যে স্কুলটাতে আমি পড়াই সেটা অবস্থিত একটা কলোনি এলাকায়। বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের যে অংশটা সত্তর সালের পর বর্ডার ক্রস করে এদেশে পালিয়ে আসেন তাঁদেরই সন্তান-সন্ততি অথবা নাতি-নাতনিরা আমার ছাত্র হয়। বলাই বাহুল্য যে অর্থনৈতিকভাবে এঁরা সমাজের একেবারে নিচের তলার মানুষ। তাদের বাবাদের কেউ ভ্যান টানেন, কেউ লেবার খাটেন, কেউ রিক্সা চালাযন, আর মায়েরা হামেশাই এখানে ওখানে ঠিকে কাজ করেন। তবে স্কুলের সিনিয়র টিচারদের মুখে শুনেছি, বর্তমানে নাকি এসব অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রচুর উন্নতি হয়েছে। আগে প্রতিদিন দলে দলে ভিখারি বের হতো ভিক্ষা করতে। কিন্তু, আমি স্কুলে যোগ দেওয়া ইস্তক সেসব দেখিনি।
যাইহোক, আমার বর্ণনা থেকে এটা আশা করি ইতিমধ্যে বুঝে গিয়েছেন যে এরকম অঞ্চলের জন্য মিড-ডে-মিল একটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস। ওটা চালু হবার আগে ছেলে মেয়েদের একটা বড় অংশ অপুষ্টিতে ভুগতো। স্কুল চলাকালীন হামেশাই একটি-দুটি ছেলেমেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়তো। এখন সেসব অনেকটাই কমেছে। তবে, কোভিডের কারণে গতবছর থেকে স্কুল বন্ধ বলে ছেলেমেয়েদের মিড-ডে-মিলে দেওয়ার সিস্টেম একটা পরিবর্তন এসেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিদিন রান্না করা খাবার দেওয়ার বদলে প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ চাল-ডাল-আলু-চিনি ইত্যাদি সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় প্রতিমাসের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে। আর, এই কাজটার পরিচালনা এবং নথিভুক্তির দায়িত্বে থাকেন ক্লাস টিচাররা। তবে, একা একজনের পক্ষে তো এত কাজ করা সম্ভব নয় - একজন সাহায্যকারীরও দরকার পড়ে প্রত্যেক ক্লাস টিচারের।
যেদিনের কথা বলছি সেদিন এরকম সাহায্যকারীর ভূমিকাতেই ছিলাম আমি।
সেদিনও অভিভাবকরা লাইন দিয়ে টোকেন নিচ্ছিলেন আর আমরা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলিতে এন্ট্রি করছিলাম, এমন সময় এক ভদ্রমহিলা এলেন। মোটামুটি ভদ্রসভ্য জামাকাপড় পরা। আগেই বলেছি যে, আমার স্কুলে সাধারণত সমাজের একেবারে নিচের তলার মানুষজনের ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে। ফলে অনেক অভিভাবকরাই স্কুলে চলে আসেন একটু ময়লা ময়লা পোশাকআশাক পরে। আর সেই কারণেই কাউকে বাইরের পোশাকে (এর দ্বারা কিন্তু মোটেই দামি পোশাক বোঝানো হচ্ছে না) আসতে দেখলে সেটা আমাদের নজরে পড়ে। যাই হোক, ওঁকে টোকেন দেবার পর আমার সহকর্মী জিজ্ঞাসা করলেন যে উনি বা ওঁর বাড়ির কেউ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন কিনা। খুব শিগগিরই নিচের ক্লাসের ছেলেমেয়েদের জন্য অনলাইন ক্লাস শুরু হতে চলেছে আমাদের। সেজন্য প্রত্যেক অভিভাবককে বলা হচ্ছে যে তাঁরা যেন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ক্লাস টিচারকে মেসেজ পাঠান, যাতে নম্বরটা ওই ক্লাসের স্টুডেন্টদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অ্যাড করে নেওয়া যায়। ভদ্রমহিলা বললেন, 'আমি পারি না, আর যে পারতো সে তো আর নেই।' আমার কলিগ বোকার মত জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল, 'কে পারত?' ভদ্রমহিলা বললেন, 'আমার মেয়ে।'
একের পর এক মৃত্যুর খবর পাচ্ছি চারপাশ থেকে। কিন্তু, এই ভদ্রমহিলাকে চোখের সামনে দেখে যেন কিরকম একটা ধাক্কা লাগল। বোঝা গেল যে উনি নিম্নবিত্ত নন, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। সেই জন্য স্কুলে আসতে হলে একটু নতুন দেখতে পোশাক পরে আসেন। কিন্তু, একই সঙ্গে আর্থিকভাবে তিনি এতটাই সংকটাপন্ন যে সন্তান হারানোর শোক মনে চেপে তাঁকে মিড ডে মিলের চাল-ডালের ভাগ পেতে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে।
আমার মতে এই কোভিড সংকটের সবথেকে বড় শিকার যদি কেউ হয়ে থাকেন তা হল এই নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে দেখলে নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের মধ্যে পার্থক্য প্রায় থাকেই না (নিম্নবিত্ত/মধ্যবিত্ত জাতীয় শব্দগুলি দ্বারা অর্থনৈতিক অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত সাংস্কৃতিক পরিচয়ও কিন্তু বোঝায়, অর্থনীতির কঠোর অনুশাসিত সংজ্ঞার বাইরে - মানে, ঠিক যে অর্থে আমরা 'middle-class values' বলি - এখানে 'মধ্যবিত্ত' শব্দটাও সেই অর্থেই ব্যবহার করছি)। বরং, কিছু ক্ষেত্রে তো নিম্নবিত্তের অবস্থা নিম্নমধ্যবিত্তের তুলনায় ভাল হয়। একমাত্র পার্থক্য থাকে কেবল দুই শ্রেণির মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে। নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে এক ধরনের ফ্লেক্সিবিলিটি থাকে। অনেক সহজে তাঁরা এক পেশা থেকে অন্য পেশায় চলে যেতে পারেন। অতিমারীতে কাজ হারানো ড্রাইভার খুব সহজে ভ্যানে করে আনাজপাতি বা ফল বিক্রি করতে পারেন (এটা নিজের চোখে দেখেছি)। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সে ভিক্ষাবৃত্তি পর্যন্ত অবলম্বন করতে পারেন নিজের সঙ্গে খুব বেশি লড়াই না করেই। কারণ, দারিদ্র জিনিসটার সঙ্গে তিনি স্বচ্ছন্দ। সামাজিক সম্মান বজায় রাখার কোনো দায় তাঁর নেই। নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সঙ্গে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের পার্থক্য ঠিক এখানেই। নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে সেই ফ্লেক্সিবিলিটিটা নেই। সামাজিক সম্মান বজায় রাখার একটা চাপ তাঁর উপরে আছে। সে আধপেটা খেয়ে থাকবে, না খেয়ে থাকবে, বাড়িঘর বন্ধক রেখে চড়া সুদে টাকা ধার নেবে - কিন্তু কখনো ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি না দিয়ে সরাসরি ভিক্ষা করার জন্য হাত সে পাতবে না।
নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের দারিদ্র জিনিসটা যেন প্রায় হাইলাইটার দিয়ে চিহ্নিত করা। তার পোশাকআশাক দেখে তৎক্ষণাৎ আপনি বুঝে যাবেন যে মানুষটা গরিব। সেজন্য আপনি মানুষ হিসেবে মোটামুটি ভালো হলে তাঁর প্রতি কিছুটা অতিরিক্ত সহানুভূতিশীলও হবেন। অর্থনৈতিক সংকটের সময় আপনি নিজে এবং বৃহত্তর অর্থে সরকার স্বয়ং চেষ্টা করবে তাঁর পাশে থাকার। ঠিক এই কারণেই প্রকট দারিদ্র অনেকের ক্ষেত্রে একটা ক্যামোফ্লাজও বটে। তিনি হয়তো ততটাও গরিব নন যতটা তিনি দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো। সে আসলে যতটা গরিব তার তুলনায় নিজেকে তিনি সম্পন্ন দেখাতে চান। দারিদ্র তাঁর কাছে লজ্জার। দরিদ্রনারায়ণ সেবার খিচুড়ির লাইনে তিনি দাঁড়াতে পারেন না। সেজন্য সমস্ত রকম সরকারি এবং বেসরকারি রিলিফ এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা থেকে হামেশাই তিনি হন বঞ্চিত।
সেদিন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হল যেন একটা ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া জাহাজকে দেখছি! অ্যারিস্টটল ট্র্যাজিক নাটকের ইমোশনাল অ্যাপিল সম্পর্কে বলতে গিয়ে যে গ্রিক শব্দদুটির ব্যবহার করেছেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায় 'সমানুভূতি থেকে শোকভোগ' ও 'আতঙ্ক'। অর্থাৎ, দর্শক এখানে দূরে দাঁড়িয়ে কেবলমাত্র 'আহা বেচারা' বলে না, সে নাটকের কুশীলবের সাথে আংশিক অথবা সম্পূর্ণরূপে নিজেকে আইডেন্টিফাই করে, চরিত্রগুলির দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়, এবং তাদের শোকভার কিছুটা হলেও নিজের মধ্যে গ্রহণ করে। এই ভদ্রমহিলাকে দেখে আমার মধ্যেও সেরকমই একটা অনুভুতি হল। আমি নিজে অর্থনৈতিকভাবে যে শ্রেণিটির অন্তর্ভুক্ত তিনিও তারই একজন লেস প্রিভিলেজড সদস্য। অর্থাৎ, ওঁর মতো পরিস্থিতিতে পড়লে হয়তো আমাকে নিজেকেও হয়তো আবিষ্কার করতে হতো ওঁরই মতো কোন একটা অবস্থায়। বলা যায় না, হয়তো আমাকেও দাঁড়িয়ে থাকতে হতো সন্তান হারানোর শোক বুকে চেপে কোনও একটা মিড ডে মিলের লাইনে...