প্রযুক্তিতে নারীদের অন্তর্ভুক্তি বা অবদান বিষয়ে তৃষ্ণা বসাকের কিছু নিবন্ধ অনেকেই হয়তো ইন্টারনেটের নানা ‘পেজ’ বা তাঁর ব্লগে পড়েছেন আগে। গল্প, উপন্যাস বা এ বইটিও হয়তো আগে পড়ে থাকতে পারেন। মোট কথা লেখালিখির জগতে তিনি আছেন নানা ভাবে কিছুদিন ধরে। তবে প্রযুক্তিবিদ্যায় যিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করেছেন স্বভাবতই তিনি সে বিষয়টিতে বেশি আগ্রহী ও ওয়াকিবহাল থাকবেন। পাঠকেরও তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশা কিছু থাকবে। বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির জগতে নারীরা এখনও বিশেষভাবে ব্রাত্য। যাঁরা আছেন বা কাজ করে গেছেন তাঁদেরও নীরবে বা আড়ালে থাকতে হয়েছে। বিজ্ঞানের জগতে মহিলাদের কাজ নিয়ে তবুও বিক্ষিপ্ত কিছু বাংলা প্রবন্ধ চোখে পড়ে। সাধারণ মানুষ জানতে চাইলে ‘প্রযুক্তি ও নারী’ বিষয় নিয়ে লেখা বাংলায় নেই বললেই চলে। ইংরেজিতেও বহুল কাজ হয়েছে তা নয়, তবে অনেকটা হয়েছে। এ বইটি হাতে পেয়ে তাই প্রথমেই খুব উত্তেজিত হলাম। মানবীবিদ্যা চর্চা যারা করেন তাঁদের কাছে এটি একটি মাইলফলক বটে।
‘যন্ত্র যখন পরপুরুষ' নামে প্রথম পরিচ্ছেদ শুরুই হয় অতি কৌতুকময় এক কাহিনি দিয়ে। ‘ওয়াটসন সাহেব ঝপ করে একটা হাওয়াকল ফেঁদে বসলেন গঙ্গার ধারে। সে-কলের চাকাগুলো সবসময় অন্দরমহলের মেয়েদের দিকে চেয়ে থাকে, ঘরের আব্রু রক্ষা করাই মুশকিল। সে-ঘরের কর্তা ... দিলেন সাহেবের নামে মামলা ঠুকে।’ এই করুণ কালো কমেডি চট করে বুঝিয়ে দেয় যন্ত্র মানেই পুরুষ, এমন সাবলীল সামাজিক সমীকরণের ফলে নারীকে অনায়াসে যন্ত্রসঙ্গ করতে দেওয়া হবে না এটাই তো স্বাভাবিক। লেখকর সরল ভাষায় এরকম নানান চমকপ্রদ গল্প জুড়ে আছে পাতায় পাতায়। এ ঘটনা আনুমানিক ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার কথা। যদিও বইতে সঠিক সন তারিখ বা তথ্যভিত্তি দেওয়া না থাকায় অনেক পাঠকের পক্ষেই বোঝা একটু মুশকিল।
ইতিহাসের দপ্তর থেকে অনেক কথাই তিনি ভারি প্রাসঙ্গিক ও রসময় ভাবে তুলে এনেছেন, তাতে বইটি সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু একটা সমস্যা চোখে পড়ে— কাল-নির্দিষ্ট করে গল্প বলার কলাটা লেখক রপ্ত করেননি। সেকালের অনেক কথা তিনি বলছেন যখন, তখন সেকালটি কবে সেটাও তো জানা দরকার! স্বর্ণকুমারী ও পুণ্যলতা-র কর্মজীবন এক কাল নয়, তিন-চার দশকের পার্থক্য। কিন্তু প্রযুক্তির জগতে মহাকায় পরিবর্তন এসেছে বিংশ শতাব্দীতে। তা ছাড়া নয়া রাষ্ট্রনির্মাণের ফলে আমরা হঠাৎ খুব অল্প সময়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম প্রযুক্তিগতভাবে। অবশ্য কথা তো আসলে হচ্ছিল নারী প্রগতি নিয়ে, সমাজে মহিলাদের অবস্থান নিয়ে। তার পরিবর্তন বিশেষ ঘটেনি।
ইলেকট্রনিক নিউমেরিকাল ইনটিগ্রেটর অ্যান্ড কম্পিউটর (এনিয়াক)। ১৯৪৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। বিশ্বে প্রথম তৈরি হওয়া ‘জেনারেল পারপাস ইলেকট্রনিক ডিজিটাল কম্পিউটার’-গুলির অন্যতম এনিয়াক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ছয় মহিলার অবিস্মরণীয় অবদান সে সময়ে সম্পূর্ণ গোপন করে যাওয়া হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে। এখানে দেখা যাচ্ছে তাঁদের দু’জনকে — মার্লিন ওয়েস্কফ (বাঁ দিকে) এবং রুথ লিখটামান। অন্যরা ছিলেন জিন জেনিংস্, বেটি স্নাইডার, ফ্রান্সেস বাইলাস এবং কে ম্যাকনাল্টি
কিন্তু এ ঠিক লেখকর মতামত নয়। ‘‘এইসব আদিজননীরা, এবং এঁদের পরে আরও অনেকের সম্মিলিত প্রয়াসে এত দিনে যেন মেয়েদের একটা জায়গা তৈরি হল। এমন একটা জায়গা যেখানে তার ‘নারী’ পরিচয়টি মুখ্য নয়। লৈঙ্গিক, সামাজিক, সমস্ত আত্মখর্বকারী পরিচয়াতীত এ এক মুক্তস্নানের সৈকত।’’ সামান্য আশি পৃষ্ঠার মধ্যে মানবীতিহাসের কত বড়ো পর্যায় পেরিয়ে এসেছি! প্রাক্-নারী আন্দোলনের যুগ থেকে একবারে উত্তর-নারীবাদী যুগে। ইতিহাস এখানে শুধু উল্লম্ব নয় অনুভূমিক ও বটে অর্থাৎ তিনি শুধু ভারতীয় গল্প বলেছেন তা নয়, আবিশ্বের একটা মানচিত্র আঁকারও চেষ্টা করেছেন। এ এক অসম্ভব কৃত্য। সংক্ষিপ্ত ভূগোলেতিহাস লেখার তাগিদে, বলাই বাহুল্য, আখ্যানটিতে কিছু কিছু ফাঁক রয়ে গিয়েছে যা পূরণ না করতে পারলে সে আখ্যান যথোপযুক্ত হয়ে ওঠা কঠিন। গবেষণাগারে সে কারণে এ বইটি হাতে নিয়ে এগোতে গেলে মাঝে মাঝেই হোঁচট খেতে হবে।
আর-একটি কঠিন সমস্যা তৃষ্ণা এড়িয়ে গেছেন হয়তো পাঠকের ওপর আস্থা রেখে। সেটি হল পারিভাষিক শব্দের বিশ্লেষণ। ‘বিজ্ঞান’ আর ‘প্রযুক্তি’ নিশ্চিতভাবে এক নয়, তাহলে গোড়াতেই বোঝা দরকার কোন্ এক্তিয়ারে নারীর অবস্থান নিয়ে কথা হচ্ছে। প্রযুক্তি বলতে ঠিক কী বোঝায়! যদি লেখকর কথা মতো ‘অসংগঠিত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পও কিন্তু মেয়েদের হাতেই গড়ে উঠেছিল...’ এমনটি বলতে হয় তাহলে তো মেয়েরা চিরাচরিত প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল, আছে, থাকবে। আক্ষেপের স্থান সেখানে নেই। কারণ জাঁতা, জাঁতি, ঢেঁকি, বঁটি সবই সেক্ষেত্রে অপরিহার্য সরঞ্জাম।
নারীবিদ্যা নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা বলবেন সেটা একেবারেই খাঁটি কথা। সেই ইতিহাস জানা এবং জানানোরও বিশেষ প্রয়োজন আছে। তাকে প্রযুক্তির মূলধারায় আনা অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমার ধারণা তৃষ্ণা সেই কাজ করতে ঠিক চাননি। ‘কর্তার ঘোড়া কিংবা কল কিছু দেখেই আর ঘোমটা টানতে হত ... রাসসুন্দরীদের।’ কর্তা, কর্তার ঘোড়া ও কল আসলে সমপর্যায়ের। পুরুষালি/প্রাতিষ্ঠানিক প্রযুক্তির জগত নিয়েই তিনি কথা বলতে চেয়েছেন।
লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউটে ‘প্লান্ট অটোগ্রাফ্স অ্যান্ড দেওয়ার রিভিলেশন্স’ বিষয়ে ভাষণ দিচ্ছেন জগদীশচন্দ্র বসু, ১৯১৪
‘দেখার অবরোধ, শেখার বাধা’ পর্যায়ে জগদীশচন্দ্র বসুর মতো বিজ্ঞানীর জন্ম যে এমনি এমনি হয় না সে বিষয়টি অত্যন্ত নির্ভুল মনোগ্রাহীভাবে আলোচনা করেছেন তৃষ্ণা। বিজ্ঞানচেতনা তৈরি করতে বা বিজ্ঞানমনস্ক হতে একটি জাতিকে শিখতে হয়। মধ্যবিত্ত বাঙালির সেটা নেই, তার একটা প্রধান কারণ শারীরিক শ্রমের প্রতি এই শ্রেণির বিরাগ। কোনো সন্দেহ নেই। এত বড়ো কথাটি সুন্দরভাবে বলেই ফেলেছেন, শ্রেণি ব্যবহার অপরিহার্য। কিছু মানুষকে তো শ্রেণিগত কারণে কায়িক পরিশ্রম করতেই হয়। জগদীশচন্দ্রও তো ওই দ্বিধাটুকু পেরিয়েই কাজ শিখেছিলেন। তার পিছনে তাঁর পৈতৃক অবদান অনস্বীকার্য। মহিলাদের ক্ষেত্রে কখনোই যা থাকে না তা হল সামাজিক (সে পরিবার অর্থেও বটে) সাহায্যের হাত।
শারীরতত্ত্ব শিক্ষা চাবিকাঠি হয়ে এককালে মেয়েদের সামনে বিজ্ঞানের দরজা খুলে দিয়েছিল। কারণ মেয়েদের ‘সর্বপ্রধান’ কম্মটি—সন্তানের জন্ম ও প্রতিপালন—সেটা করার জন্য মৌলিক জ্ঞানটুকু তো অন্তত দরকার। সূচ হয়ে ঢুকে কখনো-কখনো মহিলারাও ফাল হয়ে বেরিয়েছেন।
আমরা ইদানীং যে নতুন যুগে পৌঁছেছি সেখানে এক নতুন বিজ্ঞানচেতনার সামনে আমাদের নিয়মিত দাঁড়াতে হচ্ছে। নারী সেখানে প্রায়শই ব্রাত্য। মহিলাদের শরীর নিয়ে অন্য আখ্যান তৈরি হচ্ছে, যেখানে সেটা বর্জ্য বস্তু হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। আবার নতুন প্রযুক্তি মহিলাদের হাতে তুলে দিচ্ছে এমন ব্যবস্থা যাতে নিজেই তারা নিজেদের অন্তরালবাসিনী বানিয়ে তুলতে পারে। লেখকর কথায় ‘প্রযুক্তি মেয়েদের হাতে তুলে দিচ্ছে নিজেদের শরীর নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলার সুযোগ।’ কিন্তু আমার প্রশ্ন ওই ইচ্ছামতো শব্দটিকে নিয়ে। নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছায় নয়, চাপে পড়ে প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে। সেই জোর প্রত্যক্ষ বা প্রকট না হতেই পারে, কিন্তু সামাজিক বা সাম্প্রদায়িক বা সমপর্যায়ের দলের অদৃশ্য দাবিও হতে পারে। লেখকের হিসাব মতো ‘শিল ধোয়া জল থেকে আইভিএফ’ আসতে লেগেছে এক শতাব্দীরও বেশি। আবার শিল বাটার জগতে ফিরে যেতে আমাদের লাগছে এক শতাব্দীর কিছু কম বোধহয়।
গেরস্থালির গ্যাজেট প্রসঙ্গে একেবারে সঠিক ভাবেই লেখক বুঝিয়েছেন কেন প্রযুক্তি মানেই তা মুক্তিদাতা নয়। গেরস্থালির সাহায্যার্থে যেসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বাজারে এসেছে তা কায়িক পরিশ্রম অনেকার্থে লঘু করলেও গৃহিণীদের নতুন দিশার পরিচায়ক হয়ে ওঠেনি। ঐতিহ্যগতভাবে মেয়েদের যেসব ভূমিকা তাতেই আবদ্ধ রেখেছে। আবার চিরাচরিত রান্নাঘরে নিজেদের সুবিধার্থে মহিলারা কিন্তু নানা মাপের প্রযুক্তি তৈরি করে নিয়েছেন, ব্যবহার করেছেন।
এরই মাঝে কখন যেন অলক্ষে এটাও মনে করিয়ে দেন তৃষ্ণা, ‘মুক্তির দায় যদি কোনো মেয়ের না থেকে থাকে, তবে যন্ত্র এসে তাকে মুক্তি দিতে পারে না।’ তবে ছবিটা অত ভয়ানক অন্ধকারময় ভাবারও দরকার নেই। যন্ত্র অনেক পুরুষকেও নতুন পথে টেনে এনেছে। মহিলাদের সঙ্গে অনেক পরিবারে পুরুষরা হাত মিলিয়ে নতুনভাবে সংসার যে একেবারেই করেন না তা নয়। অল্প শতাংশ করেন বইকি। সেটা আমরা চকচকে বিজ্ঞাপনের ছবিতে যতটা দেখি বাস্তবে ততটা দেখতে পাই না।
অনেক মজার গল্পের সঙ্গে সঙ্গে অজানা তথ্যও বইটিতে আছে, তবে তা সমৃদ্ধ হত যদি আরও কিছু গবেষণা করে লেখক তত্ত্ব ও সমীক্ষার দরজা খুলতেন। অনেক বিষয় ছুঁয়েছেন যেন পাঠকে এই কথাটি বোঝাতে — এ বিষয়টি জরুরি কিন্তু বিশদভাবে জানতে গেলে পড়াশোনা করুন। সহায়ক গ্রন্থ তালিকাটি বড়োই অপর্যাপ্ত। মহিলাদের কাজের ওপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই এখন সহজলভ্য যেগুলি তালিকাতে থাকলে পরবর্তীকালে অনেকে উপকৃত হতেন। নানা স্থানে তৃষ্ণা নারীবাদের বিভিন্ন ধারার উল্লেখ করেছেন, কিন্তু আলতো ছোঁয়ায়। এর ফলে কেন জানি না মনে একটু ধন্দ বাসা বাঁধল। কিছু পাতায় কিছু বিষয়ে এই ধারাগুলির অধিকতর চর্চার প্রয়োজন ছিল, কারণ ‘নারীবাদ’ এক বিস্তৃত, বহুমাত্রিক ও বহুধা প্রবাহিত অধ্যয়নের বিষয়। কেন তা করলেন না লেখক?
বইটি সুপাঠ্য। তৃষ্ণার মূল চর্চার বা উৎসাহের বিষয় যে ফিকশন সেটা দিব্য বোঝা যায়। চরকা থেকে সাইবারফেমিনিজম, শিল-নোড়া থেকে ইকোফেমিনিসম যাবার পথটি তৈরি করেছেন রূপকথা, লোককথা, জীবনকথা দিয়ে। রাস্তায় কুড়িয়ে নিয়েছেন সমাজ, সংলাপ, অন্তঃপুর, স্ত্রীশিক্ষা, নারীশরীরের মতো জরুরি বিষয়। নিঃসন্দেহে এ এক দারুণ প্রয়াস বা বলা যেতে পারে এক ভালো শুরুয়াৎ। এ বিষয় নিয়ে আরও অনেক লেখা হোক সেটাই কাম্য।