একমাস পেরিয়ে গেছে, ৩ এপ্রিল (২০২৫) শীর্ষ আদালতের এক সিদ্ধান্ত বয়ে এনেছে গভীর সামাজিক অভিঘাত। বিপুল প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির জন্য বাতিল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনকৃত (এসএসসি) ২০১৬-র পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই। পাঁচ বছরেরও বেশি চাকরি করার পর রাতারাতি চাকরিচ্যুত হতে চলেছেন ২৫৭৩৫ জন শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী। জালিয়াতিতে অভিযুক্ত রাজ্য সরকারের অতি উচ্চতর পদাধিকারীরা। সংশ্লিষ্ট (সাবেক) মন্ত্রীসহ তাঁরা জেলে বন্দি রয়েছেন। নানান সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের নির্যাস– এসএসসি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বিপুল দুর্নীতির কারণে এবং কমিশনের অসহযোগিতায় জালিয়াত বা দোষী এবং নির্দোষী নিয়োগপ্রাপ্তদের বাছাই করার তথ্যপ্রমাণ ছিল না, তাই সমগ্র প্যানেল বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে আদালত। সম্প্রতি রাজ্য সরকার রিভিউ পিটিশনের মাধ্যমে রায়টি ফের পর্যালোচনার জন্য আবেদন জানিয়েছে সর্বোচ্চ আদালতে। ... ...
হয়তবা, প্রতিটি যুদ্ধের খবর আমাদের তৃপ্তি দেয়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, খুঁজে খুঁজে আমরা পড়ি সে-সব , দেখি, আলোচনা করি, গালি দেই, আমাদের দুর্বল হৃদয়গুলো তেতে ওঠে, আমাদের নিজের নিজের রায়ে ঘোষিত অপরাধীদের ধ্বংস কামনায় আমরা একাত্ম হই। প্রাগৈতিহাসিক সমবেত আক্রমণের উল্লাস-ধ্বনি আমাদের ফিরিয়ে দেয় - যুদ্ধ, আহা যুদ্ধ! ... ...
কাটোয়ার গিধগ্রামের শিবমন্দিরে ‘দাস’ সম্প্রদায়ের মানুষজন স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর নিজেদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা পেলেন। পুলিশ প্রশাসনের উপস্তিতিতে গ্রামের অস্পৃশ্য চামাররা মন্দিরে ঢুকলেন, সংবিধানের আর্টিকেল ২৫ এ ন্যাস্ত ধর্মাচরণের অধিকার পেলেন পাশাপাশি ৩৫০ বছরের প্রথা ভাঙলেন। তালিকা এইখানেই শেষ নয়। ‘রবিদাসীয়া মহাসঙ্ঘ’ তরফ থেকে সম্প্রতি একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়, সেখানে বলা হয় কেতুগ্রামের গঙ্গাটিকুরি শিবমন্দির, বিল্লেশ্বর শিবমন্দির, নদীয়ার কালিগঞ্জে একই পরিস্থিতি। প্রাথমিক ভাবে নিজেদেরকে প্রগতিশীল দাবী করা বাঙালি নিজেদের ইমেজ বাঁচাতে গিধগ্রামের মতো কোন এক অজ পাড়াগাঁয়ের এই ঘটনাকে ভদ্রলোকী কায়দায় নিছকই বিছিন্ন বলে উড়িয়ে দিতে শুরু করে। কিন্তু তালিকা লম্বা হতে শুরু করতেই নবজাগরনের উত্তরসূরি কলকাতার বাবুদের বেশ চিন্তা; ‘জাতপাত এসব তো বিহার উত্তরপ্রদেশের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গে এসব এলো কবে!’ ক্যালকাটা হাই কোর্টের এক মহামান্য বাঙালি বিচারপতি নদীয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মন্তব্য করেন, ‘বাংলায় তো এসব ছিল না। এখনও এই ধরনের সমস্যা বাংলায় নেই বলেই বিশ্বাস করি’। এই সাম্প্রতিক মন্তব্যের একই সুর শোনা গেছিল সেই ১৯৮০ সালে মণ্ডল কমিশনের প্রতিক্রিয়ায়। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে শুধুমাত্র দুটি জাত, ধনী এবং দরিদ্র’। রাজ্য যে জাতপাত মুক্ত এই বিশ্বাস কি একদিনে জন্মেছে? নাকি গঠনতান্ত্রিক উপায়ে বাংলা যে জাত প্রশ্নে ব্যতিক্রম সেটা নির্মাণ করা হয়েছে? আজকে এই লেখায় একটু বিনির্মাণের চেষ্টা করবো। ... ...
পরিবার নিরাপদ আশ্রয় হলেও, জীবনে এমন পরিস্থিতি আসতে পারে যখন একা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারও নিরাপত্তার ছাতা সরে যেতে পারে, আবার কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেও একা থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আজ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকলেও ভবিষ্যতে কী হবে বলা যায় না। তাই নিজের টাকা-পয়সার ব্যাপারে নিজে সতর্ক থাকা জরুরি। সমীক্ষার ফলাফল বলছে, বেশিরভাগ মেয়ে অর্থ সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী নন। ২১% মেয়ে এখনো বিনিয়োগ বা সঞ্চয় বুঝতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। আবার যারা আত্মবিশ্বাসী, তাঁদের অনেকেই পরিবারের ওপর নির্ভর করেন। সেই সঙ্গে ঝুঁকি নেওয়ার বিষয়ে মেয়েদের দ্বিধা স্পষ্ট। তবে যাঁরা নিজেদের আর্থিক জ্ঞান নিয়ে আত্মবিশ্বাসী, তাঁদেরও অনেকেই কোন ঝুঁকি নেন না! জ্ঞানটি যথেষ্ট সময়-উপযোগী ও সম্পুর্ণ তো? প্রশ্ন থেকেই যায়। ... ...
কলকাতা উচ্চ আদালতের বেশ কিছু শুনানি এখন ইন্টারনেটে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। আমি বেশ কটা দেখেছি এবং শুনে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে। বাদী-বিবাদী সবাই বাঙালি। দুই-তিন-চার-পাঁচজন উকিল, যাঁরা তর্কবিতর্ক করছেন, সবাই বাঙালি। বিষয়বস্তু বাংলার। কিন্তু পুরোটাই হচ্ছে ইংরিজিতে। কালো কোট পরে উকিলরা বিচারকের সামনে এসে নানারকম বিচিত্র উচ্চারণে ইংরিজিতে সওয়াল করছেন। বাংলায় কোনো অপরাধ হয়েছে, কোনো বাঙালি মেয়ের উপর অত্যাচার হয়েছে, বাংলার কোনো হাসপাতালে ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রশ্ন, বিচারপ্রার্থীরা আদৌ কিছু বুঝছেন কিনা তার তোয়াক্কা না করে সবটাই ইংরিজিতে। শুনলে মনে হয়, এখনও ইংরেজ জমানা চলছে, আর ছন্দ করে 'কিউকাম্বার শসা, প্লৌম্যান চাষা' মুখস্থ করছেন। ... ...
সেদিন সন্ধেবেলায় সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে টিভির পর্দায় চোখ রেখেছি, হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। কাপটা টেবিলের ওপর নামিয়ে সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি দরজার সামনে বাপি দাঁড়িয়ে আছে। চাবি এনে দরজা খুলতে খুলতেই প্রশ্ন করি – “ কী ব্যাপার বাপি ? হঠাৎ এমন সময়ে?” ম্লান হেসে বাপি উত্তর দেয় – “এই তোমার কাছে এলাম একটু পরামর্শের জন্য।” পরামর্শ? তাও আবার আমার মতো এক অচল গাড়ির গাড়োয়ানের কাছে?” “তুমি হলে মাস্টারমশাই মানুষ, তোমার সঙ্গে কথায় আমি পেরে উঠবো না।” – বেশ বিনয় করে কথাটা বলে বাপি। এই অবসরে আমার স্ত্রী বাপির জন্যও এক পেয়ালা চা এনে হাজির করেছেন। সেই কাপে ঠোঁট ঠেকিয়ে বাপি বলে, –“সামনের পরবের ছুটিতে বাড়ির সবাই মিলে একটু বেড়াতে যাবো বলে ঠিক করেছি।” বাপি মনের কথা সবটা বলে উঠতে পারে না, আমার গিন্নি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠেন, – “ বাহ্! এতো খুব ভালো কথা। যা ,যা, ঘুরে আয়। আমিতো তোর কাকুকে বলে বলে হয়রান হয়ে গেলাম। কতদিন বাড়ির বাইরে যাওয়া হয়না। তাই কোথায় যাবি ঠিক করলি? পাহাড় না সমুদ্র?” এক নাগাড়ে এতো কথা শুনে বাপিতো একরকম নাজেহাল। আমতা আমতা করে বাপি বলে,-- “এখনো তা ঠিক করে উঠতে পারিনি কাকিমা। মেয়েটা এবার মাধ্যমিক পাশ করেছে ওর দাবি তাই সবার আগে। ওর ইচ্ছে এবার পাহাড় দেখতে যাবে, অন্যদিকে ওর মায়ের ইচ্ছে সমুদ্র দেখতে যাবে। আমি তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কোথায় যাব। এই উৎসবের সময় এলেই আমার বুক , মাথা সব ধরফর করতে শুরু করে। একেতো পরবের জন্য কেনাকাটার খরচ,তার ওপর এই বেড়াতে যাওয়ার খরচ! সামলাবো কী করে,তা ভেবেই আমার ঘুম উড়েছে। কাকু, আমায় একটা উপায় বাতলে দাও দেখি।” ... ...
আমাদের রাজ্যে সম্প্রতি শিশুচুরির গুজবে গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিস এসে কোনোরকমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে না বাঁচালে এগুলি সবই লিঞ্চিংয়ের নজির হয়ে উঠত। মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি, ভবঘুরে, মহিলা-ছাড় পাচ্ছেন না কেউ। যদিও সারা বছর ধরেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ছেলেধরা, গরুচোর বা ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতেই থাকে। এগুলি সাধারণত খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় ছোট্ট খবর হিসেবে থাকে। পুলিসও নাম-কা-ওয়াস্তে একটা তদন্ত করে কেসগুলি মিটিয়ে দেয়। এই ঘটনাগুলি গ্রামের মানুষ প্রায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘটিয়ে থাকেন। এর পেছনে যে কারণগুলি তারা দেখান তা হচ্ছে (১) পুলিসি অকর্মণ্যতা, (২) দীর্ঘসূত্রী বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা আর (৩) গ্রাম বা অঞ্চলের সুরক্ষা। ... ...
মন্দা কাটার পর ২০১১ সাল নাগাদ শুরু হয় দ্বিতীয় বিপ্লব। মল তৈরি হতে থাকে দ্রুতগতিতে। বড়, মাঝারি শহরগুলো ছেয়ে যেতে শুরু করে মলে। একটা হিসেব পাওয়া যায়, যে, ২০১৭ সালে, গোটা ভারতে ৬০০ টার মতো মল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এর বেশিরভাগটাই ২০১১র পরে। মলগুলো নানারকম ছিল, কিন্তু যদি কেউ ২০১১র পরের মলগুলোর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য মনে করে দেখেন, তো মনে করতে পারবেন, এগুলো আগের মলগুলোর থেকে আলাদা। নতুন মলগুলোয় এবং পুরোনো গুলোও বদলে ফেলা হয় এমন ভাবে, যে, সেগুলো আর শুধু কেনাকাটার জায়গা নয়, সময় কাটানোর জায়গা হয়ে ওঠে। সম্পূর্ণ শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত, অজস্র রেস্তোরাঁ, খেলার জায়গা এবং অবশ্যই একটি মাল্টিপ্লেক্স। আন্দাজ করা যায়, মলের দোকানগুলো জিনিস বেচলেও, মলগুলো আসলে বিক্রি করছিল জীবনযাত্রার ধরণ। শনিবার বা রবিবার মধ্যবিত্তরা সময় কাটাতে মলে আসবে, মলগুলোই হবে গন্তব্য, এবং লোকে এসে পড়লে পয়সা তো খরচ করবেই, এইটাই ছিল লক্ষ্য। ভারত সরকার, প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে, এই পুরো প্রক্রিয়াটার পিছনে ছিল, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই পুরো সময়টাতেই বিক্রির ক্ষেত্রে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের নিয়মকানুন শিথিল করা হয় এবং মলগুলোর একটা বড় অংশই ছিল বিদেশী পুঁজির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ। এরই মধ্যে ২০১৬ সালে হঠাৎ একদিনের ঘোষণায় ভারতে চালু করে দেওয়া হয় নোটবন্দী। নগদ টাকায় লেনদেন কার্যত দীর্ঘদিনের জন্য খোঁড়া হয়ে যায়। একই সময় চালু হচ্ছিল ই-কমার্সের নানা ব্যবস্থা, অ্যাপ, এবং টাকাহীন লেনদেনের নানা ব্যবস্থা। নোটবন্দীর ক্ষেত্রে কারণ দেখানো হয়েছিল, কালো টাকা উদ্ধার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কয়েকবছর পরে দেখা যায়, প্রায় কোনো কালো টাকাই উদ্ধার করা যায়নি, ফলত গোটা নোটবন্দীকেই একটা বৃহৎ কেলেঙ্কারি বলা যেতেই পারে। এই সময় সরকারকে সরাসরি দেখা গেছে অ্যাপ দিয়ে লেনদেনের পৃষ্ঠপোষকতা করতে। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে, অ্যাপ, বড় খুচরো কোম্পানি, এবং মলগুলোর সুবিধা করে দিতেই এই সিদ্ধান্ত। শুধু এদেরই সুবিধা করে দিতে নিশ্চয়ই না, আরও অনেক সুবিধাভোগীও অবশ্যই ছিল, কিন্তু এরা যে সেই তালিকার অন্তর্গত, সে নিয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। ... ...
গুরুচন্ডা৯ প্রকাশিত রসিকার ছেলে উপন্যাসে রোহিত ভেমুলার ছায়ায় গড়া কেন্দ্রীয় চরিত্র রোশনের পাশে আছে ফয়জান, স্বনামে নয়, তার নাম ওখানে ফয়জল। তার মৃত্যুর পর মা ছুটে এসেছেন অতদূর থেকে। তাঁর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছে কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় পুলিশ, তার বর্ণনা আছে। সেই সময় প্রকাশিত বিভিন্ন কাগজের রিপোর্ট ঘেঁটে লেখা। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অনেকের ইন্টারভিউ নিয়ে তারপর তিলে তিলে গড়া হয়েছে এই দুর্ভাগা তরুণের চরিত্র। তাকে দাঁড় করানো হয়েছে রোহিত ভেমুলার পাশে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায় এই ২০১৬ এবং ২০২২ কে এক সুতোয় গেঁথে ফেলাকে অন্যায়ের প্রবহমানতা দেখাবার পক্ষে খুবই কার্যকরী হয়েছে বলে ভেবেছেন। আমরা পড়ে দেখতে পারি উপন্যাসের কিছুটা অংশ, যেখানে মায়ের চোখের জল আর প্রবল আকুতি বৃথা হয়ে যাচ্ছে। এমপ্লুরা নামের রাসায়নিক দিয়ে যে নরপশুরা ফয়জানের মৃতদেহ অবিকৃত রাখবার চেষ্টা করেছিল, তাদের নির্লিপ্ততা। রসিকার ছেলে প্রকাশ করে গুরুচন্ডা৯ যে সামাজিক যুদ্ধের সূচনা করেছে, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অমিতাভ চক্রবর্তীদের প্রতিবেদন। ... ...
তথাকথিত নীচু জাতের নারীর সঙ্গে তথাকথিত উঁচু জাতের পুরুষের বিয়ে হলে তাদের সন্তানের জাত কী হবে সুপ্রিম কোর্টে এইরকম একটি কেস উঠেছিল (civil appeal no 654 of 2012, decided on January 18, 2012)। সুপ্রিম কোর্টের অবজারভেশনের একটি অনুবাদ নীচে রইল। ইন্টারকাস্ট ম্যারেজ যদি আদিবাসী এবং অ-আদিবাসীর মধ্যে হয়, তাহলে ধরে নেওয়া হয়, সন্তান পিতার কাস্টেই পরিচিত হবে। এই ধরে নেওয়াটা জোরদার হয়, যদি এইরকম বিয়েতে পুরুষটি উঁচু জাতের হয়। কিন্তু এই ধরে নেওয়া সিদ্ধান্ত হিসেবে কখনই অপরিবর্তনীয় নয়। এইরকম বিয়ের সন্তানের প্রমাণ করার স্বাধীনতা থাকবে যে সে শিডিউল কাস্ট/ ট্রাইবের মায়ের দ্বারা আজন্ম পোষিত হয়েছে। উঁচু জাতের পিতার সন্তান হয়ে সে জীবনে কোনো সুযোগ সুবিধেই পায়নি, উপরন্তু বঞ্চনা, অমর্যাদা, অপমান এবং বাধার সম্মুখীন হয়েছে, যেমনটি তার মায়ের কাস্টের লোকেরা হয়ে থাকে। ... ...
তিনি কিভাবে জানবেন একই ঘরে অবস্থানকারী পরিবারের সদস্যদের কাছে সম্পূর্ণ আলাদা ভিডিও আসে? কিছুতেই বুঝতে পারেন না কিভাবে একটি বাচ্চা যে মানসিক অবসাদে ভুগছে তার কাছে অজস্র ভিডিও নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে আসতে থাকে, আস্তে আস্তে যা আত্মহত্যায় পথে ঠেলে দেয়? একটা ক্লিক, একটা সার্চের থেকেই তৈরী হতে থাকে এই অ্যালগরিদিমের জাল। আর ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে অপরিণত মস্তিস্ক। কিছুক্ষণ একটা বিষয় দেখলে বা সার্চ করলে আকৃষ্ট করার উপাদান দিয়ে সময় বাড়ানো- আর বিজ্ঞাপন থেকে আরো আরো রেভিনিউ। ... ...
আমরা এবারে দেখতে চাইব, সমাজ গঠনের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়ে মার্ক্সের কি ধারণা ছিল। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বয়ানে এসবের সংক্ষিপ্ত এবং প্রায়-পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা আমরা জেনে নেব। পার্থ বলছেন – “ভারতবর্ষ নিয়ে পড়াশোনা কিংবা লেখার সময় মার্কস-এর চিন্তায় একটাই মূল প্রশ্ন ছিলঃ ভারতীয় সমাজের ঐতিহাসিক অগ্রগতির সম্ভাবনা কী, কোন পথে সে অগ্রগতি সম্ভব, সে পথে বাধা কোথায়? বিশ্ব-ইতিহাসের ক্রমবিকাশের যে ছক তিনি ইউরোপের সমাজবিবর্তনের ধারা থেকে আবিষ্কার করতে চাইছিলেন, বলা বাহুল্য সেই ছকের সঙ্গে মিলিয়েই ভারতবর্ষ নিয়ে এই প্রশ্ন জেগেছিল তাঁর মনে। ... ...
খেয়াল করলে বুঝবো, “caste” তথা জাত বিভাজন অক্ষত রইল। একে ছাত্রদের সংখ্যানুপাতে বিচার করে বার্ষিক রিপোর্টে পেশও করা হল। কিন্তু গ্রামীণ বা চলে-আসা ভারতীয় সমাজের ধরনে বিষয়টিকে উচ্চ-নীচ সামাজিক প্রভেদ হিসেবে আর বিচার করা হচ্ছেনা। এক নতুন “সেকুলার সোশ্যাল হায়েরার্কি” তৈরি হল। এর অভ্যন্তরে জাত বিষয়টি বহাল তবিয়তে বেঁচে রইল, কিন্তু একটি রোপিত আধুনিকতা বা “এনগ্র্যাফটেড মডার্নিটি”র চাদর একে পরিয়ে দেওয়া হল। মেডিক্যাল কলেজ সহ হিন্দু কলেজ বা হুগলী মহসিন কলেজের মতো উচ্চশিক্ষার যে নামী প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি হল তার অঘোষিত বাতাবরণ রচিত হল যে জাত আর প্রধান পরিচয় নয়। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনের বাইরে প্রশস্ত আঙ্গিনায় কাঠামোটি অটুট রইল। ... ...
আজ থেকে প্রায় বাহাত্তর বছর আগে, ১৯৫০ সালে, প্রোফেসর উইলিয়ম এস রবিনসন একটি যুগান্তকারী পেপারে (“Ecological Correlations and the Behavior of Individuals”) প্রমাণ করে দেখান, যে, দুটি রাশির মধ্যে সম্পর্ক (অর্থাৎ কোরিলেশন) সম্পূর্ণ আলাদা-আলাদা দুরকম হতেই পারে, যদি একটি মাপা হয় সমষ্টির জন্য (অর্থাৎ এগ্রিগেট লেভেল) আর একটি ব্যক্তির পর্যায়ে (অর্থাৎ ইন্ডিভিজুয়াল লেভেলে)। রবিনসনের পেপারে ১৯৩০ সালের আমেরিকান জনগণনার—অর্থাৎ সেন্সাসের—ডেটা অ্যানালাইজ করে দেখানো হয়, যে ঐ সময়ের ৪৮টি স্টেটে যদি বিদেশে-জন্মানো (ফরেন-বর্ন) শতাংশ এবং সাক্ষর জনতার (আমেরিকান ইংলিশে সাক্ষর) শতাংশের মধ্যে কোরিলেশন পজিটিভ: ০.৫৩। এর থেকে ধারণা হতে পারে—যে রাজ্যে যত বিদেশ থেকে আসা লোক, সে রাজ্যে তত কম নিরক্ষর মানুষের শতাংশ, অথবা, তত বেশি সাক্ষরতার হার। আর একটু এগিয়ে ব্যক্তি-স্তরে নিয়ে গেলে, এমন মনে হতে পারে—যে, বিদেশে-জন্মানো মানুষের (আমেরিকান ইংলিশে) সাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা দেশে-জন্মানোদের থেকে বেশি। কিন্তু, এই সম্পর্ক-ই যদি ব্যক্তির স্তরে দেখেন, ঐ দুই রাশি—বিদেশে জন্ম আর সাক্ষরতা—এবার কিন্তু কোরিলেশন নেগেটিভ: —০.১১, অর্থাৎ সমষ্টি থেকে ব্যষ্টি-স্তরে আসতেই সম্পর্ক উল্টে গেলো। তবুও কখনো কখনো ব্যক্তির আচরণ আর সমষ্টির ব্যবহার এক-ই হয়, কখনো হয় এক্কেবারে উলটো। সেই গণ্ডগোলের নাম “ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসি”। “ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসি” শব্দবন্ধ অবিশ্যি রবিনসনের দেওয়া নাম নয়, সেটির আবির্ভাব কিছুদিন পর সেলভিনের ১৯৫৮ সালের পেপারে – ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসির সংজ্ঞা পেলাম আমরাঃ ‘the invalid transfer of aggregate results to individuals’! ... ...
বাংলার বুকে বহুদিন বাদে গণআন্দোলনের ময়দানে খেটে খাওয়া মানুষের এই বিপুল অংশগ্রহণ এত দিনের নৈশব্দ ভেদ করে সকলের কাছেই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে জীবিকা নির্বাহ করার লড়াইয়ের পাশাপাশি কেন্দ্রের আগ্রাসী হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান প্রকল্পের বিরোধিতা ধারাবাহিকভাবে করে এসেছে জাতীয় বাংলা সম্মেলন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। অর্থনৈতিক দাবীদাওয়া এবং মর্যাদার প্রশ্নে লড়াইয়ের পাশাপাশি এই আন্দোলনের আরও দুটো দিক রয়েছে। একটি হল ৯৬ সালের অপারেশন সানসাইন বিরোধি আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০০৬-২০০৭-এর উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কর্পোরেট উন্নয়নের এই মডেলকে চ্যালেঞ্জ করার প্রশ্ন। বাংলার বুকে হকার আন্দোলনের ঐতিহ্যকে মনে রেখে এখানে কয়েকটা কথা বলি। ১৯৯৬ সালে হকার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিল বামফ্রন্ট সরকার। সে প্রকল্পের নাম ছিল 'অপারেশন সানশাইন'। যুক্তিটা প্রায় একই রকম ছিল। আজ যেমন বলা হচ্ছে স্টেশনকে উন্নত করা হবে, স্টেশনটা যাত্রীদের, হকারদের নয়। সেদিনও বলা হয়েছিল ফুটপাথে হকার বসলে তা শহরের সৌন্দর্যের পক্ষে হানিকারক এবং সেই দৃশ্য মহানগরীর অন্ধকার ছবি তুলে ধরে। ... ...
ফেসবুকের ওই পোস্টটার মধ্যে হয়তো আঠা ছিল। আর স্ক্রল ডাউন করতে পারলাম না। একজন লিখেছেন, ‘স্বপ্নদীপের মৃত্যু নিয়ে এই শোরগোলের আয়ু আর মাত্র কয়েকদিন, যে কদিনের মধ্যে নতুন কিছু এসে এই ঘটনাকে চাপা না দিয়ে দেয়।’ দিন তিনচারেক আগের সেই পোস্টের ভবিষ্যৎ-বাণী ফলতে দেখেছি ইতিমধ্যেই। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন, বিগ ডে মহা-ধামাকায় তেলের সঙ্গে আটা ফ্রি আর অনলাইন খুচরো বিপণিতে নতুন কোনও ফোন উদ্বোধনের লিমিটেড টাইম ডিলের গর্জনে ক্রমশ আড়ালে চলে যাচ্ছে স্বপ্নদীপের মৃত্যু। কবীরের সুমনের গানে ছিল, 'শ্লোগান পাল্টে হয়ে যায় ফিসফাস'। এমন শিরোনামও ক্রমশ পর্যবসিত হবে টুকরো খবরে। তারপরে, আমাদের মন থেকে স্রেফ মুছে যাবে এই অকালপ্রয়াণ। পুজো এগিয়ে আসছে ক্রমশ। আশ্বিনের শারদপ্রাতে, বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ উৎসবে নিজেদের গায়ে জরির ঝালর পরব সবাই। আজকে যে খবরে মন উথালপাথাল, তা জাঙ্ক হতে দেরি নেই আর। ... ...
যাদবপুর, যাদবপুর, যাদবপুর….কান ঝালাপালা করছে… যেন পৃথিবীর আর কোথাও আমরা হেনস্তা করি না…. যেন আমাদের হাতে রক্ত লেগে নেই! আমার ছাদে গিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে….না-আ-আ-আ। এই হেনস্তা প্রতিনিয়ত, প্রতি মূহূর্তে হয়ে চলেছে। বিভিন্ন ফর্মে। আর তার ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কত কত জীবন। স্বপ্নদীপ মরে গেছে। সবাই মরে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিছু বিশাল না শুকোনো ক্ষত নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ৱ্যাগিং আসলে ক্ষমতার ভাষা, জোর ফলানোর ভাষা। সে ভাষা কোথায় নেই? আমরা “অপর”কে সম্মান দিতে জানি? জানলে আভিজাত্যের প্রতিমূর্তি জয়া বচ্চন ফিল্মফেয়ারের মঞ্চে ঋতুপর্ণর হাতে বটুয়া ধরাতেন না। জানলে শিক্ষক থেকে অফিসের বস অব্দি আমরা সবাই আমাদের অধস্তনদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাষা ব্যবহার করতাম না। আমাদের স্কুলে-কলেজে শারীরিক শাস্তি বন্ধ করার জন্য আইন আনতে হত না। ... ...
ওপরের গল্পটা বাংলার বা ভারতের বা পৃথিবীর হাজার হাজার ছেলের গল্প। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কখনো এর চেয়েও অনেক হাজারগুণ বেশি bullying আর সিস্টেম্যাটিক হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়। তাদের মধ্যে কিছু স্বপ্নদীপ থাকে, যাদের উপর অত্যাচার এমনভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় যে বেচারাদের আর লড়াই করার ইচ্ছেটুকুও আর বেঁচে থাকে না। উপরের গল্পের ছেলেটা লড়াইটা লড়তে পেরেছিল। যুদ্ধটা ওর জন্য অতটাও কঠিন ছিল না। একটা একটা করে স্বপ্নদীপ নিভে যায়। আমাদের অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে। জনমানসে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে। বাজারি আনন্দের পাতায় ঝলসে ওঠে সাংবাদিক/সাহিত্যিক/সম্পাদকের কলম। প্রাক্তন হেনস্থাকারী রাস্তায় নামে কালো পতাকা নিয়ে। টিভির পর্দায় মুচমুচে গসিপ। বাইট দিয়ে চলে যায় কলেজ পড়ুয়া, পথচারী, চেনা জানা মুখ। পণ্ডিত লোকজন সিপিএম তৃণমূলের কাজিয়ায় মন দেন। শ্রেণী সংগ্রামের যোদ্ধারা শহর-মফস্বলের দ্বান্দ্বিকতার গভীর বিশ্লেষণ করেন। ... ...