এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হোটেল ম্যানেজার - ১৩

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৭৪২ বার পঠিত
  • খোয়াইয়ের ধারে একটা পাথরের ওপর বসে রইল নিখিল। এখনও কেউ এসে হাজির হয়নি এখানে। নিতল অম্বরতলে ঝুরো পাতাপত্রের সঙ্গে হাওয়ার ফিসফিস কানাকানি। দিনভর চলে অস্থির বাতাসের অবিরাম খেলা ।  নির্জন নীরব পরিপার্শ্ব। নিখিলের মনে হল সে অনন্তকাল ধরে বসে থাকে এখানে। এই রকম জনহীন শব্দহীন বনভূমিতে সে কাঁথি, বারাসাত, অনিন্দিতা, মৃদুলা,  ঐশী .... তিলোত্তমা লজ, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের দপ্তর ..... জীবনের জ্বলন্ত অঙ্গারগুলো  ভুলে এখানে বসে থাকে । নিখিল দাস খোয়াইয়ের এই উদাস বিবাগী পরিবেশে  প্রায় এক ঘন্টা ধরে বসে রইল।
      এই নিরালা বাতাস বেশিক্ষণ বজায় রইল না। একটা বড় মারুতি সুজুকি ভ্যান ঘ্যাঁসস্ করে ওপাশে রাস্তার ওপর দাঁড়াল। নানা বয়সের একদল ট্যুরিস্ট হৈ হৈ  করে এসে পড়ল। কলরব আছড়ে  পড়ল  শান্ত মৌন  বাতাবরণে। সেলফি তোলার ধুম পড়ে গেল  ভয়ঙ্কর  উৎসাহে।

        নিখিল উঠে পড়ল। হাঁটতে লাগল ক্যামপাসের গেটের দিকে।         রাস্তার ধারে একটা ছোট দোকান। দরমার দোকানে   বসল চা খাবার জন্য। ওখানে খান চারেক কচুড়ি খেল। তারপর পাঁচ টাকার দুধ চা। বহুদিন পরে সে দুধ চা খেল। 
        শান্তিনিকেতন ক্যামপাসে ঢুকে বিচিত্রাভবনের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। বিচিত্রা, উদয়ন , শ্যামলী ,উদীচি কোন ভবনেরই ভেতরে ঢুকল না। সে অনেকবার শান্তিনিকেতনে এসেছে এবং বহুবার ওসব দ্রষ্টব্য দর্শন করেছে। আর দেখার আগ্রহ নেই। সে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল এদিক ওদিক।
       নিখিল ভাবল এখানে কোন হোটেলে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে তারপর প্রান্তিকের রিসর্টে ফিরবে। তার মনে আসছে খরচের কথা।এখানে বেশিদিন থাকতে গেলে প্রচুর টাকা খসে যাবে। সে ভাবতে লাগল ওদিকে সাঁওতাল গ্রামের দিকে গিয়ে কিছুদিন থাকা যায় কিনা। থাকতে কষ্ট হবে ওখানে। কিন্তু উপায় কি। মানব হেমব্রম বলে একজনকে সে চেনে প্রায় দশবছর ধরে। সাঁওতাল গ্রামে গিয়ে তাকেই খুঁজে বার করতে হবে। মানব খুব ভাল লোক। নিশ্চয়ই তার থাকার একটা ব্যবস্থা করবে।
    অফিসের ছুটিটাও বাড়ানো দরকার। ভাবল, তার স্মার্টফোন থেকেই একটা মেল করবে। তারপর এসট্যাবলিশমেন্ট ডিপার্টমেন্টের বিভাস ঘোষদস্তিদারের সঙ্গে কথা বলে নেবে । তারপর ভাবল ,  না না কথা টথা বলার দরকার নেই। এখন গা ঢাকা দিয়ে থাকাই ভাল। বলা যায় না , অনিন্দিতা হয়ত অফিসেও ধাওয়া করতে পারে। না না .....সে কিছুতেই নিজেকে এ মামলায় জড়াবে না। 
      কপাল ভাল, নিখিল সহজেই মানব হেমব্রমকে খুঁজে পেল। মানবের বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ। সে তো নিখিলের প্রস্তাব শুনে একেবারে কৃতার্থ হয়ে গেল। গ্রামটা অবশ্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। কারো ঘরেই ইলেকট্রিকের আলো জ্বলে না। সন্ধের পর নিঝুম অাঁধার।ঘরে ঘরে কুপি আর লম্প জ্বলে। গাছগাছালির ইয়ত্তা নেই। প্রায় জঙ্গলের মধ্যে গাঁ। বাতাসে বাতাসে জঙ্গলের গন্ধ। তবে, মুশ্কিল হল সন্ধের পর থেকে বড্ড মশা। সমস্ত অসুবিধে অস্বাচ্ছন্দ্য ঢেকে গেল মানব হেমব্রম এবং তার স্বজন প্রতিবেশীদের অকৃত্রিম সরল আতিথেয়তার স্নিগ্ধ প্রলেপে। ঘুসখোর, লম্পট, ফেরেব্বাজ নিখিল দাসের চোখে জল এসে গেল। সেদিনের রাত কেটে ভোর হয়ে গেল। আধোঘুমে স্বপ্নের মতো .....নিখিলের কানে এল,গন্ধরাজ ফুলের মতো নরম আলোয় মাখা উঠোনে মোরগের ডাক কঁকর কঁ ..... কঁকর ক .... ।
    নিখিল একটা ফুটিফাটা কাঠের চৌকিতে ছেঁড়াখোঁড়া চাদরের ওপর চোখ বুজে শুয়ে রইল আধোঘুম আধোজাগরণের আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে তার জটিল পৃথিবী থেকে অনেক দূরে।এ গাঁয়ের নাম আটঘরা।
      একটু বেলার দিকে মুড়ি নারকেল খেয়ে নিখিল বলল, ‘মানব,  আমি তা’লে আমার স্যুটকেসটা নিয়ে আসি ওখান থেকে .... ‘
    মানব হেমব্রম বলল, ‘ চলেন বাবু আমিও যাচ্ছি আপনার সঙ্গে।’
    উঠোনে ছ সাতটা মুরগী ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। মানবের দুখানা ইঁটের ঘর। জায়গায় জায়গায় মাটি লেপা রয়েছে। নিখিলের মনে হল সে শুধু হুইস্কির পেছনে কত টাকা উড়িয়েছে ।
    মানবের মেয়ে আর বৌ বেলা দশটা নাগাদ একপাল ছাগল নিয়ে ছাগল চরাতে বেরিয়ে গেল। নিখিলের খুব ইচ্ছে করতে লাগল ওদের সঙ্গে যাবার জন্য। কিন্তু লজ্জায় ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে পারল না। মানব হেমব্রম কাঠ কাটে, মাটি কোপায়, ফুলের মালা বিক্রি করে, আবার বোলপুরের এক মহাজনের ভ্যান রিক্শাও চালায়।এত কিছু করেও রোজগার অতি সামান্য। কিন্তু কোন বিরক্তি নেই। সদা প্রসন্ন মুখ। শরীর স্বাস্থ্য ইদানীং ভাল যাচ্ছে না। সর্দি কাশি ঘুসঘুসে জ্বর হচ্ছে মাঝেমাঝেই। নিখিল বুঝতে পারল এসব অপুষ্টিজনিত দুর্বলতা। তার জন্য কোন বিষণ্ণতা নেই মানবের। উঠোনের একপাশে একগাদা গোবর ডাঁই করে রাখা রয়েছে। বাতাসের ঝলকের সঙ্গে ভেসে আসছে গোবরের গন্ধ।
    মানব আবার বলল, ‘ চলেন দাদা, আপনাকে রিসর্টে ছেড়ে দিয়ে আসি।রাস্তার ওধারে ওই সাইকেল সারাইয়ের দোকানের পাশে ভ্যান রাখি।’ মানব আবার কাশতে লাগল। নিখিল মানবের পিঠে হাত দিয়ে বলল, ‘ চল মানব, তোকে ডাক্তার দেখাব। বোলপুরে বসেন ডাক্তার বিকাশ মন্ডল। ওখানে চল। ‘
    মানব বলল, ‘ বিকা...শ  ম..ন্ডল !
    সে তো অনেক টাকার ব্যাপার ....’
    নিখিল ওর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘ সে চিন্তাটা আমাকে করতে দে মানব .... কিছু ভাবিসনি ।’
                 
                       .......................
      
    ভর দুপুরবেলা। বেলা দুটো বাজতে চলল। গার্লস স্কুলের পাশের রাস্তাটা এখনও ইঁটের। পাকা হয়নি। অরিত্র হাঁটছিল বাজারের দিকে। টুকিটাকি কিছু জিনিস কেনার আছে। কতদিন ঘরে বসে থাকবে। তার মনে নানা উদ্বেগ আছে। কুকর্ম তো উদ্বেগ ডেকে আনবেই । বিনা কুকর্মেও উদ্বেগ আসতে পারে অবশ্য, সেটা অন্য কথা।
    এই দুপুরবেলায় রাস্তায় লোকজন খুব কম ।  অরিত্র ঐশীর কথা ভাবতে ভাবতেই হাঁটছিল। এই অল্প বয়সের মধ্যেই কতরকম জটিল সম্পর্কের ঘূর্ণিস্রোতে গিয়ে পড়েছে এরা। সে ভাবছে, ঐশীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেই ভাল হত। এরকম বেইমান কামিনা ‘মেয়েছেলে’ আর দুটো আছে কিনা সন্দেহ। এই কয়েক মাস হল, মনীষ সিং নামে একটা উঠতি প্রমোটারকে ধরেছে। তার বাবা বিশাল সিং-এর তিনটে হোটেল আছে উত্তরবঙ্গ দক্ষিণবঙ্গ মিলিয়ে। মনীষকে ঐশী যে সব কিছু দিচ্ছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, অরিত্র ঐশীর  আপাদমস্তক চেনে— দৈহিক এবং মানসিকভাবে। অরিত্র কখনই এ সম্পর্কে জড়াতে চায়নি। ঐশীই নানা ছলাকলার পাকে এরকম অস্বাভাবিক সম্পর্কে তাকে জড়িয়ে নিল। শুধু দৈহিক নয়, মানসিকভাবেও অরিত্র ভীষণভাবে নুয়ে পড়ল  ঐশীর কাছে। তাই সে সহ্য করতে পারেনি এরকম নগ্ন বিশ্বাসঘাতকতা। সহ্য অবশ্য সে অনেকখানিই করেছিল। শেষ পর্যন্ত সে ঘটনাক্রমে একদিন মাসীর ফাঁকা বাড়িতে  ঐশীর ঘরে 
    দুজনকে অকপট মিলনাবদ্ধ অবস্থায় দেখে আর স্থির থাকতে পারেনি। প্রবল শরীরি উন্মাদনাময় তারা জানলা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। বিস্রস্ত বিদ্ধস্ত অবস্থায় রাস্তায় বেরিয়ে এসে অরিত্র চরম প্রতিশোধ নেবার সিদ্ধান্ত নেয় । তবে অরিত্র এখন বুঝতে পারছে এটা কোন চরম প্রতিশোধই হয়নি। এসব ব্যাপার ঐশীর মতো মেয়ের কাছে নস্যি। অরিত্র এখন ভয়ে ভয়ে আছে ঐশীর প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে। প্রতিশোধজনিত ব্যাপারে সে যদি মনীষের সাহায্য নেয় তাহলে দুশ্চিন্তার কারণ আছে বইকি। অরিত্র যাদের সাহায্য নিয়েছিল তারা কদিনের জন্য গা ঢাকা দিয়েছে। এখন জানা দরকার ঐশী ঠি ক  কি মতলব নির্মান করছে। অরিত্র ভাবল, একবার মৌপিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারলে ভাল হয়। মৌপিয়া ঐশীর একেবারে উল্টো প্রকৃতির মেয়ে। সে আকারে ইঙ্গিতে তার দিদির সঙ্গে জড়াতে বারণ করেছিল।কিন্তু অরিত্র তখন নেশায় আকুল। মৌপিয়ার আকার এবং ইঙ্গিত বিফলে যায়।
      
        সামনের তেমাথার মোড়টা পেরিয়ে রেশন দোকানের সামনে পৌঁছতেই অরিত্রর বুকের রক্ত চলকে উঠল। চারটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে তাকিয়ে আঁটোসাঁটো জিনস, বুকখোলা শার্ট পরে। রেশন দোকান এখন বন্ধ। দুটো লোক জোরে সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল গার্লস স্কুলের দিকে। রাস্তা এখন একেবারেই ফাঁকা। অরিত্র উল্টোদিক ঘুরে প্রাণপণে ছুটতে অারম্ভ করল। 
     
        চারটে ছেলে সঙ্গে সঙ্গে শিকারি কুকুরের মতো অরিত্রকে তাড়া করল। তাদের ছোটার গতি অরিত্রর থেকে বেশি। অরিত্র এক ঝলক পিছন ফিরে দেখল ওদের সঙ্গে তার দূরত্ব কমে আসছে। রাস্তা নির্জন। প্রাণের ভয় অরিত্রকে গ্রাস করে নিয়েছে এতক্ষণে। তার স্নায়ুকেন্দ্র স্বতপ্রণোদিতভাবে জানান দিল যে ভাবেই হোক লোকজন থাকা এলাকায় পৌঁছতে হবে। লোকজন যে তাকে বাঁচতে সাহায্য করবেই এমন ভরসা কম। তা হলেও একটা আড়াল তো পাওয়া যাবে।তার স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতরঙ্গ তাকে  ঠেলা মেরে বাঁদিকের মাঠে নামিয়ে নিয়ে গেল তার পাড়ার অগ্রদূত সংঘের সংগে দূরত্ব কমিয়ে আনবার জন্যে । ক্লাবের কাছাকাছি পৌঁছতে পারলে অনেকটা নিরাপদ বলা যায়। অরিত্রকে তাড়া করা চারটে ছেলেও রাস্তা ছেড়ে মাঠে নামল তীর গতিতে। লোকজনের প্রতিরোধের পরোয়া তাদের আছে বলে মনে হয় না। নাহলে দিন দুপুরে খোলামেলা বেপরোয়া উন্মত্ততায় তারা কাউকে তাড়া করত না। কোনাকোনি ছুটে মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে উঠল । রাস্তায় ওঠার মুখে হোঁচট খেল অরিত্র। গতি কমে যাওয়ায় ওদের সঙ্গে অরিত্রর দূরত্ব আরও কমে গেছে । অরিত্র তার হৃৎপিন্ডের ধকধকানি যেন নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে। চারটে ছেলের সঙ্গে তার দূরত্ব এখন বিশ ফুটেরও কম। তাকে ধরে ফেলল প্রায়। অগ্র পশ্চাৎ কোন কিছুই অরিত্রর মনে মাথা তুলছে না। তার মনে হল সে মৃত্যুর সামনাসামনি হতে চলেছে। বনস্থলীতে চিতাবাঘের তাড়া খাওয়া কোন হরিণও বোধহয় এমন অনুভূতির মুখোমুখি হয়। 
    অরিত্র আবার একবার হোঁচট খেল। স্নায়ুর চাপ জড়িয়ে ধরছে তার পা। আর সাত আট ফুটের মধ্যে এসে গেছে ছেলেগুলো। সামনে একটা তেমাথার মোড়। ওই মোড়ে পৌঁছে ডান দিকের দিকের রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই অগ্রদূত সংঘের ক্লাবঘর। ওখানে দুচারজন সবসময়েই থাকে। কিন্তু ওই পর্যন্ত বোধহয় আর পৌঁছন হল না। ছেলেগুলো তিরিশ ফুটের মধ্যে চলে এসেছে। তাকে ধরে ফেলতে আর মিনিট দেড়েক  লাগবে। তারপর ......
    তেমাথার মোড়ে পৌঁছে ডানদিকে ঘুরতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটা বাইকের ওপর। ঘোরার মুখে ছিল বলে বাইকের গতি খুব শ্লথ ছিল। সাব ইন্সপেক্টর গৌতম সেন আচমকা বাধার সামনে পড়ে দক্ষ এবং ক্ষিপ্র হাতে ব্রেক চেপে  বাইক রুখে দিলেন। তারপর একটা অশ্লীল গালাগালি দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সেটা গিলে ফেললেন , কারণ তার পুলিশি অভিজ্ঞতাপ্রসূত অনুমান ক্ষমতার সূত্রে গৌতমবাবু মুহুর্তের মধ্যে পরিস্থিতি আন্দাজ করে নিলেন। বাইকের  সামনে আটকে পড়া মৃত্যুভয়ে ভীত ঘর্মাক্ত রুদ্ধশ্বাস অরিত্র আর সামনে তাকে ধাওয়া করা চারজন। এস আই গৌতম সেন বাইক থেকে নেমে ক্ষিপ্র গতিতে সার্ভিস রিভলভার বার করলেন। ছেলেগুলো আর এগোল না। দ্রুতপায়ে পেছিয়ে গিয়ে ডানদিকের তিনতলা বাড়িটার পেছন দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল অভ্যস্ত দক্ষতায়।
       গৌতম সেনের এখনকার মতো বাড়ি ফেরা হল না। ভয়ে জড়সড় অরিত্রকে বাইকে বসিয়ে তিনি থানায় ফিরে গেলেন। ওখান থেকে তার বাড়িতে ফোন করালেন ফিরতে একটু দেরি হবে বলে।
    — ‘ ওরা তোমাকে চেজ করছিল কেন ? ‘ ও সি বিপ্লব দত্ত জিজ্ঞাসা করলেন।
    — ‘ জানি না। আমি ওদের আগে কখনও দেখিনি।’ অরিত্র ক্ষীণকন্ঠে জবাব দেয়।
    — ‘তুমি তাহলে ছুটছিলে কেন ?’
    — ‘ .... ওই ... মানে...ভয় পেয়ে... 
    জানি না কেন আমাকে .... ‘ অরিত্র হাঁফাতে হাঁফাতে অসংলগ্নভাবে জবাবদিহি করে।
    বিপ্লববাবু একটু চুপ করে থাকেন।অরিত্রকে সামলে নিতে সময় দেন।তারপর আবার বলেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছিলে ? ‘
    অরিত্র পকেট থেকে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশানটা বার করে দেখিয়ে বলে, ‘ ওষুধের দোকানে যাচ্ছিলাম। বাবার জন্যে .... ওই... তারা মা ফার্মেসিতে .... আরো কিছু জিনিস কেনার ছিল।’
    — ‘ আই সি । তোমার বাড়ি তো ঘোষপাড়ায় বললে।’
    — ‘ হ্যাঁ স্যার।’
    — ‘ বাড়িতে বাবা ছাড়া আর কে কে আছেন ? ‘
    — ‘ মা অাছে। এক ভাই আছে । এক পিসী আছে।’
    — ‘ পিসী কি অবিবাহিত ?’
    — ‘ হ্যাঁ। বিয়ে করেনি। কলেজে পড়ায়। পলিটিক্যাল সায়েন্স’।
    — ‘ বাবা কি রিটায়ার্ড ?’
    — ‘ না , বাকি আছে ....সার্ভিস করেন সেন্ট্রাল এক্সাইজে।’
    — ‘ আই সি । আচ্ছা এই এলাকার মধ্যে তোমাদের কোন রিলেটিভ আছে ?’
    অরিত্র এতক্ষণে খানিকটা ধাতস্থ হয়েছে। সে এবারে বেশ সঙ্কটে পড়ে গেল। সে মনে মনে হিসেব করে নিল মৃদুলা মাসী বা নিখিল মেসোর কথা বললে শেষমেষ ঐশীর নাম আসবেই। ঐশী মার্কামারা মেয়ে, তাকে সবাই চেনে। আর পুলিশের লোক তো চিনবেই। অতি সম্প্রতি ওই ব্যাপারটা ঘটে গেছে। কান টানলে মাথা আসে । ঐশীর সঙ্গে তাকে কো-রিলেট করে পুলিশ কেসটাকে অন্য দিকে নিয়ে যেতে পারে।তাই অরিত্র রীতিমতো ধন্দে পড়ে গেল— তার মাসি মেসোর নাম নেওয়া উচিৎ হবে কি হবে না। আবার মিথ্যে কথা বলে এখনকার মতো বেঁচে গেলেও পরে পুলিশ যদি এগুলো জানতে পারে মুশ্কিল হয়ে যাবে। তাই খানিক ভেবেচিন্তে জবাব দিল, ‘ না... তেমন কেউ নেই ।’
    — ‘ আই সি । আচ্ছা তোমার কাউকে সন্দেহ হয় এ ব্যাপারে ?’
    — ‘ না ... কাকে সন্দেহ করব বলুন তো ? আমি তো কিছু বুঝতেই পারছি না । ‘ 
     কথাটা যেন বিপ্লব দত্তর কানেই গেল না। তিনি মাথা নীচু করে কি ভাবছিলেন। ঝট করে মাথা তুলে বললেন, ‘ঐশী দাসের ওপর কোন সন্দেহ হয় কি ? মন্ডলপাড়ায় থাকে। ‘
    ঘরের ভেতর বাজ পড়ল যেন।অরিত্রর কথা জড়িয়ে গেল — ‘ঐ...শী ... মানে.... কেন ... কিসের সন্দেহ ..... ‘ 
    বিপ্লববাবু বোধহয় অরিত্রর ওপর স্নেহপরবশ হয়ে বললেন ‘ ঠি ক আছে .... ওসব পরে দেখা যাবেখন।’ বলে গৌতম সেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘একটা জি ডি করিয়ে নিয়ে ওকে ছেড়ে দাও। ডেসক্রিপশান শুনে মনে হচ্ছে মালগুলো হৃদয়পুরের দিক থেকে এসেছে। যাক, সেটা পরে পারসিউ করব।আর হ্যাঁ, একজন কাউকে দিয়ে দাও ওর সঙ্গে , দোকানে গিয়ে থেকে ওষুধ কেনার পর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে। ওগুলোকে বার করব খুব তাড়াতাড়ি। ‘
    এটা এক মহা আশ্চর্যের ব্যাপার। দুই বোনের পরিবারের মধ্যে এরকম জটিল আবর্ত পাক খেয়ে চলেছে দিনের পর দিন, তা সামলাবার সক্রিয় উদ্যোগ কোন তরফেই নেই। অদ্ভুত ব্যাপার। এ দুনিয়া কত বিচিত্র সব মানুষে ভরা !

      আজ পূর্ণিমা। মেঘমুক্ত আকাশে সোনালী থালার মতো চাঁদ। মদন বেরার বাড়ির উঠোনে ঝরে পড়ছে নরম আলো। মদন দাওয়ায় ঠায় বসে আছে শিউলিতলার দিকে তাকিয়ে । রাত দশটা বাজতে চলল। সাঁঝবাতির কোন ছায়া দেখা গেল না। মদন ভাবে, শঙ্করীবাবা যে বলে গেল ....। মদনের বউ বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ।সে এসব আজগুবি কান্ডকারখানায় মোটে বিশ্বাস করে না। সে দাওয়ার একপাশে বসে কাল সকালের রান্নার কুটনো কুটে রাখছে। দাওয়ার ওপরেও যথেষ্ট চাঁদের আলো। কাঠ ঘুঁটে কয়লার খড়ো চালের ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে এক শক্তপোক্ত কাঁঠাল গাছ। ফাল্গুন পড়লেই এঁচড়ে ভরে যায়। গাছের ডালে পাতায় পাখির বাসা। অন্ধকারে পাতায় পাতায় ওদের নড়াচড়ার ফরফর করে আওয়াজ হচ্ছে। কাঁঠাল গাছের তেরছা ছায়া পড়েছে একপাশে হেলে। রসুলপুরে শিউলি গাঁয়ে ঝিম ধরা আঁধার। একটানা ঝিঁঝি রবে তিরতির করে কাঁপছে মাঝ শরতের আনমনা নিশীথ বাতাস। ওইদিকে চেয়ে একটানা ঠায় বসে থাকতে থাকতে  মদনের শরীরে কেমন ঝিম ধরে। ঘুম এসে বসতে চায় চোখের পাতায়। মদনের অন্য ছেলেমেয়েরা মোবাইল ফোনে খুটখুট করছে ঘরের ভেতরে। 

        অস্ফুটে কে যেন বলল — ‘বাবা ....’ । গভীর স্বপ্নের মধ্যে থেকে যেন উঠে এল শব্দটা। মদন চোখ বোজা অবস্থাতেই বলল—   ‘উঁ .... ‘ । একটা বেজি কোথা থেকে দ্রুতবেগে ছুটে এসে ঘুঁটের ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে গেল। মদন ঘুমের আবেশ মেখে জেগে উঠল।চোখ মেলতে দেখল শিউলি গাছটার তলায় আবছা আলোয় একটা হলুদ সালোয়ার কামিজ পরে সাঁঝবাতি দাঁড়িয়ে আছে। ঝর্ণার মতো তার শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চাঁদের আলো। মদনের বউ বসে বসে মোচা কুটছে। এদিকে তাকাচ্ছেও না। 
       মদন হঠাৎ ‘ মা..... রে ‘ বলে ডেকে উঠে টলমল পায়ে শিউলি গাছের দিকে ছুটে গেল।
    এই আচমকা ঘটনায় চমকে উঠে মদনের বউ ‘ওরে  বটুক , মিতু .... শিগ্গীর আয় ..... শিগ্গীর আয় .... তোদের বাবাকে দ্যাখ.... ‘।
       মদনের ছেলেমেয়েরা বাবাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে এল। বিছানায় শুইয়ে দিতে মদন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হল।
    আবার পরের পূর্ণিমার অপেক্ষা।

         পরের দিন মদনের বাড়িতে গ্রামের একমাত্র এম বি বি এস ডাক্তার এসে মদনকে পরীক্ষা করে বলল, ‘ খুব বেশি মেন্টাল স্ট্রেস থেকে এমন হতে পারে। এই ট্যাবলেটটা দুবেলা খাওয়ার পরে একটা করে  দশদিন খাওয়াবেন।দশদিন পর আমাকে জানাবেন।’

           ...............        .............       ...............
    বাইপাস ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা চলে গিয়ে সন্ধেবেলার ঝুপসি অন্ধকারে ক্ষেতের ধারে রাস্তার পাশে একটা বেদীর ওপর বসে থাকা এবং বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনীষা পালের ফোন আসার ঘটনাটা অমিতাভর মনে মাঝেই মাঝেই ভেসে উঠছে দু দিন ধরে । কেন কে জানে এই সদ্য অতীত স্মৃতিটা তার মনে দু তিনদিন ধরে বেশ একটা মাধুর্য সঞ্চার করছে। কেন কে জানে। অমিতাভ  সকালে ঠি ক করল আজও অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সন্ধের ঝোঁকে ওই রাস্তা ধরে হাঁটবে একা একা ।বড় ভাল লেগেছিল সেদিন।
     
        অমিতাভ অস্তরাগের শোভা দেখতে দেখতে আর দুপাশে ফলন্ত জমির স্নিগ্ধতা, পড়ন্ত বিকেলে চাষীদের দূর থেকে ভেসে আসা টুকরো টুকরো কথার শব্দ মনে মাখতে মাখতে হেঁটে চলেছিল পশ্চিম দিক বরাবর। সেই বেদীটাও এল একসময়ে। অমিতাভ বসল ওখানে। বসে সামনের ঝিঙে আর লঙ্কার ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে রইল। মোবাইলটা পকেট থেকে বার করে হাতে রাখল। তার অবচেতনে একটা অদ্ভুত আশা পাক মেরে মেরে ঘুরে ঘুরে আসতে লাগল। সে এই পরাবাস্তব গোত্রের দৃশ্যপটে লালচে ফাইবারের চশমা পরা বাক্যমুখর এক নারীর অকপট একটা ফোনের জন্য মন প্রাণ একটা নিভৃত কুঠুরিতে ভরে বসে রইল।  কার যে কখন কি হয় !
    ( ক্রমশ : )

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন