কোনোদিন ভাবিনি এতো তাড়াতাড়ি স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে হবে। হ্যাঁ, ডাঃ স্মরজিৎ জানা আমার কাছে শ্রদ্ধেয় স্যার। ফ্রেন্ড-ফিলোসফার-গাইড কথাটা বহুবার শোনা কিন্তু জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বিষয়টা এভাবে উপলব্ধি করবো দুর্বারে লিয়াজঁ অফিসার হিসাবে কাজ করতে আসার আগে বুঝিনি। কোথা থেকে শুরু করবো আর কোথায় শেষ করবো কিছু বুঝতে পারছি না। কলম তো ধরেছি অনেকের কথায় কিন্তু ভাষা আসছে না।
দুর্বার মানে যৌনকর্মীদের সংগঠন আর সেখানে যাওয়া মহিলা বা পুরুষদের সমাজের অনেক বাঁকা কথা, বাঁকা চোখের চাহনি সহ্য করতে হয়, সেটা কাজে যোগ দিয়েই বুঝেছিলাম। যদিও সেসব কিছু অতিক্রম করতে পেরেছিলাম স্যারের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি মেলাতে পেরে। আর যে দিদিদের মানবিক অধিকার, শ্রমিকের অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে কাজে যোগ দিয়েছিলাম সেই দিদিদের কাছ থেকে পাওয়া আন্তরিক ব্যবহার, তাদের কাছ থেকে পাওয়া সম্মান, ভালোবাসা আমার চলার পথ অনেক মসৃণ করেছিল।
প্রথম কমিউনিটি লিডার যৌনকর্মীর সন্তান মৃণাল কান্তি দত্ত (বাচ্চুদা) যাঁর ওপর প্রজেক্টের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করে স্যার চলে গিয়েছিলেন দেশের বাইরে, সেই বাচ্চুদার সঙ্গে দীর্ঘ বছর টিমে কাজ করার ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লড়াইটাকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় তা হাতে-কলমে করেছিলাম। আমি সবসময় বিশ্বাস করতাম চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। তাই সোনাগাছির দিদিদের সঙ্গে পথ চলা, তাদের জন্য অ্যাডভোকেসি করতে গিয়ে যা কিছু সমস্যার মুখোমুখি হওয়া, তার সবটাই ভাগ করে নিতাম পরিবারের লোকজনের সঙ্গে। আমার মেয়ে তখন বেশ ছোট, একদিন প্রশ্ন করেছিল --- "মা, বাবা তো বাড়ি এসে অফিসের কথা বলে না, তুমি রোজ বলো কেন"? বোঝাতে হয়েছিল বাবা চাকরি করেন স্রোতের অনুকূলে আর স্যার যে কাজ শুরু করেছিলেন সেটা স্রোতের প্রতিকূলে। আমার বাবা, মা, ভাই, বোন এমনকি শ্বশুরবাড়ির সকলে খুবই উৎসাহ দিতেন।
বিদেশ থেকে বা দিল্লি থেকে যখনই স্যার আসতেন তখনই একটা করে মিটিং করে সারা পৃথিবীতে এই আন্দোলন কতটা সাড়া ফেলেছে তা বোঝাতেন আর আমাদের উদ্বুদ্ধ করতেন এই বলে যে আমরা একটা ঐতিহাসিক কাজ করে চলেছি। স্যার এইচআইভি ইন্টারভেনসন পোগ্রাম নিয়ে কাজ শুরু করলেও পরে যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বার তৈরি করে তাকে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতবর্ষের বুকে অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক অব সেক্সওয়ার্কাসে রূপদান করেন যা এই আন্দোলনকে অনেক শক্তিশালী করে। মানুষ অনেকসময় সারা জীবনে দেখা একটা স্বপ্ন সফল করতে পারেনা আর স্যার যৌনকর্মী সংগঠনকে একটার পর একটা স্বপ্ন দেখিয়েছেন ও সেই স্বপ্নকে রূপ দিতে আমাদের মতো অনেক কর্মীকে কাজে লাগিয়েছেন।
গতর খাটিয়ে খাই ---শ্রমিকের অধিকার চাই
No Condom No Sex
Justice for Equality
sex work is work
এরকম অসংখ্য স্লোগান তৈরি হয়েছে।
বেশ্যা-খানকি থেকে যৌনকর্মীতে উত্তরণের পথটা অনেক কঠিন ছিল। যৌনকর্মী হিসাবে সমাজের কাছে তুলে ধরে তাদের দাবি দাওয়া ছিনিয়ে আনতে সমাজের অন্যান্য আন্দোলনে যৌনকর্মীদের যুক্ত করতে হয়েছে।
দুর্বার রিসার্চ সেন্টার গঠন করা এবং তার মাধ্যমে সমাজের অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের সংগঠন তৈরি করে তাদের আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বার বড় ভূমিকা পালন করেছে। আজকের সবুজ আমলাশোলে যেখানে মানুষ পিকনিক করতে যান, বেড়াতে যান ২০০৪ সালে সেই আমলাশোলে ছিল কঠিন পাথরে ঢাকা, রুক্ষ, শুষ্ক। আমলাশোল বিরসামুন্ডা গ্রামোন্নয়ন কমিটি ও আমলাশোল যুব উন্নয়ন কমিটি তৈরী করে তাদের মারফৎ বারবার সরকারের কাছে দরবার করেছে দুর্বার, তারই ফসল আজকের আমলাশোল।
একইভাবে পুরুলিয়ার মানভূমের অস্পৃশ্য নাচনিদের শিল্পীর অধিকার পাইয়ে দেওয়া, সেখানের গরীব শিল্পী ও বাজনদারদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়গুলি তুলে ধরতে ২০০৬ সালে মানভূম লোকসংস্কৃতি ও নাচনি উন্নয়ন সমিতি তৈরী করে এখনও সেই সমিতির পাশে থেকে পুরুলিয়ার শিল্পীদলকে বিশেষত নাচনিদের সর্বতোভাবে সাহায্য করে চলেছে দুর্বার।
এই যে ইউনিক এক একটা জিনিস, ধরুন শুধু দুর্বারের নয়, তাদের সন্তানদেরকে নিয়ে "আমরা পদাতিক" তৈরী করেছেন, "কোমল গান্ধার" করেছেন, যেটা প্রথমে যুক্ত ছিল কোমল গান্ধার সাংস্কৃতিক মঞ্চের সঙ্গে। তৈরী করে গেছেন বিনোদিনী শ্রমিক ইউনিয়ন। যা যৌনকর্মীদের নিজস্ব শ্রমিক সংগঠন, এইগুলো সত্যি আনপ্যারালাল। ভবিষ্যতে কতখানি লোকে বুঝবে বা জানবে সেটা ভবিষ্যৎ-ই বলবে, কিন্তু চেষ্টা করতেই হবে ভবিষ্যৎ-এ এগুলো এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে।
ইটপা (Immoral Trafficking Prevention Act), যার প্রয়োগ বিভিন্ন ধারার যৌনকর্মীদের রুটি রুজিতে আঘাত হানে। তাকে বাতিলের জন্য ২০০৬ সালের ৮ই মার্চ একটা গোটা ট্রেন বুক করে দুর্বার ও অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনের লোকজনকে নিয়ে দিল্লি রওনা হন। যেখানে রামলীলা ময়দানে প্রায় ৬ হাজার যৌনকর্মী সংগঠনের লোকজন ও বিভিন্ন এন.জি.ও কর্মী, ট্রান্সজেন্ডার জমায়েত হয়ে পার্লামেন্টের গেট থেকে যন্তরমন্তর পর্যন্ত র্যালি করে যাওয়া হয়। অনেক ল-ইয়ার পার্লামেন্টের গেটে দুর্বার, অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক অব সেক্স ওয়ার্কারদের সঙ্গে গলায় গলা মিলিয়ে বলেন ফেক দো ---ফেক দো ---ইটপা বাতিল করো...
একটা টিম স্যারের নেতৃত্বে পৌঁছে যায় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে। সেখানে ডেপুটেশন দেন। এরপর ২১ জনের একটি টিমের নাম আসে আমাদের কাছে, যাদের কাছে আমাদের যাতায়াত শুরু হয়। এই ২১ জন ছাড়াও প্রতিটি রাজ্যের এমপিদের বোঝাতে হয়েছিল ইটপার কুফল।
মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম যৌনকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান স্বীকৃতি বিষয়টা। ডাঃ জানা বা স্যারের কাছে পাঠ না নিলে হয়ত সমাজের এই দিকটার কথা জানতেও পারতাম না বা বা এই ভাবে আন্তরিকতার সাথে কাজ করতেও পারতাম না । স্যারের একটা জিনিস আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছিল সেটা হল, উনি এই লেভেলের একজন আন্তর্জাতিক মানুষ হয়েও প্রত্যেকের ফোন অ্যাটেন্ড করতেন। সারাদিনে কাজের চাপে যে ফোনগুলো ধরতে পারতেন না সেগুলো রাত্রে দেখে কল ব্যাক করতেন সেটা পরিচিত ব্যক্তি বা অপরিচিত ব্যাক্তি যেই হোন না কেন।
আমি যখন এখানে কাজ শুরু করি উনি বিদেশ থেকে মাসে একবার করে আসতেন। প্রায়ই বলতেন আপনারা নিজেরা পরিকল্পনা করে কাজ করুন। যেখানে যা সাপোর্ট দেওয়ার সবটাই অফিস দেবে। অর্থাৎ এখানে কাজের স্বাধীনতা ছিল। উনি চাপিয়ে দেওয়ার থেকে কর্মীরা নিজেরা ভালোবেসে কাজ করবে এতে আস্থা রাখতেন।
শবরদের সম্বন্ধে মানুষের ধারণা ছিল তারা অলস, কাজ করতে চায় না। আমলাশোলের আদিবাসী শবরদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দুর্বার প্রমাণ করেছে যে আদিবাসীদের বনাঞ্চলের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তাদের চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত করা এবং সুযোগ পেলে তারা জেলার বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারে, তীর ধনুক ছাড়াও তারা ফুটবল খেলায় যুক্ত হতে পারে এসবই স্যারের দেখানো পথে হেঁটে আমরা করতে পেরেছি।
ক্লাস ছিলেন না একেবারেই। ডাউন টু আর্থ না হলে প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নের স্বার্থে কাজ করা যায় না এটা ওনার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় কাজের সূত্রে পৌঁছে তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি। ওনার চেম্বারে একজন সাধারণ কর্মী থেকে উচ্চপদস্থ অফিসার, রিসার্চার যে কেউ যেকোনো সময় গিয়ে কথা বলতে পারতেন।
দুর্বারের এ. জি. এম বা রিট্রিট যখন হতো লাঞ্চ ব্রেক - এ আমরা থালা হাতে খাবার লাইনে দাঁড়াতাম। উনিও তাই করতেন। সারাদিন যখন আলোচনা হচ্ছে, প্রেজেন্টেশন হচ্ছে তখন উনি এক রকম, আবার সেই মানুষটাই মিটিং এর বাইরে যখন দেশ-বিদেশের কথা বলতেন তখন একেবারে খুব কাছের বন্ধুর মতো কথা বলতেন। একটা জিনিস খুব অবাক করতো আমাদের। সমস্ত বিষয়ে ওনার অবাধ বিচরণ অর্থাৎ বিজ্ঞানে যতটা দক্ষ ততোটাই ইতিহাস-ভূগোল সমাজতত্ত্ব সব বিষয়ে।
যৌনকর্মী দিদিদের প্রতি যে মমত্ব ওনার দেখেছি তা ভোলবার নয়। একজন নেত্রীর অপারেশনের সময় সস্ত্রীক সারাদিন হাসপাতালে থেকেছেন। আবার কোন নেত্রী অসুস্থ হলে কিভাবে কোনো ভালো জায়গা থেকে তাকে সুস্থ করা যাবে তার চেষ্টা করেছেন সব সময়।
দুর্বারের কাজের জন্য বছরের পর বছর ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে দলগতভাবে ছুটেছি শুধু ওনার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। স্যারের মতো মানুষদের মৃত্যু হয় না। উনি আছেন আমাদের অন্তরে বাহিরে। যেখানেই থাকুন শক্তি যুগিয়ে যাবেন ওনার সৃষ্ট কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর কিছু লেখার ভাষা পাচ্ছি না, ক্ষমা করবেন।
লেখিকা দুর্বারের এডভোকেসি অফিসার হিসেবে কর্মরত।
ডাক্তার জানার সম্বন্ধে যত জানছি,শ্রদ্ধা বাড়ছে।এই মানুষ গুলো সরকারী সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পেয়েছেন কি? বা বিবেচিত হয়েছেন কি?
খুব সামান্যই কটাদিন কাজের সুযোগ পেয়েছি। আপনার সংগে আলাপিত হওয়া ও জানা স্যারের সান্নিধ্য আমার জীবনের একটা বিশেষ অধ্যায়। জীবন যে কী, লড়াই কাকে বলে, নইলে বুঝতেই পারতাম না। ভালবাসা। নির্মাল্য কুমার মুখোপাধ্যায়
অসাধারণ লেখা