আমার দাদু সুচিত্রা সেনকে চুরি করে এনেছিলেন কলকাতা থেকে সাইকেলের রডে বসিয়ে। গ্রামের মানুষ দেখে অবাক। গালে হাত দিয়ে বলে, ওম্মা, এ তো দেখি দেবী সরেস্বতি।
দাদুর মা ঠাকুরুনটি ছিলেন বেশ বুদ্ধিমতি। তিনি ঘোমটা সামান্য নামিয়ে বললেন, সরেস্বতি হইবে ক্যান। এই হইল গে পরী। চ্যাত ভ্যাত দেখলি ঘাড় মটকে দিতি পারে।
এই হেতু সেকালে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে আর কেউ কৌতুহলী হয়নি। সুচিত্রা সেন দাদুর বাড়িতে থাকল কি গেল সেটা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। পরবর্তীকালে এই বিষয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। কোনো প্রামাণ্য সূত্রও রেখে যায়নি। গেলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
ফলে যেসব সিনেমায় সুচিত্রা সেনকে দেখি, সেই সুচিত্রা আসল সুচিত্রা সেন নয়-- ফেইক সুচিত্রা সেন। এটা হলপ করে বলা যায়। তবে সিনেমায় যে সুচিত্রা সেনকে আমরা দেখি তিনি আসলে কে?
সে প্রশ্ন আপাতত থাক।
এরমধ্যে সিনে পত্রিকার মারফত আমরা জানতে পারি সুচিত্রা সেনের বিয়ে হয়েছে। তার এক কন্যার জন্ম হয়েছে। 'সাতপাকে বাঁধা' 'সিনেমাটি মস্কোতে ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’’ পুরস্কারটি পেয়েছেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করেছে। এখানেও কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি।
সমস্যাটি এরপরের ঘটনা।
তাকে যখন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হলো, তখন জানা গেল, সুচিত্রা সেন আসবেন না। তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছেন। কাউকে দেখা দিচ্ছেন না। শোনা গেল, এই সময়ে তিনি ঘরের লোকদেরও দেখা দিচ্ছেন না। নিজের ঘরে দরজা আটকে রয়েছেন। তার মেয়ে মুনমুন সেন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারটি আনতে যেতে চেয়েছিলেন। শোনা যায়, সুচিত্রা সেন তার দরজার নিচে দিয়ে একটি চিরকুট পাঠিয়েছেন মেয়ে বরাবরে। লিখেছিলেন, না, তিনি এ পুরস্কারটি নিতে পারেন না। সুচিত্রা সেন সেজে থাকতে তার আর ভালো লাগছে না। ফিনিস।
শেষ বয়সে এসে এরকম বৈরাগ্য হতেই পারে বড়ো বড়ো মানুষের। চিরকুটের লেখা সন্দেহাতীতভাবে সেকথাই প্রকাশ করছে। কিন্তু ‘সেজে’ শব্দটা দ্বিতীয় বাক্যে প্রবেশ করে কিছু সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছে। যিনি সারাজীবন রূপালী পর্দায় বঙ্গদেশে তাবৎ বুড়ো যুবক তরুণদের স্বপ্নের নায়িকা হয়ে আছেন, বুড়ি যুবতী তরুণীরা শয়নে স্বপ্নে জাগরণে সুচিত্রা সেন সেজে থাকতে ভালোবাসেন,সেই সুচিত্রা সেন কেনো লিখবেন, তিনি আর সুচিত্রা সেন সেজে থাকতে ইচ্ছে করছেন না। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। তাহলে তিনি কি সত্যি সত্যি সুচিত্রা সেন ছিলেন না? তিনি কি অন্য কেউ?
২.
ঘুম থেকে উঠেই গান শোনার অভ্যাস গোপাল স্যান্যালের। আজ শুনবে বেগম আখতারের ঠুমরি। ‘আয়ে মহব্বত/ তেরে আঞ্জাম পে রোনা আয়েনা।’ ইউটিউবে গানটি সার্চ করতে গিয়ে চোখে পড়ল, বিডি নিউজ ২৪ এর একটি খবর নিউজফিডে ভেসে উঠেছে। লেখা, পাবনায় সুচিত্রা সেনের বাড়ি দখল। পাবনা শহরের একটি প্রভাবশালী মহল বাড়িটিতে ইমাম গাজ্জালী ইন্সটিটিউট খুলেছে। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। দেখে তার মাথায় গরম হয়ে গেল। সে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল খবরটির দিকে।
রান্নাঘর থেকে মা ডেকে বলল, টেবিলে রুটি ভেজে রেখেছি। হাত মুখ ধুয়ে আয়।
অন্যদিন এই ডাকের মধ্যেই গোপাল এসে পড়ে। আজ তাকে আসতে না দেখে মা তার ঘরে এলো। বলল, কিরে কাজে যাবি না? শরীর খারাপ নাকি?
গোপালের মুখে কোনো কথা নেই। সে ল্যাপটপের মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা লক্ষ করে মা কাছে এসে দেখল, তার গোপাল একটি মেয়ের দিকে চেয়ে আছে। দেখে একটু শরম পেলো। আবার তার একটু ভালোও লাগল, ছেলের তাহলে মেয়েতে মতি হয়েছে। এইবার বিয়ের যোগাড় করা যাবে।
কাছে এসে শুধালো, মাইয়াডা কেডারে বাপ?
শুনে সম্বিত ফিরল গোপালের। বলল, সুচিত্রা সেন।
-- কী চিত্র সেন?
--সুচিত্রা সেন।
শুনে গোপালের মায়ের মুখ থেকে হাসি হাসি মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক থেকে।
গোপাল তার বাপকে দেখেনি। হয়তো দেখেছিল। তখন হয়তো মনে রাখার বয়সই হয়নি। হলেও বহুদিন অদেখার কারণে ভুলে গেছে। বাপের নাম নেপাল। স্কুলের খাতায় লেখা নেপাল স্যান্যাল। পাবনায় বাড়ি। বাড়ি যে আহামরি তা নয়। নেপাল আর নেয়ামত দুবন্ধু সাইকেলে চড়ে স্কুলে যায়। ঘুরে বেড়ায়। তারা ভালো ছেলে গার্লস স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা তুলে তাকায় না। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
এরকমই একটি দিনে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে অন্নদাগোবিন্দ লাইব্রেরি প্রাঙ্গনে বিচিত্রা অনুষ্ঠান হলো। সেখানে অনেকের সঙ্গে নেপাল আর নেয়ামত সে অনুষ্ঠানে গেল। চাদরে মুখ ঢেকে গান-বাজনাও শুনল। এরপরে শহরের রমারাণী নামে ক্লাশ টেনের এক মেয়ে কাজি নজরুলের একটি গান নেচেগেয়ে মাত করে দিল। তার গানটি যখন শেষ হবে হবে করছে তখন শোনা গেল, কে বা কারা তরুণ কণ্ঠে বলে উঠল--
রমা মেরা রমা
হৃদয় দিয়েছি জমা।
একথা উচ্চারিত হওয়ার পরে রমার গান থেমে গেল। তার চোখে জল টলমল করে উঠেছে। সেই জল বের হতে গিয়ে থমকে আছে। দেখে সারা টাউন হল স্তব্ধ হয়ে গেল। সেই জল মাটিতে পড়ার আগেই চারিদিকে মহা কলরব উঠল। বলল, কার এমন সাহস যে ভদ্র মেয়েদের অপমান করে?
এরপর আর সাহস কেউ করেছে শোনা যায়নি। আর অনুষ্ঠানটিও আর চলেনি। রমা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে ছিল। তবে চোখ থেকে জলের ফোঁটা আর পড়েনি। গোপনে তার মুখে একটু মৃদু হাসি খেলে গেল। সে সময় তার মা স্টেজ থেকে টেনে নিয়ে গেল।
এ ঘটনা নিয়ে শহরটা সরগরম হয়ে উঠল। কেউ ছি ছি করতে লাগল। কেউ ফিসিফস, কেউবা গুজ গুজ করল। আবার কেউ কেউ টাউনহলের মোড়ে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী বক্তৃতা দিল। থানা পুলিশও তৎপর হলো। কে বা কারা কাজটি করেছে সে বা তারা ধরা পড়েনি। তবে একদিন স্কুলের হেড মাস্টার জোড়া বেত দিয়ে নেপাল আর নিয়ামতকে পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে দিলেন। তারা ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে টাউন হল মোড়ের স্মৃতি স্টুডিওতে ঘোরাঘুরি করছিল। তারা দুজনেই শুরুতে ব্যথায় হাউমাউ করে উঠলেও এক সময় অবাক হয়ে হেড মাস্টারকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদেরকে মারছেন ক্যানো?
হেড মাস্টার কোনো উত্তর দিতে পারেননি। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বেতজোড়া ফেলে দিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসেছিলেন। তাদের দিকে না তাকিয়ে বলেছিলেন, গেট আউট। রাগে তার চোখ থেকে আগুণ বের হচ্ছিল। তিনি মাথা ধরে বসে পড়লেন।
এই ছাল তোলার ঘটনাটি বাইরে জানাজানি হয়নি। এই দুটো কিশোরও খুব বেশি কষ্ট পেয়েছে কি পায়নি সেটা বোঝা না গেলেও তারা কিছুদিন কাজী নজরুল রচিত গানটি গুণগুণ করল।
তবে এই গুণগুণ করতে করতে তারা দুজন কলিগ্রামে চলে গেল। সেখানে ইশারাতুল্লাহ মাঝির থান আছে। তিনি বড়ো জাগ্রত পীর। রবিবাবু যখন এইখানে জ্যোতিদাদার সঙ্গে এসেছিলেন কিশোরকালে তখন পীর সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি ভাড়ারা গ্রামে লালান শাহের সঙ্গ করতে গিয়েছিলেন। পরে যখন রবিবাবুর যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, বাবার আদেশে বিয়ে করেছেন দক্ষিণডিহির ভবতারিনীকে, ভবতারিনী পাঁচটি ছেলেমেয়ে নিয়ে কলকাতায় আছেন, সেই তখন একদিন রবিবাবু একা একা উষাকালে খরাক্রান্ত দীর্ঘপ্রান্তরে হাঁটছেন, ভাবছেন এই গ্রামের অনাহারী মানুষদের মুখে কী করে খাবার তুলে দেওয়া যায়, তখন তিনি অকস্মাৎ দেখতে পান একজন শ্বেত শ্মশ্রুধারী গ্রামবৃদ্ধ উর্ধাকাশে হাত তুলে তাকিয়ে আছেন। তাকে দেখে শ্মশ্রুধারী গ্রামবৃদ্ধ একটু হাসলেন। উর্ধাকাশ থেকে হাতটি নামিয়ে রবিবাবুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। এ বোধ হয় ভিক্ষে চাইতে এসেছে। তিনি পকেটে হাত দিতে যাবেন তখন দেখলেন বুড়ো লোকটির মুঠো খোলা নয়, বন্ধ। সেই মুঠো বন্ধ হাতটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘'নে।’’
রবিবাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, কি?
বৃদ্ধ আবার হাসলেন। বললেন, নিয়েই দেখ না।
রবিবাবু এবার আর প্রশ্ন করলেন না। বৃদ্ধের মুঠো খুলে গেল। করপুটে একটি রূপোর টাকা। টাকার উপরে মহারানীর ছবি আঁকা।
বৃদ্ধটি যেতে যেতে বললেন, আমরা না দিলে তোরা খাবি কি?
রবিবাবু চেয়ে দেখলেন, বৃদ্ধটি আর নেই। মিলিয়ে গেছেন কুসুম কুসুম আলোর দিকে। সে আলো ধীরে ধীরে সাদা হয়ে যাবে। আবার সন্ধাকাশে কুসুমে কুসুমে চরণ চিহ্ন দিয়ে পাটে বসবে। রবিবাবু এটা নিয়ে একটা গানও লিখেছিলেন শোনা যায়--
আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই
তখন যাহা পাই
সে যে আমি হারাই বারে বারে ॥
তিনি যখন ভিক্ষা নিতে আসেন আমার দ্বারে
বন্ধ তালা ভেঙে দেখি আপন-মাঝে গোপন রতনভার,
হারায় না সে আর।।
আমি যখন তার দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই।
তার দরগা পাকা করে দিয়েছিলেন রবিবাবুর ছেলে। এলাকায় তাকে রবিপীর বলে ডাকা হয়।
নেপাল আর নেয়ামত যখন এই জাগ্রত রবি পীরের সন্ধানে কলিগ্রামে যাওয়া আসা করছে তখন একদিন কে বা কারা ফিসফাস করে বলল, হেমসাগর লেনের করুণাময় দাশগুপ্তর মেয়েটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। শোনা যায় অন্নদাগোবিন্দ লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে সেই মেয়েটি বিচিত্রা অনুষ্ঠানের ঘটনার পরে অনেকটা ঘরবন্দী হয়েই দিন কাটাচ্ছিল। একদিন বিকেলে গবাক্ষপথে যখন সে পথের দিকে তাকাচ্ছিল, তখন তার মা তার নাম ধরে একবার ডাক দেয়। সে সাড়া দেয়। দ্বিতীয় বার আবার ডাক দেয়। সেবারেও সে সাড়া দেয়। তবে তৃতীয়বারে ডাক দিলে তার আর সাড়া দেয় না। তাতে সন্দেহ হলে তার মা গবাক্ষের কাছে ছুটে এসে দেখেন, মেয়ে নেই। সারা ঘরদোর খোঁজাখুঁজি করে সে মেয়েকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন তিনি মাথায় হাত দিয়ে বিলাপ করতে থাকেন। বলেন, হায়, আমাদের কী হবে।
এই আমাদের 'কী''র মধ্যেই সমস্যাটি গুপ্ত ছিল। এই হেতু স্থানীয় মিউনিসিপালিটর স্বাস্থ্য পরিদর্শক করুণাময় দাশগুপ্ত এসে স্ত্রীর কানে কানে বলেন, এখন কান্নার সময় নয়। লোকে জানলে মানহানি হবে। ঘটনাটি গোপন করে যাও।
গোপনে অনেক তত্বতল্লাশ করেও যখন মেয়েটির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না, তখন করুণাময় দাশগুপ্তকে এক কলিগ বলেন, কলিগ্রামের জাগ্রত রবি পীরের শরণ নিয়ে ফল পাওয়া যেতে পারে। তার অসাধ্য কিছু নেই।
এই পর্যায়ে কলিগ তাকে আরো জানান, পীরের কাছে অতি সম্প্রতি কে বা কারা ধর্ণা দিয়েছিল। পীর তাদের বাসনা পুরণে একটা ছিপি আটা বোতল পড়ে দিয়েছেন। বলেছেন, এই বোতলে, ইচ্ছে করলে যাকে তাকে ভরে নিয়ে যাওয়া যায়। কেউ টেরও পাবে না।
শুনে করুণাময় দাশগুপ্ত আর দেরী না করে পাবনা থেকে কলিগ্রামে ছোটেন। থানে ধর্ণা দিয়ে কদিন পড়ে থাকেন। জানতে পারেন, মেয়েটিকে আর পাওয়ার সম্ভাবনে নেই। সে বোতলে বন্দি হয়ে চলে গেছে। জেনে দাশগুপ্তবাবু দরগার ছাতিমতলায় এসে হত্যে দিয়ে পড়েন। একদিন দুদিনের জন্য নয়, টানা এগারো দিন এই হত্যে দিয়ে পড়ে থেকে দ্বাদশ দিনে তার শ্বাস ওঠে। তার স্ত্রী এবার পাগলিনী হয়ে দরগায় মাথা ঠুকে ঠুকে রক্ত বের করতে লাগেন। শোনা যায়, এই অবস্থায় করুণাময় দাশগুপ্তর পরিবারের অবস্থা বিবেচনা করে জাগ্রত পীর ফুঁ দিয়ে তাদেরকে একটি মেয়ে বানিয়ে দিতে ইচ্ছে করেন। তিনি তাদেরকে মেয়েও বানিয়ে দেখান। সেটা দেখে করুণাময় দাশগুপ্ত বলেন, এ তার মেয়ে নয়। এর নাম মেরেলিন মনরো। অনিন্দ্য সুন্দরী। পেশায় মডেল। সিনেমায় ছোটো খাটো রোলে অভিনয় করছে। তবে তিনি নিশ্চয়ই একদা সেরা অভিনেত্রী হবেন বলে সিনেমা বিশেষজ্ঞারা ফোরকাস্ট করেছেন। এ রকম মেয়ের বাবা হতে পারলে তার গর্বের সীমা থাকবে না। তবে কিনা মেয়েটি বাঙালি হওয়া দরকার।
পীর তখন হেসে বলেন, চিন্তা মাত করো। তিনি চোখের পলকে আরেকটি ফুঁ দিয়ে মেরেলিন মনরোর চেহারাকে পালটে দিলেন। এবারের মেয়েটিকে দেখতে তার নিজের মেয়ের মতো। ১০০% ডুপ্লিকেট মনে হয় না। বলে দিলেও কেউ বিশ্বাস করবে না এটা তার মেয়ে রমা নয়। একই রকম একটু ঠোঁট টিপে হাসে। একই কণ্ঠস্বরে কথা বলে। বাঁকা চাউনি দেয়। রবি পীর বললেন, এই মেয়েকে নিয়ে যাও। এ তোমার মেয়ের মতো দেখতে হলেও ঠিক তোমার মেয়ে নয়। এর নাম সুচিত্রা সেন। আগামী দিনের এই সুচিত্রা সেন অভিনয়ে সেরা হবে।
সত্যি মেয়ে কি মিথ্যে এই নিয়ে করুণাময় দাশগুপ্ত বা তার স্ত্রীর কোনো ঝামেলা না থাকলেও তারা ঠিক করলেন, মেয়েটিকে নিয়ে নতুন কোনো ঝামেলা পড়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেবেন। বিবাহিত মেয়েদের নিরাপত্তা অপেক্ষাকৃত ভালো আছে। তাছাড়া দিন কাল বেশি ভালো নয়। গেল বছর হিটলার পড়ে গেছে। তার তোপে দেশ এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ থেকে সবে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ ভাঙাভাঙির কথা চলছে। গোপনে গোপনে ছেলে দেখতে লেগে গেলেন তারা।
যতই গোপন করুন না কেনো বিষয়টি আর গোপন থাকে না। এলাকার লোকজন জেনে যায়। তাদের মধ্যে নানাবিধ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। অধিকাংশই ছিল ক্ষোভজনিত। এখনই কেনো বিয়ে দিতে হবে? বিয়ে দিতে হলে বাইরে কেনো?--এলাকায় কি উপযুক্ত পাত্র নেই? দিতেই যখন হবে তবে গোপনে কেনো? ইত্যাদি ইত্যাদি।
সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, কে বা কারা আবিস্কার করে ফেলল, কোলকাতার বিশিষ্ট ব্যারিস্টার আদিনাথবাবুর ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এটা নিয়ে পাড়ায় মহল্লায় গুজগুজ ফিসফাস, হৈ চৈ হট্টগোল পর্যন্ত গড়াল। অতি উৎসাহী কে কারা ঠিক করল, বিয়ে তো দূরের কথা, ছেলে পক্ষকে মেয়ে দেখতেও পাবনায় আসতে দেবে না।
এসবের মধ্যে শহরের নেপাল আর নেয়ামতকে উদ্বিঘ্ন হতে দেখা গেল না। তারা দুজনে স্কুলে আসে। ফাঁকে ফাঁকে স্কুলের পেছনে ঝোঁপের আড়ালে ঢোকে। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ কাটায়। তাদের হাতে একটি বোতল। বোতলটি নিয়ে তারা খোস গল্পে মেতে থেকে। বোতলটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। বোতলের গায়ে ঠোঁট ঠেকায়।
খবরটি হেডমাস্টারের কানে গেলে তিনি জোড়া বেত হাতে তাদেরকে ধরতে গেলেন। নেয়ামত হেড মাস্টারমশাইকে আসতে দেখে সুড়ুৎ করে পালিয়ে গেল। আর ধরা পড়ল নেপাল। তার কাছে তন্ন তন্ন করে বোতলটি খোঁজা হলো। পাওয়া গেল না। হেড মাস্টার ধারণা করলেন নেয়ামত বোতলটি নিয়ে সরে পড়েছে। তাকে জোড়া বেত দিয়ে পেটাতে পেটাতে তিনি হুঙ্কার দিলেন, তার ছাত্ররা মদ খায় এটা ভাবতেই তিনি পারছেন না। নেপাল পিটানি খেতে খেতে বহুবার বলল, স্যার, আমরা মদ খাচ্ছিলাম না। আমাদের মুখ শুকে দেখুন। কোনো গন্ধ নেই। ওটা জাদুর বোতল। পীরবাবা দিয়েছেন।
--জাদুর বোতলে কী আছে? জানতে চাইলেন হেড মাস্টার।
--রমা। রমারাণী আছে। রবি পীর ফুঁ দিয়ে ভরে দিয়েছেন।
শুনে হেড মাস্টার মশাইয়ের হাত থেকে জোড়া বেত পড়ে গেল।
এরপর শহরে নেপালকে কদিন একা একা ঘুরতে দেখা যায়। তার মানিকজোড় নেয়ামতের খবর নেই। খুব বিমর্ষচিত্তে নেপালের এই নিঃসঙ্গ ঘোরাঘুরি কারো চোখে পড়ার সময় নেই। শহরের লোকে তখন হায় হায় করছে, ব্যারিস্টার আদিনাথ বাবু হয়তো খবর পাঠিয়েছেন, এই বিয়ে হবেই। কোলকাতা থেকে তিনি আসবেনই। বিয়ে উপলক্ষে রবি ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথও আসবেন। এ এলাকায় তাদের জমিদারি আছে। বিশিষ্ট গায়ক কানা কেষ্টও বরযাত্রী হবেন। তিনি সিনেমার গান গাইবেন। গাইবেন--
‘স্বপন যদি মধুর এমন হোক না কল্পনা,
তারে জাগিও না’’ ।
শোনা যায়, সে সময়ে কে বা কারা কোলকাতায় গিয়ে আদিনাথ বাবুর কাছে বেনামী চিঠি দেয়। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘পাবনাস্থিত যে কন্যার সহিত আপনার পুত্রের বিবাহ করাইবার চিন্তা করিতেছেন, আপনার সদয় জ্ঞাতার্থে জানানো যাইতেছে যে, কন্যাটি ইতিমধ্যে এক বিজাতীয় পুরুষের পানিগ্রহণ করিয়াছে। এবং কন্যাটি আসন্নপ্রসবা’।
আদিনাথ বাবু ব্যারিস্টার মানুষ। তিনি বাঙালির স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে দিব্য জ্ঞান রাখেন। তাই দেরি না করে করুণাময় দাশগুপ্তকে কন্যাটিকে কোলকাতায় গোপনে আনতে অনুরোধ করলেন। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন কন্যাটি অনাঘ্রাতা। তারপর পাবনায় নয়, কোলকাতায়ই বিয়ের ব্যবস্থা করলেন।
এ ক্ষেত্রে পাবনার আদি ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা কবিরত্ন হেরম্ব নারায়ণ মারফত আরেকটি গোপন খবর জানা যায়। সেটা হলো, বিমর্ষচিত্ত নেপাল কোলকাতায় রওনা হয়ে যায়। তার মনে হয়েছে, বোতলে বন্দী রমাকে নিয়ে নেয়ামত একা একা পালিয়ে গেলেও শেষমেষ হয়তো তার বাপচাচাদের অনুরোধে ফেরত দিয়েছে করুণাময় দাশগুপ্তর কাছে। তার বাপচাচারা চায়নি চেনাজানা লোকদের মেয়ে নিয়ে একটা দাঙ্গাফ্যাসাদ হোক। আলটিমেটলি মেয়েটি তো তাদেরও। তারা তাকে হতে দেখেছে। তার ষষ্টীর দিনে রসগোল্লা খেয়েছে। রসগোল্লা খেতে খেতে তারা দেখেছে, ছয়দিনের মেয়ে আড় নয়নে চেয়ে ঠোঁট টিপে হাসে।
নেপালের আরেকটি ধারণা জাগে, সেটা হলো-- রমাকে ফিরে পেয়ে করুণাময় দাশগুপ্ত পাবনা ছেড়ে চিরকালের জন্যই চলে যাবে। হয়তো নেয়ামতের বাপচাচারা তাদের সম্পত্তিটি কমদামে কিনে নেবে। এই শর্তেই তারা নেয়ামতের কাছ থেকে বোতলটি তারা কেড়ে নিয়েছে। বোতল ভেঙে রমাকে করুণাময় বাবুর কাছে পৌঁছে দিয়েছে। তারা এখন কোলকাতায় রওনা হয়ে গেছে।
রমারাণীর সঙ্গে আর দেখা হবে না নেপালের। হেরম্ব নারায়ণ এই নিয়ে একটি পদ লিখেছিলেন,
হিয়ার বিহনে কাঁদে নিরুপায় হিয়া।
কেমনে কাটিবে দিন ভাঙামন নিয়া।।
এই আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় কাতর হয়ে নেপাল ট্রেনযোগে কোলকাতায় রওনা হয়ে যায়। যে মুহুর্তে করুণাময় দাশগুপ্ত শেয়ালদা স্টেশনে সপরিবারে নামে, যখন তাদের রমা নামের মেয়েটি ট্রেন লাইনের ভেতর ইঁদুর দেখতে একটু সরে যায়, ঠিক সেই ক্ষণেই নেপালচন্দ্র রমাকে নিয়ে বায়ূবেগে উধাও হয়ে যায়।
কেউ কেউ বলে, এটা নিয়ে কেস কারবারিও হয়েছিল। কেউ কেউ বলে, পুলিশের কাছে ধরা পড়তে পড়তে শেষে খিদিরপুর ডক দিয়ে নেপালচন্দ্র পালিয়ে যায়। সঙ্গে রমারানীকে আধহাতি ঘোমটা পরিয়ে নিয়ে সোজা আন্দামান চলে যায়। আর ফেরেনি। ঘটনা খতম।
এইখানে এসে নেপালচন্দ্র সান্যালের ছেলে গোপাল বেশ ধ্বন্ধে পড়ে যায়। তার বাবা নেপালচন্দ্র যদি রমারানীকে নিয়ে চিরকালের জন্য আন্দামান চলে যায় তাহলে তার মা মালতিবালা কে? আর কিভাবে সে নিজে নেপালচন্দ্রের ছেলে?
এই প্রশ্নের উত্তর গোপাল স্যান্যালের জানা নেই। এ জগতে তার মা মালতিবালাই হয়তো জানলেও জানতে পারেন এইসব প্রশ্নের উত্তর। তিনি মৃদুভাষী। সারা জীবন মৃদুভাষী হয়েই আছেন। কোনো বিষাদ বেদনা তার মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছে। তার কাছ থেকে কথা বের করাও সহজ নয়। আর প্রশ্ন দুটি এতো স্পর্শকাতর যে, তাকে জিজ্ঞেস করা ততোধিক কঠিন। কিন্তু প্রশ্ন দুটি তার মাথার মধ্যে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, তারা রীতিমতো পলে পলে ঘাই মারছে।
মরিয়া হয়ে শেষে মাকে জিজ্ঞেস করল গোপাল স্যান্যাল। ভেবেছিল তার মা মালতিবালা মুখ খুলবে না। মুখ কালো করে এড়িয়ে যাবে। অজানা হয়ে যাবে এইসব গোপন শুলুক। কিন্তু আজ মুখ খুলল মালতিবালা। বলল, না, তার স্বামী নেপালচন্দ্র রমারাণীকে নিয়ে পালিয়ে যায়নি। যেতে পারে না। পালিয়ে যাওয়ার মতো লোক নয়।
প্রকৃত তথ্য হলো--দিবাকর সেনের সঙ্গে রমারানীর বিয়ে ঠিকঠাক মতো হয়ে গেল। কোথাও কোনো ঝামেলা হলো না। আর বিয়েটা কোলকাতায় নয়-- হলো পাবনায় করুণাময় দাশগুপ্তর বাড়িতেই। জাঁকজমক করে সাজানো হয়েছে। শহরের গণ্যমান্য লোক বিয়েতে শামিল হয়েছিল। আর ছিল পুলিশ। সারা বাড়িতে পুলিশ ঘিরে ছিল। নেয়ামতের খবর নেই। নেপালকে স্কুলের মধ্যে আটকে রেখেছেন হেড মাস্টার মশাই।
বিয়েটা হয়েছিল গোধুলী লগ্নে। স্কুলের হেড মাস্টার মশাইয়ের ঘর থেকে দেখা যাচ্ছিল সেইক্ষণে সারা শহর আলো ঝলমল হয়ে উঠেছে। বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেব নিজে এসেছেন লক্ষ্ণৌ থেকে। বেহাগে তিনি শানাইয়ে সুর ধরলেন। সেই সুর লতিয়ে লতিয়ে উঠল হাওয়ার মধ্যে, তখন হেড মাস্টার মশাই জনান্তিকে বললেন, এবার মালা বদল হচ্ছে। বলতে বলতে মাস্টার মশাইয়ের গলা ভারী হয়ে গেল। তিনি উঠে নেপালচন্দ্রের কাছে এগিয়ে গেলেন। দুহাত ধরে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। হু হু করে কাঁদতে লাগলেন। শোনা যায় সে কান্নার কোনো অন্ত ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে তিনি পড়ে গেলেন। তার গা ঘেমে যাচ্ছিল। তিনি কাঁপতে কাঁপতে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছিলেন। তার মুখে গ্যাঁজলা উঠেছে।
সে সময়ে পাড়ার অনাদি ডাক্তার বিয়ে বাড়ি থেকে খেয়ে দেয়ে ফিরছিলেন। বিয়েতে পুরোটা থাকতে পারেননি। সাত পাঁক ঘুরতে যাবে এমন সময়ে তিনি উঠে পড়েছিলেন। পশ্চিম পাড়ার এক রোগীকে ইঞ্জেকশন দিতে যাবেন। নেপালচন্দ্র ছুটে গিয়ে তাকে পথেই আটকালো। তিনি এসে দেখে শুনে গম্ভীর মুখে বললেন, সন্যাস রোগ। নিদান নেই। তিনি হেডমাস্টার মশাইয়ের কানে কানে বললেন, এইবার রাম রাম বলুন। রাম রাম বলুন।
শুনে হেডমাস্টারমশাইয়ের কাঁপুনি থেমে গেল। বড় বিড় করে চোখ মেললেন। মাথাটা ঘুরিয়ে কাকে যেন খুঁজলেন। বড় বড় করে স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, রমা রমা রমা….
ডাক্তার একটু অবাক হলেন। আবার বললেন, বলুন রাম রাম…
তিনি চোখ মুদলেন। মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। চোখের পাতার ভেতর থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে বললেন, হায় রমা…
ডাক্তার হাত ধরে ছিলেন। সেটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, যাও খোকা, লোকজনদের খবর দাও। হেডমাস্টার মশাই দেহ রেখেছেন।
পরদিন ভোরে রমারাণীর বাসি বিয়ে হচ্ছে। আর পাড়ার লোকেরা হেড মাস্টার মশাইকে শ্মশান ক্ষেত্রে নিয়ে যাচ্ছে। হেড মাস্টার মশাই ছিলেন চিরকুমার। তার বাপদাদার সম্পত্তি এই স্কুলেই দান করে গিয়েছিলেন। নিজের বলতে কেউ ছিল না।
তার শরীর যখন আগুনে পুড়ছে, তখন নেপালচন্দ্র হেডমাস্টার মশাইয়ের বালিশের ভেতর থেকে একটি চিরকুট খুঁজে পেল। তাতে বাঁকা হস্তাক্ষরে লেখা,
‘ রমা আমার রমা
তুমি করিও মোরে ক্ষমা।
অনেক অশ্রু রইল পড়ে জমা।।’
নেপালচন্দ্র দেখে বুঝল এটা হেড মাস্টার মশাইয়ের হস্তাক্ষর। তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো করে লেখা শিখেছিলেন। এটা নিয়ে তার কিঞ্চিৎ শ্লাঘা ছিল। অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্রও তিনি এই হস্তাক্ষরে লিখে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতেন। দু বছর আগে তার টেবিলের কাঁচের নিচে লিখে রেখেছেন, ‘বিচিত্র ছলনা জালে আকীর্ণ করে রেখেছ ছলনাময়ী।’
ফলে এই লেখা যে হেড মাস্টার মশাইয়ের সেটাতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু তিনি কেনো এই কবিতাটি লিখতে যাবেন? এটা কি রবীন্দ্রনাথের কবিতা? হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। তবে না হওয়ারই সম্ভাবনা। এরকম কবিতা রবীন্দ্রনাথের হলে নিশ্চয়ই বাংলার মাস্টার মশাই রুক্মিনীকুমার ক্লাশে পড়ে শোনাতেন। শিলাইদহে তার বাড়ি। তার রবীন্দ্র রচনাবলী কণ্ঠস্থ। রবীন্দ্রবাবু যখন এই শিলাইদহে জমিদারি দেখাশুনা করতে আসতেন, তিনি তখন রুক্মিনীকুমারের ঠাকুরদাকে ডেকে নিতেন। তার ঠাকুরদা ছিলেন বিখ্যাত বাঁশিয়াল। তাঁর বাঁশি শুনতে রবীন্দ্রবাবু খুব পছন্দ করতেন। একবার মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তার লেখা গীতাঞ্জলি কাব্য উপহার দিয়েছিলেন। কাব্যগ্রন্থটি তিনি তাদের নিত্যপূজার ঠাকুর ঘরে রেখে দিয়েছিলেন। তিনি কখনো পড়েননি বটে। পড়তেও জানতেন না। আর কাউকে পড়তে দিতেনও না। সেই বইটি ছিল তার ঠাকুর দেবতা। এই হেতু বাংলার মাস্টার মশাই ঠাকুরদাকে লুকিয়ে রবীন্দ্র কাব্য কণ্ঠস্থ করে ফেলেছেন সেই কিশোর বেলা থেকেই। ক্লাশে তিনি রোল কল করার আগে তিনটি রবীন্দ্র কবিতা বলেন। ক্লাশ শেষে দুটি কবিতা বলতে বলতে নিষ্ক্রান্ত হন।
এইসব কারণ মনে নিয়ে বলা যায়, কবিতাটি হেড মাস্টার মশাই অন্যত্র থেকে সংগ্রহ করেছেন। অথবা নিজেই রচনা করেছেন। তবে আরো কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। কেনো তিনি এই দীর্ঘশ্বাসময় কবিতাটি লিখবেন? এটা কি প্রেম অথবা বিরহের কবিতা? আর কে-ই বা এই রমা? এই রমা কি তার যুবা কালের কোনো প্রেমিকা? কেনো এই ক্ষমা প্রার্থনা? তিনি কি সেই যুবতী অথবা কিশোরী রমার প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করেছিলেন? নাকি তাকে গোপনে ভালো বেসেছিলেন? তাকে কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেননি। এই না বলার খেদ থেকেই লেখা হয়েছে এই তিনটি ছত্র? নাকি এই রমা করুণাময় দাশগুপ্তর সদ্য বিবাহিতা মেয়ে? শেষ প্রশ্নটি মনে উদয় হতেই নেপালচন্দ্রের শীরদাড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বেয়ে গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখল, লেখাটি পুরনো নয়। সদ্য লেখা। কাগজ আর কালি ঝক ঝক করছে।
হেডমাস্টার মশাইয়ের করোটি শ্মশানক্ষেত্রে যখন ফট ফট শব্দে ফাঁটছিল তখল নেপালচন্দ্র সেই চিরকুটটি নিয়ে করুণাময় দাশগুপ্তর বাড়ির দিকে ছুটে গেল। ততক্ষণে রমারাণীকে নিয়ে বরযাত্রীরা কোলকাতার পথে রওনা করেছে। রমারাণীর হাতে সেই চিরকুটটি দেওয়া হলো না।
নেপালচন্দ্র দেরি না করে কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা করল। বালিগঞ্জের আদিনাথ বাবুর বাড়িটি খুঁজে বের করল। সেবাড়িতে তখন নতুন বৌ গৃহ প্রবেশ করেছে। সে গৃহের বারান্দায় দুটো এলসেশিয়ান কুকুর ঘুরে বেড়ায়। আর রয়েছে গেটে বন্দুকধারী পাহারাদার। বাড়ির লোকে পায়ে হাঁটে না। গাড়িতে চড়ে। সে গাড়ির জানালায় পর্দা ঘেরা। কাউকে দেখা যায় না। রমারাণীর হাতে চিরকুটটি দেওয়াও হয় না। চিরকুটটি না দিয়ে কোলকাতা ছেড়ে যেতেও পারেন না।
ফলে এই সময়ে নেপালচন্দ্রকে কোলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল। তার উস্কো খুস্কো চেহারা। পায়ের স্যান্ডেল ছেড়া। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া নেই। পকেটে হেড মাস্টার মশাইয়ের সেই চিরকুট। এটা রমার হাতে তুলে না দিতে পারলে হেড মাস্টার মশাইয়ের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে না।
এর মধ্যে আদিনাথ বুড়ো হয়ে পড়ছেন। তার ছেলে দিবাকর পেশায় বাপের মতো খুব সুবিধা করতে পারছেন না। বাড়িতে কাজের লোক সব কিছু করে। রমার শুয়ে বসে দিন কাটায়। পাড়ার এমেচার থিয়েটারে একদিন অভিনয় করেছে। স্বামী দিবাকর একটু বহির্মুখী হয়ে পড়েছেন।
সেদিন টালিগঞ্জের স্টুডিওতে ক্যামেরা রেডি হচ্ছে। মেকাপ ম্যান অপেক্ষা করছেন নায়িকার। সিনেমার নাম শেষ উত্তর। শোনা গেল এই সিনেমায় নতুন একজন নায়িকার রোল প্লে করবেন। তার নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি। নায়িকা পৌঁছালেই তার নাম ঘোষণা করা হবে। তার একটি তেলচিত্র রূপোলী কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পিছন থেকে নায়িকা ছবির সামনে এসে লুকিয়ে থাকবেন। আগে সবাই দেখবেন নায়িকার ছবি। তারপর দেখতে পাবেন নায়িকাকে। কে এই নায়িকা?-- কাননবালা বা নীভাননী দেবী? নাকি মুম্বাইয়ের সায়রা বানু? সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছেন। একটা টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে সেটে। সন্ধ্যার সিন দিয়ে কাহিনী শুরু।
ঠিক সন্ধ্যামুখেই গাড়ি এসে স্টুডিওর গেটে থামল। ঋজু ভঙ্গিতে হেঁটে গাড়ি থেকে নেমে পা বাড়াল নতুন নায়িকা। তার সারা শরীর আলখাল্লা দিতে ঢাকা। কেউ তার মুখ দেখতে পায়নি।
ধীরে ধীরে রূপোলী কাপড় সরে গেল ছবির উপর থেকে। অনিন্দ্য সুন্দর এক নারী। সাদা কালো। সিনে জগতের কেউ তাকে আগে দেখেনি। ছবি দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। এবার পরিচালক নায়িকার নাম ঘোষণা করলেন। সুচিত্রা সেন। ঈশ্বরের নিজের হাতে চিত্রিত মুখ।
এবার স্পট লাইট সদ্য উন্মুক্ত ছবিথেকে নিচে নেমে এলো। সেখানে সেই অনিন্দ্য সুন্দর আসল সুচিত্রা সেনকে দেখা যাবে। তিনি হেসে উঠবেন। সেই ভুবন মোহিনী থেকেই শুরু হয়ে যাবে শেষ উত্তর সিনেমার শুটিং।
সবাই অধীর আগ্রহে দেখতে পেলো, আলোতে আলখাল্লা পড়ে আছে। মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে না। সবাই মনে করল, হয়তো আলখাল্লার নিচে নাচের মূদ্রায় শুয়ে আছেন। আলখাল্লাটি সরালেই তিনি উঠে দাঁড়াবেন। বলবেন, আমি সুচিত্রা সেন। আমার ভুবনে আপনাদেরকে স্বাগতম।
পরিচালক ছুটে গেলেন। আলখাল্লাটি তুললেন। সুচিত্রা সেন তার হাত ধরে উঠবেন। হাতটি বাড়ালেন। কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখল একটি হাত উঠে এসেছে বটে। তার হাতও ধরেছে। তবে সেটা কোনো মেয়েমানুষের নয়। কোনো মানুষেরও নয়। সেটা এক মহাজাগতিক শূন্যতার হাত। নিজের হাত থেকে শুন্যতাকে ঝেড়ে ফেলে শেষ উত্তর সিনেমার পরিচালক জনান্তিকে বলে উঠলেন, হায় সুচিত্রা।
পরিচালক নিজেই সুচিত্রা সেনকে গাড়িতে করে নিয়ে এসেছেন। নিজেই আলখাল্লা পরিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেই সুচিত্রা সেন এখন মিসিং।
পরিচালক ভেঙ্গে পড়লেও শেষ উত্তর সিনেমার প্রযোজক কিন্তু বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। তিনি পরিচালককে বললেন, এভাবে ভেঙ্গে পড়লে আমাদের ব্যবসা মার খাবে। ব্যরিস্টার আদিনাথের সম্ভ্রম ধুলায় লুটিয়ে যাবে। এছাড়া আর ভালো ঘর থেকে মেয়েরা সিনেমায় নামতে আসবে না। কাননবালার মতো বেপাড়ার মেয়েদের উপরেই নির্ভর করতে হবে। তিনি, সেটে উপস্থিত সাংবাদিক অতিথিদের বললেন, নায়িকা সূচিত্রা সেনের নিকটস্থানীয় আত্মীয় অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি শেষ মুহূর্তে আসেননি। তবে অচিরেই আসবেন। তখন আবার আপনাদের নিমন্ত্রণ করা হবে।
এখান থেকে কয়েকটি সন্দেহ করা যায়। সুচিত্রা সেনকে কিডন্যাপ করা হয়েছে খুব খিপ্র গতিতে। করেছে কোনো অতি দক্ষ পেশাদারী টিম। অথবা সুচিত্রার শ্বশুর ব্যারিস্টার আদিনাথ অভিনয়ের অনুমতি দিলেও স্বামী দিবাকর ঠিক ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলেন না। আবার পিতাঠাকুরের অবাধ্যও হতে পারেননি। ফলে মৌনী হয়েই ছিলেন। তিনিই হয়তো এই কিডন্যাপটি করিয়েছেন। তৃতীয় আরেকটি আশংকা পরিচালকের মনে উদয় হয়েছে। সেটা হলো, টালিগঞ্জের সিনে স্টুডিওতে তাদের প্রতিপক্ষ শত্রুতা করার জন্যই হয়তো সুচিত্রা সেনকে কিডন্যাপটি করেছে। তবে এক্ষেত্রে সম্ভবত কোনো পেশাদার কিডন্যাপার নয়, তারা সম্ভবত কোনো যাদুটোনা জানা ফকির সন্যাসীকে দিয়ে মন্ত্র বলে কাজটি করেছে। তিনি এ ধরনের অলীক ক্ষমতাধর এক নাগা সন্যাসীকে চেনেন। গঙ্গার ধারে ছুটে গেলেন। নাগা সন্যাসীকে খুঁজে বের করলেন। তার চাহিদামোতাবেক নাগা সন্যাসী এক ছিটে ধুনিধুলো থেকে আরেকজন ফেইক সুচিত্রা সেন সৃষ্টি করে দিলেন। তিনি হাসি মুখে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ব্যারিস্টার আদিত্যনাথের বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। কেউ না বুঝলেও স্বামী দিবাকর বুঝতে পারলেন, এ তার স্ত্রী রমা নয়। অন্য কোনো রমনী। কিন্তু পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে ব্যাপারটা চেপে গেলেন। বাহিরমুখী হলেন। মদে আসক্ত হলেন। পরে বিলেতেও চলে গেলেন। সেখানেই তিনি নীরবে নিভৃতে নশ্বর দেহ রাখেন। জীবনে বেঁচে থাকাটা হয়ে উঠেছিল অর্থহীন।
আর শেষ উত্তর সিনেমার পরিচালকও সিনেমাটি করার উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। তিনি জীবনে কখনো দুই নম্বরী কাজ করেননি। ফলে দুই নম্বরী নায়িকা নিয়ে কাজ করতে পারেন না। শেষ উত্তর সিনেমাটি কখনো আলোর মুখ দেখার সুযোগ পায়নি।
তবে লালবাজার থানায় ভীন্ন একটি তথ্য আছে। সেদিন টালিগঞ্জ সিনে স্টুডিও থেকে একজন ভদ্রমহিলাকে ছিনতাই করার খবর পেয়ে পুলিশ ছিনতাইকারীদের তাড়া করে। জোব চর্নকের সমাধীর কাছে পুলিশের গুলিতে ছিনতাইকারী মারা যায়। ছিনতাইকারীর পকেটে একটি চিরকুট পাওয়া যায়।
তাতে বাঁকা হস্তাক্ষরে লেখা,
'রমা আমার রমা--
তুমি করিও মোরে ক্ষমা।
অনেক অশ্রু রইল পড়ে জমা।।’
তবে পুলিশ সেখানে ছিনতাইকৃত কোনো মহিলাকে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় পায়নি। পুলিশের কাছে অনির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া আরেকটি তথ্য রয়েছে। সেটা হলো, ছিনতাইকৃত মহিলাটিকে কে বা কারা পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। আরেকটি সূত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়, মহিলাটির নাম রমারাণী। অথবা সুচিত্রা সেনও হতে পারে। আর নিহত কিডন্যাপারের নাম নেপালচন্দ্র। এই নেপালচন্দ্র পাকিস্তানের চর হিসেবে কাজ করে আসছে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, নেপালচন্দ্র তার প্রকৃত নাম নয়। এটা ফেইক। প্রকৃত নাম হয়তো নিয়ামত। অথবা নেপালচন্দ্র স্বধর্ম ত্যাগী। লাল বাজারের এই রিপোর্টটি অতি গোপিনীয় সিল মারা রয়েছে। ক্লাসিফায়েড। ফলে এটা কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।
আখ্যানের এইখানে এসে গোপাল স্যান্যালের মা ফুঁসে ওঠেন। বলেন, মিছে কথা। নেপালচন্দ্র পাকিস্তানের চর নন। স্বধর্ম ত্যাগীও নন। তিনি কমিউনিস্ট। আর নেপালচন্দ্র সেদিন মারা যাননি। সেদিন টালিগঞ্জেও যাননি। কাউকে কিডন্যাপ করার প্রশ্নই আসে না। এটা নিতান্তই গুজব।
প্রকৃতপক্ষে সেদিন নেপালচন্দ্র বিয়ে করতে রাজশাহীর পাকশিতে গিয়েছিলেন। খিদিরপুরে ডক শ্রমিক ইউনিয়নে কাজ করতেন তিনি। দুবার জেলও খেটেছিলেন। শেষবার তার খবর পেয়ে তার মেজো মামা বাড়ি নিয়ে আসে। ছেলেকে ঘরমুখী করার জন্য তার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। সে বিয়েতে পাকশির অন্যতম শ্রমিক নেতা জসীম মণ্ডলও এসেছিলেন।
জসীম মণ্ডল নববধুর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, বউমা। নেপালচন্দ্রের বিয়া অনেক আগেই বিপ্লবের লগে হইয়া গেছে। তুমি তার সেকেন্ড বউ। সব সময় তারে পাইবা না। মাঝে মাঝে সে তোমার কাছে উঁকি দিয়া যাবে।
ব্যাপারটা সত্যি সত্যি সেরকমই হয়েছিল। স্বামী প্রবরটি হঠাৎ হঠৎ উধাও হয়ে যেতো। শোনা যেতো আজ রংপুর তো কাল নাটোর। পরের দিন দিনাজপুর। সেখান থেকে দুইমাস কোনো খবর নেই। চলে গেছেন সুসং দুর্গাপুর। ছয়মাস পরে একদিন বাড়ি আসেন রাত করে। দুদিন থাকলেন। তৃতীয় দিনে হাওয়া হয়ে গেছেন। এদিকে স্ত্রীর পেটে সন্তান এসেছে। সেদিকে খেয়াল নেই। একদিন জসীম মণ্ডলই খবর আনলেন। তিনি নেই। কুমিল্লায় পুলিশের এনকাউন্টারে নিহত হয়ে থাকতে পারেন। তবে নিহত যে হয়েছে্ন সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। পার্টি তাকে খুঁজে পায়নি। হতে পারে, নেপালচন্দ্র জেলে আছেন। সেখানে পচে মরছেন। কমিউনিস্টদের বেলায় যেরকম হয় আর কি, তার মুক্তির কোনো সুযোগই আর হবে না। দুনিয়া থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাবেন। তবে নেপালচন্দ্র আর যাই হোক না কেনো তার কোনো রকম নারী ঘটিত দোষ নেই। তিনি রমা বা সুচিত্রা সেনের কিডন্যাপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না-- এ ব্যাপারে তার স্ত্রীর কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই কথাটি তার কোনো কোনো আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না বলেই মনে হয়। একবার তার স্বামীর ঘনিষ্ট এক কমরেড বলেছিলেন, ব্যাপারটা কী জানেন বৌদি, মানুষকে সব সময় বিশ্বাস করা ঠিক নয়। প্রবৃত্তি মানুষকে কখন কোথায় কিভাবে নিয়ে যায় তা কেউ বলতে পারে না। যাকে আমরা ব্রহ্মচারী হিসেবে বাইরে থেকে দেখছি ভেতরে ভেতরে হয়তো তিনি ভয়ংকর কামুক। এ ব্যাপারে আপনি ফ্রয়েড সাহেবের বই পড়ে দেখতে পারেন। ঘটনা হলো, আমরা পার্টি থেকে তদন্ত করে দেখেছি, নেপালচন্দ্র স্কুল জীবনে রমারাণী নামে এক মেয়েকে কিডন্যাপ করেছিল। পাবনা থানায় রেকর্ড আছে।
এইখানে এসে ভেঙ্গে পড়ে নেপালচন্দ্রের স্ত্রী। এতোকাল তিনি চুপ করেই ছিলেন। তার সামনেই অনেক কল্পগাঁথাকেই পল্লবিত হতে দেখেছেন। কপালের লিখন বলেই গণ্য করেছেন। এই পড়ন্ত বেলায় আর নিতে পারছেন না। ছেলে গোপালের হাত ধরে বলে ফেললেন, তার জীবনে আর কোনো চাওয়া নেই। শুধু একটা চাওয়া, তা হলো, তার স্বামী রমা কিংবা সুচিত্রা সেন, নাম যা-ই হোক না কেনো, তাকে কিডন্যাপ করেননি-- এই বিষয়টা দুনিয়ার সামনে প্রমাণ করে দেওয়া।
এইখানে এসে গোপাল স্যান্যাল দিশেহারা হয়ে যায়। ছেলেবেলা থেকে তার মাকে কখনো ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি। এই প্রথম মা হু হু করে কাঁদল। জলে ভেসে গেল তার দুই হাত।
৩.
আমাদের ঠাকুরদা সুচিত্রা সেনকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিলেন, এটা আমরা মুখ পরম্পরায় শুনে আসছি। আমাদের বাড়ির সিন্দুকে রক্ষিত দলিল দস্তাবেজে তার নাম উল্লেখ নেই। সে সময়ের কথা বলতে পারে এলাকায় তার বয়েসীও কেউ নেই।
শুধু আমাদের মা আছে। মা এখন নবতিপর। অনেক কিছুই ভুলে গেছে। অনেক কিছুই ভুল ভাল বলে। খেই হারিয়ে ফেলে কথার মাঝখানে। সুতরাং মায়ের কথার উপরে ভরসা করা মুশকিল। কিন্তু মাকে ছাড়া উপায়ও নেই।
মাকে সুচিত্রা সেন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মা প্রথমে ঠাওর করতে পারে না। বলে চিত্রা নামে একটি মেয়ে ছিল। সে একবার সুন্দি নাইল তুলতে গিয়ে জলে ডুবে যায়। চিত্রা নয় জানালে মা বলে, তাদের মামাবাড়িতে সুমিত্রা নামে মামাতো বোন ছিল। তার বাল্যকালেই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। সে ভালো আল্পনা খাড়তে পারতো। অকালে সে বিধবা হয়ে যায়। সঙ্গে পাঁচটি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে। ধান ভেনে মুড়ি ভেজে তার সংসার চালাতো। তার মুড়ি খেলে সে স্বাদ আর ভোলার উপায় নেই। এক ধরনের নোনা স্বাদ বহুদিন জিহবায় লেগে থাকে। মা তখন আবদার ধরে সে মুড়ি আবার খাবে। যে মুড়িই দেওয়া হোক না কেনো মায়ের মন আর ভরে না। বারবার সুমিত্রার মুড়ির কথা বলে বলে চোখ মোছে।
মাকে তখন আমরা মুড়ি খেতে দিয়ে বলি, সুমিত্রা নয়। সুচিত্রা। সুচিত্রা সেন।
মা শুধায়, কী সেন?
--সুচিত্রা সেন। আমাদের ঠাকুরদা চুরি করে নিয়ে এসেছিলেন।
ঠাকুরদার কথায় মা এবার একটু গম্ভীর হয়ে পড়ে। তারপর মাথায় আঁচল টানে। বলে, তোদের ঠাকুরদা গানবাজনা করতেন। সংসারের দিকে মন ছিল না। এজন্য বাড়ির কেউ পছন্দ করত না। বেচারার সখ ছিল কৃষ্ণ ঠাকুর হবেন। লীলে করে বেড়াবেন।
বাড়ির লোকজন বলে, বেচারাকে বিয়ে দাও, বিয়ে দাও। বিয়ে দাও বললেই তো হবে না। যার বিয়ের জন্য এতো শোরগোল তার খবরই নেই। আজ বাগেরহাট তো, কাল নওগাঁ। পরশু চিটাগাং তো তরশু কোলকাতা। তার পাত্তা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে জাপান বোম ফেলে গেছে। মানুষের খাওয়ার জন্য কচুঘেচুও ফুরিয়ে গেছে। নোয়াখালিতে গান্ধীবাবুর ছাগল চুরি হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে জিন্না সাহেব পাকিস্তান পয়দা করে ফেলেছেন। পাকিস্তান ভারতের মধ্যে একটা যুদ্ধ ঘটে গেছে। কিন্তু আমাদের ঠাকুরদা ঠিক কোথায় তা বাড়ির লোকজন জানে না। হয়তো দাঙ্গায় মারা গেছে। হয়তো জেলে আছে।
এর মধ্যে দেখা গেল কোলকাতার জোব চার্নকের সমাধীক্ষেত্রের পাশে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে সে মৃত নয়। ভয়ে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। এবং অচেতন দেহটি কোনো পুরুষ মানুষের নয়। মেয়ে মানুষ। অনিন্দ্য সুন্দরী। এলেবেলে নয় মোটেই কাপড়চোপড় দেখলেই বোঝা যায়, অভিজাত শ্রেণীরই কেউ হবে। এভাবে এভাবে পড়ে থাকলে এই মেয়েমানুষটি শেয়াল কুকুরের ভোগে যাবে।
এ পথ দিয়ে একজন লোক হেঁটে যাচ্ছিল। তখন রাত্রি। এলাকাটি ভালো নয়। এখানে গুণ্ডাপাণ্ডাদের চলাচল আছে। কী ভেবে লোকটি মেয়েমানুষটিকে কাঁধে তুলে রওনা দিল। কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সবার অগোচরে চলে গেল।
আমরা মাকে শুধাই, এই লোকটি কি আমাদের ঠাকুরদা?
মা, একটু হেসে বলে, হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। তারপর হিসেব করে বলে, এটা জিন্নাহ সাবের আমল। তিনি ঢাকা এসেছেন। ঢাকায় এসে বলেছেন, পাকিস্তানে থাকলে হলে উর্দু ভাষায় কথা বলতে হবে। সে সময়ে তোদের ঠাকুরদার বয়স আট চল্লিশ বছর। মাথার চুলে সামান্য পাক ধরেছে। এই বয়সে কি যাতা করতে পারে?
--তবে।
--তবে?
--তবে, শোনা যায়, তিনি সত্যি সত্যি সাইকেলে করে বহুদিন পরে বাড়ি ফিরলেন। এলাকার বটতলা থেকেই তার সাইকেলের বেল শোনা গেল। তখন সবে ভোর হতে শুরু করেছে। একটা মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে। ডগডগ করে কুসুমকোমল সূর্য উঠেছে।
কে একজন হরেন নামে ঢুলিবাড়ির প্রবীণ ঢুলি তখন খালে মুখ প্রক্ষালন করছিল। সেই ঢুলিই শুধালো, কইত্থেকিকা আইলেন ছোটোবাবু?
অন্য সময় হলে তিনি সাইকেল থামাতেন। আজ থামালেন না। থামালে দেরি হয়ে যেতে পারে।
তবুও থামাতে হলো। হরেন ঢুলিকে দর্শন না দিয়ে তিনি চলেন না। একটু তফাতে গিয়ে খুব সাবধানে সাইকেলটিকে দাঁড় করালেন। তারপর হেঁটে এসে হরেন ঢুলির কাছে এলেন। হরেণ ঢুলি এই ভোরে খড়গাদার মধ্য থেকে হরে কেষ্ট সা'র স্পেশাল একটা দেশি বোতল বের করল। দুজনে ঢুক ঢুক করে পান করল।
পান একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। সকাল সকাল একটু নেশা এসে গেল। হরেন ঢুলির সাইকেলের দিকে চেয়ে দেখতে পেল, কে একটি মেয়ে সাইকেলের পাশে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখটা ঠাওর করতে পারছে না। তার চারদিকে এখনো এই ভোর ভোর হবো হবো ক্ষণে চাঁদের আলো ফুটি ফুটি করে জ্বলছে। আর কী এক অজানা ফুলের সুবাস ভেসে যাচ্ছে এই চরাচরে।
দেখে হরেন ঢুলি একটু টাসকি খেয়ে নড়েচড়ে ওঠে। বলে, ছোটোবাবু কি বিয়া কইরা আইলেন?
ছোটবাবু একটু ঝিম এসে গিয়েছিল। সেই ঝিমের মধ্যেই বললেন, কি কইরা আইলাম?
এ প্রশ্নে হরেণ ঢুলি একটু থমকে গেল। ছোটোবাবু এলেমদার মানুষ। তার সঙ্গে একটু মদ খাওয়া যায় বটে কিন্তু তাকে নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করা যায় না। ঢোক গিলে বলল, না, বিয়া কইরা নয়। একজন ঠাইরেন দেখতে পাচ্ছিলাম মনে লয়।
এবার চোখ তুলে ছোটোবাবু সাইকেলের দিকে তাকালেন। তার সঙ্গে কোনো ঠাউরেন থাকার কথা নয়। এসেছেন একা। যাবেন একা। এর মধ্যে ঠাইরেন কোত্থেকে এলো?
তিনি শুধালেন, ঠাইরেন কী করে?
হরেন ঢুলি আরেকটু পান করে। তার চোখ মুদে আসে। সেই অবস্থাতেই বলে, ঠাইরেন দাঁড়ায় আছে ঘন ঘন চোখ মোছেন। মেলা দূর থেইকা আইছেন বুঝছি।
ছোটোবাবু উঠে পড়েন। সাধারণ নেশাতে তিনি টলেন না। সাইকেলের কাছে এসে দেখেন, সত্যি সত্যি ঠাইরেন বটে। সাইকেলের রডে উঠে বসেন। তার মুখের উপর থেকে ঘোমটা সরে যায়। তিনি চমকে ওঠেন। এই মুখটিকে তিনি চিনতে পারছেন। কোলকাতার পত্রিকায় এর ছবি ছাপা হয়েছিল। শেষ উত্তর সিনেমার নায়িকা। সুচিত্রা সেন। শেষ উত্তর সিনেমার স্যুটিং বন্ধ হয়ে গেছে। পত্রিকাটি এ নিয়ে কয়েকটি গসিপ লিখেছে। ১. সুচিত্রা সেন নামে নতুন অভিনেত্রীকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। সেজন্য শেষ উত্তর সিনেমাটি সুটিং বন্ধ হয়ে গেছে। ২. প্রযোজক একজন ফেইক সুচিত্রা সেন আনলেও পরিচালক আর শেষ উত্তর সিনেমাটি করতে চান না। অরিজিনাল সুচিত্রা সেনকে পাওয়া গেলেই তিনি আবার সিনেমাটি করবেন। ৩. অরিজিনাল সুচিত্রা সেন ওরফে রমারানীকে কেউ কিডন্যাপ করেনি। তার স্বামী দিবাকর তাকে ঘরবন্দী করে রেখেছেন। অচিরেই তাকে নিয়ে বিদেশে চলে যাবেন। কিন্তু রমারানী বিদেশে যেতে চান না। তিনি দেশে সিনেমার নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চান। ৪. তিনি ঘরের জানালা ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছেন। তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি।
এবারে তিনি চিন্তায় পড়েন, এই সুচিত্রা সেন কী করে এলো তার সাইকেলে? তার মাথা কাজ করে না। তিনি সাইকেল ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কী করবেন বুঝতে পারছেন না।
শুধু দেখতে পেলেন এই সুচিত্রা সেন তার গভীর আঁখি তুলে তাকিয়ে আছে। তার চোখে জল আর হাসির রেখা খেলা করে। হরেন ঘাট থেকে চেঁচিয়ে বিলল, ছোটোবাবু, ঠাইরেনকে খাড়ায় রাইখেন না। বাড়ি নিয়া যান।
এরপর ছোটোবাবু দাঁড়ালেন না। তিনি সাইকেল ঠেলে ঠেলে চললেন। তার মনে হলো, এই মাটির রাস্তা বড়ো এবড়ো থেবড়ো। প্যাডেল চালিয়ে গেলে রডে বসা কুসুমকোমল সুচিত্রা সেনের গায়ে ব্যথা লাগতে পারে। তিনি সারাপথ সাইকেলে না চড়ে ঠেলে চললেন। এলাকার লোকজন দেখলো, ছোটোবাবু সাইকেল ঠেলে ঠেলে বাড়ি আসছেন। তার চোখে মুখে কী এক অপার রহস্যময় আলো ফুটেছে।
এই পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি এই ঠাইরেনের কথা। ঠাকুরদার মধ্যে একটি পরিবর্তন এলো। তিনি প্রথমবারের মতো তার ঘর তালাবন্ধ করে রাখা শুরু করলেন। সে ঘরে ঠাকুরদা থাকেন না। মাঝে মাঝে তালা খুলে ঢোকেন। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে যান। তাকে বোঝা ভার। তিনি এইরকম রহস্যময়। প্রায় প্রায়ই উধাও হয়ে যান। আবার এসে পড়েন। তার দেখা মেলা ভার।
এইটুকু বলে আমাদের মা থামে। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা তাড়াতাড়ি শুধাই, তারপর কী হলো?
মা যেন ঘুম থেকে ওঠে। বলে, এরকমই একটি দিনে বাড়িতে পুলিশ এলো। আয়ূব খানের আমল। তিনি যা কন তাই আইন। রাস্তায় মিলিটারি পাহারা দেয়। আর মাঝে মাঝে পুলিশ আসে বাড়িঘরে।
আমরা সংশয়ে পড়ি। মা বোধ হয় আবার ভুলভাল বকতে লেগেছে। মায়ের হাত ধীরে ধীরে টিপে দেই। বলি, মা, আয়ূব খান ১৯৫৮ সালে ক্যু করে ক্ষমতা নেয়। আর তুমি বলছিলে তার আটদশ বছর আগের কথা।
মা হেসে ফেলে। বলে আট দশ বছর আগে কেনো। হতে পারে আটদশ বছর পরের কথা। সেটা চৌষট্টি সালের বড়ো দাঙ্গার পরেও হতে পারে। বুঝলি বাবা, আয়ূব খান কোলকাতার সিনেমা আসা বন্ধ করে দিলেন।
আমরা হিসেব করে দেখি সেটা ১৯৫৮ সালের কথা। এ সময়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাকে সরিয়ে দিতে আয়ূব খান সামরিক আইন জারি করে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এরপর টানা দশ বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। তিনিই ভারতে যাদের আত্নীয়স্বজন নানা সময়ে চলে গিয়েছে তাদের সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করেছেন ১৯৬৫ সালে।
মা ততক্ষণে আবার বলতে শুরু করেছে।
পুলিশ এসে বলে তোদের ঠাকুরদা পাকিস্তানের চর হিসেবে কোলকাতায় যায়। সেখান থেকে বিখ্যাত সিনেমা অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনকে চুরি করে নিয়ে আসে। কথা ছিল সুচিত্রা সেনকে সরকারের হাতে তুলে দেবে। সরকার তাকে জিম্মি করে ভারতের কাছে দাবী জানাবে, কাশ্মীরকে ফেরত না দিলে সুচিত্রা সেনকেও ফেরত দেবে না।
পুলিশ জানায়, ঠাকুরদা সুচিত্রা সেনকে সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে। যেন কোনোভাবেই হোক না কেনো তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
এই হেতু তারা বাড়িটিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজল। এমনকি তারা ঠাকুরদার তালাবদ্ধ ঘরটির তালা ভেঙ্গেও দেখল। সে ঘরে একটি তক্তপোষ, একটি পুরনো টেবিল আর তার উপরে দেওয়ান ই হাফিজের শায়েরী ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। বাড়ির লোকজনও এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারল না। তারা ঘরটিতে আবার আরেকটি তালা লাগিয়ে দিল। গ্রামের লোকজনকে হুমকি দিয়ে যখন ঘোষণা দিল, ঠাকুরদার চুরি করে আনা সুচিত্রা সেন সম্পর্কে তথ্য না দিলে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে, পাখির মতো গুলি করে সবাইকে মেরে ফেলা হবে তখন, গ্রামের লোকজন ঠাকুরদাকে সাইকেলে চড়ে একা দেখতে আসতে দেখলেও বলল, হ্যাঁ, তারা ঠাকুরদাকে সুচিত্রা সেনকে সঙ্গে নিয়ে আসতে দেখেছে। দেখেছে, ঘোড়ায় চড়ে ঠাকুরদা একদিন মধ্য রাত্রিতে আসছেন। সেদিন সারাদিনই ছিল মেঘলা৷ সন্ধ্যার পরে বেশ কিছুটা বৃষ্টি হয়েছে। পথঘাটে কাদা জমেছে। কুয়াশার মতো জলরেখা তখনো হাওয়ায় ভাসছে। এই আধো অন্ধকারে জলের কুয়াশায় সব কিছু স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ একবার হুট করে বেরিয়ে এলে তারা যেন দেখেছিল, ঘোড়ার জিন ধরে ঠাকুরদা খুব সাবধানে কাদার মধ্যে পা ফেলে ফেলে হেঁটে আসছেন। আর ঘোড়ার পিঠে একজন জেনানা বসে আছেন। তার মুখ রেশমি কাপড়ে ঢাকা। রমনীটি খুব ধীরে ধীরে একটি গান গাইছে। গানটি হলো, এ মহব্বত তেরে আঞ্জাম…
আমাদের নবতিপর মা-ও চোখ বুজে গুণগুণ করে গানটি ধরে। গাইতে গাইতে তার চোখে আশু ঝরে। তর্জমা করে বলে, হে প্রেম তোমার জন্য আশ্রু ছাড়া জীবনে আর কী পেলাম।
তখন আমরা মাকে স্মরণ করিয়ে দেই-- এ গানটি গেয়েছেন বেগম আখতার।
তখন মা বলে, এই গানটি ঠাকুরদা বেগম আখতারের কাছ থেকেই শুনেছিলেন। তিনি এ গানটি শুনতে লক্ষ্মৌতে গিয়েছিলেন।
আমরা তখন বলি, ঘোড়ার চড়ে যিনি এসেছিলেন, তিনি সুচিত্রা সেন নন বোধ হয় । তিনি লক্ষ্মৌয়ের কোনো বাই হবেন।
মা তখন মাথা নেড়ে সায় দেয়। বলে, এককালে উলপুরে পূজার সময়ে বাইদের মুজরো হতো। উলপুরের জমিদারের আদেশে ঠাকুরদার বাবা গন্নিবিবি নামে এক বাইকে ঘোড়ায় পিঠে চড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন। গ্রামবাসী সেদিন যে মহিলাকে সুচিত্রা সেন হিসেবে বর্ণনা করেছে পুলিশের কাছে, তিনি নিশ্চয়ই সুচিত্রা নন। তিনি গন্নিবিবিই হবেন। আর যে লোকটা গন্নিবিবিকে নিয়ে আসছিলেন তিনি কিন্তু তোদের ঠাকুর নন-- ঠাকুরদার বাবা। সেদিন বৃষ্টির মধ্যে আধো অন্ধকারে তারা আদৌ কাউকে দেখেনি। আয়ূব খানের পুলিশের নির্যাতন থেকে বাঁচতে ঠাকুরদার বাবা আর গন্নিবিবির আগমণের দৃশ্যটাই ঠাকুরদার নামে চালিয়ে দিয়েছে গ্রামের লোকজন। বলেছে, তাকে দেখতে দেবী সরেস্বতি।
সেদিন যে পুলিশ অফিসার ঠাকুরদাদের বাড়িতে তল্লাশী চালিয়েছিলেন, তিনি গোপনে বলেছিলেন, সুচিত্রা সেনের তিনি বড়ো ভক্ত। তার অভিনয় দেখে তিনি পাগল। সুচিত্রা সেনকে পেলে তিনি নিশ্চয়ই তাকে পাক সরকারের হাতে ধরিয়ে দেবেন না। নিজের জীবন বাজি রেখে কোলকাতায় পৌঁছে দেবেন। অনুরোধ করবেন আবার সিনেমা করতে। সেই পুলিশ অফিসারিটি তখন দ্বীপ জ্বেলে যাই সিনেমায় সুচিত্রা সেনের পাগল হয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক অভিনয়ের স্মরণ করে হু হু করে একটু কেঁদেও উঠলেন নিঃশব্দে।
তখন এই হু হু করে কান্নারত পুলিশ অফিসারকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো, ঠাকুরদা ১৯৫০ সালে দিনাজপুরে রানীশংকৈলে গিয়েছিলেন। সেখানে পুলিশের গুলিতে আহত এক সাঁওতাল মহিলাকে পথের পাশে পড়ে থাকতে দেখেন। তখনো তার প্রাণবায়ূ ছিল। গুলি করার আগে বা পরে মহিলাটিকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। ঠাকুরদা মনে করেছিলেন, মহিলাটিকে চিকিৎসা দেওয়া গেলে বেঁচে যাবে। কিন্তু এ এলাকার কোনো হাসপাতালে বা চিকিৎসালয়ে নেওয়া হলে পুলিশ আবার তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। আবার ধর্ষণ করবে। আবার গুলি করবে। সেকারণে ঠাকুরদা সাঁওতাল মহিলাটিকে কাঁধে করে বর্ডারের দিকে ছুটতে থাকে। ইন্ডিয়া নিয়ে যেতে পারলে মহিলাটিকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে।
তবে, বর্ডারে পৌঁছানোর পরে যতোটা জানা যায় ঠাকুরদা বর্ডার গার্ডের গুলিতে নিহত হয়েছেন।
তার মৃত্যুর খবর এ বাড়িতে নিয়ে আসে নিয়ামত নামে একজন লোক। ফলে ১৯৫০ সালের পরে বা আয়ূব খানের আমলে ঠাকুরদার এ গ্রামে আসার কোনো প্রশ্নই নেই।
নিয়ামতের আসল বাড়ি পাবনা। তবে স্কুলে থাকতেই সে পাবনা থেকে রানী শংকৈলে মামাবাড়ি চলে যায়।
সেদিন নিয়ামত বাড়িতে দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। ঘুম থেকে উঠলেও তাকে অস্থির লাগে। সে অস্থিরতা একদিনের নয়। মনে হয়, দীর্ঘদিন ধরেই তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এই ভার আর সহ্য করতে পারছে না।
ঠাকুরদার মাকে নিয়ামত নিভৃতে ডেকে বলে, তার একবার ঠাকুরদার ঘরে যাওয়া দরকার। তিনি যখন এ বাড়িটা ছেড়ে চলে যাবেন তখন সেই ঘরটি তালাবদ্ধ করে যাবেন। সে তালা যেনো কখনো কেউ না খোলে। বলে, কখনো কেউ যদি নেপাল স্যান্যালের দোহাই দিয়ে আসে তবেই যেন ঘরটি খুলে দেওয়া হয়।
মাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সেই নিয়ামত চলে গেল ভারহীন মানুষের মতো। বহুদিন পরে কিশোর বয়সের মতো মনে ফূর্তিতে গান গাইতে গাইতে চলে গেল।
আমরা মায়ের কাছে তখন গোপাল স্যান্যালের কথা বলি। তার মায়ের কথা বলি। তার কান্নাভেজা গভীর বেদনার কথা বলি। বলি নেপাল স্যানালের কথা। মা তখন টুকটুক করে ঠাকুরদার সেই তালাবন্ধ ঘরের তালা খুলল। ঘরের জানালা খুলে দিল। আর এক পশলা আলো এসে ঢুকল। সেই আলোর মধ্যে দেখা গেল, সারা ঘরে ধুলো আর মাকড়সার জাল। তার মধ্যে তক্তপোষ। আর একটা ওলটানো টেবিল।
মা ঘরের পূর্ব উত্তর কোন দেখিয়ে দিল। সেই জায়গাটি খুড়লে বের হলো একটি বোতল। বোতলটির মধ্যে পাওয়া গেল একটি তরুণীর সাদাকালো ফটোগ্রাফ। তরুণীটির মুখ হাসি হাসি। নাচের ভঙ্গিতে আছে। শুধু চোখ টলমল। চোখ থেকে সেই জল বের হতে গিয়ে থমকে আছে। বহু পুরনো হলেও ফটোগ্রামের তরুণী চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু স্পষ্ট করে চেনা যায় না। ছবির উলটো পিঠে স্টুডিওর নাম লেখা আছে-- স্মৃতি স্টুডিও, টাউন হল মোড়, পাবনা।
আরেকটি কাগজ ভাজ খুঁলে দেখা গেল, তার গায়ে ঝর্ণা কলম দিয়ে লেখা--
রমা রমা রমা,
হৃদয় দিয়েছি জমা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।