এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • সাঁঝবাতির রূপকথারা

    হরিদাস পাল
    আলোচনা | বিবিধ | ২৮ ডিসেম্বর ২০০৮ | ৬৬১ বার পঠিত
  • সাঁঝবাতি আর রূপকথার মধ্যে নাড়ির টান। সন্ধেবেলায় যখন ঘরের আঙিনায় ছায়ারা গাঢ় হয়ে আসে, জ্বলে ওঠে সাঁঝবাতি, একের পর এক, তখনই জন্ম নেয় রূপকথারা। জন্ম নেয় ঠাকুরমার কাঁপা-কাঁপা গলার ওঠাপড়ায়। আর খোকাখুকুরা শোনে,চোখের পাতায় নেমে আসা ঘুমের ঢেউকে তাড়িয়ে দিয়ে। চোখের মণি বড় বড়, বেড়ে গেছে বুকের ধুকপুকুনি। রূপকথা ভয় পাওয়ায়। ঠাকুমা দেখেন নাতিনাতনির চোখে ভয় ঠাঁই করে নিয়েছে। রাক্ষস - খোক্কসের দল ঘিরে ফেলেছে বাড়ি। এবার ঠাকুমা গলার স্বর পাল্টান - কে জাগে? লালকমল না নীলকমল? খোকা-খুকু জেগে আছে। এবার ওরা প্রাণপণে প্রার্থনা করে-- সময় নেই, সবাই জাগো। জেগে ওঠো লালকমল, ঘুমিও না নীলকমল। রূপকথা জাগতে শেখায়। এবার রাক্ষ্‌স-খোক্কসের দলের হারার পালা। নীলকমলের হাতে আছে এক আশ্চর্য তলোয়ার। ঠাকুমা বলে দেন--- কোন সরোবরের মাঝখানে কোন স্ফটিকস্তম্ভের মধ্যে লুকোনো রয়েছে রক্ষরাজের প্রাণভোমরা। এবার রূপকথা মারতে শেখায়।

    --- মারো রাজকুমার, মারো! তলোয়ারের এক আঘাতে ভেঙে ফেলো ঐ স্ফটিকস্তম্ভ। তারপর ? দু'আঙূলে টিপে মারো রক্ষরাজের প্রাণভোমরাকে। ইতিমধ্যে খোকন হয়ে গেছে রাজকুমার, হয়ে গেছে লালকমল-নীলকমল। সে এবার অনায়াসে বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে টিপে ধরে ভোমরাটিকে। নিজের অজান্তে ও কখন যেন ঘৃণা করতে শিখে গেছে, রূপকথা শিখিয়েছে। ঘৃণা না করলে যে মানুষ মারা যায় না। ঘৃণার অদম্য শক্তি।

    ঘৃণা না করলে কোন মানুষ পারে না গর্ভবতী মায়ের পেট চিরে দিতে, ছোট বাচ্চাকে আছড়ে মেরে ফেলতে। জামাকাপড় খুলে নিয়ে কয়েকশো লোককে গ্যাস চেম্বারে পাঠাতে বা একে-৪৭ দিয়ে সারাশরীরে সেলাই করে দিতে। কিন্তু একটা আরশোলা, কেঁচো,কেন্নো, ইঁদুর? এদের আমার মত ভীতু, ঝামেলা এড়িয়ে চলা লোকও পারে পা দিয়ে পিষে দিতে, ফাঁদ পেতে খাঁচায় আটকাতে বা বিষাক্ত অ্যাসিড ঢেলে নির্বংশ করতে।

    ঘৃণা প্রেরণা জোগায় আমার মত হাজারো আলসে ঢিলেঢালা অচল লোককে সচল হতে, সক্রিয় হতে। ঘৃণার এই প্রেরণাদায়ী ভূমিকা খেয়াল না করলে বোঝা যাবে না গুজরাত ২০০২-০৩, মুম্বাই-ভোপাল ৯২-৯৩, বা দিল্লীর শিখনিধন, বা ভিওয়ান্ডি, বা নেলী, বা টাটার ব্লাস্ট ফার্নেসে সহকর্মীকে ঢুকিয়ে দেয়া।

    শুনেছি হিরোশিমায় অ্যাট্‌ম বোমা ফেলা পাইলটের শেষের দিনগুলো কেটেছে কোন মেন্টাল অ্যাসাইলামে। মনে হয় উনি হিরোশিমাবাসী "ইয়েলো গুক'' দের যথেষ্ট ঘৃণা করতে পারেন নি। তাহলে মানসিক ভারসাম্য হারাতেন না। ব্লাডি নিগারদের আমাদেরই মত মানুষ ভাবলে ক্লু-ক্লুক্স্‌-ক্ল্যানের সদস্য হওয়া যায় না। সম্ভবত: কার্লাইল একবার বলেছিলেন---- ভারতশাসন আর শেকস্‌পীয়র পাঠ, দুটো একসাথে হয় না।

    রূপকথা রচনা করে ঘৃণার পেডাগগি। ঘৃণা মানুষের চেহারা বদলে দেয়। তারা হয়ে যায় রাক্ষস-খোক্কস্‌। তাদের দাঁতগুলো হয় মূলোর মত, কানদুটো হয় কুলোর মত। গায়ের লোম হয় শক্ত কাঁটাওলা। থাবায় বড় বড় নখ। ওদের বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলে ফিনকি দিয়ে লাল নয়, কালোরক্ত বেরোয়। ওরা বেঁচে আছে মানে বেঁচে আছে ভয়। ওরা এগিয়ে আসছে মানে আমরা আক্রান্ত। ওরা আমাদের ভয় পায়, ঘেন্না করে। আমরাও ওদের ভয় পাই, ঘেন্না করি। হয় ওরা থাকবে নয় আমরা। কিন্তু আমরা যে বাঁচতে চাই। তাহলে ওদের বাঁচতে দিলে চলবে না। মারতে হবে। সোজা কথা। বাঁচতে গেলে মারতে হবে, ওদের মেরেই বাঁচতে হবে।

    ওরা কারা? ওরা হল "ওরা''। প্রত্যেক যুগে আলাদা আলাদা ওরা। কখনও পিশাচ, কখনও দানো, কখনো রাক্ষস, কখনো খোক্কস। প্রত্যেক যুগে আমাদের রূপকথা শোনাতে আসেন ঠাকুমা-দিদিমারা। কার ঠাকুমা? আমাদের সব্বার। ঠাকুমার পরিচয় কুঞ্চিত লোলচর্মে, মাড়িবেরকরা ফোকলা হাসিতে,শ্বেতশুভ্র আঁচলের গিঁট খুলে নাতি-নাতনীদের হাতে ধরিয়ে দেয়া নিষিদ্ধ খাবারের গন্ধে। কিন্তু আসল পরিচয় গল্পের ঝুলিতে। গল্পে থাকে সান্ত্বনার প্রলেপ। রুপকথার রাজকুমারের সাথে একাত্ম হয়ে খোকনের ঘা' খাওয়া অহং শান্ত হয়। স্কুলের মাঠে খোকন মার খেয়েছে দামড়া ছোঁড়াদের হাতে, ক্লাসে মনিটরের মিথ্যে চুকলি শুনে বেঞ্চের ওপর দাঁড়াতে হয়েছে। কিন্তু সাঁঝবাতির মিটমিটে আলোয় রূপকথা শুনতে শুনতে ভাবে --"ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে, ঢালতলোয়ার ঝন্‌ঝনিয়ে বাজে, কি ভয়ানক লড়াই হল মা যে!''। পরের দিন আবার ক্লাসে যায়, ভাবে সাঁঝবাতির রূপকথারা দিনের আলোতে আজ মিলিয়ে গেছে বটে , কিন্তু একদিন ঠিক ফুটে উঠবে। এ'ভাবেই খোকনেরা বড় হয়। ধীরে ধীরে রূপকথারা এক'পা- দু'পা করে স্থান করে নেয় মনের গোপন মণিকোঠায়। বড়-হয়ে -ওঠা খোকন সিনিক হয়ে যায়।--- সেদিন আসবে কবে? যে মাসেতে রোব্বার নেই সেই মাসেতে হবে!

    কিন্তু বড়খোকনেরও চাই রূপকথা। অন্যরকম রূপকথা। চাই ইচ্ছাপূরণের গল্প। কারণ মার খাওয়া খোকনের নিয়তি।

    স্কুল-কলেজে অ্যারিস্টোক্র্যাট পরিবারের ছেলেরা তাদের চারচাকার রথে অনায়াসে নিয়ে চলে যায় ওর স্বপ্নে- দেখা- রাজকন্যাকে। চাকরির প্রতিযোগিতায় সে থই পায় না। জীবিকার ময়দানে খেলতে নেমে সারাক্ষণ পাঁজরে লাগে কনুইয়ের শক্ত খোঁচা। কাকে দোষ দেবে? কে সেই রাক্ষস?

    এমন সময় আসে নতুন যুগের রূপকথা--- সেলুলয়েডের পর্দায়। অমিতাভ বচ্চন দৈবশক্তির বরপ্রাপ্ত যোদ্ধা। একাই একশ' রাক্ষসের মোকাবেলা করার ক্ষমতা রাখেন। নায়িকার সাধ্য কি মুখ ফিরিয়ে দূরে সরে থাকে! নায়িকার বাবা রক্ষরাজ কখনও মাফিয়া, কখনও ঘুষখোর পুলিস অফিসার, কখনও রাজনৈতিক নেতা।আজকের রূপকথারা একটা নতুন শরীর পায়।

    এই রূপকথারাও একসময় "ব্যবহৃত হতে হতে, শুয়োরের মাংস হয়ে যায়''। ডাক পড়ে অন্য প্রজাতির রূপকথাদের। আসুন, আমরা গত একশতাব্দী ধরে জন্মনেয়া -বেড়েওঠা- মিলিয়েযাওয়া বড়খোকনের রূপকথাদের দেখি।

    প্রথম রূপকথা-- স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। একবার ইউনিয়ন জ্যাক নেমে গিয়ে ত্রিবর্ণ হাওয়ায় পত্‌পত্‌ করুক--- ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। "হম্‌ রহে , না রহে , উস্‌কা কোঈ গম্‌ নহীঁ, তেরে রাহ্‌ কে লিয়ে রোশনী জ্বলা দিয়া, অয়্‌ ওয়তন্‌''। ক্ষেতে সোনা ফলবে, কারখানায় মজদুরেরা ছেনি-হাতুড়ির বদলে বোতাম্‌ টিপে মেশিন চালিয়ে উৎপাদন করবে। সবাই পাবে মাথার ওপর ছাদ, লজ্জা ঢাকার কাপড়, দু'বেলা ভরপেট খাবার আর অসুখ হলে ভগবানের মত ডাক্তার। ছোট বাচ্চারা পথেঘাটে খেলে বেড়াবে না, চায়ের দোকানে কাজ করবে না, স্কুলে যাবে। কোলকাতার যীশুরা আর ফুটপাথে জন্মাবে না। দরকার শুধু সাদা চামড়ার রাক্ষসকে হারিয়ে তার থেকে রাজপাট ছিনিয়ে নেয়া।

    দেশ স্বাধীন হল। এক দশকের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনের ধোবিঘাটে আছাড় খেতে খেতে এই রূপকথার রং জ্যাল্‌জেলে হয়ে গেল। সাদারা আর রাক্ষস রইল না। আবার কালো রাক্ষসও পথেঘাটে দেখা যেতে লাগলো। ফলে রূপকথারও পরিবর্তন হল।

    দ্বিতীয় রূপকথা। আমরা জানলাম-- ''চিনি তোমায় চিনি গো, জানি তোমায় জানি গো, সাদাহাতির-- কালা মাহুত তুমি না?'' আমরা জানলাম --- ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, দেশ কা জনতা ভূখা হ্যায়। আর জানলাম--- আছে এক রূপকথার দেশ, যেখানে ছোটলোক-ছোটজাত বলে কেউ কাউকে ঘেন্না করে না। সেখানে বেকার নেই, ভিখিরি নেই, সাঁঝবাতি জ্বলে ওঠার সময় রং মেখে গলির মুখে দাঁড়ানো মেয়েরা নেই, হাঘরে নেই, পাঠশালায় যেতে গুরুদক্ষিণা নেই, ডাক্তার ডাকলে ভিজিট নেই। চায়ের দোকানে বাসনধোয়া বাচ্চা নেই। আর --আর একটু চেষ্টা করলে ঐ রূপকথা আমাদের মাটিতে নেমে আসবে। -- দামামা ওই বাজে, দিনবদলের পালা এল ঝোড়ো যুগের মাঝে। অতএব, আর একটু হাত-লাগাও ভাই সকল। আউর থোড়া! হেঁইয়ো! দম লাগাকে, হেঁইয়ো! মনুমেন্ট ময়দানে, ব্রিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সাঁঝবাতি জ্বলার সময়,মাটিতে পেতে বসা খবরের কাগজকে মশালের আলোর থেকে ফুলকি হয়ে ছিটকে বেরিয়ে সেইসব রূপকথারা জোনাকির মত হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে লাগলো।

    সত্যিই তো! প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন হওয়ার একমাসের মাথায় চালের দাম কমতে লাগলো, কেরোসিনের দাম কমতে লাগলো। তবে কি জোতদার-মজুতদারের দল ভয় পেয়েছে? কারখানায় কারখানায় নতুন নতুন ট্রেড ইউনিয়ন স্বীকৃতি পেল। বৃটিশের ট্রাম কোম্পানী বামসরকার রাষ্টীয়করণ করে নিল। ঊ:, এ যেন কোন বিপ্লবী সরকার আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজেয়াপ্ত করছে। "ঘেরাও'' বলে এক নতুন হাতিয়ার পেয়ে গেল মজদুরেরা। সোনারপুর-কালিকাপুরে চাষীরা মাঠে লালপতাকা পুঁতে জোতদারের পরোয়া না করে ধান কাটতে লাগলো। পুলিস কোথায়? পুলিস? আমরা শুনলাম-- নতুন জমানায় পুলিস সাধারণ মানুষের বন্ধু। বলা হল খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের লড়াইকে পুলিশ লেলিয়ে দমন করা হবে না। এ যে রূপকথা সত্যি হতে চলেছে।
    "বাজি ফুটলো ইধার-উধার, মেঘে মেঘে বাইজ্‌লো কাঁড়া,
    রাত-বারোটার কঠিন আঁধার চাঁদ কইরলেক ডিংলা-ফাড়া''।

    কিন্তু কুয়াশা ঘেরা রূপকথার আমেজ বেশিদিন রইলো না। ধু-ধু গ্রীষ্মে খট্‌খটে রোদ্দূর। অবাক হয়ে খোকন দেখে চালের দাম আবার বেড়েছে, কিছু জিনিস বাজার থেকে উধাও। পুলিস গুলি চালিয়ে মজুর মারছে কাশীপুর অর্ডিনান্স্‌ ফ্যাকটরিতে, চাষীবৌদের মারছে উত্তরবঙ্গে । খোকনেরা হতভম্ব। এ কি "যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ''? না কি "মানুষের মর্মে মর্মে করিছে বিরাজ নরকের কীট, শুকায়েছে কালস্রোত, কর্দমে মেলেনা পাদপীঠ''।

    না:, চাই অন্য রূপকথা, চাই নতুন ঠাকুমা।

    হ্যারি পটারের সৃষ্টিকর্ত্রী শ্রীমতী রাউলিং তখন এক্কাদোক্কা খেলছেন। জানতেন না বোধহয় যে প্রায় তিনদশক পরে ক্ষিদের জ্বালা তাঁর হাত ধরে লিখিয়ে নেবে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তার একের পর এক রেকর্ডভাঙ্গা এক অনন্যসাধারণ রূপকথার সিরিজ।

    কিন্তু ষাটের দশকের শেষ আর সত্তরের শুরু -- এক অত্যাশ্চর্য্য সময়। আকাশ থেকে সারা পৃথিবী জুড়ে নেমে এল অসংখ্য লাল-নীল-হলুদ রূপকথার জাদু। প্যারিসে সরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের দল, রেনো কারখানার মজদুর আর জাঁ পল সার্ত্রের মত বুদ্ধিজীবি --- সবাই পথে নেমেছেন। আমেরিকায় ভিয়েৎনামে নাপাম ফেলার প্রতিবাদে মিছিলে সামিল সাধারণ মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে শোনা যায় জোন বেইজ, বব ডিলান, পীট সিগারদের যুদ্ধবিরোধী গানের প্রতিধ্বনি। ডেট্রয়েট, শিকাগোতে আফ্রো-আমেরিকানদের আন্দোলন ক্রমশ: উগ্ররূপ নিচ্ছে। টম কাকার কুটিরকে ভুলে কালো মানুষেরা বরণ করেছে নতুন একটি রূপকথাকে ---- ব্ল্যাক পাওয়ার। নতুন নতুন রাজপুত্তুর--- ম্যালকম্‌ একস্‌, স্টোকলি কারমাইকেল। মার্টিন লুথার কিং এর রূপকথা তুলনায় যেন একটু সাদামাটা। এক নতুন গল্পদাদু হার্বার্ট মার্কিউজ শোনাচ্ছেন "ওয়ান ডাইমেনশনাল ম্যান'' এর আর এক রূপকথা। আবার বীটলস্‌দের এক রাজপুত্তুর জন লেনন শোনাচ্ছেন --"স্ট্রীট ফাইটিং ইয়ারস্‌''।

    রূপকথার ঢেউ ছড়ায় ভারতবর্ষে। পাওয়ারফুল চশমা চোখে খেঁকুরে চেহারার এক স্বপনবুড়ো শোনাতে লাগলেন জাদুমন্ত্র -"হিং-টিং-ছট্‌''। ছোটখোকন-বড়খোকন সবাইকে ডাক দিলেন, সবাই পড়াশোনা ছেড়ে গাঁয়ে গাঁয়ে কৃষকদের মধ্যে প্রচার করুক শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনীতি। একে-৪৭ এর নামও তখন কেউ শোনে নি। তাতে কি! প্রথাগত দা-কুড়ুল যাই পাও নিয়ে আক্রমণ কর। তাহলে আগামী গ্রীষ্মে বাংলার বিশাল সমতল দিয়ে লিবারেশন আর্মি মার্চ করে যাবে। উনি আরও বল্লেন - "আমি যখন বলি সত্তরের দশক, মুক্তির দশক তখন দিবাস্বপ্ন দেখি না। আর সত্তরের দশক বলতে আমি পঁচাত্তর সালের বেশি ভাবতেই পারি না।''

    অপরূপ রূপকথা। বড় খোকন, ছোটখোকন, হরিদাস পালের মতন মেজ-সেজ আর যত খোকন সবার তখন আঠেরো বছর বয়স। ওরা দেখল পরীক্ষা দিয়ে পাশ করার চেয়ে পরীক্ষা বয়কট করা অনেক বেশি কৃতিত্বের। জগদীশ বসু - বিদ্যেসাগর হওয়ার চেয়ে ক্ষুদিরাম - প্রফুল্ল চাকী হওয়া অনেক বেশি গৌরবের। ওরা অবাক হয়ে দেখল পাড়া-পড়শীর দল আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে না। আশপাশের দশটা পাড়ার বুঁচি-টেঁপি-চামেলির চোখে ওরা বীর। পুলিশকে ভয় পায় না! কি সাহস! মাগো!
    "বড় সুখবর শুনিলাম বাঘা জোতদার মরিল নাকি! গেরিলা কিসানের ঘায়ে জোতদার মরিল নাকি?''
    আর "চীনের চেয়ারম্যান আমাদেরই চেয়ারম্যান চীনের পথ আমাদেরই পথ
    জয় আমাদের হবে, রেডবুক হাতে মুক্তির নিলাম শপথ।''

    এ যে শতাব্দীর সীমানা পেরিয়ে জেগে উঠেছে পুরোনো এক রূপকথা! সাঁওতাল বিদ্রোহের ডাক---"উল্‌ উলান''! তীরকাঁড় নিয়ে বন্দুকধারী ইংরেজফৌজের মোকাবেলা! শালের জঙ্গল কথা বলছে -- মারাং বুরু আমাদের দেবতা, মারাং বুরু আমাদের ভরসা। মারাং বুরু বুলছে -- উদের গুলি সব ধুঁয়া হয়ে যাবে। দিকুদের গুলি, সাদা চামড়ার গুলি সব ধুঁয়া হয়ে যাবে।

    ১৯৭৫ এ সব রূপকথা চুপকথা হয়ে গেল। লিবারেশন আর্মির মার্চপাস্টের জায়গায় এল দেশজুড়ে "জরুরী অবস্থা''। আর এল নতুন এক ঠাকুমার উঁচুপর্দার কথনে নতুন রূপকথা---"গরীবি হটাও''। গল্পবলার সময় সুরের ওঠানামার সাথে সাথে তাল মিলিয়ে দোলে হাতের জাদুদন্ড। মন্ত্রবলে জেলখানা ভরে ওঠে। দিল্লির গরীব মহল্লা অদৃশ্য হয়। সরু সরু গলিঘুঁজি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। দেখা দেয় ঝাঁ-চক্‌চকে রাজপথ-জনপথ, এশিয়ান ভিলেজ। খালি হাওয়ায় ভেসে আসে হাপরের মতন আওয়াজ, শ্বাস টানার শব্দ। নীচুগলায় কেউ গাইতে থাকে--"জঙ্গল-জঙ্গল ঘুমকে দেখা, বস্তি-বস্তি ঘুমকে দেখা, হর তরফ হরিয়ালি হ্যায়, সির্ফ আঁখে সবকী খালি হ্যায়।''

    আশির দশক এল, খোকনদের জন্যে নতুন খেলনা নিয়ে -- কম্পিউটার। এ এক আশ্চর্য ক্রিস্টাল বল। এর দিকে তাকিয়ে থাকো, দিনরাত ভুলে যাবে। ক্রিস্টাল বল ঘোরে। খোকনেরা ওর মধ্যে দেখতে পায় -- ভূত- ভবিষ্যৎ। বর্তমান? সে তো স্ফটিকগোলক নিজেই। মুক্তির দশক? হা-হা-হা-হা!!
    "মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি? মুক্তি কোথায় আছে?''

    কিন্তু আশির দশক থেকে শুরু হল এক নতুন প্রজাতির রূপকথা। দাড়ি-পাগড়ি-আলখাল্লা পরা রূপকথার চরিত্ররা নেমে এলেন পৃথিবীতে। বল্লেন-- আমি ঈশ্বরের দূত। এসেছি সব পাপ ধুয়ে এই ধরিত্রীকে পুণ্যভূমি বানাতে। বিধর্মীদের সমূলে বিনাশ করে ন্যায়ের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। খোকন! চোখের জল মোছ। আমার সঙ্গে এস। তোমরা অনেক অত্যাচার সহ্য করেছ। আর নয়! শয়তানের সাম্রাজ্যে অসম্মানের জীবনযাপনের চাইতে মৃত্যু শ্রেয়। এবার পাল্টা আঘাত হানো। দিন আগত ঐ! খোকন হতভম্ব। শয়তান কোথায়? -- কেন? তোমার চারপাশে তাকিয়ে দেখ। আমরা ঈশ্বরের সন্তান, আমরা মহাকালীর বাচ্চা। আমরা শ্বেতশুভ্র ভগবানের প্রজাতি। খালি আমরাই দ্বিনের অনুগামী। আমরা ছাড়া বাকি সবাই "ওরা''। ওরা ইবলিশের বাচ্চা। ওরা সভ্যতার কলংক। ওদের বাঁচতে দিলে চলবে না।

    নতুন রূপকথাগুলোর দাপটে ঠাকুমা-দিদিমা-পোটলিবাবা সবাই দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেলেন। কেউ কেউ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। চারদিক ভরে উঠলো অভিশাপ-ফতোয়া আর ধর্মযুদ্ধের ঘোষণায়। খোকনেরা কি করবে? শোন খোকন! চোখ খোল। দেখ কি সাদামাটা অকিঞ্চিৎকর তোমার জীবন। এর জন্যে তুমি দায়ী নও। দায়ী ওরা। ওদের খতম করতে হবে। হত্যা করা পাপ? ভুল শুনেছ। মানুষ-মারা পাপ। ওরা মানুষ নয়। আরশোলা-ইঁদুর মারলে পাপ হয় না। আবার ভাবো। তুমি মারা গেলে ভগবানের কাছে যাবে। ঈশ্বর তোমাকে কাছে টেনে নেবেন। বেঁচে থাকলে তোমার মুঠোয় গোটা দুনিয়া।
    "হত বা প্রাপ্সসি স্বর্গং, জিত্বা ত্বং ভোক্ষ্যসি মহীম্‌''।

    খোকনেরা বুঝলো-- কলির শেষ হয়ে এসেছে। দুনিয়ায় পাপের ঘড়া প্রায় ভরে এসেছে। বিদীর্ণ হল ধনভান্ডার তল, পাতালগুহায় উঠেছে জাগিয়া কালীনাগিনীর দল। নতুন রূপকথার স্বপ্নে বুঁদ সবাই। আক্রমণ, প্রতিআক্রমণ। শয়তানদের ক্ষমতার প্রতীক সব চিহ্ন ভেঙ্গে চুরমার করো। ভেঙ্গে পড়লো বাবরি মসজিদ। ধূলোয় মিলিয়ে গেলেন বামিয়ানের বুদ্ধ। আর আকাশ থেকে বজ্র নামলো--- বিশ্বব্যাপার কেন্দ্রের গগনচুম্বী ইমারত তাসের প্রাসাদের মত ধ্বসে পড়লো।

    এবার সাদাচামড়ার ক্লীনশেভড্‌দের রূপকথায় দাড়িওলারা হল ডেভিলস্‌ অ্যাড্‌ভোকেটস্‌। আর দাড়িওলারা বল্লো - মেয়েদের মত মোমপালিশ গাল যাদের তারাই আসল শয়তানের চ্যালাচামুন্ডা। রক্তের ধারা ছড়িয়ে পড়ছে। হ্যারি পটারেরা অসহায়। তারা বুঝতে পারছে না জাদুকর অধ্যাপকদের মধ্যে কে শুভ, কে অশুভ।

    আর গত প্রজন্মের খোকনেরা? তারা আজ সব হরিদাস পাল হয়ে নিজের নিজের গর্তে সেঁধিয়ে গেছে। কোন প্রচলিত রূপকথায় তাদের বিশ্বাস নেই। কিন্তু রূপকথা যে চাই, রূপকথা ছাড়া যে চলে না। হাওয়ায় ভেসে নেমে আসবে কি কোন নতুন রূপকথা? হরিদাস পালেরা তারই দিন গোণে। ততদিন?

    ততদিন-- Ignorant armies clash by night.

    ডিসেম্বর ২৮, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৮ ডিসেম্বর ২০০৮ | ৬৬১ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    রূপকথা - Esha Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন