মিয়ানমার কিভাবে বাংলাদেশের সীমানা লঙ্ঘন করছে?- ২৮ আগস্ট বিকেলের দিকে মিয়ানমার থেকে নিক্ষেপ করা একটি মর্টার শেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় ঘুমধুমের তুমব্রুতে এসে পড়ে।
- ৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি গোলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় পড়ে।
- ৯ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার ভূখণ্ড থেকে ছোড়া একটি গুলি বাংলাদেশ সীমান্তের তুমব্রু এলাকায় এসে পড়ে।
- ১৬ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু নোম্যানস ল্যান্ডে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় মিয়ানমারের মর্টার শেল নিক্ষেপে ইকবাল নামে এক রোহিঙ্গা নিহত হন। এ ছাড়া ওই ঘটনায় এক শিশুসহ পাঁচ রোহিঙ্গা নাগরিক আহত হন। তারা এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
- মিয়ানমার সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় একের পর এক স্থলমাইন স্থাপন করছে। আগে এ ধরনের মাইন বিস্ফোরণে রোহিঙ্গারা হতাহত হলেও এখন বাংলাদেশিরাও এর শিকার হচ্ছেন।
কেন করছে?
চারটি কারণ বের করা যায় -- (১) মিয়ানমার জান্তাবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামী আরাকান আর্মিকে (এএ) ঠাণ্ডা করতে (যার ফলে এরা সুযোগ পেয়েছে)
- (২) বাংলাদেশের ওপর রাগ ঝাড়তে (কারণ এরা বাংলাদেশের ওপর ক্ষিপ্ত)
- (৩) মিয়ানমারে আরও যে ৬ লাখ রোহিঙ্গা আছে তাদের বাংলাদেশে পাঠাতে (কারণ রোহিঙ্গাদের এরা পছন্দ করে না)
- (৪) বাংলাদেশকে যুদ্ধে প্ররোচিত করে দেশের উদ্বাস্তু ১২ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগকে দীর্ঘায়িত করা, (কারণ মিয়ানমার সামরিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে শক্তিশালী আর যুদ্ধে মিয়ানমারেরই লাভ)।
প্রতিটি পয়েন্ট ধরে ব্যাখ্যা করা যাক ...
(১) আরাকান আর্মিকে (এএ) ঠাণ্ডা করতে
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে আরেক দফা সেনা অভ্যুত্থানের পর পুরো মিয়ানমার জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে, সবাই জানেন। মিয়ানমারে বেশ কয়েকটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। এর মধ্যে একটি হলো রাখাইনের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করছে আরাকান আর্মি (এএ), যারা বাংলাদেশের সাথে লাগোয়া প্রদেশ রাখাইন (পূর্বে আরাকান) ভিত্তিক। এই বিক্ষোভকারীরা চলমান সেনাশাসনের অবসান ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পথে নামে। অন্যদিকে, স্বাধীনতাকামী জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোও বেসামরিক বিক্ষোভকারীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণার পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সারাদেশে আক্রমণ শানিত করে। এই আরাকান আর্মি গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়ে ১৯ জন পুলিশসহ বেশ কিছু সেনা সদস্যকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী তাই পাল্টা জবাব দিতে বিমান ও হেলিকপ্টারের সহায়তায় আরাকান আর্মির অবস্থানে আক্রমণ পরিচালনা করছে। আর এভাবেই তারা সহজেই বাংলাদেশ সীমান্তে এই সামরিক অভিযানে মিয়ানমার বাংলাদেশের স্থল ও আকাশ সীমা লঙ্ঘন করার সুযোগ পাচ্ছে।
কিন্তু এটাই কি একমাত্র কারণ? একজন অভিজ্ঞ সীমান্তরক্ষীর কথা শোনা যাক। দিল মোহাম্মদ তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান, যার মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশে কাজ করার ১০ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি বলছেন, এই গোলাগুলি একতরফাভাবে ও পরিকল্পিতভাবেই হচ্ছে। কারণ, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বহু আগে থেকেই আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে সরিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা এই আশ্রয়শিবির ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নয় কারণ, এই শিবিরের পেছনে রাখাইন রাজ্যেই তাদের বাড়ি। তার কথাটির গুরুত্ব বুঝতে হলে বুঝতে হবে তার বর্ণিত আশ্রয়শিবিরটি সম্পর্কে। মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ৪,২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা পাঁচ বছর ধরে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় আশ্রয়শিবির গড়ে তুলে বসবাস করছে। আশ্রয়শিবির ঘেঁষে পেছনে মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া ও রাখাইন রাজ্যের একাধিক পাহাড় ও তার ওপর মিয়ানমারের একাধিক তল্লাশিচৌকি। আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি ১৫ দিন পরপর আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গাদের ত্রাণসহায়তা দেয়। এখন মিয়ানমারের পাহাড় থেকে ছোড়া মর্টারের গোলাটি আশ্রয়শিবিরের উত্তর পাশের কোনারপাড়া খালের ভেতরের অংশে পড়ে যেখনে রোহিঙ্গাদের বসতি কম। এটা আশ্রয়শিবিরের ২০ থেকে ৩০ গজ ভেতরে পড়লে হতাহত মানুষের সংখ্যা আরও বেড়ে যেত। এ ছাড়া শূন্যরেখার বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি গোলা এসে পড়েছে। কাঁটাতারের পাশে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের টহলও বাড়ানো হয়েছে। ফলে তুমব্রু সীমান্তের ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে’ আশ্রয় নেয়া সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এছাড়াও দেখা যায়, মিয়ানমার অতীতে চীন ও থাইল্যান্ডের আকাশসীমাও লঙ্ঘন করেছে, তবে তারা ক্ষমা ও দুঃখ প্রকাশের পর আর পুনরাবৃত্তি ঘটায়নি। কিন্তু জান্তা সরকার বাংলাদেশে সীমানা লঙ্ঘন এক বার নয়, বারবার করছে। তাই এটা এক্সিডেন্টাল নয়।
যাই হোক, মিয়ানমারের এভাবে বাংলাদেশের সীমানালঙ্ঘনকে কেবল মাত্র এএ-কে দমন দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়না। তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই বাংলাদেশের সীমানা লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু কেন? এটা জানতে অন্যান্য পয়েন্টগুলোতে যেতে হবে।
(২) বাংলাদেশের ওপর রাগ ঝাড়তে
অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হলেও এটি প্রভাবক হতেই পারে। তো কী কী কারণে মিয়ানমার বাংলাদেশের ওপর রেগে আছে জানা যাক...
(ক) সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত মামলায় মিয়ানমার বাংলাদেশের কাছে হেরে গেছে, যা মিয়ানমারের জান্তা সরকার সহজভাবে নেয়নি। মিয়ানমার ধরেই নিয়েছিল এই কেস তারা জিতে গেছে। কারণ সাধারণত সমুদ্রের পাশাপাশি কিংবা বিপরীত দিকে রাষ্ট্র থাকলে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমদূরত্ব নীতি বা Equidistance principle প্রয়োগ করা হয়, আর এটা করা হলে বাংলাদেশ বঙ্গপোসাগরের একটি ছোট অংশ পেত, বাকিটা চলে যেত মিয়ানমারের কাছে। কিন্তু বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ক ট্রাইব্যুনালকে বোঝায়, এই কেসে এই ইকুইডিস্টেন্স প্রিন্সিপল প্রয়োগ করলে বাংলাদেশ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাই পূর্বে মিমাংসিত মামলার নজির উত্থাপন করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ন্যায়পরতার নীতি বা Ex aequo et bono এর ভিত্তিতে এই বিরোধ নিষ্পত্তির যুক্তি দেখায়, আর বাংলাদেশের যুক্তিটাই গ্রহণ করে রায় দেয়া হলে মিয়ানমার ক্ষুব্ধ হয়ে যায়।
(খ) অনেকেই জেনে থাকবেন যে, আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে, আর মামলাটি করেছে গাম্বিয়া। হ্যাঁ, আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া করেছে মামলাটি। এই মামলায় আন্তর্জাতিক আদালত উভয় পক্ষের শুনানি শেষে মিয়ানমারের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করে, যাতে মিয়ানমারের প্রতি চারটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে -
- রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে তথা জাতিসংঘ গণহত্যা চুক্তির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত হওয়া ঠেকাতে মিয়ানমারকে সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।
- মিয়ানমার নিশ্চিত করবে যে তার সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি অন্য কোনো অনিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট কোনো ধরনের গণহত্যা করবে না বা গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না।
- গণহত্যা চুক্তির আওতায় বর্ণিত অপরাধগুলোর তথ্য-প্রমাণ বিনষ্ট না করতে এবং সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
- অন্তর্বর্তী আদেশ বাস্তবায়নের বিষয়ে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে আগামী চার মাসের মধ্যে আদালতকে জানাতে হবে এবং এই মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস অন্তর আদালতে অন্তর্বর্তী আদেশ পালন বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি মিয়ানমারের আপত্তি ছিল, গাম্বিয়ার এই মামলা করার অধিকার তথা আইনগত যোগ্যতা নেই এবং আন্তর্জাতিক আদালতেরও এই মামলার বিচার করার অধিকার নেই। মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আদালতের অধিকার বা এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করে যে চারটি আপত্তি তুলেছিল আন্তর্জাতিক আদালত গত ২২ জুলাই তার সবকটিই খারিজ করে দেয়, যার সোজা অর্থ হলো, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলার বিচার চলবে। এই রায়ে মিয়ানমার চাপের মুখে পড়ে। এখন গাম্বিয়ার প্রায় ৯৬% মুসলিম, দেশটি ১৯৭৪ সালে ওআইসি (Organisation of Islamic Cooperation) এর সদস্য হয়। মিয়ানমার মনে করে, গাম্বিয়াকে দিয়ে ওআইসি এই মামলা করিয়েছে, আর বাংলাদেশই ওআইসি-কে এতে প্ররোচিত করেছে। আর সেজন্যও মিয়ানমার বাংলাদেশের ওপর চটেছে।
(গ) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলার তদন্ত চলছে, যা হলো ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের লাখ লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়নের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ হয়েছে কি না তা নিয়ে। এখানেও মিয়ানমার আইসিসির আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অধিকার নিয়ে আপত্তি করে। কারণ যে রোম সনদের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত হয়েছে মিয়ানমার এখন পর্যন্ত তাতে স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু আইসিসি বলে, রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের পর তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, বাংলাদেশ রোম সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ ও তারা আইসিসির উদ্যোগকে সমর্থন করে বলে তাদের অধিকার আছে। ফলে শুরু হয় তদন্ত। বাংলাদেশ এই তদন্তকে সমর্থন না করলে মিয়ানমারের আপত্তি হয়তো টিকে যেত। ফলে এটাও মিয়ানমারকে বাংলাদেশের ওপর ক্ষুব্ধ করে।
সীমানা লঙ্ঘনে মিয়ানমারের এই ক্ষোভের প্রকাশের প্রভাব থেকে থাকবে...
(৩) মিয়ানমারে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে তাড়াতে
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হিসেবে আগমনের পরও প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রয়ে গেছে। মিয়ানমার জান্তা সরকার এখন অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদেরকেও বিতাড়িত করতে চায়। বাংলাদেশ সীমান্তে আরাকান আর্মি দমনের জন্য সামরিক অভিযানকে দেশটি রোহিঙ্গা বিতাড়নের কৌশল হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। এই অবস্থায় মিয়ানমারের যেসব এলাকায় সামরিক অভিযান পরিচালিত হচ্ছে তার আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের রোহিঙ্গাদের এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যার ফলে আবারও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। রোহিঙ্গা সংখ্যাগরিষ্ঠ মংডু ও অন্যান্য এলাকায় মিয়ানমারের প্রচুর সেনাকে নিযুক্ত করা হয়েছে। তুমব্রু কোনারপাড়া সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে রোহিঙ্গা শিবিরে গত ১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেলের বিস্ফোরণে একজন নিহত ও ছয় জন আহত হয়। বাংলাদেশের ভেতরের একটি বাড়ির উঠানেও গোলা এসে বিস্ফোরিত হয়। এগুলো থেকে মিয়ানমারের এই অবশিষ্ট ৬ লাখ রোহিঙ্গাদেরও বাংলাদেশে পাঠাবার আভাস পাওয়া যায়। এর ফলে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢলেরও আশঙ্কা বাড়ছে। এখন মিয়ানমারের এই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেই থেকে যেতে চায়। কিন্তু সংঘাতময় পরিস্থিতিতে জীবন হুমকিতে পড়লে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করবেই, আর তাই বাংলাদেশ যুদ্ধে জড়ালে যুদ্ধের পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা নির্যাতন বাড়িয়ে মিয়ানমার অবশিষ্ট রোহিঙ্গা বিতাড়নের সুযোগ পেয়ে যাবে। যেমন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে বাঁচতে ভারতের মিজোরাম সীমান্তেরে চিন স্টেটের (প্রদেশ) হাজার হাজার মিয়ানমারের নাগরিক টিয়াউ নামের পাহাড়ি নদী পেরিয়ে মিজোরাম রাজ্যে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যেই অনেক রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে চাইছে, কিন্তু তাদেরকে পুশব্যাক করে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে তাই বাংলাদেশও বেশ তৎপরতা দেখাচ্ছে। সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি ও কোস্ট গার্ডকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রেখেছে।
প্রশ্ন করতেই পারেন, বাংলাদেশের এভাবে এই রোহিঙ্গাদেরকে আগমনের ঢলকে আটকানো কতটা যৌক্তিক বা নৈতিক। উল্লেখ্য, এখানে বাংলাদেশ তার স্বার্থ দেখছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে থাকা ১২ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে, যা অন্যান্য দেশের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের তুলনায় অনেক বেশি। সেই সাথে রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও বেশ নেতিবাচক। এরা দেশের বিভিন্ন জায়গা জমি যেমন দখল করেছে, তেমনি অপরাধেও যুক্ত হয়েছে। আর বর্তমানে দেশে যে ইকোনমিক ক্রাইসিস চলছে তাতে রোহিঙ্গাদের এই নতুন ঢলকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া আরও চাপ সৃষ্টি করবে। আর পরিস্থিতি সামনে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক মহামন্দা ধেয়ে আসছে। জাতিসংঘ বলছে, করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক উদ্যোগ হ্রাস, ক্রমবর্ধমান সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি কারণে এক সময়ের ক্ষুধার ঢেউ এখন ক্ষুধার সুনামিতে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান ডেভিড বিসলে সতর্ক করে বলেছেন, বিশ্বের প্রায় ৩৪ কোটি মানুষ অনাহারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ৭ কোটি মানুষ অনাহারে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। দুর্ভিক্ষ দরজায় কড়া নাড়ছে। এই বছরই একাধিক দুর্ভিক্ষের প্রকৃত ও বিপজ্জনক ঝুঁকি রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বলেছেন, বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ব্যাপকভাবে কমে আসছে। আর এর মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে উঠতি বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোকে। এই অবস্থায় নতুন করে আরও ৬ লাখ উদ্বাস্তু গ্রহণ বাংলাদেশের জন্য ঠিক হবেনা।
(৪) বাংলাদেশকে যুদ্ধে উস্কানি দেবার মাধ্যমে ১২ লাখ উদ্বাস্তুর প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত করা ও মিয়ানমার সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী
বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে থাকা ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবসানের যে আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে (তা নিয়ে ২ নং পয়েন্টে উল্লেখ করেছি) তাতে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হতে পারে। আর এই দীর্ঘসূত্রিতায় লাভ মিয়ানমারের। আর মিয়ানমার বাংলাদেশকে সহজেই যুদ্ধের জন্য প্রভোক করতে পারে কারণ বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধকে মিয়ানমার ভয় পায়না, কারণ সামরিক দিক দিয়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের চেয়ে শক্তিশালী। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সামরিক তুলনা করা যাক...
বাংলাদেশে ১৬ কোটির মত মানুষ, মিয়ানমারে ৬ কোটির মত। বাংলাদেশের ডিফেন্স বাজেট ৪ বিলিয়ন ডলার, তো মিয়ানমারের ২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু তবুও মিয়ানমার সামরিক সক্ষমতায় বাংলাদেশের থেকে এগিয়ে। পাওয়ার ইন্ডেক্সের দিক দিয়ে বাংলাদেশের র্যাংক ৪৬, মিয়ানমারের ৩৯ (ডিফেন্স বাজেটের এত টাকা কই যায় চিন্তা করুন)। বাংলাদেশে এক্টিভ পারসোনেল এক লাখ ৬৫ হাজার, মিয়ানমারে ৪ লাখ; বাংলাদেশে মোট এয়ারক্রাফট ১৯০টি, মিয়ানমারে ২৮০টি; কম্ব্যাট এয়ারক্রাফট বাংলাদেশে ৪৪টি, মিয়ানমারে ৮৩টি (আরও ১৩টি আসছে) এটা নিয়ে পরে আরও বিস্তারিত বলছি); ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট বাংলাদেশে ১৩টি, মিয়ানমারে ২৬টি; বাংলাদেশে অ্যাটাক হেলিকপ্টার নেই, মিয়ানমারে আছে ৯টি; বাংলাদেশে ট্যাংক ৩২০টি, মিয়ানমারে ৬৬৪টি; বাংলাদেশে আর্মারড ভেহিকল ৮৩৭টি, মিয়ানমারে ১৫৮৭টি; সেলফ প্রোপেলড আর্টিলারি বাংলাদেশে ২৭টি, মিয়ানমারে ১৯০টি; টোউড আর্টিলারি বাংলাদেশে ৩৭১টি, মিয়ানমারে ১৮৬৯টি; মোবাইল রকেট প্রোজেক্টর বাংলাদেশে ৬৯টি, মিয়ানমারে ৪৮৬টি; ফ্লিট স্ট্রেংথ বাংলাদেশে ১১২টি, মিয়ানমারে ১৫৫টি। তবে হ্যাঁ, সাবমেরিন, ফ্রিগেট ও করভেট বাংলাদেশে বেশি। বাংলাদেশ সমুদ্রে কিছু শক্তি দেখাতে পারবে, কিন্তু আকাশ ও স্থলপথে অবস্থা ভাল না। উল্লেখ্য, ফাইটার এয়ারক্রাফটের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য কেবল কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটিতেও। বাংলাদেশে ৪৪টি ফাইটার এয়ারক্রাফটের মধ্যে ৩৬টিই থার্ড জেনারেশন ফাইটার (চীনের চেংদু এফ৭), মাত্র ৮টি হলো ফোর্থ জেনারেশনের (রাশিয়ার মিগ-২৯)। অন্যদিকে মিয়ানমারের ৮৩টি ফাইটার এয়ারক্রাফটের মধ্যে ২টি রাশিয়ার ৪.৫ জেনারেশনের এসইউ-৩০, আর আরও ৪টি আসছে। এদের ৪র্থ জেনারেশনের মিগ-২৯ এর সংখ্যা ৩১টি, যা বাংলাদেশে মাত্র ৮টি, শুধু তাই নয়, এদের কাছে চীনের ফোর্থ জেনারেশনের ফাইটার জেএফ-১৭ থান্ডারও আছে ৭টি, আরও ৯টি সামনে আসছে। থার্ড জেনারেশনের ফাইটারও ২১টি পড়ে আছে। সব মিলে মিয়ানমারের এয়ার ফোর্স বাংলাদেশের এয়ার ফোর্সের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী, সাথে আর্টিলারিও। আর অস্ত্রের দিক দিয়ে মিয়ানমার বিভিন্ন শক্তিশালী দেশের থেকে সাপোর্ট পাচ্ছেই। রাশিয়া মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কাছে যুদ্ধবিমান ও সাঁজোয়া যান সরবরাহ করেছে। চীন যুদ্ধবিমান ও পণ্য সরবরাহ করতে পারে এমন উড়োজাহাজ সরবরাহ করেছে। সার্বিয়া রকেট ও কামানের গোলা দিয়েছে আর ভারত রিমোট এয়ার ডিফেন্স স্টেশন দিয়েছে। রাশিয়া ও চীনের কাছে মিয়ানমারের অর্ডার রয়েছে। এর কাছে এই সব শক্তিশালী দেশের সমর্থনও রয়েছে। তাই অনেক বেশি সামরিক শক্তি ও শক্তিশালী দেশগুলোর সমর্থনের কারণে মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে সংঘর্ষকে ভয় পায়না, বরং বাংলাদেশকে যুদ্ধে প্রোভোক করে যুদ্ধ শুরু করতে পারলেই মিয়ানমারের লাভ।
যে কারণে বাংলাদেশের নতুন করে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ঢল গ্রহণ করা ঠিক হবে না উল্লেখ করেছি, ঠিক একই কারণে উচিৎ হবে না মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের যুদ্ধে জড়ানো। যুদ্ধে বাংলাদেশের কোন লাভ হবে না, বরং ক্ষতিই হবে। আর মিয়ানমারের হবে লাভ, আর সেকারণেই তারা যুদ্ধ চায়। তাহলে বাংলাদেশের করনীয় কী? কূটনৈতিক পদ্ধতিতে সমাধানের প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের নির্দেশে যেহেতু তদন্ত শুরু হয়েছে, তাই আজ হোক কাল হোক রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হবেই, আর মিয়ানমারও তাদেরকে মেনে নিতে বাধ্য হবে। তাই ধৈর্য ধরাটাই বাংলাদেশের করনীয়। জতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমানা লঙ্ঘনের বিষয়টি উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেখা যাক কী হয়...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।