“ ও চাচী...”
“ বলো বাপজান...”
“ তোমাদের সবার ইনসিওরেন্স করা আছে তো?”
“ সেটা কি বাপজান?”
“ আরে, জীবন বীমা, LIC...?
“ ও তাই বলো, হ্যাঁ, আমরা LIC কেটিছি বাপ।”
হ্যাঁ, কোন প্রত্যন্ত গ্রামে গেলে, এমন মানুষ পাবেন, যারা LIC কাটেন। এই সংলাপ, বৃহত্তর ভারতের সমাজ জীবনে LIC-র অঙ্গাঙ্গী উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে। বৃহৎ অংশের ভারতবাসী যারা ব্যাংক বা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পা রাখতেও সংকোচ বোধ করেন, তাদের মধ্যে জীবন বীমার প্রয়োজনীয়তা বোধ জাগ্রত করা এখনো দূর গ্রহ ভ্রমনের শামিল। আসলে প্রকৃত আর্থিক সাক্ষরতার (FINANCIAL LITERACY) অভাব যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির (FINANCIAL INCLUSION) অন্তরায় বারংবার তা প্রতীয়মান হয়, যখন বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থায় বিনিয়োগ করে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে মানুষ সর্বস্বান্ত হন। সাধারণ ভারতবাসীর মৌলিক স্বভাবে কিন্তু সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি পরম্পরাগত। কিন্তু প্রকৃত লোকশিক্ষার অভাব, পরিবেশগত প্রলোভন মানুষের যথাযথ আর্থিক পরিকল্পনা তথা সঠিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায় পা রাখার অনীহায় পর্যবসিত হয়। এমতাবস্থায়, এমন কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যে কিনা মানুষের সঞ্চিত অর্থের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে, সেই অর্থভাণ্ডার যথাস্থানে কুশলী বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের পরিকল্পিত উন্নয়নের কাজে লাগবে আবার মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ফেরতযোগ্য রাশিতে রূপান্তরিত করবে এবং অবশ্যই সম্পূর্ণ কাজটাই করবে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে গিয়ে, তেমন কাউকে দরকার। আর, ঠিক এই কাজটি সাড়ে-ছয় দশক ধরে LIC করে চলেছে। তাই, আজও বৃহৎ অংশের ভারতীয়, জীবন বীমা করে না, LIC করে।
দীর্ঘ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনে দীর্ণ, দারিদ্র্য এবং অশিক্ষা ক্লিষ্ট ভারতবাসী, স্বাধীনতার পরেও বেসরকারি আর্থিক সংস্থার সীমাহীন তছরুপের শিকার হতেই থাকেন। সদ্য স্বাধীন দেশে, ব্যাংক ও বীমা সংস্থা ছিল কিছু শিল্পপতি তথা ধনী ব্যবসায়ীর কুক্ষিগত। বৃহৎ উৎপাদন শিল্প নির্মাণ, পরিকাঠামো উন্নয়নের ন্যায় পুঁজি নিবিড় ক্ষেত্রে এই মালিক গোষ্ঠীর বিনিয়োগে কোন উৎসাহ ছিল না, বরং সরকারকেই এই সমস্ত দায় বহনের পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁরা। অথচ অর্থের পুঞ্জিভূত ক্ষেত্রগুলি নিজেদের দখলে রেখে দেওয়ার প্রবৃত্তি ছিল ষোলোআনা। তদানীন্তন সমস্ত বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, দুটি বিষয় খুব সাধারণ ছিল। এক, যখন তখন সাধারণ মানুষের সঞ্চিত অর্থ সম্পূর্ণ গায়েব হয়ে যাওয়া এবং দুই, ঐ প্রতিষ্ঠানগুলির কর্মচারীদের ওপর সীমাহীন শোষণ। তবে, সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে তখন জাতীয়তাবাদের টাটকা বাতাস বইছে, শ্রমিক কর্মচারীরা সংগঠিত হচ্ছেন সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। এমন পরিবেশে, সারা দেশজুড়ে বিভিন্ন বীমা সংস্থার কর্মীরাও সংগঠিত হতে শুরু করলেন, মরণপণ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে সমস্ত বীমা কোম্পানির মালিকের সামনে শক্তিশালী প্রতিবাদের প্রাচীর গড়ে তুললেন। বেসরকারি মালিকের অন্যায়প্রবৃত্তি, সাধারণ মানুষের অর্থের নিশ্চয়তা, দেশের পরিকল্পিত উন্নয়নে অর্থের জোগান এবং সর্বোপরি বীমা কর্মচারীদের লড়াই, সরকারকে বাধ্য করল বীমা ব্যবসার ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে। বীমা কোম্পানি, কো-অপারেটিভ ও প্রভিডেন্ট ফান্ড সোসাইটি ইত্যাদি ২৪৫টি সংস্থাকে অধিগ্রহণ করে ভারত সরকার, ১৯৫৬ সালের ১৯ জানুয়ারী একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে “ভারতীয় জীবন বীমা নিগম” বা LIC প্রতিষ্ঠা করলেন। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে LIC কাজ শুরু করলো, ১৯৫৬'র ১লা সেপ্টেম্বর থেকে। তখন LIC'র ওপর এসে পড়লো সমস্ত অধিগৃহীত প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিপূরণের দায়, সমস্ত কর্মী এজেন্টের দায়িত্ব। যার পরিমাণ, তখন ছিল কমবেশি, ৫ কোটি ২১৫ লক্ষ টাকা। সরকার LIC কে দিল মাত্র ৫ কোটি টাকা।
মানুষের সঞ্চিত অর্থের নিরাপত্তা, সেই অর্থের কুশলী বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্মানজনক বৃদ্ধি এবং অবশ্যই দেশগঠনে মানুষের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের কার্যকরী প্রয়োগ, মূলগত এই উদ্দেশ্য নিয়েই LIC'র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল - গত ৬৫ বছরের ইতিহাস সেই উদ্দ্যেশ্য পূরণে সাফল্যের স্বর্ণালী সাক্ষ্য বহন করে। বীমাগ্রাহকের সঞ্চিত অর্থের নিরাপত্তা প্রদানে, “ভারতীয় জীবনবীমা নিগম আইন, ১৯৫৬"-র ৩৭ নং ধারা অনুযায়ী LIC-তে সঞ্চিত অর্থ, বীমারাশি, ঘোষিত বোনাসের ওপর সরকারের “সার্বভৌম নিরাপত্তা”-র (SOVEREIGN GUARANTEE) সংস্থান আছে। তথাপি, ১৯৫৬ থেকে আজ অব্দি, কোনোদিনই LIC-কে নিজের প্রয়োজনে সরকারের কাছে অর্থের জন্য তদবির করতে হয়নি। সরকারের তৈরি ৫ কোটি টাকার LIC আজ ৩৯ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদশালী প্রতিষ্ঠান। উপরন্তু, LIC-ই সরকারের বিপদে আপদে SOVEREIGN GUARANTEE-র ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বারংবার। শুধুমাত্র দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১৭-২০২২) যদিও বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশন তুলে দেওয়ার মাধ্যমে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অবসান ঘটানো হয়েছে; LIC বিনিয়োগ করেছে ২৮ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন ভারতে কোন একক সংস্থা হিসেবে দেশের সামাজিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগে LIC একমেবাদ্বিতীয়ম। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শক্তি উৎপাদন (বিদ্যুৎ, কয়লা), প্রাকৃতিক,গ্যাস, পেট্রোপণ্য, বৃহৎ পরিকাঠামো (সড়ক, বাঁধ, সেতু ইত্যদি নির্মাণ), রেল, ব্যাংক সহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সর্বত্র LIC'র বিনিয়োগের গৌরবোজ্জ্বল উপস্থিতি। শুধুমাত্র সরকারী ক্ষেত্র না, বেসরকারি ক্ষেত্রেও LIC'র পুঁজির গতিবিধি অবাধ। গুজরাতের জামনগরের বৃহৎ তৈল সংশোধনাগার হোক, বা দুচাকার বাইক অথবা চার চাকার গাড়ির কোম্পানি, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের রথীমহারথী থেকে, টেলিকম শিল্পের অন্দরমহল, সর্বত্রই LIC'র বিনিয়োগের মসৃণ বিচরণ। ভারতের বৃহৎ শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে LIC'র দ্বারস্থ হয়েছে অর্থের সংস্থানে। বছর বছর, ভারত সরকারের ঘোষিত বাজেটের পরিকল্পনা খাতের বরাদ্দের জন্য অর্থ সংস্থান LIC'র বাৎসরিক দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের শেয়ারবাজারের বৃহত্তম প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীও LIC। স্থাবর সম্পত্তির (REAL ESTATE) বিচারে, ভারতীয় রেল ব্যতীত LIC'র সমতুল্য কেউ নেই এই দেশে। প্রকৃত অর্থেই ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শ্রী চিদাম্বরমের কথা অনুযায়ী “LIC ভারতের মুকুটের সর্বাধিক মূল্যবান রত্ন”। দেশগঠনে LIC'র ভূমিকাকে পাশে সরিয়ে, নিছক একটি বীমা সংস্থা হিসেবেও যদি LIC'র দক্ষতাকে বিচার করা হয়, তবে আমরা দেখতে পাই, মৃত্যুকালীন দাবী নিষ্পত্তি (DEATH CLAIM SETTLEMENT RATIO), যা কিনা একটি জীবন বীমা সংস্থার কর্মকুশলতার প্রধান পরিমাপক, তাতে LIC পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। বীমাগ্রাহকের সংখ্যায় LIC পৃথিবীতে শীর্ষস্থানীয়। সম্পত্তির বিচারে LIC পৃথিবীর প্রথম দশটি বীমা সংস্থার একটি। পরিষেবার নিরিখে LIC পৃথিবীর সর্বাধিক মূল্যবান ভারতীয় ব্র্যান্ড।
জনজীবনে LIC'র নিবিড় উপস্থিতি কিম্বা দেশীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড, ৬৫ বছরের এই গৌরবগাঁথা যাত্রা কিন্তু কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। আশির দশকে LIC কে ৪টি সংস্থায় ভেঙ্গে দেওয়ার পরিকল্পনা যদিও বা রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু দেশ যখন “আর্থিক উদারীকরণ” নামক পুঁজিবাদী আগ্রাসনের যুগান্তরে প্রবেশ করলো, সমস্ত ক্ষেত্রের সব রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার ন্যায় LICও বহুবিধ আক্রমণের সম্মুখীন হতে শুরু করলো। ১৯৯৪ এর মালহোত্রা কমিটির সুপারিশে ভারতীয় বীমা ক্ষেত্রে আমূল সংস্কারের নীলনকশা আঁকা হল। দেশি বিদেশী বেসরকারি সংস্থার জন্য বীমা ক্ষেত্র উন্মুক্ত করার নিদান দেওয়া হল, LICতেও সরকারের অংশীদারি কমিয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হল। ১৯৯৯ তে এই সুপারিশ অনুযায়ী INSURANCE REGULATORY & DEVELOPMENT AUTHORITY (IRDA ACT,1999) তৈরি করা হল। ২০০০ সাল থেকে জীবন বীমা ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ অনুমোদিত করে দেশি বিদেশী বেসরকারি কর্পোরেটদের জন্য উন্মুক্ত করা হল। সংসদে তদানীন্তন NDA সরকারের সাফাই ছিল, এর ফলে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জীবন বীমার আওতায় আরো বেশি মানুষকে আনা সম্ভব হবে, প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ এলে দেশের পরিকাঠামো উন্নয়নে অতিরিক্ত পুঁজির সংস্থান হবে সরকারের হাতে। এরপরে দুই দশক অতিক্রান্ত, প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের সীমা ২০১৫ তে ৪৯ শতাংশ এবং ২০২১এ ৭৪ শতাংশ করা হয়েছে। বাস্তবিক বিদেশী বিনিয়োগ কতোটুকু এসেছে? IRDA'র বাৎসরিক রিপোর্ট ঘেঁটে দেখা যাবে, সর্বাধিক কোন সংস্থায় বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ৩৫% মতো। ২০০০ থেকে ২০২১ অব্দি, সর্বমোট বিদেশী বিনিয়োগ জীবন বীমা ক্ষেত্রে মাত্র ৯০০০ কোটি টাকা, বলাই বাহুল্য এর কানা কড়িও দেশের সামাজিক বা পরিকাঠামো ক্ষেত্রে কাজে লাগেনি। এই ৯০০০ কোটি টাকার পাশে রাখুন, ৫ কোটি টাকার পুঁজি নিয়ে শুরু করা LIC অদ্যাবধি সরকারকে ডিভিডেন্ট বাবদ দেওয়া ২৬০০০ কোটি টাকাকে। আর, বেশি বেশি মানুষকে বীমার আওতায় নিয়ে আসার প্রশ্নে যদি তুলনা করা হয়, উদারীকরণের দুই দশক পার করেও, ২৪টি বেসরকারি ও বহুজাতিক বীমা সংস্থার সাথে প্রতিযোগিতা করে LIC আজও ৭১ শতাংশর বেশি পলিসির বাজার ও ৬৬ শতাংশর বেশি প্রিমিয়ামের ভাগ দখলে রেখেছে। পৃথিবীর কোথাও, যেখানে দু'দশক আর্থিক উদারীকরণ কার্যকরী হয়েছে, কোন রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার এই সাফল্য তথা আধিপত্যর দৃষ্টান্ত আর একটিও নেই। সম্পূর্ণ কৃতিত্ব LIC'র প্রকৃত মালিক ৪২ কোটি বীমা গ্রাহকের, অপর দুই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হলো লক্ষাধিক কর্মচারী এবং প্রায় ১২ লক্ষ এজেন্টের।
LIC'র এই অপ্রতিরোধ্য সাফল্যই, বেসরকারিকরণের নীতি ও কর্পোরেটদের তল্পিবাহক সরকারের চক্ষুশূল। প্রায় তিন দশক ধরে, বীমাগ্রাহকদের আস্থা, এজেন্টদের সঙ্গে নিয়ে কর্মচারীদের নিরন্তর লড়াই সংগ্রাম যে LIC'র রাষ্ট্রায়ত্ব চরিত্র বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, কর্পোরেট স্বার্থে সেই রাষ্ট্রায়ত্ব চরিত্র খর্ব করার নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। ২০২০'র বাজেট প্রস্তাবে LIC'র IPO (INITIAL PUBLIC OFFERING) আনার মাধ্যমে শেয়ার মার্কেটে LIC'র নথিভুক্তকরণের ঘোষণা করা হয়। তিনটি যুক্তি পেশ করে সরকার IPO আনার স্বপক্ষে। বলা হয়, এতে সরকারের হাতে ভালো পরিমাণ অর্থরাশি আসবে, যা কিনা দেশের কাজে লাগবে, LIC'র কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং LIC'র আর্থিক দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা দেশের মানুষের কাছে আরো স্পষ্ট হবে। তিনটে নেহাতই অসার যুক্তি। স্বাধীনতার পর থেকে যে পরিমাণ আর্থিক বিনিয়োগ LIC'র থেকে সরকার পেয়েছে তার ধারে ভারে আর কেউই নেই, ফি বছর গড়ে ৪ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগযোগ্য ফান্ড LIC তৈরি করে, সেই সংস্থার শেয়ার বিক্রি করে টাকা তোলা মানে, সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে মেরে ফেলার শামিল। কর্মদক্ষতার বিচারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে LIC'র অবস্থান প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনস্বীকৃত। LIC'র আর্থিক স্বচ্ছতার বিষয়টিও প্রশ্নাতীত, কারণ সম্বৎসর LIC সংসদে তথা IRDA'র কাছে আর্থিক হিসাব নিকেশ পেশ করে থাকে।
এই ঘোষণার পর থেকেই দেশজুড়ে বীমাকর্মচারীরা এজেন্টদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। বীমাগ্রাহকের সঙ্গে নিয়ে প্রবল বিক্ষোভ আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। কখনো বীমা ধর্মঘট, কখনো দিল্লীর যন্তর মন্তরে ধর্না সমাবেশ, কখনো দেশব্যাপী শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে, কিম্বা কখনো দেশব্যাপী দলমত নির্বিশেষে সাংসদদের কাছে IPO বিরোধী যুক্তি উপস্থাপনার দ্বারা একটি বৃহত্তর ঐক্যমত্য গঠনের প্রচেষ্টায় তাঁরা ব্রতী। কৃষক আন্দোলনের যৌথমঞ্চেও এই আন্দোলন একটি এজেন্ডা হিসেবে জায়গা করে নেয়। ক্রমে দেশব্যাপী, প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হতে শুরু করে, খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের শরিক দলের নেতা উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক থেকে শুরু করে তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখর রাও, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্তালিন, এমনকি নয়া উদারবাদের প্রবক্তা কংগ্রেস, সেই দলের ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিং এরা সকলেই LIC'র শেয়ার বিক্রির সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। বামপন্থী দলগুলির ধারাবাহিক বিরোধিতার অংশ হিসাবে কেরালার বিধানসভায় LIC'র শেয়ার বিক্রির প্রতিবাদে প্রস্তাব পাশ হয়। সদ্য অনুষ্ঠিত CPI(M) এর পার্টি কংগ্রেসে LIC'র IPO বিরোধী রেজলিউশন পাশ, এবং সর্বশেষ তাদের পলিটব্যুরো দেশব্যাপী LIC IPO বিরোধী আন্দোলনে শামিল হবার সিদ্ধান্ত ইত্যাদি ঘটনাসমূহ রাজনৈতিক স্তরে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।
দেশব্যাপী প্রবল বিক্ষোভ আন্দোলনের সম্মুখীন হয়ে, তথা ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা ক্ষোভের আঁচ পেয়ে সরকার কিছুটা রক্ষণশীল ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়। সংসদে সরকার ঘোষণা করতে বাধ্য হয়; LIC'র সামান্য কিছু শেয়ার সরকার বিক্রি করবে মাত্র, LIC কে বেসরকারি করার কোন পরিকল্পনা সরকারের নেই, ভবিষ্যতেও কখনোই LICতে সরকারের অংশীদারিত্ব ৫১ শতাংশের নিচে নামানো হবেনা সহ সরকারের SOVEREIGN GUARANTEE বজায় থাকবে। যদিও আন্দোলনরত বীমাকর্মচারীরা সরকারের এই আশ্বাসে আস্থা জ্ঞাপন করেনা, বরং এই IPO আনা যে বেসরকারিকরণের প্রথম পদক্ষেপ, এই বিষয়ে তাঁরা সজাগ। কারণ জুমলায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পাওয়া সরকারের সংসদে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, পালন না করার অতীত নজির অজস্র। ২০২১-২২ অর্থ বর্ষের মধ্যেই শেয়ার মার্কেটে লিস্টিং এর লক্ষ্য নিয়ে সরকার যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে LIC'র মূল্যায়নের কাজ শুরু করে। মিলিম্যান এডভাইসর নামক সংস্থা ও আর কিছু সহযোগী সংস্থার ওপর এর দায়িত্ব বর্তায়। ৩৯ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদশালী LIC, যার স্থাবর সম্পত্তির (REAL ESTATE) কোন হিসেব কোনোদিনই করা হয়নি, তার তড়িঘড়ি মুল্যায়নের উদ্যোগেই স্পষ্ট হয় সরকারের আসল উদ্দেশ্য ও অবস্থান। নিয়ম অনুযায়ী সেবির (SEBI) কাছে অবশেষে প্রাথমিক হিসেব ড্রাফ্ট রেডহেরিং প্রসপেক্টাস জমা পড়ে ১৩ই ফেব্রুয়ারী, ২০২২। এর পূর্বেই সংসদে সাংবিধানিক রীতি-নীতিকে অবজ্ঞা করে অর্থ বিলের মাধ্যমে “ভারতীয় জীবনবীমা নিগম আইন, ১৯৫৬”-র প্রয়োজনীয় সংশোধনী করা হয় এবং অপরাপর SEBI'র আইনেও বদল আনা হয় যাতে LIC'র শেয়ার সরাসরি বিদেশী সংস্থা কিনতে পারে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যায় যে, ড্রাফ্টে প্রস্তাবিত; সরকার প্রাথমিক ভাবে LIC'র ৫ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়বে। যার ৬৫ শতাংশ সংরক্ষিত থাকবে দেশি বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য, এবং বাকি ৩৫ শতাংশ থাকবে খুচরো বিনিয়োগকারীদের জন্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সরকার রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার শেয়ার বিক্রি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ১লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। দেশের সর্বাধিক সফল LIC'র 'মেগা' শেয়ার বিক্রি করে সিংহভাগ টাকা তুলবে এটাই ছিল উদ্দেশ্য। ধীরে ধীরে বাস্তবতার সমান্তরাল চাপে সরকারের টার্গেট ক্রমশ কমতে থাকে। মার্চের শেষেই এই প্রক্রিয়া শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। অকস্মাৎ, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সমূহ পরিবর্তন ঘটে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার ফলে। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে, আন্তর্জাতিক লগ্নিপুজির কারবারিরা নতুন করে পুঁজি বিনিয়োগ থেকে সরে আসে। তার ওপর, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে রাশিয়া (বিশ্বের দ্বিতীয় জ্বালানী তেল সরবরাহকারী দেশ) মার্কিন লবিকে বেকায়দায় ফেলতে ঘোষণা করে, রাশিয়ার কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত সস্তায় তেল কিনতে হলে ডলারের পরিবর্তে রুবলে কিনতে হবে। কোভিড পিরিয়ডের পর আবার আমেরিকা পেট্রোডলার মূল্যপতনের সম্মুখীন হয়। আমেরিকা এই অবস্থা সামাল দিতে ফেডেরাল রিসার্ভের সুদ বাড়িয়ে দেয়। ফলে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুজির বর্তমান গন্তব্য আমেরিকা।
এই উদ্ভুত পরিস্থিতে, ভারতীয় শেয়ার মার্কেটে LIC'র শেয়ার ছাড়া আদৌ সমীচীন হবেনা বলেই শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞদের বড়ো অংশের মত। কিন্তু, সরকার একগুঁয়ে। ১২ই মে-র মধ্যে প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে না পারলে SEBI'র কাছে জমা দেওয়া ড্রাফটের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। ফলে আবার নতুন করে মূল্যায়ন সময়সাপেক্ষ, নূন্যতম মাস তিনেক সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাবে। শেষ অব্দি জানা যাচ্ছে, LIC'র শেয়ার ২রা মে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য ও ৪ ঠা মে খুচরো বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত হতে চলেছে। এই তৎপরতার সাথে বড় ধরনের দূর্নীতির সম্ভাবনার পূর্বাভাস দিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সকল মানুষের মনে এখন যে প্রশ্ন সবথেকে বড় হয়ে উঠছে, LIC'র প্রকৃত মালিক কে? সরকারের কি নৈতিক অধিকার আছে এই সংস্থার সম্পদকে সস্তায় ব্যাক্তি মালিকানার জন্য উন্মুক্ত করার? দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের ঐ বীমাগ্রাহক যে কিনা প্রকৃত মালিক LIC'র, তিনি কি জানেন তার আস্থা এবং বিশ্বাসকে বাজারে বিক্রি করছে সরকার!! যাদের জন্য LIC'র এই কুবেরের ঐশ্বর্য উন্মুক্ত করছে, তাদের বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই এই সম্পদ সৃষ্টিতে। বিনিয়োগের বর্তমান চেনা ছক থেকে LIC যত সরে যেতে থাকবে, তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঐ বৃহত্তর গ্রাম ভারতের প্রান্তিক মানুষজন যারা LIC কেটেছে বলে নিশ্চিন্তে থাকে। বর্তমানে LIC'র একটিই ফান্ড, যার থেকে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত, ৯৫ শতাংশ পায় ঐ বীমাগ্রাহক বোনাস বাবদ, আর সরকার পায় ৫ শতাংশ ডিভিডেন্ট বাবদ। ইতিমধ্যেই, LIC'র ফান্ডকে (পার্টিসিপেটরি আর নন-পার্টিসিপেটরি) ২টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। পার্টিসিপেটরি ফান্ড থেকে সংগৃহীত লভ্যাংশের ৯০ শতাংশ পাবেন পলিসি হোল্ডার, আইন সেভাবেই পরিবর্তন করা হয়েছে আর শেয়ার হোল্ডার নন-পার্টিসিপেটরি পলিসি সৃষ্ট লভ্যাংশের ১০০ শতাংশ পাবেন ডিভিডেন্ট হিসাবে। স্বভাবতই ব্যাক্তিগত শেয়ার বিনিয়োগকারী চাইবে নন-পার্টিসিপেটরি পলিসিই LIC বিক্রি করুক। বিশ্বের বৃহত্তম কো-অপারেটিভ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নকশায় চলা LIC, যে মডেলে বীমাগ্রাহক প্রকৃত মালিক, আর কর্মচারী ও এজেন্টরা প্রধান স্টেক হোল্ডার, তাদের অন্ধকারে রেখে , তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে, সরকার, যে কিনা LIC'র নিছক ফান্ড ম্যানেজার, কার স্বার্থ চরিতার্থ করতে শেয়ার বিক্রির এই ঘৃণ্য খেলায় নেমেছে - তা আজ দেশের সকল নাগরিককে কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে হবে। আজ কেউ হয়ত ভাববেন, আমার এত মাথা ঘামানোর কি দরকার? LIC'র পলিসি আর কিনবো না, কিম্বা যা আছে , তুলে নেবো, ব্যাস, আমি নিশ্চিন্ত। কিন্তু, আপনি LIC'র বীমা গ্রাহক হওন কিম্বা না হউন, আপনি LIC'র দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে উপকৃত। যে রাস্তা বা ব্রিজের ওপর দিয়ে আপনি যাচ্ছেন, যে পানীয় জল আপনি খাচ্ছেন, যে বিদ্যুতের আলো পাখা ব্যাবহার করছেন, যে ট্রেনে চাপছেন, সর্বত্রই জুড়ে আছে ঐ ৪২ কোটি বীমাগ্রাহকের বিশ্বাসপুষ্ট অর্থ, বীমাকর্মী ও এজেন্টের ঘাম। ভারতবর্ষের অর্থনীতির এই মেরুদণ্ড আজ বিক্রি হলে সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনিও আর্থিক ভাবে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন না।
পূর্বেই উল্লেখিত, শেষ এক মাসে LIC শেয়ার বিক্রি নিয়ে সরকারের গতিবিধি, ক্রমশ সন্দেহর মেঘ ঘনীভূত করছে। বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, মার্চের শেষ দিকে যে LIC'র মূল্যায়ন (EV) ১৬ লক্ষ কোটি টাকা ধার্য হয়েছিল, এপ্রিল মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৪০ লক্ষ কোটি। ভাবুন, যে LIC প্রতি বছর ৪- ৫ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত তৈরি করে, তার নিজের বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫.৪০ লক্ষ্ কোটি টাকা? সরকার আন্তর্জাতিক লগ্নিকারিদের সাড়া পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে, ৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত থেকে নমনীয় হয়ে ৩.৫ শতাংশ শেয়ার আপাতত বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মার্চ মাসেও যে LIC'র শেয়ার বিক্রি করে ৬৩০০০ কোটি টাকা ঘরে তোলার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল সরকার, এখন সেই লক্ষ্যমাত্রা নামিয়ে এনেছে ২১০০০ কোটি টাকায়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, LIC'র প্রকৃত মূল্যায়নের (EV) সমান্তরালে শেয়ার প্রতি দাম নির্ধারণে মাল্টিপল ফ্যাক্টর পদ্ধতিতে যে নির্ণায়ক রাশি ধরা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্যতায় অবিশ্বাস্য। LIC'র এই ক্রমান্বয় অবমূল্যায়ন, জলের দরে শেয়ার বিক্রির সরকারী প্রবণতা কি কোন গুঢ় অভিসন্ধির ইঙ্গিত বহন করছে? ভবিষ্যৎ বলবে!! এর পরেও বিশ্বাস করা যায়, যে LIC'র শেয়ার বিক্রির উদ্দেশ্যগুলি যা বলেছিল সরকার, তার কোন যৌক্তিকতা আছে? অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহলে কানাঘুষো, স্বাধীন ভারতে বৃহত্তম IPO SCAM হতে চলেছে। দেশপ্রেমীর মুখোশে “দ্বেষপ্রেমী” এই সরকারের দেশ বিক্রির অভিপ্রায় রুখতে এখুনি সর্বস্তরের নাগরিক, বীমাগ্রাহক, এজেন্ট , কর্মচারী ঐক্য গড়ে তুলে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে, দেশের স্বার্থে দশের লাগি।