এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  সমাজ

  • নির্ভরতা বনাম স্বনির্ভরতা 

    Tanima Hazra লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | সমাজ | ১৭ আগস্ট ২০২৩ | ১০৭৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কাল বিকেলে এক পরিচিতার  বাড়িতে বেড়াতে গেছিলাম। তিনি সারাক্ষণ তাঁর মতে কোট আনকোট অকর্মণ্য, অলবড্ডে স্বামীটির বিবিধ চর্চা করে গেলেন, যিনি কিছু পারেন না, সংসার বিষয়ে কিছুই জানেন না, খেয়াল রাখেন না, দায়িত্ব পালন করেন না। ভদ্রলোক প্রকৃতই ভদ্র তাই প্রতিবাদহীন অধোবদনে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে রয়েছেন সোফার অন্যদিকে। অথচ ভদ্রলোক যথেষ্ট উচ্চপদস্থ এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে নিজের কাজের জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত। 

    মহিলার অনুযোগের লিষ্টটা দীর্ঘ, 
    তিনি নিজের জামাকাপড় কোথায় কি আছে বা থাকে জানেন না, রুমাল, ইনার গারমেন্টস তাঁর কাছ থেকে টেনে টেনে নিয়ে ধুতে দিতে হয়, 
    বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, তোয়ালে ইত্যাদি ব্যাপারে উদাসীন, 
    কখন কি খাবেন জানেন না,
    সব হাতে ধরে দিতে হয়,
     নিজের ওষুধ নিজে কেনেন না, টাইমে খান না, 
    নিজের চা নিজে বানাতে পারেন না,
     নিজের খাবার নিজে বেড়ে খেতে পারেন না, 
     নিজের টিফিন বক্স নিজে গোছাতে পারেন না,
     নিজের জুতো, চটির হদিশ নিজে জানেন না, 
     এমনকি তাঁরই  আত্মীয়দের জন্য কি জামাকাপড় কেনা হবে, তাঁর বোনের মেয়েকে কি গিফট দেওয়া হবে সেই সিদ্ধান্তও নিজে নিতে পারেন না। 
     তাঁর গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া বা শার্টের সাইজ তিনি নিজে জানেন না, 
     ইত্যাদি, প্রভৃতি........

    ভদ্রমহিলা রান্নাঘরে চা বানাতে গেলে, ভদ্রলোক আমাকে নিচুস্বরে ফিসফিস করে বল্লেন, সবই জানতাম জানেন, হষ্টেলে থেকে পড়াশোনা করে বড় হয়েছিলাম তো, কিন্তু বিয়ের পরে ইনি এসে সব কিছু নিজের মতো করে নিয়ে নিলেন, প্রথম প্রথম রান্নাঘরে ঢুকে ওঁকে হেল্পও করতে চেয়েছি, কিন্তু আমি নাকি ঠিক করে পারি না, ফেলে ছড়িয়ে নষ্ট, নোংরা করি, ভুলভাল রঙ বা সাইজের জামাকাপড় কিনে ফেলি এসব বলে উনিই ভাগিয়ে দিতেন, আর আমিও ধীরে ধীরে সব ওঁর হাতে দিয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম, এখন দেখছি বেশ কিছুদিন ধরে উনি ওসব নিয়ে খোঁটা দিতে শুরু করেছেন। এখন আর এইবয়সে নতুন করে ওসব কাজ পারবো কি নিজে, কিন্তু সবার সামনে বারবার আমার অপদার্থতা প্রমাণ করার চেষ্টা যে ওনার সেটাও হজম করা, উত্তেজিত হয়ে পড়ি আজকাল, অথচ এমনটা অভদ্রতা আমার স্বভাববিরুদ্ধ..........

    এই চিত্রটির কিন্তু আবার একটা উল্টো পিঠও আছে।
    একবার আমার এক বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ব্যাংকের একটি কাজের বিষয়ে, সে বেশ আদুরে আর গর্বিত স্বরেই বল্ল, আমি ওসব ব্যাংক, বাড়ির ট্যাক্স, ট্রেন বা ফ্লাইটের টিকিট বুক করা, ওলা উবের বুক করা ওসব কিচ্ছু পারি না রে, ওসব আমার হাবিই করে। ও আমাকে একা একা কোথাও যেতে পর্যন্ত দেয় না, সব সময় হয় গাড়ি বুক করে দেবে, না হয় সাথে সাথে যাবে। অবশ্য মাঝে মাঝে কথা শোনাতেও ছাড়ে না তার জন্য, বলে তুমি একটা আনস্মার্ট, সব আমার ঘাড়ে ফেলে ফুরফুরে হয়ে দিব্যি তো দিন কাটিয়ে দিলে। আমি না থাকলে বুঝতে পারবে দুনিয়াটা কী। 
    কিন্তু কী বল তো, এই বয়সে এসে আবার নতুন করে ওসব শেখা, মাথায় নেওয়া কেমন যেন টেনশানে পড়ে যাই এখন, আর শিখতে ইচ্ছে করে না, মুখ বুজে দুকথা শুনেই নি, এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দি...... 

    শুধু স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কেই কিন্তু নয়, ছেলেমেয়ে এমনকি  বৃদ্ধ বাবা মায়ের ক্ষেত্রেও কিন্তু অনেক সময় আমরা ভালবাসার অজুহাত দিয়ে নিজেরই অজান্তে তার ব্যক্তিগত স্বনির্ভরতার পরিসরে ঢুকে পড়ি।

    বাবু তুই পারবি না, রেখে দে আমি করে দিচ্ছি, মনা তুই বুঝিস না, তোর দ্বারা হবে না, আমি করে দিচ্ছি। 
    কিংবা মা তুমি কোথাও যেতে হলে একা একা বা বন্ধুদের সাথে যেও না, আমাদের সাথে যাবে, 
    বাবা তুমি সারাক্ষণ টিভি দেখবে না, আমরা চপ চানাচুর খাচ্ছি বলে, তুমিও খাবে না, তুমি দুধ কর্ণফ্লেক্স খাও, 
     তোমাদের মাল্টিপ্লেক্সএ কষ্ট করে সিনেমা দেখতে যাবার অত কী ইচ্ছে এই বয়সে, ঘরে বসে আরাম করে ওটিটিতে দেখো না।  

    না, এগুলো করে  আপনি হয়ত নিজেকে খুব দায়িত্বশীল ভাবছেন, তা কিন্তু নয়, যিনি শারিরীকভাবে সক্ষম তাঁকে এইভাবে 
    ভালবাসার নামে নিজস্ব কাজে বা ইচ্ছার ক্ষেত্রে  বিকলাঙ্গ বানিয়ে তার তাঁবেদারিকে উপভোগ করাও কিন্তু এক রকমের শোষণ। 

    আসলে আমরা যাঁরা অন্যের সিদ্ধান্তটা নিজে নিয়ে ফেলে তাঁকে সেটা মানতে বাধ্য করি তাঁরা কিন্তু উল্টো দিকের মানুষটাকে সত্যি সত্যি ভালবাসি না, তাঁদের ইচ্ছেগুলোকে মর্যাদা দিই না, তাদের কর্মক্ষমতাকে সম্মান করি না। শুধু আগ বাড়িয়ে সাহায্য করে তাদের  নির্ভরশীলতাটাকে উপভোগ করি এবং  নিজেদের সুপিরিয়রিটি জাহির করি। 

    কিন্তু তাহলে  কি আপনি আপনার প্রিয় মানুষটির কোনো কিছুর ব্যাপারেই খেয়াল রাখবেন না? যা করছে করুক, দেখবেন না? 

    উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, তিনি ব্যস্ত থাকলে, তাঁকে তাঁর প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলো ভালবেসে মনে করিয়ে দেবেন, যাবতীয় বিপদ আপদ বা স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সতর্ক হতে উপদেশ দেবেন, কিন্তু আদেশ দেবেন না, এটাই কর, এটাই করতে হবে, না হলে অশান্তি হবে, না হলে তুমি অবাধ্য, উদ্ধত এইসব দোষারোপ করবেন না। 

    মনে রাখবেন, উপদেশ হচ্ছে ভালবাসার নিদর্শন আর আদেশ হলো কর্তৃত্বের। 
    অন্যকে নির্ভরশীল করে কব্জা করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই,যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই  আসল হৃদ্যতা হচ্ছে তার ইচ্ছেগুলোকে সম্মান করা, 
    তার স্বাধীনতাকে মূল্য দেওয়া

    ।। ©তনিমা।।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৭ আগস্ট ২০২৩ | ১০৭৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ২১:৫৮522572
  • ''না, এগুলো করে  আপনি হয়ত নিজেকে খুব দায়িত্বশীল ভাবছেন, তা কিন্তু নয়,যিনি শারিরীক ভাবে সক্ষম তাঁকে এইভাবে 
    ভালবাসার নামে  নিজস্ব কাজে বা ইচ্ছার ক্ষেত্রে  বিকলাঙ্গ বানিয়ে তার তাঁবেদারিকে উপভোগ করাও কিন্তু এক রকমের শোষণ। '' 
    দুর্দান্ত!  অনেক দিন পর ব্লগ পড়ার আনন্দ টের পেলাম। সহজ সরল ভাষায় কী করে সত্যের চাবুক কষতে হয়, এ লেখাটি তাই দেখিয়ে দিল। স্যালুট লেখিকাকে  আমাদের নিজেদের দর্পণ যা একান্তই প্রাত্যহিক, তাকে এভাবে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য।  
  • Falguni Mazumder | ২৫ আগস্ট ২০২৩ ১৯:২৭522940
  • একদম ঠিক
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন