কৃষ্ণাঙ্গ বিক্ষোভে আমেরিকা উত্তাল। রাজনৈতিক ভাবে, আমেরিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সম্মান অর্জন প্রচেষ্টা আজ এক নতুন বিস্ফোরক বাঁকে। রাজনৈতিক আলোচনা চলবে। এই প্রবন্ধটি তিন প্রজন্মের কৃষ্ণাঙ্গ লেখকদের লেখা প্রসংগে। নবারুণ ভট্টাচার্য্য প্রতিষ্ঠিত 'ভাষাবন্ধন' পত্রিকায় ২০১৭ র উৎসব সংখ্যায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত। লেখক নিজেই অনুমতি যোগাড় করেছেন পুনঃপ্রকাশের। গুরুচন্ডালির পাতায় নানা দেশের সাহিত্য আলোচনা নতুন না হলেও প্রতিবারই তা একাংশ পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন করেছে এবং অকারণ এক মিথ্যা দেশপ্রেমের আড়ালকে অবলম্বন করে বিতর্ক হয়েছে। তাতে অবশ্য বাংলা ও অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের কিছুই এসে যায় না, লেখক এবং অপেক্ষাকৃত অনুত্তেজিত পাঠকেরা তাঁদের কাজ চালিয়ে যাবেন, সম্মান অর্জনের লড়াইয়ের সর্বজনীনতা এই সব মূর্খ-কূপমন্ডুকতার উর্ধে। লেখাটি বা তার মান অবশ্যই আলোচিত সাহিত্য মহত্ত্বের প্রতিনিধি হওয়ার দাবী করে না।
~~~~
স্বল্প পরিচিত সংস্কৃতির বইপত্তর আলোচনার সময়ে, অনুরাগী পাঠকেরা একটা আলোচনায় মজা পান, এই বইয়ে কী করে এসে পৌছনো গেল। যাত্রা এবং যতি দুটো জিনিস নিয়েই আগ্রহ অসম্ভব না।। ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি, কৃষ্ণাঙ্গ লেখক লেখিকাদের সঙ্গে আমার পরিচয় মূলতঃ আফ্রিকার উপনিবেশ এবং বর্ণবৈষম্য বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে পরিচয়-এর হাত ধরে। আর গত শতাব্দীর ৭০ বা ৮০ র দশকের পাঁচটা এঁচোড়ে পাকা বাঙালী পোলিটিকাল অ্যানিমাল এর মত আমিও চিনুয়া আচেবে পড়ার ঢের আগে, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং ম্যান্ডেলা সম্পর্কে জানতে গিয়ে মান্ডেলা, ওয়াল্টার সিসুলু আর স্টিভ বিকো এবং রবার্ট মুগাবে র রাজনৈতিক লেখার সঙ্গে অল্প পরিচিত হই। তার পরে চিনুয়া আচেবে দুর্দান্ত লাগলেও, ওলে সোয়াইন্কা সুবিধে করতে পারি নি, নাটক গুলো দেখা হয় নি বলে। অপর দিকে আমার ইংল্যান্ড ফ্রান্স আমেরিকার কৃষ্ণাংগ লেখক লেখিকাদের একেবারেই পড়া হয় নি, একেবারে হালে শুরু করেছি মাত্র। অতএব এই লেখাটি সংক্ষিপ্ত রাখার চেষ্টা করব।
২০০১-২০০২ সাল নাগাদ, আমার হাতে প্রথমে আসে গ্যারি ইয়াং বলে এক সাংবাদিকের লেখা। অসম্ভব সংবেদনশীল সব লেখা বা বক্তৃতা। ইরাক যুদ্ধ প্রসঙ্গ, সরকারে নীতি, সমাজিক সমস্যা নিয়ে সাংবাদিকতার লেখা। ভদ্রলোক গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিখতেন। এর কিছুদিন বাদে আমি জেমস বাল্ডউইন কে আবিষ্কার করি। জেমস বাল্ডউইন সম্পর্কে আমার আগ্রহ প্রচন্ড বেড়ে গেছিল এটা জানার পরে যে ইনি ফ্রান্সে বেশ কিছুটা সময় কাটাচ্ছেন। এবং প্রখ্যাত উপন্যাস, 'গিওভানি'জ রুম' পড়ার পরেই দুটো জিনিস মাথায় ঘুরতে থাকে, আগে পরের কিছু কৃষ্ণাঙ্গ লেখকদের অন্তত অল্প কিছু লেখা পড়তে হবে। তো সেই উদ্যোগের ফল ই আজকের আলোচ্য।
আজকের আলোচনার জন্য বেছে নিয়েছি তিনজন লেখককে, রালফ এলিসন (১৯১৩ - ১৯৯৪), এঁর প্রখ্যাততম উপন্যাস 'ইনভিসিবল' কেই মোটামুটি ভিত্তি করা হবে, এর পরে বালডউইন (১৯২৪-১৯৮৭), এঁকে কোনভাবে কোন পংক্তিতে ফেলাই মুশকিল, অসামান্য প্রতিভাবান আমেরিকার সাহিত্যজগতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নক্ষত্রের পুরো কাজ এবং নানা না-কাজ, এই আলোচনায় ধরা মুশকিল, তবু তাঁর সময়্টাকে আমরা ধরার চেষ্টা করব, কাজের অসম্ভব বৈচিত্র, একদিকে বর্ণবৈষম্যের প্রতিক্রিয়ায় উন্মাদের মত ক্রোধ, অন্য দিকে আশ্চর্য্য নরম সমকমী প্রেমের কাহিনীর রচয়িতা, আমেরিকার বৌদ্ধিক ঐতিহ্য সংক্রান্ত বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখা বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ গুলিও ওঁরই রচনা। এবং শেষে, সিস্টার সোল্জা (১৯৬৪-) নামক একজন অসম্ভব জনপ্রিয় একেবারে হালের ৯০ এর দশকের লেখিকাকে নিয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। তিনজন তিনটে সময়ের প্রতিনিধি শুধু না, বিচিত্র প্রজ্ঞার অধিকারে, এবং বর্ণবৈষম্যের সর্বগ্রাসী বিচিত্র ইতিহাসের কি রকম ধরণের বাঁকগুলিতে এঁরা উপস্থিত হয়েছিলেন, সেটা একটু ধরার চেষ্টা করবো।
১৯৫২ য় প্রকাশিত হওয়ার পরেই অসম্ভব সাড়া ফেলে দেওয়া উপন্যাসটি সম্পর্কে, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রাফ এলিসন পরে প্যারিস রিভিউকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৩২ নাগাদ উনি এলিয়ট এর ওয়েস্টল্যান্ড পড়েন। এবং ওঁর মনে হতে থাকে, আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের হাত থেকে এরকম লেখা বেরোচ্ছে না কেন। ব্যক্তি সম্ভাবনার বিকাশ যে বর্ণবৈষম্যের ঐ দমবন্ধ পরিস্থিতিতে অসম্ভব, সেইটেই যেন এই উপন্যাসের মূল দিক। দক্ষিণাঞ্চলের পৃথগিকৃত সামাজিক জীবন থেকে পালাচ্ছে একটি লেখাপড়ায় ভালো কিশোর বা সদ্য যুবক, এবং এসে পড়ছে হার্লেম অঞ্চলের বিক্ষুব্ধ মানুষের মধ্যে যেখানে বীভৎস জাতি দাঙ্গা হচ্ছে। দক্ষিনাঞ্চলের জীবনটা তার এমন, যেন সে অদৃশ্য, তার কৃষ্ণাঙ্গ অস্তিত্ত্বই যেন নাগরিক সমাজ নামক প্রতিষ্ঠান অস্বীকার করে।
আমার কাছে যে পেঙ্গুইন মডার্ন ক্লাসিক্স সংস্করণটি রয়েছে, তাতে ভুমিকা লিখে দিয়েছেন জন কালাহান, আর স্বয়ং এলিসন এর লেখা ১৯৮১ র একটি সংস্করণের ভূমিকাটিও রয়েছে। ১৯৫২ তে কেন হই চই পড়ে গেছিল এলিসন এর এই উপন্যাস নিয়ে, বুঝতে গেলে অতি সংক্ষেপে যেটা বোঝা দরকার, সোভিয়েত ব্যবস্থাকে বার বার বর্জন করার কথা বলার পরেও, আমেরিকার যা অবস্থা তখন চলছিলো, তাতে বর্ণবাদের বীভৎস প্রভাব এবং রক্তক্ষয় ইত্যাদি বার বারই দেশবাসীর একটা বড় অংশের সামনেই আমেরিকার শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছিল। ১৯৫২ তে মনে রাখতে হবে, ৫০ বা ৬০ এর দশকের সম্মিলিত বা ব্যক্তিগত প্রতিবাদগুলি বা সে প্রেক্ষিতে নেওয়া আইনি ব্যবস্থা গুলি কিন্তু তখন ও জমাট বাঁধে নি। অতএব সম্মিলিত কৃষ্ণাঙ্গ অস্তিত্ত্ব বিপদের মুখে ছিল এবং ব্যক্তিগত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের পক্ষে মানুষ হিসেবে পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশ করাই অসম্ভব ছিল। দক্ষিন অঞ্চলের অত্যাচার থেকে উত্তর আমেরিকার বড় বড় শহরে চলে আসছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারগুলি, স্রেফ ভাগ্য সন্ধানে, আমেরিকার নতুন সবল শিল্প অর্থনীতি যদি তাঁদের কিছুটা জায়গা দেয়। এরকম একটা সময়ে রাল্ফ এলিসন প্রায় ৮ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই উপন্যাসটি দাঁড় করাচ্ছেন, যেখানে এক সদ্য কৃষ্ণাঙ্গ যুবক একটা খোঁজে নেমেছে, প্রকৃত আমেরিকার নভেলের খোঁজে, প্রকৃত আমেরিকার ভাষার খোঁজে, আমেরিকার কয়েকশো বছরের ঐতিহাসিক বা নাম গোত্রহীন মানুষের সঙ্গে তার দেখা হচ্ছে, কিন্তু সে চলেছে।
তার যাত্রা শুরু হচ্ছে, এক ভালো ছাত্রের কলেজ এবং নিজের শহর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ভাষার, সংস্কৃতির জন্য জায়গা খোঁজার সেই যাত্রায়, সে শেষে একজন পেশাদারী বক্তা হয়ে উঠছে, কিন্তু তার পরে আস্তে আস্তে সে চুপ করে গিয়ে লিখতে চাইছে। বুঝতে পারছে, আমেরিকার নিজস্ব জাতি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সমাহার হিসেবে আত্মপ্রকাশের যে প্রক্রিয়া তার থেকে এই ব্যক্তিগত যাত্রা খুব আলাদা হতে পারে না, অন্তত যদি আমেরিকা নিজেকে প্রকৃত ভাবে চিনতে আগ্রহী থাকে, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে বাদ দিয়ে তার ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা থেকে সে বিরত থাকে। এলিসন কোথাও একটা ঊনবিংশ শতকীয় জাতির এবং জাতীয় রাষ্ট্রের বিবর্তনের সঙ্গে উপন্যাস জিনিসটার গড়ে ওঠাটাকে এক জায়্গায় করে দেখেছিলেন, মোবি ডিক এবং হাক ফিন তাঁর প্রিয় উপন্যাস ছিল। এবং খুব সহজেই বোঝা যায়, ১৯৫২ য় এসে আমেরিকার কালো দের নিজেদের বর্ণপরিচয় এবং নিজস্ব ভাষা প্রবর্তন ও নিজেদেরই করে নিতে হছিল।
এলিসন নিজে ব্লুজ সংগীত কে বলেছিলেন, "an impulse to keep painful details and episodes of a brutal experience alive in one's aching consciousness, to finger its jagged grain, and to transcend it, not by the consolation of philosophy, but by squeezing from it a near tragic, near comic lyricism"। এলিসন-এর বন্ধু অ্যালবার্ট মারে, এই কালাহানকৃত ভূমিকাটিতেই খবর পাচ্ছি, এলিসনের লেখাকে বলেছিলেন "par excellence, the literary expression of blues, it was as if Ellison had taken an everyday twelve bar blues tune, (by a man from down South sitting in a manhole up north in New York singing and signifying about how he got there) and scored it for full orchestra"।
এর পরে আমরা জেমস বালডউইন প্রসঙ্গে আসবো। বাল্ডউইন প্রসঙ্গের সমস্যা অনেক। প্রধানত প্রাবন্ধিক, কিন্তু হাতে গোণা কয়েকটি যে উপন্যাস লিখেছেন, তাতেই অমরত্ত্বে স্থিত। আরো বড় সমস্যা রয়েছে, বালডউইন সমকামী পুরুষ ছিলেন এবং কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন, সেই অভিজ্ঞতার তীব্র প্রান্তিকতা তাঁর বিশ্লেষণকে, বিষয় নির্বাচনকে পরিচালিত করেছে, অথচ বৃহদর্থে রাজনৈতিক অবস্থানের বাইরেও, চেতনার সুক্ষ্মতম অনুরণনের ধ্বনিও তাঁর লেখাকে বিশিষ্ট করেছে। সত্যি বলছি, যখন প্রথম বার “গিওভানি'জ রুম” পড়ি, কিছু কিছু জায়গায় প্রথম কৈশোরের প্রথম ভালোলাগা কবিতা পাঠের অনুভূতিতে ফিরে গেছিলাম। আবার কোথাও, গভীর প্রেমে কঠিন আঘাত পাওয়ার পরে, ঘনিষ্ঠ মানুষের মৃত্যুর খবর এলে, যেরকম দিশেহারা লাগে, অন্ধকারকে অতল বলে মনে হয়, সে অনুভূতিও ফিরে এসেছিল। আশ্চর্য্য কাব্যিক মায়া রয়েছে তাঁর গদ্যে, অথচ যখন চান, তখন ক্রোধ, হতাশা কিম্বা স্থানভেদে রসময় হর্ষ প্রকাশে ন্যুনতম কুন্ঠা বোধ করেন না।
সত্যি এঁর মাপের লেখককে কেন যে একটি প্রবন্ধে তাও আবার কয়েকটি অনুচ্ছেদে ধরার চেষ্টা করতে গেলাম নিজেই নিশ্চিত নই। শুধু মনে হয়েছিল, যে অসংখ্য এবং অসহ্য বৈপরীত্যগুলি রয়েছে তাঁর জীবনে এবং রচনায়, যে বিরাটত্ত্ব রয়েছে, তার একটা দূরবীনের এক ঝলকও কি প্রকাশ করতে পারবো না? চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সত্যিই কম না।
‘গিওভানি'জ রুম’ গল্পটা এই যে, একজন অনামী আমেরিকান যুবক, এক ইতালিয়ান লোকের প্রেমে পড়ছে পঞ্চাশের দশকের প্যারিসে, ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ সাল অব্দি প্যারিসে ছিলেন বালডউইন, এবার সেই প্রেমের চাপান উতোরই গল্পের মূল বিষয়, কিন্তু পড়তে গিয়ে প্রথম যেটা খটকা লাগবে, ভাষ্যকার কিন্তু সমকামী বর্ণ-অস্পষ্ট পুরুষ এবং প্রবাসী আমেরিকান, কারণ গল্পটার ভৌগোলিক/স্থানিক প্রেক্ষিত হল প্যারিস এবং ফ্রান্স। মনে হবে ভাষ্যকার আশ্চর্য্য একা, কিন্তু নিউ ইয়র্ক হার্লেমের কৈশোর তার পিছু ছাড়েনি, কৃষ্ণাঙ্গ হয়েও গ্রীনিচ ভিলেজ বা প্যারিসের লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবিদের বোহেমিয়ান জীবনে তিনি স্বচ্ছন্দ, অথচ কতটা সহজে একাত্মীকৃত তা পরিষ্কার না। কখনো মনে হবে, তাঁর বাইবেলময়, প্রচারক হিসেবে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, তাঁকে যতটা প্রভাবিত করেছে, তার থেকে কি অন্যান্য আমেরিকান মহত্তম লেখকদের তিনি যে অসম্ভব যত্ন সহকারে পাঠ করেছিলেন, তাঁদের দ্বারা কম প্রভাবিত হয়েছিলেন? হেনরি জেম্স সম্পর্কে তাঁর আলোচনা বিশ্ববরেণ্য সাহিত্য আলোচনার মধ্যে পড়ে। মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হবে, যদি আমেরিকার ইতিহাসের ঐ বছরগুলির কৃষ্ণাঙ্গ না হতেন, সমকামী না হতেন, তাহলে কি শুধুই সুন্দরের পূজারী একজন লেখকেকে পেতাম আমরা? যদিও মনে সন্দেহ না রাখাই ভালো, যে তাহলেও একজন বিশ্ববরেণ্য শিল্পী কেই পেতাম আমরা।
অনেক সমালোচকই মনে করেন, তাঁর আশ্চর্য্য অপমানবোধ, এবং নানা অন্তর্দ্বন্দ তাঁকে লেখক হিসেবে নিঃশেষ করে দিয়েছিল। আমাদের দেশেই বা কত সম্ভাবনাময় আদিবাসী, মুসলমান, কাশ্মীরি, মনিপুরী, দলিত শিল্পী লেখকের প্রতিভা আমাদেরই রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য বিকশিত হতে পারছে না কে যানে। কিন্তু, অনেক লেখার মধ্যে অনেক অসম্পূর্ণতা থাকা সত্ত্বেও, যতদিন পৃথিবীতে ভাষা সাহিত্য ধর্ম থাকবে ততদিন বিদ্বেষের ইতিহাসে নিমজ্জিত আমেরিকার ইতিহাস সম্পর্কে শিক্ষা নিতে গেলে আমাদের জেমস বালডউইন কে পড়তেই হবে।
অবশেষে আসি সিস্টার সোলজা-এর রচনা প্রসঙ্গে। ভাষাবন্ধনের পাঠকরা আমায় মার্জনা করবেন, কৃষ্ণাঙ্গদের সাহিত্যে ব্যক্তিগত পাঠক হিসেবে আমার একেবারেই প্রাথমিক শিক্ষানবিশি চলছে, সিস্টার সোল্জার একটিই উপন্যাস আমি পড়ে উঠেছি, তাও ট্রিলজির একটা প্রথম ভাগ। কিন্তু এই আলোচনা যদি বইগুলি সম্পর্কে হাতে গোণা কয়েকজনকেও গবেষণা করায়, তবে কিঞ্চিত উদ্দেশ্য সাধন হয়। সিস্টার সোলজার লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে একটু বিচিত্র ভাবে। আমায় মাঝে মাঝে ভারত থেকে আমেরিকায় যে শহরে কাজে আসতে হয়, সেখানে একদিন বাসে, অন্তত চেহারায় অতি দরিদ্র এক মহিলার হাতে এই বইটা আমি দেখি, এক ক্লান্ত বিকেলে। উঁকি মেরে লেখিকার নাম দেখে ভাবি, ঠিক আছে, এঁর নাম কখনো শুনিনি, পড়ে দেখি, এবং তার পরে তথ্যের একটা বিস্ফোরণে যোগাড় করে ফেলি বিখ্যাততম কাজ গুলির একটা। "মিডনাইট, আ গ্যাংস্টার নভেল"।
সিস্টার সোলজা জন্মেছিলেন লিজা উইলিয়ামসন নাম নিয়ে, একেবারে ৯০ এর দশকের অল্পবয়সী লেখক, একাধারে রাপার, রাজনৈতিক সংগঠক, চিত্র প্রযোজক ইত্যাদি। ক্যালিফোর্নিয়ায় রডনি কিং কান্ডে ইনি হঠাৎই একটা ক্রুদ্ধ মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। রডনি কিং এর ঘটনা আপনাদের স্মরণে আছে কিনা জানি না, সারা পৃথিবীর কাগজে হই চই হয়েছিল, ১৯৯২ নাগাদ, একটা ফুটেজ প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তাতে দেখা যায়, ৪ জন শ্বেতাংগ পুলিশ অফিসার এক কৃষ্ণাঙ্গ রডনি কিং কে প্রবল প্রহার করছে, এই ফুটেজ প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাবানলের মত রায়ট হয়ে লস এঞ্জেলেস শহরে এবং অন্যত্রও কিছুটা ছাড়িয়ে পড়ে। কালো মানুষদের উপরে পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক অত্যাচার দীর্ঘ দিন বার বার প্রমাণিত হয়েছে, এবং বিভিন্ন শহর আর স্টেট গুলির পুলিশ বিভাগের প্রধানরা, নিরাপত্তা আর বাহিনীর মনোবলের স্বার্থে তাকে অবজ্ঞা করেছেন, এ মানে দীর্ঘদিন ধরে চলছে, আজকের ব্ল্যাক লাইভ্স ম্যাটার আন্দোলন প্রমাণ করে এই অনাচার এখনো শেষ হয় নি। তো ১৯৯২ তে, সিস্টার সোলজা মন্তব্য করে বসেন, যার সারবত্তা হল, প্রতি সপ্তাহেই তো কালোরা কালোদের খুন করে নানা অপরাধে, এক সপ্তাহ দেখি কালোরা একটু সাদাদের শিক্ষা দিক। এর পরে বিল ক্লিন্টন, তখন সম্ভবত তিনি নির্বাচনে ডেমোক্রাট পার্টির প্রার্থী, রামধনু কোয়ালিশন-এর উদ্যোক্তা জেসি জ্যাকসনের সভায় তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, এই ধরণের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না, রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার বাধ্যবাধকতাতেই বলেন, আমরা এই ধরণের মানুষের সমর্থন চাই না ইত্যাদি। (উক্তি নয়)। তার পরে প্রচুর হই হই হয়, সিস্টার সোলজা বলেন যে তাঁকে প্রেক্ষিত বাদ দিয়ে উদ্ধৃত করা হয়েছে ইত্যাদি। তো তথ্য বিস্ফোরণএর পরে স্বাভাবিক ভাবেই, বইটি না পড়ে আর উপায় ছিল না।
সিভিল রাইট্স আন্দোলন আলোচনার প্রসঙ্গেই শুধু না, ঐতিহাসিক ভাবে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতার যে পর্যায়গুলো করা হয়, তাতে স্থিতধি তন্ন্বিষ্ঠ উচ্চারণ, একাকী প্রার্থনা অথবা প্রতিজ্ঞা, অথবা কখনো জীবন মৃত্যুর বিপদ উপেক্ষা করে মুক্তির আশায় উন্মত্ত দৌড়, প্রবল ধংসের ক্রোধ, প্রতিশোধস্পৃহা, এক ধরণের নিজস্ব উচ্ছাস, তাতে কে শামিল হল খেয়াল না রাখা - এরকম নানা পর্যায়ে অনেকে দেখেন।। একদিকে যেমন জ্যাজ ব্লুজ তৈরী হচ্ছে সঙ্গীতে, পাশাপাশি চার্চের ধর্মীয় বৃন্দসঙ্গীত যখন রাজনৈতিক ভাবে উই শ্যাল ওভারকাম হয়ে উঠছে, এবং আস্তে আস্তে স্বাধীনতার আত্মসম্মানের দরজা খুলছে একটা স্তরে, প্রতিভার কিছু স্বীকৃতি আসছে, আবার ভোগবাদের নেশা দ্রব্যের তাড়নায় আত্মবিস্মৃত গানও হচ্ছে। কালোদেরই। এক ধরণের আলোচনা পদ্ধতিতে, কৃষ্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতার বিবর্তনের পাশাপাশি রেখে কৃষ্ণাঙ্গ সংগীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করা হয়। এই হিসেবে দেখলে রাপ বা হিপ হপ সঙ্গীত সেই সময়েই, সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, যখন কয়েকটা ঘটনা ঘটছে, কৃষ্ণাঙ্গ জ্যাজ, ব্লুজ, গসপেল, ক্যালিপসো বা রেগে রাজনৈতিক সঙ্গীতের দিকপালেরা খানিকটা রেকর্ড কোম্পানীর ব্যবসায়ে জড়িয়ে যা্ছেন, সেটা কোথাও সমান্তরাল কোথাও মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত অর্থনীতি। কিন্তু ঘেটোর অপরাধের জগত, আইনের আর বেআইনির গন্ডীর এপারে ওপারে অনায়াস যাতায়াতের যে জীবন, তার প্রতিফলন গানে আসতে শুরু করছে। এই গানের তীব্র সারকাজম, তীব্র অথচ রসিক হতাশা, দেওয়ালের গ্রাফিতির মত অদৃশ্য হাতে রাতারাতি আমেরিকার শহর গুলির কালোদের পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। নানা ধরণের ড্রাম মেশিন সস্তাতেও পাওয়া যাচ্ছে এই সময়ে, এবং টার্নটেবিল রেকর্ড আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে বা তার গতি টাকে হাত দিয়ে কমিয়ে বাড়িয়ে, এক ধরণের ঈষৎ কর্কষ কিন্তু তীব্র ছন্দের আকর্ষণ সম্পন্ন আবহ তৈরী হচ্ছে। প্রথম রেকর্ড করছেন 'সুগারহিল গ্যাং' নামে একটা দল, মূলত এরা নিউ ইয়র্ক এর।
আইনী বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আর সামাজিক স্বীকৃতির মাঝে দোলাচালের জীবন, আর অন্যদিকে শিক্ষার অভাব, অসংখ্য সামাজিক বিষয়, দারিদ্র্য অথবা হঠাৎ প্রতিযোগিতা করে ধনী হওয়ার আকাঙ্খা বা কখনো কখনো তার একটা সাফল্য, অথবা ক্রোধ বা বিশ্বাস বা শুধুই কমিউনিটি চর্চায় ব্যাপৃত জীবন, যেখানে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সম্মান অর্জন করাটাই যেখানে এখনো অনেকের পিছু ছাড়ে না, সেখানে এরকম সঙ্গীত তৈরী হওয়া আশ্চর্য্য না। আবার এরই মধ্যে মূল ধারায় সম্মান সূচক প্রত্যাবর্তনের গানও রয়েছে। একই আঙ্গিকে, যাঁরা একেবারে হালের ব্ল্যাক-আইড-পিজ শুনেছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন।
তো এই ধরণের গানের, আবৃত্তির, সঙ্গীতের যে জগতটা, সেটা আনতে চাইছেন উপন্যাসে সিস্টার সোলজা, ভাষায়, সিচুয়েশনের প্রয়োগে। কিন্তু একটা জায়গায় আমার অসম্ভব খটকা লাগছে, অজ্ঞানতা তার মূল কারণ হতে পারে। আমি বুঝতে পারছি না, কেন, কী কারণে, আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ না, এক আফ্রিকার প্রায় রাজপুত্রকে যেন এনে ফেলছেন নিউ ইয়র্ক এর রাস্তায় গলিতে, তার প্রায় অশরীরি চলাফেরা নায়কোচিত প্রায় অপরাধের জগতের একটা জীবন রচনা করছেন। নায়ক চরিত্রে।
আমেরিকা, জামাইকা, ব্রিটেন সর্বত্র কৃষ্ণাঙ্গদের সাংস্কৃতিক উচ্চারণের একটা ঐতিহাসিক পর্যায় ছিল আফ্রিকার উৎস খোঁজা। কলোনির, ক্রীতদাস প্রথার ইতিহাসকে অতিক্রম করার উচ্চাশা, শুধু মাত্র নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের খোঁজে। কবি ল্যাংস্টন হিউজ সমকালীন আধুনিকতাকে প্রতীকি ভাবে বর্জন করে আফ্রিকায় ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, শোনা যায় নিজের সমস্ত বই আটালান্টিকে ফেলে দিয়েছিলেন। মার্লে বা তাঁর সমসাময়িকরা একাধিকবার আফ্রিকান মাতৃভূমির একটা ডাকের কথা বলেছেন, অনুভব করেছেন। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক খোঁজ জীবনযাপনে, আর রাজনৈতিক সংগ্রামে বেশি দূর কাজে লাগানো যায়নি বলেই আবার ভূমিপুত্র হিসেবেই সমনাগরিকত্ত্বের দাবীকেই প্রধান করেছেন। যদি একেবারে সমসাময়িক রাপ গায়ক লেমার-এর সম্প্রতি রোলিং স্টোন পত্রিকায় বেরোনো সাক্ষাৎকারটি পড়েন, বোঝা যাবে, নিজেদের মাটিতেই রয়েছেন, অন্য কোনখানে মানস ভ্রমণের প্রয়োজন অনুভব করছেন না, এবং সর্বান্তকরণে সমর্থন করছেন, সম্মান অর্জনের লড়াই। তো এই প্রেক্ষিতে আমার বার বার মনে হছিল, এই আশচর্য্য প্রাণবন্ত উপন্যাসে, এই পিছুটান কেন, তাহলে কি সঙ্গীত যেটা পারছে, উপন্যাস সেটায় ব্যর্থ হচ্ছে? রাল্ফ এলিসনের তৈরী করা আমেরিকান নভেলে কৃষ্ণাঙ্গ স্বর এনে তাকে প্রকৃত আমেরিকান করে তোলার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে? বিশুদ্ধতার খোঁজ কেন করতে হচ্ছে সিস্টার সোলজাকে, এই অসামান্য উপন্যাসটি পড়ার পরেও তার উত্তর আমি এখনো পাইনি, আরো পড়া ছাড়া গতি নেই।
পড়ব ।
বোধি ,
তোমার এই সিরিজ চলুক। ক্যান কারও বিরক্তির কারণ হবে? এটা তো স্পষ্ট করে আলাদা টই । যার পোষায় না সে অন্য ড্রিংক্স নেয়। অনেকদিন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য ও বইগুলোর নাম বাজারে সবার মুখে। এবার আফ্রিকান সাহিত্য নিয়ে হোক। এই টইয়ের দৌলতে, বিশেষ করে তোমার ও 'ar' এর কথাবার্তায় অনেক বই এবং লেখকের খোঁজ পাচ্ছি এবং পড়া শুরু করেছি। মায়া এঞ্জেলু ও চিনুয়া আচেবে পড়া ছিল টোনি মরিসনের প্রবন্ধ। বল্ডউইনের ব্যাপারে উত্তর কৈশোরে বামপন্থী ম্যাগাজিনে তাচ্ছিল্য ভাব দেখে পড়িনি। এখন হুলেবেকএর দুটো বই কিনে ফেললাম।
আমি 'টেকোবুড়ো' হওয়ার পর এই ধরণের সাহিত্য পড়া মাত্র শুরু করেছি। কাজেই তোমার এই টই আমার কাছে মহামূল্যবান। ছেড়ে দিও না।
ভালো লাগল। মনে পড়ল বাল্ডউইনের 'গোইং টু মিট দ্য ম্যান' গল্প সংকলনটির কথা, যার নামভূমিকার গল্পটিতে বিছানায় যৌন শিথিলতায় ভুগতে ভুগতে একজন শ্বেতাঙ্গ শেরিফের স্মৃতিতে ফিরে আসে ছোটবেলার সেই দৃশ্যটি, যখন সে বাবার কাঁধে চড়ে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা দেখতে গিয়েছিল। পড়তে পড়তে মান্টোর কথা মনে পড়ে।