এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • অন্ধকার ও একটি কবিতা

    ফিনিক্সচন্দ্র বাঁড়ুজ্জে লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১০০ বার পঠিত
  • সাঁঝবাতির তেল শেষ হয়ে সদ্য নিভিয়েছে। ঘর জুড়ে পলতে পোড়ার একটা গন্ধ। পোষ না মানা বিড়াল টা জানলা দিয়ে এসে তক্তায় ঝাঁপ দিয়ে শব্দ করে নেমে ঘরের ভেতর খাবারের সন্ধানে মেঝেতে নিঃশব্দে পা ফেলে ওঘরে চলে গেল।

    এতে দীপকের কোনো হেল দোল নেই। ও জানে রাতের অভ্যস্ত এই রুটিন। সন্ধ্যের দীপটা এতক্ষণ না জ্বললেও বিড়ালটা ঠিকই আসে, শব্দ করে জানলা থেকে তক্তায় ঝাঁপ দেয় তারপর নিঃশব্দে ওঘরে চলে যায়। এতক্ষণ প্রদীপটার দিকেই চেয়ে ছিলো সে। ভাবছিলো এই ঘরের অন্ধকারের তপস্যা ভাঙতে কী প্রাণপণ চেষ্টায় অপ্সরার মতো কেঁপে কেঁপে জ্বলে চলেছে শিখাটি। তেল শেষ হওয়ায় শেষ ভঙিমায় সর্বস্ব উজার করে দিয়ে নিভে গেল। অবশেষে অন্ধকার জিতে গেল।

    এই অন্ধকার একসময় বড়ো ভয়ের ছিলো। কিন্তু বয়স বাড়তে বাড়তে নিজের ভেতরের অন্ধকারগুলোর সাথে কারবার করতে করতে না জানি কবে সে ভয় কেটে গেল। অন্ধকারকে এখন বেশ একটা শান্ত ছেলের মতো লাগে। যে এসে পাশে বসে নিঃশব্দে, তার মোটেই ড্রাকুলার মতো দুটো দাঁত নেই যা কোঁত করে ঘাড়ে বসাবে। সে আসবে বসবে,  যদি শোনার মতো কান থাকে সে কথা কইবে একান্তে। যদি বলার মতো কথা থাকে সে শুনে যাবে একান্তে। রীতিমতো ফ্রেন্ডলি।

    দীপটা নিভে যাওয়াতে সেই অন্ধকার নেমে এসেছিলো দীপকের কাছে। ধীরে ধীরে আসর জমে উঠছিলো। মনের গভীর অন্ধকারে ব্যাক্তিগত ভাবে জমানো ভাবনাদের খুলে রাখছিলো সে। এমন সময় বিড়েলের ঝাঁপানোর শব্দ হল তক্তায়। আসরে কোনো বিচ্যুতি ঘটলো না। বারান্দার আলোয় বিড়ালটাকে একবার ও ঘরে যেতে দেখে নিয়ে আবার শুরু হল যত অসামাজিক ব্যাক্তিগত আলাপন। এই আলাপনের মাঝেই দীপকের কাছে কবিতারা আসে কখনো-সখনো। ফোনের নোট প্যাডে লিখে নেয় অন্ধকারকে পাশে বসিয়ে। এক অস্বচ্ছ গুমট থেকে আসে তাগিদ। প্রথম লাইন ভেবে নিয়ে লেখার পর ধীরে ধীরে লেখাই তাকে এগিয়ে নিয়ে চলে। লেখার সেই আবেশের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ হয়। যতক্ষণ আবেশ ততক্ষণ আনন্দ অনাবিল। আগে লেখা শেষ হলে একটা আনন্দ হত। কিন্তু দীপক লক্ষ্য করেছে সেটা এখন আর হয়না। এখন মনে হয় সেটা ছিলো সৃষ্টির গর্বের আনন্দ। আর এখন সৃষ্টির নেশা যতক্ষণ পেয়ে থাকে ততক্ষণই একটা আনন্দ, লেখা শেষ মাদকতাও শেষ। এই দুই অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য তো আছেই।

    অন্ধকার মৌন সম্মতি জানায় তারপর আরও গাঢ় হয়ে এসে আরো কাছে এসে বসে। দীপকের ভালো লাগে। সারাদিনের আলোয় কুড়ানো স্মৃতি থেকে দু একটা ছবি এঁকে দেখায় বারবার। তারপর তাদের বিশ্লেষণ করতে করতে মাঝে মধ্যে ঢুকে পড়ে মনখারাপির কারাগারে। অন্ধকার আরো একটু গাঢ় হয়ে আরো একটু কাছে এসে বসে। কবিতার বীজ চোখের ভেতরে যে টুকু আলো তাতে অঙ্কুরিত হয়ে জন্ম নেওয়ার জন্য বীজত্বক ফাটাতে শুরু করে। দীপকের বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে।

    হাত ধরোনি 
    শুধু প্রেয়সীর মায়াটুকু মেখে
    চারপাশ ঘিরে আছো আমার অবয়বের 
    ঠোঁটে রাখছো ঠোঁট 
    চুরি করছো অজস্র চুম্বন 
    অথচ জানতে পারছি না আমি
    তোমাতে মিলিয়েছি আমার অন্ধকার যত
    আলোহীন যত মায়াহীন পৃথিবীতে চিনেছো আমায়
    চিনেছি তোমায় লিপ্ত অনুরাগে আমার এ অন্ধত্বে
    চিন্তা করো না চোখ ফিরে পাই যদি
    প্রতি পলকে তোমাকেই পাবো জানি
    হে অন্ধকার! হে প্রেম! হে ঈশ্বর!

    নোট প্যাডে লিখে নেয় দীপক। তারপর বালিশে এলিয়ে দেয় মাথা। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর ভাবে লিখতে লিখতে অনুভূত হওয়া আনন্দের কথা। ভাবনাকে ঘিরে যত না শব্দের স্ফুরণ তার চেয়েও অধিক এক অনুভূতিগত রিলিফ! আহ কি শান্তি! 

    এর পর ওই কবিতাটাও বেশ্যা হয়ে ওঠে। দীপক আর ধারে কাছেও যায় না কবিতাটির। নোট প্যাডে পড়ে থাকে। ইচ্ছে হলে মুছে দেয় অথবা মোছে না। এই এক বদ অভ্যাস তার। অনেকদিন পর যদি বা কখনো নিজের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা কবিতাগুলোর কাছে যায়ও তখন সেগুলো অচেনা লাগে। মনে হয় এসব দুর্বোধ্য শব্দের ডাস্টবিন কখনোই কবিতা হয়ে উঠতে পারেনি। এসব কী পাগলামো করেছে সে। বেচারা কোনো রকমে অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা সেসব কবিতারা আর তাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে পারেনা। সে ডিলিট করে দেয় সব।  এই ঘটনা চক্রাকারে চলতেই থাকে। তবে দুটো কবিতা সে কখনোই মুছে ফেলেনি। সেগুলো কাওকে দেখাইওনি। 

    একবার অপার আনন্দ দেওয়ার পর সেগুলোর প্রতি বিতৃষ্ণার কারণেই দীপক তার নিজের কবিতাদের বেশ্যাদের সঙ্গে তুলনা করে। অন্ধকার ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। দীপকের চোখের পাতা চড়চড় করে ওঠে।  অন্ধকার আরো খানিকটা ঘনিষ্ট হয়ে আসে। চোখ বন্ধ করলে সে আর অন্ধকার নিবিড় নিবিষ্ট এক হয়ে ওঠে। আরো কিছুক্ষণ এইভাবেই চলে আলাপন। তারপর কখন, কোন মুহূর্তে ঘুম নেমে আসে আমরা কেউ জানতে পারি না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন