত্রা চলছে অবিরাম। পার্ক মানে সবুজ উদ্যান, সেখানে কোন পাকা বাড়ি বানানো সাধারণত বারণ; যেমন আমাদের কলকাতা ময়দানে যত দূর জানি ইট পাথর গাঁথা যায় না (আমার সময়ে তাই ছিল), ইউরোপের পার্কেও মোটামুটি একই নিয়ম। লন্ডনের হাইড পার্কের ভেতরে পাকা বাড়ি নেই কিন্তু সেই একই ইংরেজ প্রভু তাদের উপনিবেশে অন্য আইন জারি করে ফিনিক্স পার্কের মাঝে বানিয়েছিল দুটি বিশাল বাস ভবন; একটি তাদের রাজশক্তির প্রতিভূ ব্রিটিশ লেফটেন্যান্টের স্থায়ী বসতবাড়ি অন্যটি ব্রিটিশ চিফ সেক্রেটারির। এই কলোনির দুই প্রধান পরিচালক শলা পরামর্শ করেছেন একত্রে। ব্রিটিশ লেফটেন্যান্টের বাড়িটি এখন আইরিশ রাষ্ট্রপতির সরকারি আবাস (যেমন আমাদের ময়দানের একধারে গভর্নর জেনারালের অট্টালিকা এখন রাজ্যপালের বাড়ি)। ব্রিটিশ চিফ সেক্রেটারির সাবেক বাসভবনটি বর্তমানে এ দেশের আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের আবাস। তার হয়তো একান্ত ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আছে – আমেরিকার দু ডজন প্রেসিডেন্টের বাপ ঠাকুরদা বা ঊর্ধ্বতন কোন পুরুষ একদা আয়ারল্যান্ড থেকে ভাগ্যের সন্ধানে নতুন মহাদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। আইরিশ হেরিটেজ সম্বলিত রাষ্ট্রপতির তালিকাটি দীর্ঘ - যেমন ইউলিসিস গ্রান্ট, অ্যান্ড্রু জ্যাকসন, উড্রো উইলসন, হ্যারি ট্রুম্যান, জন কেনেডি, লিন্ডন জনসন, রিচার্ড নিক্সন, জেরাল্ড ফোর্ড, জিমি কার্টার, রোনাল্ড রেগান, বুশ পরিবার, জো বাইডেন। এই ছোট দ্বীপ থেকে গিয়ে আইরিশরা আমেরিকাকে দিয়েছে কেবল তাদের মুখের বুলি নয়, বহু রাষ্ট্রপতিও । ... ...
ডাবলিনের কেন্দ্রস্থল, স্টিফেন্স গ্রিনের অদূরে দেশের প্রাচীনতম বিদ্যায়তন ট্রিনিটি কলেজের ক্যাম্পাসটি বিশাল, সেখানে একটি কলেজ। আমার মতন মানুষের অহেতুক কৌতূহল মেটানোর জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি সুবন্দোবস্ত করেছেন। জুন-জুলাই-আগস্ট এই তিন মাস কিছু দক্ষিণার বিনিময়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে রাত্রিবাস করা যায়, রীতিমত বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট, যার নামই হল ফুল আইরিশ ব্রেকফাস্ট (ডিম, সসেজ, মাশরুম, টমেটো, ব্ল্যাক পুডিং, প্রচুর আলু এমনকি আলুর পিঠে বা প্যানকেক)! জানলা খুললেই সবুজ লন, পাথর বাঁধানো চত্বর, ট্রিনিটি কলেজের নানান ফ্যাকাল্টির ঐতিহাসিক বাড়ি, বেল টাওয়ার (কাম্পানিলে)। মনে হয় এই বুঝি ঘণ্টা পড়বে, পণ্ডিত মশায়ের ক্লাস, নর, নরৌ, নরাঃ। ... ...
শনের সাহচর্যে ডাবলিনে গিয়ে দেখলাম দুশ বছর আগেই প্রখর আইরিশ মেধা এই সঙ্কটের সমাধান করে ফেলেছে; যেমন কোনো পাবের লম্বা বার একাধিক ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত, আপনার সামনে সুধাভাণ্ডের সমারোহ সমেত বারটেন্ডার, কিন্তু আপনার দু পাশে পাতলা কাঠের আবরণ, পেছনে স্বতন্ত্র দ্বার বা পর্দা; আপনাকে বা আপনার সহচর /সহচরীকে তাবৎ জনতা দেখতে পাচ্ছে না, আপনি তাদের কলকণ্ঠ শুনছেন। যে স্নাগের প্রশংসায় শন পঞ্চমুখ, সেটি বার থেকে এক পা দূরের ছোটখাটো কেবিন, যেখানে আপনি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বসে সান্ধ্য আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, একপাশে একটি খোপের ভেতর দিয়ে বার টেন্ডার আপনার ইচ্ছা জানতে চাইবে এবং তদনুযায়ী বিয়ার পৌঁছে দেবে, কখনোই পর্দা ঠেলে আপনার আড্ডায় ঢুকে বলবে না, এই যে আর কি চাইলেন? ... ...
ইতালিয়ান বৈজ্ঞানিক আসকানিনো সবরেরো নাইট্রো গ্লিসারিন নামক বিস্ফোরক পদার্থের বিধ্বংসী শক্তির বিষয়ে অবগত ছিলেন কিন্তু একে পোষ মানিয়ে সঠিক ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে পারেননি। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং ততজনিত প্রাণহানির পরে আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল সেটিকে নিরাপদ প্রতিপন্ন করে তাকে সেটি বাক্স বন্দি ও দেশে দেশে রপ্তানি দ্বারা প্রভূত অর্থ উপার্জন করলেন – এর নাম ডিনামাইট। শেষ বয়েসে তিনি একদিন খবরের কাগজে পড়লেন কে বা কারা তাঁকে ‘মৃত্যুর ব্যবসায়ী’ আখ্যা দিয়েছে। নোবেল স্থির করলেন তাঁর অর্জিত বেশির ভাগ ধন সম্পত্তি (সাত মিলিয়ন ডলার,আজকের হিসেবে অনেক বিলিয়ন) তিনি তুলে দেবেন সুইডিশ নোবেল ইনসটিটিউটের হাতে। এই অর্থের সুদ হতে ইনসটিটিউট প্রতি বছর পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সফল মানুষদের সম্মানে দান করবেন চারটি পুরষ্কার, তার চয়ন ও প্রদানের দায়িত্ব নেবে সুইডিশ নোবেল সংস্থা। কিন্তু এই সঙ্গে তিনি আরেকটি ক্লজ জুড়ে দিলেন- বিশ্বে যুদ্ধ বন্ধ করার এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে মৈত্রী গড়ে তুলে শান্তিকে নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেছেন এমন মানুষকে সম্বর্ধিত করার জন্য দেওয়া হবে নোবেল শান্তি পুরষ্কার, তার প্রাপক নির্বাচন করবেন নরওয়ের পার্লামেন্ট দ্বারা বেছে নেওয়া পাঁচ জনের একটি কমিটি। মনে রাখা দরকার সময়টা উনবিংশ শতকের শেষ দশক, নরওয়ে তখন সুইডেনের অধীনে একটি অঙ্গরাজ্য মাত্র; তাঁদের পার্লামেন্ট আছে বটে কিন্তু সুইডেনের রাজা থাকেন তার মাথার ওপরে। কেন যে আলফ্রেড নোবেল তাঁর নামাঙ্কিত এবং ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত পুরস্কারের সঙ্গে অসলো তথা নরওয়েকে জুড়ে দিলেন তার কোন সঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। নরওয়ে সে সময়ে মাঝারি আয়ের ছোট দেশ, ইউরোপে তার স্থান অনেকেরই পিছনে, এমনকি ১৯৩৬ সালে রোমানিয়ার পেছনে। অসলোর জনসংখ্যা আমাদের শ্যামবাজার আর বরানগরের মাঝে গুঁজে দেওয়া যায়। ... ...
এরিক ফান রিবেকের ডাচ অনুগামীরা সিদ্ধান্ত নিলেন ওই দ্বীপে জেলখানা বানিয়ে শাস্তি প্রাপ্ত অপরাধী, অবাঞ্ছিত, পূর্ব এশিয়া, মাদাগাস্কার ও কেপ কলোনির রাজনৈতিক বন্দিদের যদি সেখানে নির্বাসন দেওয়া হয় তাহলে ডাঙ্গায় ইট গেথে কাঁটা তার ঘিরে জেলখানা বানানো ও ডজন ডজন প্রহরী পোষার খরচাটা বাঁচে। রোবেন আইল্যান্ড কেপ টাউন থেকে দূরে নয়, বাইনোকুলার দিয়ে নজর রাখা যায়, কিন্তু পথ দুর্গম; তার আশে পাশে অজস্র মগ্ন মৈনাক, ঝোড়ো হাওয়ায় আকস্মিক উচ্ছলিত আটলান্টিকের জলরাশি, পালাবার পথ নাই। অন্তত দু ডজন জাহাজ ডুবেছে এখানে নোঙর বাঁধতে গিয়ে। কারাগারে পাহারাদার লাগবে কম। ওই দ্বীপ থেকে কেউ সাঁতরে কেপ টাউন পৌঁছুতে তো পারবেই না বরং হাঙরের মেনুতে পরিণত হবে। চিন্তাটি সঠিক। তিনশো বছরে নৌকা যোগে মাত্র দুটি সফল পলায়নের কাহিনি জানা যায়, তবে কোন বন্দীর সাঁতরে কেপ টাউন পৌঁছুনোর রেকর্ড নেই। ... ...
এইখানে প্রকৃতি একটি ফাঁদ পেতে রেখেছেন। আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তে আরেকটি অন্তরীপ আছে তার নাম হাং ক্লিপ। নাবিক জানে ফেরার সময়ে মহাদেশের শেষ বিন্দুতে এসে জাহাজ যাবে উত্তর মুখে,সাদার্ন ক্রসকে চোখে রেখে, আফ্রিকার উপকূল যথারীতি রইবে ডান দিকে। তিনশো বছর আগে কিছু নাবিক ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের সময়ে এই হাংক্লিপ অন্তরীপকে কেপ অফ গুড হোপ ভেবে জাহাজের মুখ ঘুরিয়েছেন উত্তর দিকে, ফলে অনেকটা ঘুরে এসে আবার বুঝেছেন, উত্তর নয় এখন তাদের জাহাজের মুখ ঘোরাতে হবে দক্ষিণে, তবে পৌঁছুবেন আসল কেপ অফ গুড হোপে। এই ভ্রান্তির কারণে উপসাগরের নাম ফলস বে যার নাম হওয়া উচিত ছিল দি রং বে! হেলিকপটার থেকে দেখলে মনে হবে ফলস বে যেন একটি প্রকাণ্ড প্রাকৃতিক বাথটাব, প্রায় একটি বর্গক্ষেত্র, তিরিশ বাই তিরিশ কিলোমিটার! ... ...
আফ্রিকা মহাদেশ পরিক্রমা করে ইউরোপ থেকে ভারত তথা পূর্ব এশিয়ার পথ খুঁজে নিয়েছেন পর্তুগিজ অভিযাত্রী নির্মম লুটেরা ভাস্কো দা গামা। সেই দীর্ঘ নৌ-সফরে নাবিকদের প্রয়োজন মাঝেমধ্যে স্থল-বিরতি, একটি সাময়িক আস্তানা, খাদ্য ও পানীয়ের সরবরাহ কেন্দ্র। লিসবন থেকে পালতোলা জাহাজের প্রায় তিন মাস লেগে যেত আফ্রিকার শেষপ্রান্তে পৌঁছতে, খানিক থেমে আবার যাত্রা। পূর্ব এশিয়া (ইস্ট ইন্ডিজ) যাওয়ার পথে একদিন ইয়ান ফান রিবেক হল্যান্ড থেকে আশি জন পুরুষ, আট জন মহিলা সহ তিনটি জাহাজ নিয়ে আটল্যান্টিকের অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে পাহাড়ের নিচে এই শান্ত বন্দরে নোঙর ফেললেন, সেদিন ৬ই এপ্রিল, ১৬৫২। রিবেক ও তার সঙ্গীদের জায়গাটা বেশ ভালো লেগে গেল। দূরে গাঢ় নীল সমুদ্র সফেন অথচ বন্দর নিস্তরঙ্গ, সামনে খাড়া পাহাড় যার শিখর একেবারে সমতল; তার নাম দিলেন টাফেলবার্গ, টেবল মাউন্টেন। ভারত, জাভা, বোর্নিও , মশলা-দ্বীপ নাহয় পরে যাওয়া যাবে। আগন্তুক ডাচ মানুষেরা ভাবলেন এখানেই আড্ডা গাড়া যাক - স্থানীয় মানুষদের উচ্ছেদ করে সংসার পাতলেন। সেই আফ্রিকার দক্ষিণতম ভূখণ্ডে শ্বেত-পদসঞ্চারের প্রারম্ভ, যার মাশুল গুণতে হবে সেখানে স্থিত বা আগত সকল অশ্বেতকায় মানুষকে, মালে, চিনা,ভারতীয়কে। এই অন্তরীপ শহর আর হাল ভেঙে ক্লান্ত নাবিকের কোনো বুড়ি ছোঁয়ার বন্দর রইল না। ক’টা দিন থেমে চাল কলা আলু কুমড়ো পটল জাহাজে তুলে নিয়ে, ফ্লাস্কে জল ভরে ভারত যাত্রার ওয়েটিং রুমও নয়। নতুন বিজনেস মডেল - জমিদারি, চাষবাস আর ভারত অভিযাত্রীরা যখন এখানে থামবেন তাঁদের ‘চায় গরম’ অফার করা, মোটরওয়ের রেস্তোরাঁর মতন। লোভী ডাচ ক্রমশ দখল করবেন চাষের জমি, লাগাবেন আঙুরের চারা, দূরে ভাগাবেন খোই খোই জাতিকে তাঁদের হাজার বছরের বাসভূমি থেকে। ... ...
আমরা ট্যাঁকখালির জমিদারের মত অন্য সমুদ্রতটে গিয়ে থানা গাড়লাম। দিব্যি ঝলমলে রোদ, পরিষ্কার বালি, র্যাল্ফ ফিনেসের চোখের মত রঙের দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রের জল --- হঠাৎ দেখলে মনে হবে এখানেই আসেপাশে একতা জেড পাথরের ঘর দেখতে পাওয়া যেতে পারে। শুয়ে বসে, বই পড়ে, জলের ধার দিয়ে হেঁটে, আবার ডাব খেয়ে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে আমরা দুগ্গা বলে গড়িতে উঠলাম। এবার ঘরের ছেলেমেয়ে ঘরেই অর্থাৎ স্যান হুয়ানে ফিরে যেতে হবে। পরের দিন ফিরতি ফ্লাইট। উত্তর পূব কোণ থেকে স্যান হুয়ান যাওয়া খুবই সোজা। সটান পুব বরাবর গেলেই আয়তক্ষেত্র সম্পূর্ণ হবে। তেমন তাড়াহুড়ো না করেই পুরো দ্বীপটা বেড় দিয়ে ঘুরে আসা গেল। ... ...
২০২১ সালের গ্রীষ্মে স্যান হুয়ানের গভর্নর রিকার্ডো রোসেলোর কিছু চ্যাট মেসেজ কেন্দ্র করে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ফাঁস হওয়া ঐ মেসেজগুলি রোসেলো এবং তাঁর ঘনিষ্ট বৃত্তের মধ্যে বিনিময় হয়েছিলো। সেগুলো থেকে জানা যাচ্ছে হারিকেন মারিয়ায় যাঁদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাঁদের প্রতি রোসেলো অ্যান্ড কোম্পানি খুবই উদাসীন মনোভাব পোষণ করে। এছাড়াও ঐ মেসেজগুলিতে নানা আপত্তিকর মন্তব্য এবং দূর্নীতির স্বীকারোক্তি রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি নিয়ে অসন্তুষ্ট মানুষ এর পরেই রাস্তায় নেমে আসে। জালিয়াতির অভিযোগে রোসেলোর দুজন শীর্ষ আমলা গ্রেপ্তার হওয়ার পর, জুন মাস নাগাদ, ব্যাপার খুবই ঘোরালো হয়ে ওঠে। পুলিশ প্রতিবাদকারীদের হঠাতে গিয়ে বলপ্রয়োগ করে, ফলে আরো বেশি প্রতিবাদ, পুরো দ্বীপ জুড়ে অন্দোলন ইত্যাদি হয়। বিদেশ থেকে নামকরা কয়েকজন শিল্পী আসেন প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিতে (তাঁদের একজন রিকি মার্টিন )। ... ...
তীরে এসে তো আর প্রেস্টিজ ডোবাতে পারিনা, তাই মুখে হিন্দি শেখা ডাকাবুকো অভিনেতার মত হাঁ হাঁ কিঁউ নেহি টাইপের ভাব করে ভেসে পড়তে হলো। এই অঞ্চলটা প্রায় একইরকম তবে বৈচিত্র্য আরো বেশি। মিনিট কুড়ি ধরে সেখানেও কুস্তি করে তারপর একসময় মুক্তি পেলাম। বীরের মত জল থেকে উঠে এলাম, মুখের ভাবটা আরো ঘন্টা দুই জলে থাকতে পারলেই ভালো হতো। শুনলাম ৫০-৫৫ বছরের ঐ ভদ্রলোক, যিনি সপরিবারে স্নরকেলিং করতে এসেছেন, তিনি অগাধ সমুদ্রে সাঁতার দিয়ে একটা কচ্ছপের পেছনে ধাওয়া করেছিলেন। তারপর এতদূরে চলে যান (এবং কচ্ছপটা এতই দ্রুতগামী) যে তাঁর ভয় হতে থাকে ফিরতে পারবেন না। অতঃপর বুদ্ধিমানের মত ফিরে এসেছেন। বুঝলাম যে লড়াইটা আদপেই সংস্কৃত আর হিন্দির না, বস্তুত তারা হলো "অলসো র্যান" ক্যাটাগরি। আসল হিরো হলো হলিউড, সেখানে সবই সম্ভব। কচ্ছপটা জোর বেঁচে গেছে। ... ...
সেই ছোট থেকেই একটা রেটরিকাল প্রশ্ন শুনে আসছি - ন্যাড়া বেলতলায় যায় কবার? এসক্যাম্ব্রিয়ন সমুদ্রতটে পৌঁছে প্রশ্নটা মর্মে এসে বিঁধলো। বিশাল সমুদ্রতট, সাদা বালি দিয়ে ঢাকা। সমুদ্র যত নয়নাভিরাম, ততই ভীতিপ্রদ। জায়গায় জায়গায় বেজায় ঢেউ, দুয়েকজন সার্ফিং করছেও দেখা গেল। তার ওপরে দেখলাম বিস্তর লোক, প্রায় কার্নিভ্যালের মত আবহাওয়া। দিনটা শুক্র বা শনিবার নয়, সম্ভবত বুধবার। এত লোকের কি কোন কাজ নেই, কি জ্বালা ! মনটা দমে গেল, মানসচক্ষে দেখতে পেলাম আমায় খাবি খাওয়া অবস্থায় জল থেকে তুলে নিয়ে আসা হচ্ছে, তীরের লোকেরা হেসে খুন। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত দেখলাম স্নরকেলিং এর বাকি সদস্যদের। ... ...
"যে অংশটুকু বাকি ছিল এই কাহিনির, লিখে গেলাম। এই কাহিনিকে মরে যেতে দিও না। আলো হাতে, প্রেম বুকে নিয়ে, চোখে স্বপ্ন নিয়ে, হৃদয়ে সাহস নিয়ে আমরা সবসময় মানুষের পাশে পাশেই থেকেছি। তাপিতকে শান্ত কর। ভ্রান্তকে পথ দেখাও আলমিত্রা। তোমার কাছে এসে যেন লোকে শান্তি পায়। মাছি হয়ো না, মৌমাছি হও। তুমি স্বেচ্ছায় আমার পথ বেছে নিয়েছ। আমি চলে যাবার পর থেকেই শুরু হোক তোমার পথ চলা। শেবার রানির বাকি কাহিনি লিখে গেলাম। রানির মত হও। একাকী, সাহসী, ব্যতিক্রমী, নির্জন । " ... ...