কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বিশাল সাহিত্যসৃষ্টির সুরসিক সমঝদার, এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে একেবারে ভিন্ন স্বাদে সেই একই বাংলা ভাষায় নিজের কবিতা লেখা কবি শঙ্খ ঘোষের বিশিষ্ট সৃজনশীলতার পরিচয় বলা যায়। ১৯৩২ সালে তাঁর জন্ম তখনকার পূর্ব-বাংলায়, কবিদের ভাষায় তাঁদের ‘শস্যশ্যামল’ দেশ। সেখানে জন্ম-নেওয়া শঙ্খ ঘোষ উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আসেন এবং পরবর্তী কালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখনশালায় (যেখানে ‘সংস্কার’ উপন্যাসটি লেখার সময় কন্নড় সাহিত্যিক ইয়ু আর অনন্তমূর্তিও এসে যোগ দিয়েছিলেন, সেই ইন্টারন্যাশানাল রাইটিং প্রোগ্রামে) ১৯৬৭ সালে এক বছরের ছাত্রবৃত্তিসহ কাজ করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে (রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া বিশ্বভারতী এবং অন্যান্য বিখ্যাত সংস্থাতেও) বিশেষ সম্মানের সাথে অধ্যাপনা করেছেন ১৯৯২ সাল অবধি। আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে বক্রোক্তি নয়, স্বভাবোক্তির দিকেই যাঁর কবিতার চলন, তিনি নিজেই ‘কুন্তক’ ছদ্মনামে সাহিত্য সমালোচনা করেছেন। এমনটা আমার মনে হয়, অবশ্য বাংলা সাহিত্যের চর্চা যারা করেন তাঁরা আরও ভালো বলতে পারবেন। ১৯৭৭ সালে ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য শঙ্খ ঘোষ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। সরস্বতী সম্মানে ভূষিত হন ১৯৯৮ সালে। ২০১১ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধি দিয়ে ভূষিত করেন। ২০১৬ সালে লাভ করেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। অবশ্য এই সব তথ্য তো আজকাল খুব সহজেই পাওয়া যায়।
কবি শঙ্খ ঘোষের কাব্যশৈলীর রসাস্বাদন কিন্তু তত সহজ নয়। শুধু তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর কবিতা বোঝা সম্ভব হবে না। এ কাজ মীমাংসার, হিউয়েরিস্টিক নয়, হারমানিউটিক। তাঁর একটি রচনা— আয়ু। এর সুনিবিড় পাঠ এবং সঘন আস্বাদ নিয়ে কবির সৃজনশীলতার একটা ছোট্ট উদাহরণ পাওয়ার আমরা চেষ্টা করব। কিন্তু তার জন্য, ওই কবিতাটি অবধি পৌঁছোনোর জন্য, আমাদের একটু নিজেদের প্রস্তুত করে নিতে হবে। সেই প্রস্তুতি শঙ্খ ঘোষের অন্যান্য কিছু রচনার পাঠ এবং আলোচনার মধ্যে দিয়ে আমরা করে নিতে পারব।
শঙ্খ ঘোষের কবিতা হিন্দি অনুবাদে, বই আকারে পাওয়া যায়। তার জন্য আমরা অনেক দ্বি-ভাষিক কবি-অনুবাদকের কাছে কৃতজ্ঞ। তার মধ্যে গুজরাট-স্নেহী দুজন কবি, ভোপালের ‘ভারত ভবন’ এবং দিল্লির ‘রজা ফাউন্ডেশন’-এর কারিগর কবি অশোক বাজপেয়ী, এবং বিখ্যাত গুজরাটি চিত্রকর জয়রাম পটেলের কাজের উপর মরমি সমালোচনা করেছেন যিনি, সেই প্রয়াগ শুক্লকে অগ্রণী মানা হয়। এই প্রবন্ধটি লেখার সময়, প্রয়াগজির সঙ্গে আমার টেলিফোনের মাধ্যমে বহুবার আলোচনা হয়েছে। কবিতাগুলির অনুবাদ করার সময় তাঁর কাছে শঙ্খ ঘোষের মূল রচনার বাংলা বিন্যাস এবং শব্দমাধুরী নিজের কানে শোনার বিশেষ সৌভাগ্য আমার হয়েছে। রজা ফাউন্ডেশন এবং রাজকমল প্রকাশনার মিলিত প্রচেষ্টায় ‘মেঘ জ্যায়সা মনুষ্য’ শীর্ষক হিন্দি অনুবাদে শঙ্খ ঘোষের একটি কাব্য সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটিতে, প্রয়াগ শুক্লাজির অনুবাদে শঙ্খ ঘোষের ‘মেঘের মতো মানুষ’ এককথায় অনবদ্য। যেমন ভাবপূর্ণ মূল রচনা, তেমনই ভাবে ভরা তার অনুবাদ। এই রচনার শেষ পঙ্ক্তিটি দেখি— ‘ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমিও হয়তো কোনোদিন/হতে পারি মেঘ!’
এমনই তবে সেই ‘মেঘের মতো মানুষ’, সমগ্র বিশ্বের প্রতি অনুকম্পাভরা একটি কবি-মন। তাই এমন কবির কবিতার খুব কাছে যাওয়ার এই হল বিপদ— ‘ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমিও হয়তো কোনোদিন/হতে পারি মেঘ!’
পূর্বাভাস পেয়ে গেছেন তো? প্রিয় পাঠক, এই প্রবন্ধটি তো সেই কবির কাছে যাওয়ার একটা ছোটো প্রয়াস মাত্র!
কেমন লাগবে তবে এমন কবির কবিতা অবসর সময়ে বসে পাঠ করতে? খুব কাছ থেকে? অনেক কাব্যসংগ্রহে শঙ্খ ঘোষের কবিতার তরজমা ইংরাজি বা হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। গুজরাতের ভোলাভাই পটেল আগে করেছেন আর এখন প্রসাদ ব্রহ্মভট্ট মূল বাংলা থেকে অনুবাদ করছেন। (প্রসাদভাইয়ের সঙ্গে এই লেখা চলাকালীন অনেক বার ফোনে কথা হয়েছে, এবং তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে শঙ্খ ঘোষের কবিতার আবৃত্তি শুনেছি।)
তাহলে, শঙ্খ ঘোষের কবিতা খুব কাছ থেকে কেমন লাগে? ‘মেঘের মতো মানুষ’-এর থেকে ভিন্ন স্বাদের দুটি কবিতা থেকে উদাহরণ দিই তবে? সেই দুটি থেকে প্রথম কবিতাটি তো বর্ষাধারার মতো সহজে ঝরে পড়বে এমন মনে হয় না। আর দ্বিতীয়টি তো—নিজ নিজ সীমানা খুঁজতে খুঁজতে, একে অন্যের সাথে ছোটো বড়ো যুদ্ধ করতে করতে, বিবিধ লোকালয়ের সীমানা ছাড়িয়ে আরপার বয়ে চলা কোনো নিত্যসলিলা বড়ো নদীর মতো লাগে আমার। সুদূর পর্বতমালার উৎস থেকে জন্ম নিয়ে সুদূরের মহাসাগরের দিকে যেন ধাবমান এই কবির কবিতা—যা কাব্যশাস্ত্র এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষুদ্র সীমানা খুব সহজেই অতিক্রম করে যায়। নিজস্ব এবং সর্বসাধারণের, ভাবে ভরা কিন্তু চিন্তাশীল, সামুদায়িক এবং একই সঙ্গে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, রাজনৈতিক আবার মনোবৈজ্ঞানিক, এই কাব্যনদী অনেক রাজনৈতিক বিচারধারাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে, নানা দ্বন্দ্বের মাঝে ভেদরেখা ঘুচিয়ে এগিয়ে চলে।
এমন কবিতা লেখা সহজ কাজ নয়। আর এমন কবিতাকে জানা, অথবা মানা, কোনোটাই তার থেকে সহজ নয়।
শঙ্খ ঘোষের কাব্যবাণীর বহু চর্চিত এক পরিচয় হল তাঁর মৌনতা। এই মৌনতা অর্থবহ এবং বহুমুখী। যেমন তাঁর এমনই একটি কবিতা ‘নাম’ শুরু হচ্ছে এভাবে: ‘কোনো জোর কোরো না আমায়।’
অনেক কথা বলতেই হবে তা কবি মানেন না, তবে যখন বলার ইচ্ছা করেন তখন কারও কোনো নিষেধ বা অনুরোধ উপরোধের তোয়াক্কা তিনি করেন না। এই সত্যপ্রতিবদ্ধ কবির বিখ্যাত অনমনীয়তার এ এক পরিচয়। ‘নাম’ কবিতায় কবি বলছেন, ‘কোনো জোর কোরো না আমায়।’ (কাকে বলছেন? শাসককে, সংস্থাকে, স্বজনদের, পাঠকদের, সমালোচকদের? কাকে, তাই যদি জানিয়ে দেন, তবে আর তিনি কবি কীসের?) তিনি তো শুধু এটুকুই বলেছেন—
নাম
কোনো জোর কোরো না আমায়।
শব্দগুলি খুলে যাক, খুলে-খুলে যায়
যেমন-বা ভোর
জলস্রোত বহুদূরে টেনে নিয়ে যেমন পাথর
জনহীন টলটল শব্দ করে
দিগন্তের ঘরে
আমাদের নাম মুছে যায় চুপচাপ। খুব ক্ষীণ
টুপটুপ খুলে পড়ে ঘাসের মাথায় নীল, আর কোনো দিন
কোনো জোর কোরো না আমাকে।
পছন্দ হল? নাকি একটু দুর্বোধ্য মনে হল? তবে প্রিয় পাঠক, আসুন একটু অন্যভাবে চেষ্টা করি: এই কবিতাটির শুরুটা যদি আমরা এমনভাবে পড়ি— ‘শব্দগুলি খুলে যাক, খুলে-খুলে যায়/ যেমন-বা ভোর’— কেমন, পড়েছেন? কোনো প্রকৃতিপ্রেমী রোমান্টিক কবিতা বা মধুর গীতের মতো সুগম হয়ে গেল তো, এই রচনা?! কিন্তু, কবি যে শুরুর পঙ্ক্তি লিখেছেন তা তো— ‘কোনো জোর কোরো না আমায়।’ শুনেছেন এর স্বরভার? এর গর্জন? কবিতার সম্পূর্ণ অর্থই যে গেল বদলে, তার চলন একেবারে ভিন্ন।
এই কবিতা পড়তে পড়তে গুজরাটি কবি উমাশঙ্কর জোশীর ‘রচো রচো অম্বরচুম্বী মন্দিরো’ (করো, নির্মাণ করো গগনচুম্বী মন্দির। ‘জঠরাগ্নি’, ১৯৩২) কবিতার পঙ্ক্তি মনে পড়ে যায়। এই কবিতায় উমাশঙ্কর যেন ‘তর্জনী তুলে তর্জন করছেন’— তখন এমনই বলেছিলেন এক গুজরাটি সমালোচক। শঙ্খ ঘোষের ‘নাম’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিটিও যেন ঠিক সেই একই মুদ্রার। ‘কোনো জোর কোরো না আমাকে।’ কেউ— কোনো সরকার, কোনো ব্যক্তি— কেউ এই কবির উপর জোর করতে পারেনি। পারে না। এক অর্থে কবি তাই সত্তাধারীদের কাছে ‘দুর্গম’।
বাংলা ভাষার এই কবির সমগ্র কবিতা যদিও এর থেকে অনেক বেশি দুর্গম। তবে যে-ভাবুক পাঠক এই সাহসি সফর করতে ইচ্ছুক, তিনি নিশ্চয় এই কাব্যসৃষ্টির অনুপম ‘ভয়ংকর’ সৌন্দর্যের, নিরতিশয় বেদনানন্দ ভরা এক অসীম জীবনের অনুভব-বৈভব আস্বাদন করতে পারবেন। তাহলে কেমন হতে পারে কবি শঙ্খ ঘোষের কাব্যসৃষ্টি?
‘কাব্যতত্ত্ব’ শীর্ষক কবিতাটি দেখি এবারে —
কাব্যতত্ত্ব
কাল ও-কথা বলেছিলাম না কি?
হতেও পারে, আজ সেটা মানছি না।
কাল যে-আমি ছিলাম, প্রমাণ করো
আজও আমি সেই আমিটাই কি না।
মানুষ তো আর শালগ্রাম নয় ঠিক
একইরকম থাকবে সারাজীবন।
মাঝে মাঝে পাশ ফিরতেও হবে
মাঝেমাঝেই উড়াল দেবে মন।
কাল বলেছি পাহাড় চূড়াই ভালো
আজ হয়তো সমুদ্রটাই চাই।
দুয়ের মধ্যে বিরোধ তো নেই কিছু
মুঠোয় ভরি গোটা ভূবনটাই।
আজ কালকে যোগ দিয়ে কী হবে?
সেটা না হয় ভাববো অনেক পরে।
আপাতত এই কথাটা ভাবি —
ফুর্তি কেন এত বিষম জ্বরে?
এর মধ্যে আমরা বিশেষ করে লক্ষ করি চারটি পঙ্ক্তি — মানুষ তো আর শালগ্রাম নয় ঠিক / একইরকম থাকবে সারাজীবন। / মাঝে মাঝে পাশ ফিরতেও হবে / মাঝেমাঝেই উড়াল দেবে মন। এই পঙ্ক্তিগুলিতেই কবি বিলক্ষণ বর্ণনা করছেন কেমন হতে পারে তাঁর কাব্যসৃষ্টি। কিন্তু, ‘কাব্যতত্ত্ব? এতে কাব্যতত্ত্বর কথা কোথায় লেখা আছে?’ এমন ফরিয়াদ করার লোকের তো অভাব নেই, কি গুজরাটে, কি বাংলায়! প্রিয় পাঠক, এই পঙ্ক্তিটি বারে বারে শুনুন—‘মাঝে মাঝে পাশ ফিরতেও হবে/ মাঝেমাঝেই উড়াল দেবে মন।’ ‘মাঝে মাঝে’ দ্বিরুক্ত, এবং তাও আবার দু-বার! পরের পঙ্ক্তিতেই — ‘মাঝেমাঝেই’। প্রকৃত কবি তিনি, তদুপরি আবার স্বল্পবাক, তিনি তো আর অকারণে পুনরুক্তি করবেন না। তবে কী-এমন আছে এই ‘মাঝে মাঝে’-তে যা কি না আলোকপাত করতে পারবে কবির ‘কাব্যতত্ত্ব’ বিষয়ে? যা করে তুলবে এই কবিতাটিকে ধীর ও গম্ভীর! দেখা যাক।
প্রিয় পাঠক, সংস্কৃত কাব্যশাস্ত্রের শিখরসম ১৭ শতকের কবি পণ্ডিতরাজ জগন্নাথের ‘গঙ্গালহরী’ পড়েছেন? অথবা ‘রসগঙ্গাধর’ গ্রন্থ? পণ্ডিতরাজ জগন্নাথ ( যিনি শাহ জাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শিকোহ্-র বন্ধু ছিলেন) কাব্যের জ্ঞানকে এক বিশেষ জ্ঞান বলে উল্লেখ করেছেন (কান্ট এবং ফ্রয়েডের কাছে আমরা এসব যখন শিখেছি, তার বহু আগেই, অবশ্য)। কিন্তু কী প্রকারের ‘বিশেষ জ্ঞান’? তার্কিক নয়, ব্যবহারিকও নয়। জগন্নাথের মতে কাব্যের সারবস্তু হল ‘ভাবের-জ্ঞান’ (না, ‘ভাবুক’ জ্ঞান নয়), নব্য ন্যায় দর্শনের মতে ‘ভাবের-জ্ঞান’ শব্দ-গুচ্ছের অর্থ ‘পুনঃ পুনঃ অনুসন্ধানাত্মক জ্ঞান’। পুনঃ পুনঃ অনুসন্ধান, যার একদিকে জ্ঞাতা এবং অন্য দিকে জ্ঞেয়, এই দুয়ের মাধ্যমে যা সাধিত হয়, তাই ‘ভাবের-জ্ঞান’— এমনই তো বলে কাব্যজ্ঞানমীমাংসার ভূমিকা।
আর ‘পুনঃ পুনঃ’ কি ‘মাঝে মাঝে’ হতে পারে না?
হতে পারে বইকি! পারে কেন, অবশ্যই হয়। আর তাই এই হল শঙ্খ ঘোষের কবিতা সম্বন্ধে বিশেষ মত: জ্ঞানের গতিশীলতা, এই হল তাঁর কবিতার ভূমিকা। বিগতকালকে আগামীর সাথে জুড়ে দিতে এত উতলা হলেন কেন? সমাজকে, ধর্মকে, আর্থিক ক্ষমতাকে, দেশকে?
‘আজ কালকে যোগ দিয়ে কী হবে?
সেটা না হয় ভাবব অনেক পরে।
আপাতত এই কথাটা ভাবি—
ফুর্তি কেন এত বিষম জ্বরে?’
যেন বলছেন গতকাল আর আজ-কে পরস্পরের সাথে জুড়ে দিলে কী হবে ‘সেটা না হয় ভাবব অনেক পরে’—এখন আপাতত কবিতা করতে দাও আমায়। ভাবতে দাও— ‘ফুর্তি কেন এত বিষম জ্বরে?’— এ কার শরীরের তাপ? কবির, কাব্যনায়কের, সমাজের, দেশের? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হলে বলতেন ‘নীরার’। শঙ্খ ঘোষ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নন! এক্কেবারে আলাদা। এই ‘ফুর্তি’ এল কীভাবে? ‘ইয়ং লাভ’ থেকে, সুনীল বলবেন। গোবর্ধনরাম অলক, সরস্বতীচন্দ্র আর কুমুদ, এই তিনজনকে নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। আর শঙ্খ ঘোষ বলবেন—
উত্তর যদি তিনি দিয়েই দেন তবে কবি কীসের? কবি শুধু ইশারামাত্র করবেন, আর তার না-বলা কথা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকের। কবি তো কেবল এইটুকুই বলবেন:
‘মানুষ তো আর শালগ্রাম নয় ঠিক
একইরকম থাকবে সারাজীবন।
মাঝে মাঝে পাশ ফিরতেও হবে
মাঝেমাঝেই উড়াল দেবে মন।’
চারপাশের পরিবেশ যাতে নিজেদের অনুকূলে হয়, তাই সত্তাধারীরা নানারকম জোর খাটানোর পরিকল্পনা করে যায়। তারা চায় সমস্ত মানুষকে আজীবন ‘শালগ্রাম’-এর মতো একইরকম রেখে দিতে। শঙ্খ ঘোষের কবিতা তাদের এই অচল স্থবিরাবস্থাকে স্পর্ধাভরে অস্বীকার করে।
বহুবার কবির সাথে দেখা হয়েছে আমার। বিদেশে, দেশে, এমনকি তাঁর নিজের বাসস্থানেও। কলকাতায় ওঁর ফ্ল্যাটে—একজন প্রোফেসরের যেমন হয়, তেমনই পুরোনো একটা ফ্ল্যাটে, ওঁকে দেখে আমার মনে একটা প্রশ্ন এসেছিল। এখন যা বিদেশ, সেই বাংলাদেশ, তারই কোনো এক চাঁদপুর গ্রামে, তাঁর জন্মস্থান। সেই গ্রামকে আজও কি মনে পড়ে ওঁর? কীভাবে? মাঝে মাঝে? যেমন ‘মাঝেমাঝেই উড়াল দেবে মন’, সেই ভাবে?
যেমন ভারতবর্ষের পূর্ব ভাগের মূল নিবাসী এবং শেষ জীবনে কাশীবাসী পণ্ডিতরাজ জগন্নাথ বলেছিলেন, যেমন পূর্ব ভারতের একটি ভাগে, পূর্ববাংলায় জন্মগ্রহণ করে কলকাতায় বসবাস-করা কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন এই রচনায়, এবং, যেমন আমার সাথে পশ্চিম ভারতের গুজরাটি সাহিত্য পরিষদের সমস্ত সাথি আজ বলছেন, সেই ‘পুনঃ পুনঃ অনুসন্ধান’-এর কথা। জ্ঞানের গতিশীলতার কথা। ভারতীয় সাহিত্য এমন করেই রচিত হয়, এমন করেই উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে, অজর-অমর!
কিন্তু এই অসামান্য কবিতাটির শেষ ক-টি পঙ্ক্তি যেন ভুলে না যাই আমরা:
‘আজ কালকে যোগ দিয়ে কী হবে?
সেটা না হয় ভাবব অনেক পরে।
আপাতত এই কথাটা ভাবি—
ফুর্তি কেন এত বিষম জ্বরে?’
জবাব হলো: ফুর্তি কাব্যতত্ত্বের জোরে।
শঙ্খ ঘোষ কেবল শাশ্বত জীবনবোধের কথা বলেন না। তিনি সময়সম্প্রাজ্ঞ, ইতিহাসজ্ঞ; তাঁর কবিতা ‘পলিটিকাল পোয়েট্রি‘, ‘রাজবিদ্যাবিদ কবিতা’, অথবা, গুজরাটি কবি উমাশঙ্কর জোশীর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘লোককারণ’-যুক্ত কবিতা।
শঙ্খ ঘোষের একটি বিখ্যাত কবিতা হল ‘ত্রিতাল’। লোককারণের কবিতা এটি। সাংকেতিক কবিতায় সুপ্রসিদ্ধ এই কবি তাঁর ‘ত্রিতাল’ কবিতায় ‘পোয়েট্রি অফ স্টেটমেন্টস’-এর খুব কাছে চলে গেছেন। লোককারণের ভাষায় কবি সবাইকে বলছেন :
ত্রিতাল
‘তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া’
‘তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া
পাতালমুখ হঠাৎ খুলে গেলে
দুধারে হাত ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া
তোমার কোনো ধর্ম নেই, এই
শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।
শ্মশান থেকে শ্মশানে দেয় ছুঁড়ে
তোমারই ওই টুকরো-করা-শরীর
দুঃসময়ে তখন তুমি জানো
হল্কা নয়, জীবন বোনে জরি।
তোমার কোনো ধর্ম নেই তখন
প্রহরজোড়া ত্রিতাল শুধু গাঁথা—
মদ খেয়ে তো মাতাল হতো সবাই
কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল!’
এই কবিতা থেকে পাওয়া তথ্য আর ‘কাব্যতত্ত্ব’ থেকে নেওয়া তথ্য, এই দুটি, শঙ্খ ঘোষের গতিশীল কবিতায় বারে বারে আশেপাশে জুড়ে যায়। আর তারই মাঝে দৃশ্যমান হয় শঙ্খ ঘোষের নিজস্ব জায়গা, তাঁর কবিতার লোকেশন, বাংলা কবিতার (এবং সমকালীন ভারতীয় কবিতার) বিরাট ব্যাপ্তির মধ্যস্থলে।
এ এক এমনই অবস্থান, তিনটে নদীর সংগমস্থলে যেমন আটকে থাকে কোনো গ্রাম, যেখানে ব্যক্তিগত এবং সামুদায়িকের, প্রেমের এবং প্রকোপের, রাজকীয় এবং স্বকীয়তার কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা আর থাকে না—এমনই এক সংগমস্থল— যেখানে তিনটে নদীর জলই মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অসন্দিগ্ধ রাজকীয় পরিণামসহ কবিতা থেকে শঙ্খ ঘোষের কবিতা তাই একেবারে আলাদা।
কবিতার এই অবস্থানই কাব্যবাণীকে বাগ্মিতার দিকে না নিয়ে গিয়ে, তাকে আস্তে আস্তে মৌনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলে। কাব্যবাণীর এই যে বাগ্মিতার সাথে আলগা হয়ে যাওয়া সংযোগ, যা তাকে মৌনতার দিকে অনায়াসে ঠেলে দেয়, তাই হল কবি শঙ্খ ঘোষের সৃজনশীলতার মাতৃভাষা।
অনেক বলতেই হবে, এ কথা তিনি মানেন না, তবে যখন বলতে চান তখন কারও তোয়াক্কা করেন না। কেউ কিছু বলছে, জোর করে বাধানিষেধ চাপিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু তা বলে তিনি পিছিয়ে আসেন না। সত্যপ্রতিবদ্ধ কবি— যিনি সত্যিই একজন ‘মেঘের মতো মানুষ’— শঙ্খ ঘোষের বিখ্যাত অনমনীয়তার এই পরিচয় ছড়িয়ে আছে তাঁর অসংখ্য কাব্যকৃতিতে। তাঁর এমনই এক রচনার নিবিড়পাঠ আজ আমরা (অবশ্যই আধুনিক রীতিনীতি মেনে) করব।
‘আয়ু’ কবিতায় শঙ্খ ঘোষের বাক-ভঙ্গিমা কেমন হতে পারে, আসুন প্রথমেই তার সামান্য আন্দাজ আমরা করে নিই। আমরা জানি কেমন করে একজন কথাসাহিত্যিক তাঁর পাঠকের সঙ্গে আলাপচারিতায় মজে যান; আর কেমন করেই বা একজন নাট্যকার তাঁর নাটকের চরিত্রদের পারস্পরিক বাক্যালাপে ব্যাপৃত রেখে নিজে চুপচাপ দূরে বসে শোনেন, কিন্তু কবি?... কবির কথা তো এই দুই সাহিত্যস্রষ্টার থেকে একেবারেই আলাদা; কবি অসামান্য, অতুলনীয়! তার উপর শঙ্খ ঘোষের মতো স্বল্পবাক, মৃদুভাষী কবি! তাই তিনি তাঁর ‘আয়ু’ কবিতায় যা বলতে চেয়েছেন, তার ধারা তবে কেমন হবে? কবিকে হয়তো কখনও কথাসাহিত্যিকের মতো, আবার কখনো-কখনো নাট্যকারের মতো, মনে হতেই পারে; তবু, কবি কিন্তু মূলত নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলা একজন মানুষ। আত্মসংবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে যিনি সর্বসংবাদ প্রকাশ করতে সক্ষম, তিনিই তো কবি।
‘আয়ু’ কবিতায় শঙ্খ ঘোষ এমনই এক আত্মসংবাদে মগ্ন, এ তাঁর নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন। কিন্তু তবু আমাদের কথাই তো বলছেন কবি এই কবিতাতে— তাই আসুন, মন দিয়ে শুনি, চুপচাপ:
আয়ু
এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নীচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে
স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও।
(এই কবিতাটি গুজরাটি ভাষায় অনুবাদ করেছি আমি; অনুবাদে সহযোগ করেছেন— সুকবি অরুণ কমল (পাটনা), সুতপা চৌধুরী (কলকাতা), প্রবোধ পারিখ (মুম্বাই)—টেলিফোনে, অর্থসহ মূল পাঠ, শোনার পরে অনুবাদ করা হয়েছে)
মন দিয়ে শুনছেন যে শ্রোতা তিনি হয়তো এই কবিতায় দুটি বিসংবাদী সুর শুনে চমকে উঠছেন! আজ্ঞার সুর যে এখানে বড়ো বেশি প্রকট এবং সুতীব্র, আবার কাতর কণ্ঠের কোমল সুরও। পরস্পরবিরোধী সুর সব, কবি শঙ্খ ঘোষের এমনই কাব্যরীতি যে এই দুই অতি ভিন্ন সুরের মেলবন্ধনেই তিনি রচনা করে চলেছেন এক অনবদ্য রাগিণী— যেন পাঠকের কাছে পেশ করছেন কোনো সিম্ফনি। কেমন করে? আসুন দেখি— কবিতার নামটি সহ কেবলমাত্র বারোটি পঙ্ক্তি দিয়ে কবি যেন বাজিয়ে দেখালেন বেটোফেনের অষ্টম সিম্ফনি। শীর্ষকের পঙ্ক্তি থেকেই কবিতাটি যেন আচমকা শুরু হয়ে যাচ্ছে, এবং আর কোনো ভূমিকা ছাড়াই কবি সহসা তীব্র স্বরে বলে উঠছেন, ‘চুপ করো!’ কাব্য রচনা আরম্ভ হওয়ার আগে কারা কোথায় এত কী বলাবলি করছিল! ওইসব বক্তাদের স্বমুগ্ধ বাক্যবাণী মাঝপথে থামিয়ে কবি প্রায় গর্জে উঠছেন, ‘চুপ করো।’ কিন্তু সম্পূর্ণ কবিতাটি এই একটি মাত্র সুরে কখনোই আবদ্ধ নয়। কারণ ‘চুপ করো’, এমন তীব্র স্বরে শুরু করেও কবি, মাত্র চারটে পঙ্ক্তির ব্যবধানে একেবারে ভিন্ন স্বরে, প্রায় শোনা যায় না এমন অস্ফুটে, সকাতরে বলছেন, ‘লেখো আয়ু লেখো আয়ু’। (মৃদুল দ্বিরুক্তি শুনতে পেলেন, এই স্বল্পভাষ, সদা অনমনীয় কবির?) এই অসামান্য রচনার কাব্যত্ব এই দুই পরস্পরবিরোধী স্বরের সংঘাতের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠছে। এই দুই স্বরের ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে রচিত হয়েছে যেন এক বিরল রাগিণীর সুরসংগত!
মাত্র উনপঞ্চাশ শব্দের কাব্যবিস্তারে কবি বার নয়েক ‘আয়ু’ আর ‘লেখো’ এই দুটি শব্দের ব্যবহার করেছেন— এ কবিতায় ব্যবহৃত অন্য যে কোনও একটি শব্দের থেকে অনেক বেশিবার। শুধু ওই দুটি শব্দই জুড়ে আছে কবিতাটির ১৮ শতাংশেরও বেশি। কাজেই, আমি গুজরাটি লব্জের কৌতুকে (!) বলতেই পারি, এই দুটি শব্দে কবি এতখানি বিনিয়োগ করে থাকলে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কতখানি লভ্যাংশ শুধু এই দুটি শব্দ থেকেই নিংড়ে নিতে পারছেন তিনি, তা সহজেই অনুমেয়! যেমন কোনো গণিতজ্ঞ বলবেন, অথবা যেমন বলবেন, কার্ল শেপিরোর মতো কোনো আমেরিকান ‘নিউ ক্রিটিক’! (শেপিরোর নিজের হাতে গড়া ‘স্কুল অফ লেটারস’-এ আমি স্নাতোকত্তর পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাই, এবং শঙ্খ ঘোষের স্বল্প-ব্যয়ী কাব্যবাণীকে কাছ থেকে বোঝার জন্যই এই গণিত! এই ‘ক্লোজ রিডিং’, এই ‘অভিনব নিবিড়পাঠ’!)
‘চুপ করো’ এবং ‘লেখো’— এই দুটি আজ্ঞা নিজেকে করেন যে-কবি, তাঁকে বোঝা বড়ো সহজ কাজ নয়! কিন্তু সহজে যার কূল পাওয়া যায়, এমন কলমবাজেরা আর যা খুশি হতে পারেন, কবি নন! তাই আমাদের এই উনপঞ্চাশটি শব্দ আর গুণে গুণে ঠিক (নাম সহ) বারোটি ছোটো পঙ্ক্তির এই কবিতার পাশে বসে তার কথা শুনতে হবে।
এবার উৎকর্ণ হয়ে শুনুন, আর মন দিয়ে দেখুন এই কাব্যকল্প:
‘শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর’— কাকে কী বলছেন এখানে কবি?
নিজেকেই বলছেন, যে-আদরের মর্মর কবিতাটি শুরু হওয়ার আগে শোনা গিয়েছিল তাকে এখন লুকিয়ে রাখো। কোথায়? ‘শষ্পমূলে‘। মাটির তলায় চাপা দিতে বলছেন না, শুধু ঘিরে আড়াল করে রাখতে বলছেন ‘আদরের মর্মর’কে। কোথায়? পাথরের তলায় নয়, কচি ঘাসের মূলে!—কঠোর-কোমল এমনই সৃষ্টি এই স্রষ্টার। ‘চুপ করো’, কঠোর স্বরে বলছেন নিজেকে। ‘ঘিরে রাখো’ কণ্ঠস্বরে কোমলতা যেন ঝরে পড়ছে।
কেন? এই কবিতাটির ধ্বনির ব্যাখ্যা তবে কেমন হবে? রসধ্বনি? প্রিয় পাঠক, আমাদের কবিতা, আমাদের মতো করেই পড়ি তবে।
কবি আরও দুটি কাব্যকল্প তৈরি করছেন, আমাদের মনে মনে নোট করে রাখা প্রশ্নগুলির আভাস আগাম জেনেই যেন। আসুন, এই দুটি কাব্যকল্প একটু মন দিয়ে দেখি: ‘ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড় / তোমার চোখের নীচে আমার চোখের চরাচর / ওঠে জেগে’
কিছু একটা তৈরি হল, ঘটে গেল, ঘরে আর বাইরে। কিছু একটা ঘটল তখন আর এখনের মাঝখানে— কবি যে কবিতা লিখছেন তা বর্তমান কালে, আর আমরা যে প্রত্যেকে এই কবিতাটি পড়ছি তাও তো এই বর্তমান কালেই। হয়তো এমন কিছু হয়েছে যে কবি বলতে বাধ্য হয়েছেন: ‘চুপ করো/লেখো’। কী হয়েছে? জবাব তো, প্রিয় পাঠক, আমাদের প্রত্যেককে নিজে নিজেই খুঁজে নিয়ে, অনুভব করে, বুঝে নিতে হবে, আত্মস্থ করে নিতে হবে, জবাব তো আমাদেরই দিতে হবে। কবি তো কেবলমাত্র একটি-দুটি কাব্যকল্প তৈরি করে আমাদের দেবেন, এক কুশল নাট্যকার যেমন একাঙ্ক নাটক আমাদের সামনে তুলে ধরেন, ঠিক তেমনই।
কবি তা হলে এই কবিতায় দুটো কথা বললেন: ‘আদরের মর্মর’কে ঘিরে আড়াল করে রাখো, চুপ করো’,— এই একটা কথা। এবং ‘লেখো আয়ু লেখো আয়ু’, এটা হল দ্বিতীয়। কিন্তু ‘আয়ু’ শব্দটির অর্থ এখানে কী? সেটা বুঝতে গেলে আমাদের দ্বিতীয় কাব্যকল্পটি দেখতে হবে: ‘স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ / আয়ু’।
প্রথম কাব্যকল্পে বাতাসের, দ্বিতীয় কল্পে জলের বিনাশক শক্তির ত্রাস আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ঘরেও, বাইরেও। নিজস্ব স্নেহ-সৃষ্টিতেও, আবার ব্যাপকার্থে জীবনে, সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক, বাস্তবেও।
ঝড়ে ‘তোমার চোখের নীচে আমার চোখের চরাচর/ওঠে জেগে’— তারই সাথে ‘ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান’, ‘স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি,’ ঘূর্ণির ভিতরে আয়ু স্তব্ধ হয়ে যায়। ওই দেখুন, প্রিয় পাঠক, আমাদেরই চোখের সামনে...
আর, আস্তে আস্তে আমাদের মনে বোধ জেগে ওঠে যে, আরে, এ তো আসলে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আয়ুর কবিতা। আয়ু স্তব্ধ হয়ে গেছে, চারদিকে। এমন বিপদকালে তুমি কোথাকার কোন্ স্নেহের মর্মরের কথা বলছ আর শুনছ হে? ‘চুপ করো’। কিন্তু, না, এই ভাবে চুপ করলে চলবে না। ‘লেখো আয়ু লেখো আয়ু’।
কেমন অদ্ভুত কাজ করায় কবিতা! কেমন তাগিদের! তবে করলেই কেমন সহজ সরল হয়ে যায় সব— মাত্র উনপঞ্চাশটি শব্দ আর এগারোটি পঙ্ক্তি দিয়ে কেমন সহজ করে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন শঙ্খ ঘোষ!
করে দেখালেন তো, প্রিয় সাথি, আমাদের সকলের নিজস্ব রীতিতে, একেবারে নিজের মতো করে?
আলবেয়ার কামু যেমন বলেছিলেন, “by the effort of each and the union of all.”
"যে লেখে সে কিছুই বোঝে না/ যে বোঝে সে কিছুই লেখে না/ দুজনের দেখা হয় মাঝে মাঝে ছাদের কিনারে/ ঝাঁপ দেবে কিনা ভাবে অর্থহীনতার পরপারে"
প্রিয়তম কবিকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন।এককথায় বললে সারাজীবন সহজ করে কঠিন কথা বলার সাধনা করে যাচ্ছেন মনে হয়।
লেখাটা খুর ভালো লাগল।
সিতাংশু যশচন্দ্রকে অনেক অভিনন্দন এমন মরমী সহজিয়া আলোচনার জন্যে।
গুরু অ্যাডমিনকে অভিনন্দন এমন সংগ্রহের জন্যে।
ধন্যবাদ প্রিয় কবিকে নিয়ে আলোচনার জন্য।
'এ এক এমনই অবস্থান, তিনটে নদীর সংগমস্থলে যেমন আটকে থাকে কোনো গ্রাম, যেখানে ব্যক্তিগত এবং সামুদায়িকের, প্রেমের এবং প্রকোপের, রাজকীয় এবং স্বকীয়তার কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা আর থাকে না—এমনই এক সংগমস্থল— যেখানে তিনটে নদীর জলই মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অসন্দিগ্ধ রাজকীয় পরিণামসহ কবিতা থেকে শঙ্খ ঘোষের কবিতা তাই একেবারে আলাদা।'
বা, এই বাক্যগুলি।
'কবিতার এই অবস্থানই কাব্যবাণীকে বাগ্মিতার দিকে না নিয়ে গিয়ে, তাকে আস্তে আস্তে মৌনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলে। কাব্যবাণীর এই যে বাগ্মিতার সাথে আলগা হয়ে যাওয়া সংযোগ, যা তাকে মৌনতার দিকে অনায়াসে ঠেলে দেয়, তাই হল কবি শঙ্খ ঘোষের সৃজনশীলতার মাতৃভাষা।'
শঙ্খ ঘোষের জন্মদিনে এই সাত ভাষাভাষী কবিতা-পাঠকের ন-টি লেখা প্রকাশের পরিকল্পনা অভিনব উদ্যোগ। সব ক'টি লেখাই যে খুব ভালো লেগেছে তা নয়, কিছুটা সাধারণ লেগেছে কখনও- কিন্তু আন্তরিকতা, পরিকল্পনার অভিনবত্ব, লেখা সংগ্রহ ও অনুবাদের পরিশ্রম এবং অবশ্যই কিছু উত্তম লেখা- এই সমস্ত মিলিয়ে সম্পাদক, কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ।
কয়েকজন অ-গুরুজনের মুখেও এ' উদ্যোগের উচ্চ প্রশংসা শুনলাম।
কি জানি " আয়ূ" কবিতাটার ব্যাখাটা মনঃপূত হল না। আমার মোটেই দুরকম স্বর মনে হয় নি। একটাই স্বর। তা আত্মমগ্নতার। আর ইনভেস্টমেন্ট আর রিটার্ন নিয়ে যা গুজ্জু প্রগলভতা করলেন সেটাও হজম হল না।