এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • আদিবাসী বিদ্রোহ -- কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
    আলোচনা | বিবিধ | ১৬ নভেম্বর ২০০৮ | ৯৩৪ বার পঠিত
  • জুলাই ২০০২
    --------------
    ঘটনা ১।
    কেন্দ্রীয় শুল্ক বিভাগের কর্মচারী অভিজিৎ সিংহের বাড়িতে পুলিশ আসে ২০০২ সালের জুলাই মাসে। "জনযুদ্ধ' গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত, এই অভিযোগে এক বৃহস্পতিবার মধ্যরাত্রে দমদম নাগেরবাজারের ফ্ল্যাট থেকে এই ৩২ বছরের যুবককে "তুলে' নিয়ে যায় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পুলিশ। "গ্রেপ্তার' নয়, "তুলে নিয়ে যায়'। ধৃতের স্ত্রী মানসী সিংহ জানান, "বৃহস্পতিবার রাত দেড়টা নাগাদ বাড়ির কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজা খুলে দেখি দুজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে। তাঁরা জানান, ওঁরা পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে আসছেন। সেখানকার এক জনযুদ্ধ নেতার ডায়রিতে নাকি আমার স্বামীর নাম পাওয়া গেছে। তাই ওঁরা আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য নিয়ে যেতে চান। আমি ওঁদের কাছে পরিচয়পত্র দেখতে চাই। বলি, আমার বাবাও পুলিশের ডিএসপি। ওঁরা পরিচয়পত্র না দেখিয়ে বলেন, তাঁরাও ডিএসপি পদমর্যাদার অফিসার। আমি তখন জানতে চাই, কোনো পরোয়ানা আছে কিনা। ওঁরা জানান, না। আমি বলি, অন্তত: লিখে দিন যে, ওঁকে নিয়ে যাচ্ছেন। ওঁরা বলেন গ্রেফতার করলে দিতাম। '

    সেই রাতে সারা বাড়ি ঘিরে ছিল ২০-২২ জন পুলিশ। ছিল র‌্যাফ। সেই রাতে বাগুইআটি থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় অভিজিৎকে। মারধোর করা হয়নি। তবে অভিযোগ, অন্য ধৃতদের মারধোর করা হয় অভিজিতের সামনেই। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম পর্ব শেষ হলে সে রাতের মতো তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। হাজিরা দিতে বলা হয় মেদিনীপুরে। সেই মতো শনিবার তিনি মেদিনীপুরের শালবনী থানায় যান। ফিরে আসেন সেদিনই। রাত ১১ টায়। পরদিন রবিবার, সকালে বাড়ি থেকে বেরোন। সন্ধ্যে ৬টা নাগাদ বাড়িতে ফোন আসে দমদম জিআরপি থেকে। অভিজিতের মৃতদেহ পাওয়া গেছে দমদম আর উল্টোডাঙ্গার মধ্যে, দমদম স্টেশনের কাছে। প্রাথমিক তদন্তের পর, পুলিশ অনুমান করে, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

    ঘটনা ২।
    একই রাতের ঘটনা। হুগলীর মাহেশের সুবোধ করের বাড়িতে পুলিশ আসে ভোরবেলা। "শুক্রবার রাত তিনটে নাগাদ বাড়িতে একটি ফোন আসে। কেউ জানতে চায়, এটা সুভাষ করের বাড়ি কিনা। তারপরে অবশ্য আর কেউ কিছু বলেনি। এর পরেই দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। বাইরে বেরিয়ে দেখি চারপাশে পুলিশ। তাঁরা বলেন, চুপ করে থাকুন, সার্চ করছি আমরা। দাদা যে ঘরে থাকেন, সেখানে ঢুকে পুলিশ তল্লাশি চালায়। পরে আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়।' জানাচ্ছেন সুবোধবাবু।

    তাঁকে নিয়ে গাড়ি প্রথমে দমদম, পরে বাগুইআটি যায়। বাগুইআটি থানায় প্রথমে বসিয়ে রাখা হয় পুলিশের জিপে। থানায় আরও কয়েকজনকে ধরে আনা হয়েছিল। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দফায় দফায় জেরা চলে। তারপর সুবোধবাবুকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশ পরে জানায়, যে, তাদের "ভুল' হয়ে গিয়েছিল। সুবোধবাবুকে তারা ধরতে চায়নি। এই "সামান্য' ভুলের ঠেলায়, সুবোধবাবু, আত্মহত্যা না করলেও, ততক্ষণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

    ঘটনা ৩।
    রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়কে ধরা হয় দমদমের মতিঝিল অ্যাভিনিউ থেকে। রাত ১১টা নাগাদ তাঁর বাড়িতে পরপর দুটো ফোন আসে। তাঁরা তখন টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিলেন। দুটি ফোনই ধরেন কৌশিকবাবু। প্রথমবার ফোনে কেউ জানতে চায় এটাই বেণুবাবুর (কৌশিকবাবুর ডাকনাম) বাড়ি কিনা। দ্বিতীয় ফোনে কেউ কোনো কথা বলেনি।

    রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ তাঁদের অ্যাপার্টমেন্টের রক্ষীকে কে বা কারা ডাকাডাকি করছে বলে শোনা যায়। কৌশিকবাবুর ভাই শৌভিক নিচে গিয়ে দেখেন পুলিশ তাঁর দাদার ডাকনাম ধরে ডাকাডাকি করছে। পুলিশকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। কৌশিকবাবুর বাবা পরে জানান, "নিজেকে মেদিনীপুরের ডিএসপি পরিচয় দিয়ে মৃণাল মজুমদার নামে এক পুলিশ অফিসার জানান, শালবনী থানায় আপনার ছেলের নামে মামলা আছে। খুব খারাপ মামলা। জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছি'।

    বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আরও দুজনকে তুলে আনে পুলিশ। টিঙ্কু ঘোষ এবং পরাশর ভট্টাচার্য। শনিবার মেদিনীপুরের দায়রা আদালতে এঁদের তিনজনের বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। পুলিশের অভিযোগানুসারে, ধৃত কৌশিকবাবু শুধু জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর সদস্যই ছিলেন না, সংগঠনের সাংস্কৃতিক দিকও দেখাশোনা করতেন। অভিযোগ, এই তিনজনের উপরেই পুলিশি হেফাজতে যথেচ্ছ নির্যাতন চালানো হয়। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মেনে এদের কারও ক্ষেত্রেই পুলিশ "মেমো অফ অ্যারেস্ট' তৈরি করেনি, নিজের পদমর্যাদা ও নামাঙ্কিত পরিচয়পত্র ধারণ করে গ্রেপ্তার করতে যায়নি। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিলনা, তবুও তাঁকে ধরা হল কিভাবে, এ প্রশ্নের উত্তরে ওয়েস্টার্ন রেঞ্জের আইজি জিৎরাম ভগত জানান, শালবনীর একটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে তাঁকে ধরা হয়েছে। এইসব ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা লাগেনা। তিনি আরও জানান, যে, "সংগঠন করলে তো আমরা কাউকে ধরছিনা। দেশবিরোধী কোনো কাজ করলে বা কোনোরকম অ্যাকশন করলে তবেই আমরা তাঁদের ধরছি।'

    এর কয়েকদিন পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানান, যে, অভিজিৎ সিংহের মৃত্যু এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের উপর "পুলিশী নির্যাতনের অভিযোগ' এর উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত করা হবে। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অধীনে থাকা পুলিশি বাড়াবাড়ির অভিযোগের তদন্ত করবেন স্বরাষ্ট্র দপ্তরেরই এক সচিব। অভিজিৎ বাবুর মৃত্যুর ঘটনা "দুর্ভাগ্যজনক' হলেও, তিনি জানান, জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে আপসহীন অভিযান চলবেই। "জনযুদ্ধ গোষ্ঠী এবং এমসিসি খুনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। এটাই তাদের ঘোষিত নীতি। ফলে তাদের সঙ্গে কোনো আপস নয়।' অভিজিৎবাবুর গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে পুলিশের "ভুল' নিয়ে জনৈক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে, আপসহীন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "আপনাকে তো পুলিশ গ্রেফতার করেনি। আপনার আপত্তি কীসের।'

    আরও ধরপাকড়
    --------------
    এটি শুধু একটি রাতের ঘটনা। যা এর পরে বারবার ঘটবে। ২০০২ সালের জুলাই এবং আগস্ট মাস জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর সদস্যদের ধরপাকড়ের জন্য বারবার শিরোনামে উঠে আসবে মিডিয়ায়। ধৃতরা আর তাদের আত্মীয়স্বজন ছাড়া আর কেউ কোনো আপত্তি করবেনা, কারণ অন্যদের তো আর কেউ গ্রেপ্তার করেনি। জুলাই মাসের শেষের দিকে, বীরভূম জেলার খয়রাশোল আর মুরারই থানা থেকে গ্রেপ্তার করা হবে ১০ জনকে। জনযুদ্ধ এবং এমসিসি সমর্থক সন্দেহে। খয়রাশোলে ধৃত নিখিল দাসের কাছে পাওয়া যাবে একটি পাইপগান। আর মুরারই এর ৯ জনের কাছে পাওয়া যাবে শুধু কিছু প্রচারপত্র। "সংগঠন করলে তো আমরা কাউকে ধরছিনা' বলার পরে আইজি জিৎরাম ভগত নিজে যাবেন ধৃতদের জেরা করতে।

    কেউ কোনো আপত্তি করবেনা, শুধু বিজেপি ছাড়া। কারণ বিজেপির এক স্থানীয় নেতাকে "ভুল' করে তুলে নিয়ে যাবে পুলিশ। দলের জেলা সভাপতি নির্মল মন্ডল জানাবেন, মাঠে কাজ করার সময় বিজেপির আঞ্চলিক সম্পাদককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন অবশ্য ছেড়ে দেওয়া হয়। জেলার অনগ্রসর সমাজের খেতমজুরদের জঙ্গী সন্দেহে পুলিশ হয়রানি করছে বলে আপত্তি তুলবে তারা। বলাবাহুল্য ২০০২ সালের সেই অভিযোগ মৃদুই থাকবে। কলকাতা শহর পর্যন্ত তার ঢেউ পৌঁছবেনা।

    আগস্ট মাসে মুর্শিদাবাদ-নদীয়ার সীমান্তে নওদা থেকে জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করবে পুলিশ। ধৃতদের মধ্যে কলকাতার একটি কলেজের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীও থাকবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের এই ছাত্রীটির কাছে পাওয়া যাবে কিছু পুস্তিকা এবং একটি ডায়রি। যাতে কবে কার সঙ্গে মিটিং করতে হবে সেই তথ্য লেখা। বাকিদের মতো এই মেয়েটির বিরুদ্ধেও আনা হবে রাষ্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার অভিযোগ। তার বাবা মা তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন দিন কতক পরে। মেয়েটি তখন জেল হাজতে। বাবা-মাকে সে জানাবে গ্রেপ্তার করার পর পুলিশি হেফাজতে তাকে চারদিন টানা অভুক্ত রাখা হয়েছিল।

    আদিবাসী বিদ্রোহের প্রস্তুতিপর্ব
    ---------------------------
    ২০০৮ এর নভেম্বর মাসের আদিবাসী বিদ্রোহ নিয়ে লিখতে গিয়ে ২০০২ সাল নিয়ে অ্যাতো ধানাই-পানাই কেন? কারণ একটাই। দুম করে বোমা ফাটলে তা সকলের চোখে পড়ে। কিন্তু বিস্ফোরণের আগে বহুবহুদিন ধরে জ্বলতে থাকা আগুন, দীর্ঘদিনের প্রস্তুতিপর্ব, চোখের আড়ালে থেকে যায়। আমরা, এই লেখায়, সেই চেপে রাখা সিম্পটমের সন্ধান করছি। ছাইএর নিচে কোথায় কোন শিখা রুমাল নাড়ছিল চোখের আড়ালে, তার সুলুকসন্ধান করছি। দুম করে আজকে ফেটে পড়া বোমাটির লম্বা সলতেতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল সেই ২০০২ সালে। বা তারও আগে। আমাদের চোখে পড়েনি। কারণ আমাদের তো আর পুলিশ গ্রেফতার করেনি।

    এবং এই প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, যে, এখানে যে ঘটনাগুলির কথা বলা হল, সেগুলি হিমশৈলের চূড়াটুকু মাত্র। মিডিয়ায় প্রকাশিত। মিডিয়া সেটুকুই দেখে, যা, শহরের নাগরিক চোখে ধরা পড়ে। সেই অসঙ্গতিটুকু নিয়েই লেখে, যা একান্তই শহুরে এলিটদের সংকটে ফেলে। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে প্রবল হৈচৈ হয়, কারণ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর মুরারই গ্রামের ধৃত ৯ জনকে নিয়ে সেভাবে কোনো "খবর' হয়না, কারণ ওরা গ্রামীণ, অনগ্রসর। প্রত্যন্ত গ্রামের "মানবিক অধিকার' রক্ষার জন্য কোনো মিডিয়া নেই। আদিবাসী বা নিম্নবর্গের কোনো "শরীর' থাকতে নেই, "মানবিকতা' থাকতে নেই। শহরের বাইরে যা কিছু, তা নেহাৎই পরিসংখ্যান। সেই পরিসংখ্যান ঘেঁটেই দেখা যাচ্ছে, ২০০২ সালের আগেও পরিস্থিতি খুব সুবিধার কিছু ছিলনা। ২০০২ এর জুলাই মাসে আইজি ভগত জানান, যে, নিষিদ্ধ না হওয়া সত্ত্বেও বিগত এক বছরে জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর তিন শতাধিক সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মিডিয়ার চোখের মণি কলকাতা শহরে নয়, এর বেশিরভাগ অংশটাই হয়েছে প্রত্যন্ত মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়া জেলায়, যেখানে "সভ্যতা'র আলো পৌঁছয়না। ধৃতদের বিরুদ্ধে দেশবিরোধী কার্যকলাপ এবং হত্যার মামলা আনা হয়েছে।

    জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর রাজ্য কমিটির সদস্য "সুবোধ' এই সময়েই বিবৃতি দিয়ে জানান, যে, জনযুদ্ধ সন্দেহে, মেদিনীপুর, বাঁকুড়ায় নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে পুলিশ। ঐ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় একটি নিবন্ধে লেখেন, ""২০০০-এর ডিসেম্বরে কোচবিহার-জলপাইগুড়ি-দার্জিলিং জেলার জনজাতি, বিশেষ করে রাজবংশী মহল্লায় গিয়ে দেখেছি কেপিপি (কামতাপুর পিপলস পার্টি) করার অপরাধে পুলিশ ছেলেবুড়ো যাকে পেরেছে ধরে নিয়ে গিয়ে পিটিয়েছে। জেলে পুরেছে। কাউকে বা থানায় নিয়ে গিয়ে শাসানো হয়েছে। শাসানির পরই সিপিএমের স্থানীয় নেতা এসে বলেছে "কোনও ভয় নেই, রোজ পার্টি অফিসে আসবি'। অত্যাচার, পীড়ন সাময়িকভাবে সমস্যা আড়ালে ঠেলে দিতে পারে হয়তো, কিন্তু তার ফল ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। স্বাভাবিক প্রকাশ-পথ না পেলে ক্ষোভ যে বিস্ফোরণে পরিণত হতে পারে... ''

    স্বাভাবিক প্রকাশ-পথ না পেলে ক্ষোভ বিস্ফোরণে পরিণত হয় ঠিকই। কিন্তু তাতে সময় লাগে। ক্ষোভ যন্ত্রণা ইত্যাদি বাড়তে বাড়তে একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করার প্রয়োজন থাকে। ২০০২ থেকে ২০০৮, কালের হিসেবে, ৬ বছরের দূরত্বে। এই ৬ বছরে পুলিশি জুলুম, অন্তত: পরিসংখ্যানের হিসেবে, কমেনি। বরং বেড়েছে। ২০০২ সালে জনযুদ্ধের তিন শতাধিক কর্মী-সমর্থক কারান্তরালে ছিল। আর ২০০৭ এর শেষদিকে বন্দীমুক্তি কমিটির দেওয়া হিসেব অনুযায়ী রাজ্যে "রাজনৈতিক কারণে বন্দী'র সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি। বলাবাহুল্য, এতে মাওবাদী ছাড়াও আরও অন্যান্য "উগ্রপন্থী' গোষ্ঠীর লোকজনও আছে। এর একটা বড়ো অংশ, প্রান্তিক, অবহেলিত জনজাতির অংশ। যাদের গ্রেপ্তারের খবর খবরের কাগজে ওঠেনা, উঠলেও জেলার পাতার এককোণে। যাদের গ্রেপ্তারের সময় নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়েছে কিনা, লকআপে বেধড়ক ঠেঙানো হয়েছে কিনা, অকারণে "ফাঁসানো' হয়েছে কিনা দেখার জন্য কোনো মিডিয়া অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে নেই।

    স্রেফ মানবাধিকার সংস্থার পরিসংখ্যানে এই প্রান্তিক মানুষদের যন্ত্রণার কোনো পরিমাপ হয়না। আতঙ্ককে, ক্রোধকে, সংখ্যায় মাপা যায়না। পুলিশ হয়তো একটি গ্রামে একজনকে ধরে নিয়ে যায়, কিন্তু গোটা গ্রাম তছনছ করে ছড়িয়ে রেখে যায় আতঙ্ক। ঘোষিত বা অঘোষিত ভাবে জানিয়ে যায়, প্রয়োজনে আমরা আবার আসব। আদিবাসী প্রান্তিক মানুষের বসবাসের প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে হিসেব কষে বা না-কষে এভাবেই ছড়ানো হয়েছে আতঙ্ক। ছড়ানো হয়েছে আতঙ্ক, জন্ম নিয়েছে ক্রোধ। উভয়েরই পরিমাপ এই ৬ বছরে ক্রমশ: বেড়েছে। সেই ক্রোধ, আতঙ্ক, জমতে জমতে একদিন যে বিস্ফোরণ ঘটাবে, সেটা খুব অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।

    খুনের রাজনীতি
    ---------------
    অতএব, বিস্ফোরণ যে একটা ঘটবে জানাই ছিল। কিভাবে, কবে ঘটবে, জানা ছিলনা। প্রান্তিকতার বিরুদ্ধে রাষ্টীয় যুদ্ধ ঘোষণার অনিবার্য পরিণতি এটা হতে বাধ্য। সেই হিসেবে এই আদিবাসী বিদ্রোহ অপ্রত্যাশিত কিছু না।

    কিন্তু প্রশ্ন হল, এটা করার কারণ কি ছিল? বস্তুত: রাষ্ট্র জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করে ২০০২ এর জুলাই মাসেই। ইতিপূর্বেই তাদের তিন শতাধিক সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হলেও, সেই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে জানান, যে, "জনযুদ্ধ গোষ্ঠী এবং এমসিসি খুনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। এটাই তাদের ঘোষিত নীতি। ফলে তাদের সঙ্গে কোনো আপস নয়।' কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়দের গ্রেপ্তারের কয়েকদিনের মধ্যেই গোয়ালতোড়ে সিপিএম এর এক স্থানীয় নেতা এবং তাঁর দেহরক্ষী খুন হন। জনযুদ্ধ গোষ্ঠীকে এই কাজের জন্য দায়ী করে পুলিশ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দবাজার পত্রিকা রাজ্য সরকারের সঙ্গে প্রায় একই সুরে সুর মিলিয়ে সম্পাদকীয় লেখে, "জনযুদ্ধের মতো গোষ্ঠীর ক্রিয়াকলাপ পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে বিপজ্জনক। পরিস্থিতি বিপদসীমা অতিক্রম করিবার আগেই এই উপদ্রব সমূলে বিনাশ করা দরকার। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে ব্যাপক অভিযানের সূচনা করিয়াছেন তাহা কেবল জরুরি নয়, আপসহীন ভাবে তাহা চালাইয়া যাওয়া অত্যন্ত জরুরি। রাজ্যবাসী তাঁহার নিকট সর্বাগ্রে দাবী করেন একটি কঠোর, তৎপর এবং দক্ষ প্রশাসন।'

    এই পুরো দাবীটির মূল বক্তব্য দুটি। এক। জনযুদ্ধ বা এমসিসি শুধুই খুনের রাজনীতি করে, এটা প্রতিষ্ঠা করা। দুই। খুনের রাজনীতির জবাবে একমাত্র বিকল্প হল সরকারি তরফে পাল্টা যুদ্ধ , এটা ঘোষণা করা।

    এই দুটি দাবীর প্রথমটি, অর্থাৎ, জনযুদ্ধ বা এমসিসি শুধুই খুনের রাজনীতি করে, যার জন্য যুদ্ধঘোষণা অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটি বস্তুত: অর্ধসত্য। একথা ঠিক, যে, ২০০২ সালের জুলাই মাসে জনযুদ্ধের কার্যকলাপের মূল কেন্দ্র পশ্চিম মেদিনীপুরে রাজনৈতিক খুনোখুনির সংখ্যার একটি নাটকীয় পরিবর্তন হয়। কিন্তু সেটা বেশির দিকে নয়, কমের দিকে। রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, যে, ২০০০ সালে ঐ জেলায় রাজনৈতিক খুন হয় ১২৫ টি। ২০০১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত খুনের সংখ্যা ১০০। আর সে জায়গায় ২০০২ এর জুলাই পর্যন্ত রাজনৈতিক খুন হয়েছিল মাত্র ১২টি। সংখ্যার এই নাটকীয় পরিবর্তনের পিছনে, অন্য কিছু নয়, আছে, বঙ্গের প্রধান রাজনৈতিক দল সিপিএম এবং প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেসের এলাকা দখলের লড়াই। ১৯৯৮ সাল থেকে মেদিনীপুরের কেশপুর-গড়বেতা এবং আরও অন্যান্য অঞ্চলে রাজনৈতিক জমি দখলের জন্য এই দুটি দলের মধ্যে প্রবল রাজনৈতিক সংঘর্ষ চলছিল। কেশপুর গড়বেতা অঞ্চলে প্রবল পেশীশক্তি দেখিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বেশ কিছু এলাকা "দখল' করে ফেলে। বেশ কিছু সিপিএম সমর্থকের প্রাণ যায়। জবাবে সিপিএম পুলিশ এবং কর্মীবাহিনী নামিয়ে এলাকা গুলিকে "পুনর্দখল' করে। এইসব সংঘর্ষ চলে ২০০১ পর্যন্ত। ২০০২ সালে মোটামুটি পুনর্দখল সম্পূর্ণ হবার পর গোটা এলাকায় সিপিএমের একচেটিয়া অধিকার স্থাপিত হয়। তৃণমূল কংগ্রেস হয়ে যায় ব্যানার স্বর্বস্ব। এবং খুনোখুনি কমে যায়।

    ফলে ঐ এলাকায় রাজনৈতিক খুনোখুনির বা খুনের রাজনীতির জন্য কাউকে যদি দায়ী করা যায়, তারা হল মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি। কয়েকটি পকেটে থাকা জনযুদ্ধের খুনের রাজনীতি, তখনও, ঐ জেলায়, সংখ্যার বিচারে সামান্যই। মজা হচ্ছে, "খুনের রাজনীতি' করা মূলধারার দলগুলির বিরুদ্ধে কিন্তু কোনো যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেসের তথাকথিত "স্বাধীনতার যুদ্ধ' এর মূল কান্ডারি রফিক, বা সিপিএমের "পুনর্দখল' এর হোতা তপন-সুকুর (যারা পরবর্তীতে নন্দীগ্রাম কান্ডের পর গ্রেপ্তার হবেন), থেকে গেছেন আইনের হাতের বাইরে। এঁদের বিরুদ্ধে কোনো আপসহীন সংগ্রাম চালানো হয়নি। বরং যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে। কারণ হিসেবে একটি তত্ত্ব ঘোষণা করা হয়েছে, যে, খুনের রাজনীতির একমাত্র জবাব হল সরকারি তরফে পাল্টা যুদ্ধ। আসলে কিন্তু যুদ্ধটা খুনের রাজনীতির বিরুদ্ধে আদৌ নয়। যুদ্ধটা একটি বিশেষ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। আদিবাসী সমাজের কিছু কিছু পকেটে ছড়িয়ে ছিল যাদের জনভিত্তি।

    শুভেন্দু দাশগুপ্ত, সেই সময়েই, এই প্রসঙ্গে লেখেন, "জনযুদ্ধ এমনই একটা সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল, তারা নিষিদ্ধ নয়, তাদের পত্রিকা, পুস্তিকা, ইস্তাহার বিলি করার, মত প্রচার করার, সদস্য সংগ্রহ করার, শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার অধিকার রয়েছে। যেমন আর সব রাজনীতিক দলের আছে। এই দলের বিভিন্ন প্রকাশনা পাবার, পড়ার, দলের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হবার অধিকার যেকোনো নাগরিকেরই আছে। এসব কোনো বেআইনী কাজ নয়, দল নিষিদ্ধ হলে বেআইনী হয়ত। এবং যদি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য -- সেই দল জনযুদ্ধই হোক আর সিপিআইএমই হোক -- কাউকে খুন করে তবে সেটা প্রচলিত স্বাভাবিক আইনেই মোকাবিলা করা যায়। তার জন্য রাষ্ট্রকে যুদ্ধ ঘোষণা করার দরকার হয়না।
    আসলে রাষ্টের সঙ্গে যুদ্ধঘোষণা করার কথা নয়। কিন্তু রাষ্টের সবসময় একটা চেষ্টা থাকে রাজনীতিক বিরোধিতার বিরুদ্ধে অগণতান্ত্রিক, অনৈতিক ও মানবিক হয়ে ওঠার, হয়ে যাওয়ার। এই প্রচেষ্টায় বাধা দেয় নানা গোষ্ঠী, সংগঠন, সম্প্রদায়,প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি যাদের সম্মিলিত নাম নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটি।'

    এসব কথায় কান দেওয়া হয়নি। স্পষ্টত:ই রাষ্ট্র সেই সময় দমনের খেলায় মেতেছিল। আর সিভিল সোসাইটির আওয়াজ ছিল ক্ষীণ।

    এখানে একটা প্রশ্ন উঠে আসতেই পারে, যে, একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যারা প্রকাশ্যেই রাষ্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, সেটাই তাদের রাজনৈতিক লাইন, তাকে প্রতিরোধ করার কি অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতি আদৌ ছিল? নির্বিচার দমন ছাড়া আর কোনো পদ্ধতি কি আদৌ অবলম্বন করা যেতে পারত? কৌশলগত ভাবে আর অন্য কোনো বাস্তবসম্মত পন্থায় মোকাবিলা কি করা যেত জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর? বস্তুত: বিকল্প কোনো পদ্ধতি অসম্ভব কিছু ছিলনা। জনযুদ্ধ গোষ্ঠী বাম রাজ্যে খাতা খোলে, সম্ভবত: নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে। ঐক্যবদ্ধ সিপিআই (মাওবাদী) তখনও বহুদূরের গল্প। আর পাঁচটা নকশালপন্থী গোষ্ঠীর মতই, পশ্চিমবঙ্গের সামান্য কয়েকটি পকেটে তখন তাদের অস্তিত্ব। গোপন সংগঠন বলে তাদের কার্যকলাপের এবং আভ্যন্তরীন বিতর্কের ইতিহাসের একটি যথাযথ বিবরণ খুঁজে বার করা অসম্ভব (যদিনা তারা নিজেরাই কিছু প্রকাশ করে)। তবুও এদিক-সেদিক থেকে পাওয়া টুকরো-টাকরা খবরে যেটুকু জানা যায়, যে, সেই সূচনার দিনগুলিতে বাংলায় কাজের কৌশল নিয়ে জনযুদ্ধের ভিতরে আভ্যন্তরীন বিতর্ক ছিল। একটি মত ছিল, যে, অন্যান্য রাজ্যের মতই সশস্ত্র স্কোয়াডই হতে পারে আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি। অন্য মতটি ছিল, যে, যেহেতু বাংলায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ, অন্য রাজ্যের চেয়ে ভালো, তাই, সশস্ত্র আন্দোলনের বদলে মুখ্য জায়গায় রাখা উচিত গণ আন্দোলনকে। (বলাবাহুল্য, এই বিতর্কের খবরটি খবরের কাগজ জাতীয় সেকেন্ডারি সোর্স থেকে নেওয়া। ফলে আভ্যন্তরীন বিতর্ক যে হুবহু এইরকমই ছিল, তা নাও হতে পারে। তবে সশস্ত্র স্কোয়াড/জঙ্গী আন্দোলন সংক্রান্ত একটি মতপার্থক্য যে সংগঠনটিতে ছিল এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।)

    কৌশলগতভাবেই, রাজ্যের কর্ণধারদের উচিত ছিল, রাজ্যের বহুচর্চিত গণতান্ত্রিক পরিবেশকে সত্যি সত্যিই আরও প্রসারিত করা। এমনকি জনযুদ্ধের মতো ঘোষিত "জঙ্গী' সংগঠনের জন্যও। তাতে লাভ হত এই, যে, জনযুদ্ধের মধ্যেকার গণ আন্দোলনপন্থী অংশটি সংগঠনের মধ্যে নিজেদের লাইনটি সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলত। শান্তিপূর্ণ পথে নিজেদের দাবীদাওয়ার জন্য আন্দোলন সম্ভব হলে, সম্ভবত: জনযুদ্ধের মধ্যে "গণতন্ত্রপন্থী' লাইনটিই বিজয়ী হত। রাষ্ট্র কৌশলে নিজের কাজটিও সমাধা করে ফেলতে পারত। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশটিকে বিকশিত করার পরিবর্তে, সরকার ঠিক বিপরীত পথটি গ্রহণ করে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক মোকাবিলার বদলে নেওয়া হয় গ্রেপ্তার, নিপীড়ন এবং দমনের পথ। ফলে যা হবার তাইই হয়। ক্রমাগত: ধরপাকড়ের ফলে, "এ রাজ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনো পরিবেশ নেই', এই মতটিই জনযুদ্ধের অভ্যন্তরে এবং তার ছোট্টো গণভিত্তির কাছেও একরকম প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। নি:সন্দেহে এটি রাজ্য সরকারের একটি বিরাট কৌশলগত ভুল। যে ভুলের কারণে প্রতিশোধ এবং হিংসাকে নিজের জনভিত্তির কাছে একটি "নৈতিক' কাজ হিসাবে দেখানোর সুযোগ পেয়ে যায় জনযুদ্ধ। "অকারণে হিংসা' প্রায় কোনো জনগোষ্ঠীর কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু "হিংসার জবাবে হিংসা', তুলনামূলকভাবে "নৈতিক' একটি অবস্থান। এই "নৈতিক' অবস্থানটিকে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ জনযুদ্ধের হাতে তুলে দেয় রাজ্য সরকারই।

    কার্য কারণ
    ----------
    ফলে নিশ্ছিদ্র দমননীতি একরকমভাবে আজকের এই বিদ্রোহের পরিস্থিতিকে ত্বরান্বিত করেছে, সন্দেহ নেই। একদিকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের উপর নামিয়ে আনা হয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন আতঙ্কের সন্ত্রাসের পরিবেশ, অন্যদিকে "মাওবাদী' গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে কার্যত: যুদ্ধঘোষণা করা হয়েছে। যার সর্বশেষ ফলাফল ২০০৮ সালের এই আদিবাসী বিদ্রোহ। কিন্তু সরকার এটা কেন করেছিল? কেন নেওয়া হয়েছিল, এই দমনের চন্ডনীতি? "খুনের রাজনীতি' এর কারণ নয়, আমরা দেখলাম। অন্য কারণ কি হতে পারে, আমাদের জানা নেই। আমরা স্রেফ আন্দাজ করতে পারি।

    একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, সরকার বিপদের আশঙ্কা করেছিল। ২০০২ সালের আগে পর্যন্ত জনযুদ্ধ আর পাঁচটা নকশালপন্থী দলের মতো কেবলমাত্র একটি আঞ্চলিক গোষ্টী ছিল। অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু পকেটেই সীমাবদ্ধ ছিল যাদের কার্যকলাপ। ২০০২ সালেই সর্বপ্রথম টের পাওয়া যায়, যে, একটি আঞ্চলিক শক্তি হয়ে থাকার বদলে তারা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে পা রাখতে চাইছে। ২০০২ সালেই জনযুদ্ধ আরেকটি সমমনোভাবাপন্ন নকশালপন্থী গোষ্ঠী "পার্টি ইউনিটি'র সঙ্গে মিশে যায়। পার্টি ইউনিটির কার্যকলাপ ছিল মূলত: তৎকালীন বিহারে। ঐ বছরেই দন্ডকারণ্যের গভীর জঙ্গলে দুইটি গোষ্ঠীর "ইউনিটি কংগ্রেস' অনুষ্ঠিত হয়। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হল, যে, এই ইউনিটি কংগ্রেসেই ঐক্যবদ্ধ পার্টিটি তাদের "সামরিক' কার্যকলাপ নিয়ে একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতদিন পর্যন্ত দুটি সংগঠনেরই "সামরিক' কার্যকলাপ চালানো হত পার্টিদুটির স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশ এবং প্রয়োজনানুসারে। এই সম্মেলনেই স্থানীয় স্কোয়াডগুলিকে একটি কেন্দ্রীয় সামরিক সংগঠনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। তৈরি হয় একটি বিধিবদ্ধ গেরিলা "সেনাবাহিনী'। যার নাম পিপলস গেরিলা আর্মি। তৈরি করা হয় একটি "সে¾ট্রাল মিলিটারি কমিশন'।

    ফলে আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ ছিল, যে, এই ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্রীয় সামরিক গোষ্ঠীটি তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ গোটা দেশজুড়ে বাড়িয়ে চলবে। প্রভূত পরিমানে বেড়ে ওঠার আগেই এই বিপদকে সমূলে ধ্বংস করতে হবে, সরকারি সিদ্ধান্তের পিছনে এরকম একটা যুক্তি কাজ করা অসম্ভব নয়।

    দ্বিতীয় আরেকটি সম্ভাব্য কারণও থাকতে পারে, যা, নিতান্তই স্থানীয়। আগেই বলা হয়েছে, যে, ১৯৯০ এর দশকের শেষ দিক থেকেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা অশান্ত হয়ে উঠেছিল প্রবল রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণে। এই সংঘর্ষের পিছনে মূলত: ছিল এলাকা দখলের লড়াই। কেশপুর-গড়বেতা সহ অনেকগুলি প্রত্যন্ত এলাকা "দখল' করার তৃণমুলী "যুদ্ধ' দিয়ে শুরু হয় এই সংঘর্ষ। তৃণমূলের মতে এই "দখল' প্রক্রিয়া ছিল একটি গণ অভ্যুত্থান, "দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ'। আর সিপিএমের মতে এ ছিল, নেহাৎই সমাজবিরোধীদের অস্ত্রশক্তি কাজে লাগিয়ে গায়ের জোরে এলাকাদখল। এই যুদ্ধের প্রথমভাগে কেশপুর সহ অনেকগুলি এলাকা "দখল' করে নেয় তৃণমূল-বাহিনী। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে সংঘর্ষ। খুন এবং পাল্টা খুন। অবশেষে সিপিএম বাহিনী তৃণমূল গোষ্ঠীকে সরিয়ে দিয়ে "পুনর্দখল' করে এলাকাগুলি। ২০০২ সাল নাগাদ এই পুনর্দখল প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের অস্তিত্ব কার্যত: মুছে যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে। শান্ত হয়ে আসে এলাকা।

    কেশপুর এলাকায় এই সংঘর্ষের মধ্যে জনযুদ্ধ গোষ্ঠীরও ভূমিকা ছিল বলে শোনা যায়। যুদ্ধ-পরিস্থিতির মধ্যে, তারাও কয়েকটি থানার বিস্তীর্ণ অঞ্চল "দখল' করে রেখেছিল। "পুনর্দখল' এর সময় স্বভাবত:ই তাদেরও মেরে তাড়ানোর দরকার হয়েছিল। ফলত: ঘটেছিল ছোটো আঙরিয়ার হত্যাকান্ডের মতো ঘটনা। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস আর জনযুদ্ধের কার্যকলাপের মধ্যে কিছু তফাত ছিল। তৃণমূল যেমন "যুদ্ধ'তে হেরে গিয়ে এলাকার দখল ছেড়ে দিয়ে পরাজয় স্বীকার করে, গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী জনযুদ্ধের সংগঠকরা স্বভাবত:ই সেটা করেনি। ছোটো-ছোটো পকেটে তারা লুকিয়ে-চুরিয়ে সংগঠন বাড়ানোর কাজ করেই চলে। কখনও তাড়া খেয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। কিন্তু "পরাজয়' স্বীকার করেনি। হয়ত এইটুকু সিঁদুরে মেঘেই আশঙ্কার কারণ দেখেছিল স্থানীয় যুদ্ধক্লান্ত সিপিএম। আরেকটি "যুদ্ধ'এর সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্য দরকার ছিল এলাকাকে সম্পূর্ণ বিরোধীশুন্য করে ফেলা। তৃণমূল কংগ্রেস ইতিমধ্যেই হাল ছেড়ে দিয়েছে। অতএব, সর্বশক্তি নিয়োজিত হয় জনযুদ্ধকে নির্মূল করতে।

    এগুলো সবই সম্ভাব্য কারণ। স্পেকুলেশন। আরও অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে। তবে কারণ যাইই হোকনা কেন, ফল একটিই। নতুন শতাব্দীতে তুমুল দমননীতি নেমে আসে জনযুদ্ধের উপর। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব হিসেবে প্রত্যন্ত আদিবাসী এলাকায় শুরু হয় ধরপাকড়। অত্যাচার। নিপীড়ন। এই আতঙ্কের জবাব আসে অন্য তরফের বুলেটে। বুলেটের জবাবে আসে পুলিশী বুটের শব্দ। তার জবাবে আসে পুলিশ-সিপিএম খুন। খুনের জবাবে সিআরপিএফ। সিআরপিএফ এর জবাবে ল্যান্ডমাইন। এইভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে চলতে থাকে হিংসা আর প্রতিহিংসার কিস্যা। মাওবাদী বন্দুক আর পুলিশী অত্যাচারের মধ্যে ঢাকা পড়ে যায় একটা গোটা জনজাতি। এই হিংসার পরিমন্ডলে একটি বিদ্রোহ ক্রমশ: অনিবার্য হয়ে ওঠে। একান্ত অনিবার্য হয়ে ওঠা এই বিদ্রোহটিই আমরা দেখলাম ২০০৮ সালের এই নভেম্বর মাসে।

    উন্নয়ন
    -------
    আরেকটি বহু আলোচিত বিষয়কে আমরা এখানে এতক্ষণ এড়িয়ে গেছি, যার নাম উন্নয়ন। শুধু সন্ত্রাস দিয়ে এই বিদ্রোহের পুরোটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাই, যদিও বহু আলোচিত, তবুও, শেষ করার আগে সেই প্রসঙ্গটিও আমরা এখানে ছুঁয়ে যাব। বিগত কয়েকটি দশক ধরে সারা ভারত জুড়ে আমরা নিও-লিবারাল মুক্ত অর্থনীতির জয়ধ্বনি শুনে আসছি। শাইনিং ইন্ডিয়া, জিডিপির উর্ধ্বগতি ইত্যাদি অগ্রগতির বাণীতে আমাদের টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়া পরিপূর্ণ। কিন্তু সেই সঙ্গে যে তথ্যগুলি আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, তারা হল, "সেজ' আর বিদেশী বিনিয়োগের এই বাড়বাড়ন্ত সত্ত্বেও অর্গানাইজড সেক্টরে কর্মসংস্থান বাড়ছেনা। যা বাড়ছে, তা হল, ভারত এবং ইন্ডিয়ার মধ্যের সেই চিরাচরিত ফাঁক। নিও-লিবারাল উন্নয়নের ঝলকানির মধ্যে সকলের চোখ এড়িয়ে এই ফাঁক ক্রমশ: চওড়া হচ্ছে। ভারত আর ইন্ডিয়ার অধিবাসীদের মধ্যে ব্যবধান বেড়েই চলেছে।

    সুদীপ চক্রবর্তী "রেড সান' এ দেখিয়েছেন, যে, নগরমুখী উন্নয়নের এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে, অদূর ভবিষ্যতে ভারতের ২৫ কোটি গ্রামীন "আউট-ল্যান্ড' বাসী বাস্তুচ্যুত সর্বহারা হবে। এরা "উন্নয়ন' এর "ভুলে যাওয়া' অংশ। হয় এদের "ভুলে যাওয়া' মানুষ হয়ে প্রত্যন্ত গ্রামীন এলাকায় বসবাস করতে হবে, নয়তো স্থানচ্যুত বস্তিবাসী হয়ে শহরে এসে উঠতে হবে। এতে করে এদের অবস্থার উন্নতি না অবনতি হবে, সে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। একদল মনে করেন, যে, আখেরে শহুরে উন্নতি "চুঁইয়ে পড়ে' এদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাবে। অন্যদল মনে করেন, শেষমেষ এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জায়গা হবে ডাস্টবিনে। কিন্তু যা নিয়ে বিতর্ক থাকার কোনো অবকাশ নেই, তা হল, অবস্থার উন্নতি হোক, বা না হোক, বলপূর্বক স্থানচ্যুত হয়ে নতুন করে নতুন জায়গায় জীবন শুরু করতে কেউই পছন্দ করেন না। একদম নিম্নস্তরের গ্রামীণ মানুষজনও না।

    এবং ভারতবর্ষের বর্তমান উন্নয়নের মডেলে নিজ পেশায় এবং নিজ স্থানে বর্তমান থেকে এই সুবিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের উন্নতির সর্বাধুনিক মডেল হল "সেজ', যা, সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের বদলে স্থানীয় নাগরিক উন্নয়নের পকেট তৈরির কথা বলে। কিছু-কিছু পকেটে উন্নতি হলেই, বাকি এলাকার মানুষও ক্রমশ: তা থেকে উপকৃত হবেন, এই হল, তত্ত্ব। ওদিকে একেকটি বিশেষ শিল্প অঞ্চল, একেকটি শিল্পনগরী তৈরি করতে যে বিপুল পরিমান মানুষকে স্থানচ্যুত হতে হয়, উন্নয়নের এই প্রক্রিয়ায় তাদের কনসেন্ট নেবার কথা ভাবা হয়না। এবং, আগেই বলা হয়েছে, বলপূর্বক স্থানচ্যুত হতে, কেউই পছন্দ করেন না। বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষের কাছে, নিজের জমি, জীবিকা ছেড়ে, অনিশ্চিতের দিকে যাত্রা করা, একরকম মৃত্যুরই সামিল।

    ফলে, এই প্রতিটি স্থানচ্যুত মানুষই একজন সম্ভাব্য বিদ্রোহী। ফলে, এটা একটুও আশ্চর্যজনক নয়, যে, নিও-লিবারাল অর্থনীতি যতই তার জয়ধ্বনি ঘোষণা করেছে, ততই অলক্ষ্যে বেড়েছে ভূমিপুত্রদের ক্ষোভ। মাওবাদীরা এই স্থানচ্যুতির, ভারত এবং ইন্ডিয়ার মধ্যে বেড়ে চলা ফাঁককেই কাজে লাগিয়েছে এবং লাগাচ্ছে। সারা ভারতের চেয়ে বাংলা এ ব্যাপারে একটুও আলাদা নয়। নন্দীগ্রামের কথা আমরা সকলেই জানি। আমাদের আলোচ্য মেদিনীপুর জেলার শালবনীতেও তৈরি হচ্ছে জিন্দালদের একটি কারখানা, যা ইতিমধ্যেই "সেজ' মর্যাদা পেয়েছে। নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে। কিন্তু শালবনী ছিল একদম চুপ।

    স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখায় দেখিয়েছেন, যে, চুপ থাকা মানেই ক্ষোভহীনতা নয়। বরং চুপ করে থাকা অনেকসময়ই নিরুপায়তাকে সূচিত করে। শালবনী পঞ্চায়েত সমিতি সম্পূর্ণ বিরোধীশুন্য। সম্পূর্ণ বিরোধীশুন্যতার মধ্যে নিজের বিরোধিতাকে সজোরে প্রকাশ করতে সাহস লাগে। সেই সাহস অনেকেই দেখাতে পারেন না। স্বাতী লিখছেন, ""পরিত্যক্ত প্রাথমিক স্কুলভবনের কাঁচা দাওয়ায় বসে আটদশজন গ্রামবাসী এক স্বরে বললেন, "পঞ্চায়েত পাবলিকের পক্ষ না নিয়ে জিন্দালের পক্ষ নিয়েছে'। তাঁদের অভিযোগ, পঞ্চায়েত যদি গ্রামবাসীর পক্ষ নিত, তবে দোফসলী জমি প্রকল্পের আওতা থেকে বাঁচত, জমির দর বাড়ানো যেত, আর চাকরি, শেয়ার প্রভৃতির প্রতিশ্রুতি লিখিত ভাবে আদায় করা যেত, ব্লক অফিসে রাখা যেত তার কপি।''

    এই ক্ষোভ নথিভুক্ত হয়নি কেন? ""স্পষ্টতই, রাজনীতির সঙ্গে প্রশাসনের এখানে কোনো তফাত নেই। এবং জমি বিক্রির শর্ত নিয়ে প্রতিবাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধিতার তফাত নেই। আসনাশুলির বাসিন্দারা ৫০-৬০ একর উর্বর জমি দিতে চাননা শুনে শচীন্দ্রবাবু (পঞ্চায়েত সদস্য) যেমন বললেন, "ওরা রাজনীতিক বিরোধিতার জন্য বলছে।' আর আসনাশুলির বাসিন্দারা জিন্দালের ডাকা জনশুনানিতে কোনও কথা বলেননি, কারণ, "কিছু বলতে গেলেই তো বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাব।' ''

    প্রসঙ্গত: জিন্দাল এখানে যে তিনটি জিনিস "প্যাকেজ' এর মধ্যে দিচ্ছে, তারা হল, ১। জমির জন্য টাকা। ২। পরবর্তীকালে শেয়ারের প্রতিশ্রুতি। ৩। পরিবারপিছু একজনের চাকরির প্রতিশ্রুতি। টাকা ছাড়া বাকি দুটি জিনিসই স্রেফ মৌখিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু না।

    তো, কথা একটাই। যে, শালবনীতে জমি হস্তান্তর বিরোধিতাহীন এবং শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে বলেই মনে করার কোনো কারণ নেই, যে, এলাকায় কারখানা গড়ে ওঠার পদ্ধতি নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই। বরং, উল্টোটাই বোধহয় ঠিক। যে, ক্ষোভ আছে। কিন্তু তা প্রকাশ করার বাতাবরণ নেই। এবং, ক্ষোভ যথাসময়ে প্রকাশিত না হলে, জমতে জমতে একসময় তা বিস্ফোরণ ঘটায়, এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়।

    একথা মনে করার কোনো কারণ নেই, যে, ঐ সামগ্রিক এলাকায় উন্নয়ন সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষোভই শালবনীর জমি হস্তান্তর থেকে উদ্ভুত। আসলে শালবনী একটি উদাহরণ মাত্র। যা দেখিয়ে দেয়, যে, উন্নয়নের চালু মডেলে, আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে স্থানচ্যুত, জীবিকাচ্যুত মানুষের অংশগ্রহণের কোনো অধিকার নেই। ক্ষোভটা এই অধিকারহীনতার। আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এই ক্ষোভটা আরও বেশি হবারই কথা। কারণ পাহাড়, জমি, বা নদীকে আদিবাসীরা চিরকালই দেখেছে, নিজেদের, একান্তভাবেই নিজেদের সম্পত্তি হিসেবে। পাহাড় বা জমি উন্নয়নের নামে অন্য লোকের হাতে চলে যাবে, কিন্তু কি শর্তে কিভাবে যাবে, বা আদৌ যাবে কিনা, এ নিয়ে মতামত দেবার কোনো অধিকার ভূমিপুত্রের নেই, ক্ষোভটা এই অভাবজনিত। উন্নয়নের গোটা মডেলটা নিয়েই আসলে ক্ষোভ ভূমিপুত্রদের, সুদীপ চক্রবর্তীর হিসেব অনুযায়ী ভারতের প্রান্তিক ২৫ কোটি মানুষের। এই ক্ষোভের সঙ্গে ইন্ধন জুগিয়েছে মাওবাদী তকমা। পুলিশের অত্যাচার।

    শেষ কথা
    ---------
    এই চিত্রটা সর্বভারতীয়। তৈরি হচ্ছে শিল্পনগরী। হচ্ছে "উন্নয়ন'। সঙ্গে হচ্ছে উচ্ছেদ। উন্নয়ন থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে ভূমিপুত্ররা। ক্ষোভ বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাওবাদী কার্যকলাপ। আঞ্চলিক ভাবে বিক্ষোভ হচ্ছে। এবং প্রতিটি বিক্ষোভকেই মাওবাদী তকমা দিয়ে দমন করার চেষ্টা হচ্ছে। যা জন্ম দিচ্ছে শেষহীন হিংসার এক চক্রের।

    ১৯৯৭ সালে ইন্ডিয়া টুডে একটি জনমত সমীক্ষা করে। প্রশ্ন ছিল, "আপনি কি মনে করেন আগামী ৫০ বছরে ভারত এক থাকবে, না টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে?' ৩৬% মানুষ এর উত্তরে "টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে'র পক্ষে রায় দেন। ২৩% মানুষ জানান, যে, তাঁরা নিশ্চিত নন। আর ৪১% মানুষ ভারতের ঐক্যের পক্ষে রায় দেন। এই সমীক্ষার ১১ বছর পরে, মনে হচ্ছে, অন্তত: দু-টুকরো হওয়াটা ক্রমশ: অনিবার্য হয়ে উঠছে। ভারত-ইন্ডিয়া ক্রমশ: আলাদা হয়ে যাচ্ছে। একদিকে সেজ, সিটি সেন্টার, সূক্ষ্ম কুইজিন তত্ত্ব, মল-মাল্টিপ্লেক্স খচিত ইন্ডিয়া। অন্যদিকে হাঁড়িয়া-মাদল-মহুয়া, তীর-ধনুক-একে৪৭ খচিত মাওবাদী অধ্যুষিত ভারত। একদিকে লাগামহীম নিও-লিবারাল ইন্ডিয়া, যেকোনো বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে প্রবল প্রতাপে দমন করার প্রতাপশালী ইন্ডিয়া, অন্যদিকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রধারী নির্মম ভারত। ২৬শে জানুয়ারির প্যারেডে লালকেল্লার সামনের সদর্প ট্যাঙ্কের পদচারণা, আর ইন্টারনেটে মাওবাদীদের প্রচার করা ভিডিওয় পিপলস গেরিলা আর্মির জলপাই পোশাকের প্যারেড পাশাপাশি দেখলে একটি হাড় হিম করা গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা ছাড়া আর কিছু মনে আসেনা।

    এই সম্ভাবনাকে কি রোখা যাবে? উত্তর ভবিষ্যতের হাতে।

    নভেম্বর ১৬, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৬ নভেম্বর ২০০৮ | ৯৩৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন